শৈশব হইতেই চন্দ্রের প্রতি আমার আকর্ষন অসীম।মাতা যখন আমাকে ক্রোড়ে লইয়া 'আয় আয় চাঁদ মামা' গান শুনাইতেন তখন অপেক্ষায় থাকিতাম কখন চন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইবে। অপেক্ষা করিতে করিতে ঘুমাইয়া যাইতাম কিন্তু চন্দ্রের দর্শন পাইতাম না। বেশ কিছুদিন পর জানিতে পারিলাম চন্দ্র সত্যি সত্যি কখনো আসে না। উহা ঘুম পাড়ানি গান মাত্র। মনে পড়ে সেদিন ব্যাকুল হইয়া কাদিয়াছিলাম। তখন হইতেই চন্দ্র বিরহে কাতর হইলাম। রাত্রিবেলা ছাদে গিয়া চাঁদের পানে চাহিয়া থাকি, সেখানেই ঘুমাই। অবস্থা দেখিয়া পিতা-মাতা বিচলিত হইলেন। বড় হইয়াও যখন এ ঘোর কাটিল না তখন স্বজনদের পরামর্শে তাহারা একপ্রকার জোর পূর্বক বিবাহ দিলেন। বিবাহই নাকী এই রোগের একমাত্র দাওয়াই। যাই হোক কিছুদিন ভালোই কাটিয়াছিল। কিছুদিন পরে পুত্রের জন্ম হইলে তাহার মাতা যখন 'আয় আয় চাঁদ মামা' গাইতে শুরু করিল তখন আবারো পূর্বের ন্যায় অনুভূত হইল। অর্থাৎ পুনরায় চন্দ্রের আকর্ষনে পড়িলাম। কিন্তু এইবার আর আগের মতো পাগলামি করিলাম না বরং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলাম চন্দ্রে অভিযান করিব। অবশ্য পিতা-মাতা এবং স্ত্রী শুনিয়া ইহাকে আরো বড় পাগলামী বলিয়া আখ্যায়িত করিল। কিন্তু আমি আমার স্বীদ্ধান্তে অটল থাকিলাম। যেভাবেই হোক চন্দ্র পৃষ্ঠে পদচিন্থ রাখিবই।
স্বীদ্ধান্ত তো নিলাম। কিন্তু বাস্তবায়নের উপায় কী। করি সাংবাদিকতার চাকরী গোল আলু পত্রিকায়। এইখানে বলিয়া রাখি, এই পত্রিকাটি না থাকিলে এই দেশের সার্বভৌমত্ব থাকিত কীনা সন্দেহ। বিশেষ করিয়া, আলুর মূলাবোধ তো চরম। আর উহার সম্পাদক কথি ভাই এই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান তা ভবিষ্যতে প্রমানিত হইবে। তাই কথি ভাইয়ের নিকট গিয়া আমার মনের আশা ব্যক্ত করিলাম। শুনিয়া তিনি আমাকে ব্যাপক উৎসাহ দিলেন। ইহাও বলিলেন, আমাকে প্রথম দেখিয়াই তিনি বুঝিয়াছিলেন আমি অভিযাত্রী হইব। তিনি প্রকৃতই বিচক্ষন। যাই হোক, কথি ভাইয়ের পরামর্শ মতো নাসায় যোগাযোগ করিলাম। কিন্তু তাহারা বলিল, চন্দ্রাভিযান অনেক পূর্বেই বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এখন শুধুমাত্র মহাশূন্যে মানুষ পাঠানো হয় আর নভোচারী হইবার যোগ্যতা অর্জন করিতে হইলে নাকী আমাকে দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহন করিতে হইবে। বাকী থাকিল পর্যটক হিসেবে মহাশূন্য ভ্রমন। কিন্তু এতে অভিযানের মর্যাদা পাওয়া যাইবে না। আর তারা চাঁদেও গমন করে না। শুধু পৃথিবীর চারিপাশে ঘুরপাক খায়। তাই ইহাও বাতিল। বিফল হইয়া ফিরিয়া আসিলাম। কথি ভাইয়ের সাথে পুনরায় দেখা করিলাম। তিনি শুনিয়া প্রথমে কিছুক্ষন চিন্তা করিলেন। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলিলেন, চন্দ্রে তোমাকে পাঠাইবই। উনার ত্যজদীপ্ত কন্ঠ আমাকে পুনরায় অনুপ্রানিত করিল। কিন্তু উপায় কী। কথি ভাই বলিলেন; কারো উপর নির্ভর করিয়া নয়,নিজ উদ্যোগেই যাইতে হবে। আমি অবাক হইয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া রইলাম। তখন তিনি আমাকে বলিয়া দিলেন কী করিতে হইবে। অত:পর তাহার পরামর্শ মোতাবেক গোল আলুর কারিগরি সহায়তায় ধোলাইখাল হইতে চন্দ্রযান তৈরি করা হইল। চন্দ্র যাত্রার মহড়া স্বরূপ মহাশূন্যের এদিক ওদিক ঢু মারিয়া আসিলাম। আমার এই সাফল্য দেশব্যাপি ব্যাপক আলোড়ন তুলিল। কথি ভাই তো আমাকে লইয়া বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করিয়া ফেলিল। কিন্তু আমার মূল লক্ষ্য চন্দ্র। তাই সেই মোতাবেক প্রস্তত হইতেছিলাম।
প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন তখনই একটি খবর পাইয়া হতাশায় পড়িয়া গেলাম। আমার মত আরো বহু মানুষই নাকী চন্দ্রযাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন করিয়াছে। হায় বাঙালীর কপাল! একাকী চন্দ্রজয় করিবার গৌরব অর্জন করিব তাও হইল না। এই খবর শুনিয়া মন ভাঙিয়া গেল। চন্দ্রযাত্রার ইচ্ছা লোপ পাইতে থাকিল। সব শুনিয়া কথি ভাই দেখা করিলেন। নতুন করিয়া উৎসাহ দিয়া বলিলেন ইহাই উত্তম হইয়াছে, একাকী যাওয়ার চাইতে কোন দলের সহিত গমন করিলে বিপদে-আপদে সাহায্য পাইব। তাহার পরামর্শ মতো একটি দলের সহিত যোগাযোগ করিয়া তাহাদের সহিত চন্দ্র যাত্রা শুরু করিলাম।
আমাদের দলখানি ভারত হইতে উড্ডয়ন করিল। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ আরো বহু দেশ হইতে বহু দল প্রস্তুতি লইতেছিল, কিন্তু আমাদের আগে কেহ যাত্রা আরম্ভ করিতে পারে নাই। তাই আমরাই যে সর্বাগ্রে চন্দ্রে পৌছাইব তাহা বলাই বাহুল্য। প্রকৃতপক্ষে তাহাই হইল। দুইদিন পরে আমরা চন্দ্রের কক্ষপথে উপনীত হইলাম। এখন অবতরনের পালা। খুব সাবধানে অবতরনের কার্য সম্পাদন করিলাম। এই সময়টা খুব উৎকন্ঠায় কাটিতেছিল। ঠিকঠাক মতো নামিতে পারিব কীনা তাহা লইয়া ব্যাপক দুর্ভাবনায় পড়িয়াছিলাম। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই অবশেষে আমাদের দলের সবগুলো বাহন সঠিক ভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরন করিল। অত:পর প্রথম আমাদের দলপতি চন্দ্রপৃষ্ঠে তাহার পদচিন্থ অর্পন করিলেন। তারপর একে একে আমরা সবাই তাহাকে অনুসরন করিয়া চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরন করিলাম। তখন আমার অনুভূতি ভাষায় ব্যাক্ত করার মতো নয়। এতোদিনের স্বপ্ন পূরন হইল! আমি সত্যই চন্দ্রপৃষ্ঠে বিচরন করিতেছি! বার বার গায়ে চিমটি কাটিয়া নিশ্চিত হইলাম। কথি ভাইয়ের কথা মনে পড়িতে লাগিল, তাহার কারনেই আমার স্বপ্ন সত্য হইয়াছে।
ইতোমধ্যে সকলে ব্যস্ত হইয়া ছবি তুলিতেছে। উল্লেখ্য, চন্দ্র পৃষ্ঠে অবতরনের প্রমান স্বরূপ দুনিয়াকে পশ্চাতে রাখিয়া প্রত্যেকের ছবি তুলিতে হয়। এই ছবি প্রদর্শন করিলেই চন্দ্র বিজয়ের সার্টিফিকেট মিলিবে। আমি ভাবিলাম এতো তাড়াহুড়ার আবশ্যক কী! দুনিয়া তো পলাইয়া যাইতেছে না। তাই আমি প্রথমে গোল আলুর ব্যানারের ছবি তুলিলাম। তারপর কথি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করিয়া সুখবর জানাইয়া দিলাম। কথি ভাই তৎখনাৎ দেশব্যাপি এ সংবাদ ছড়াইয়া দিলেন। দেশে যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি হইল তাহা কথি ভাই পুনরায় আমাকে জানাইয়া দিলেন। এইদিকে আমাদের স্বল্প মেয়াদে চন্দ্র ভ্রমনের সময় ফুরাইয়া আসিতেছিল। সকলে গোছগাছ শুরু করিয়া দিল। আমার মনে পড়িয়া গেল দুনিয়াকে পশ্চাতে রাখিয়া প্রমানস্বরুপ যে ছবি তুলিতে হয় তাহা এখনো তোলা হয় নাই। তৎক্ষনাৎ ক্যামেরা প্রস্তুত করিয়া দুনিয়ার দিকে তাক করিলাম। করিয়াই দেখি হায় হায় কী অদ্ভুত কান্ড দুনিয়া উধাও! দিক ভুল হইয়াছে ভাবিয়া চারিদিকে দৃষ্টি দিলাম। না দুনিয়া কোথাও নাই। এই কী কান্ড হইল! দুনিয়া কই গেল! ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপিতে লাগিল। তাড়াতাড়ি দলপতির দৃষ্টি আকর্ষন করিলাম। তিনি সুধাইলেন, 'কী হইয়াছে'। আমি কাঁপিতে কাঁপিতে কোনমতে হাত নির্দেশ করিয়া বলিলাম, 'দুনিয়া তো নাই!'। তিনি সহাস্যে জবাব দিলেন, 'দুনিয়া তো ওখানে নয়, মাথার উপরে'। এতক্ষনে আমার মনে পড়িল দুনিয়া ঘুরে, চাঁদও ঘুরে। কিন্তু মাথার উপরে থাকিলে ছবি তুলিব কেমনে ভাবিয়া উপরে তাকাইলাম। এইবার আর চোখের পানি বাঁধ মানিল না। উপরের দিকও ফাঁকা। তারমানে দুনিয়া সত্যই উধাও হইয়া গিয়াছে। কাঁদিতে কাঁদিতে দলপতিকে বলিলাম, 'উপরেও তো ফাঁকা'! তিনি জবাব দিলেন,'এখন দুনিয়া দেখা যাইবে না'।
'কেন'?
'বোকা, ইহাও জানো না। এখন সূর্যগ্রহন চলিতেছে তাই দুনিয়া কোন আলো নাই।'
'এই অবস্থা কতক্ষন থাকিবে?' আমি জিজ্ঞাসা করিলাম।
তিনি হিসাব করিয়া বলিলেন, 'আরো পাঁচ মিনিট থাকিবে'।
তাহার জবাব শুনিয়া ধড়ে প্রান ফিরিয়া পাইলেও স্বস্তি পাইলাম না।আর তিন মিনিটের মধ্যে আমাদের রওনা দিতে হইবে। তাহলে ছবি তুলিতে পারিব না। দলপতিকে সমস্যার কথা জানাইলাম। 'এতো্ক্ষন কেন ছবি তুল নাই',তিনি রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন।
'আমি কী জানিতাম নাকী আজকে সূর্যগ্রহন হইবে', আমি মিনমিন স্বরে জবাব দিলাম।
'তাহলে আর কী এখন ছবি ছাড়াই যাও'।
'কিন্তু দেশের জনগনকে কী জবাব দিব। ছবি ছাড়া গেলে ধোলাইখাল রূপীয় কারসাজি ভাবিয়া সকলে ধোলাই দিবে'।
'বলিবে ক্যামেরা নষ্ট হইয়া গিয়াছিল'।
'আমার একার ক্যামেরা নষ্ট হইতে পারে, কিন্তু আর কারো ক্যামেরায় ছবি তুলিলাম না কেন সে প্রশ্নও তো উঠিবে। তখন আমি কী জবাব দিব'
'সামান্য একখানা ছবির জন্য লোকে অবিশ্বাষ করিবে ইহা কোন কথা হইল'।
'সাধারন মানুষ অবিশ্বাস করিবে না; কিন্তু আমাদের দেশে কিছু ব্লগ আছে সেখানে সবাই খুব ঝামেলা করিবে। বিশেষ করিয়া চান্দু নামক এক ব্লগার আছে সে তো আপনারা সাক্ষ্য দিলেও বিশ্বাস করিবে না'।
'এক কাজ করিবে; যাহারা ছবি চাহিয়া প্রশ্ন করিবে তাহাদের বলিবে জন্ম সনদ পত্র, জন্মক্ষনের ছবি প্রদর্শন করিতে। দেখিবে তাহারা চুপ হইয়া যাইবে'।
দলপতির এই কথা আমার মনে ধরিল। তাছাড়া ব্লগের কথা কয়জনে শুনিবে। গোলআলু পত্রিকা আর কথি ভাই আমার পক্ষে থাকিলেই যথেষ্ট। তাই নিশ্চিন্ত মনে ফিরতি পথ ধরিলাম। ফিরিয়া আসিতে বহুত পথ পাড়ি দিতে হইবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ১১:২৩