মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে হত্যার মধ্য দিয়ে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্ষিয়ান সব ক'জন নেতাকে হত্যা করা হলো। এখন বাকি আছেন মীর কাসেম এবং দেলোয়ার হোসাইন সাইদী। এই দুই জনের মধ্যে সাইদী আজীবন কারাদন্ডের সাজায় আছেন। মীর কাসেম জামায়াতের রাজনীতিতে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। তবে জামায়াতের অর্থনৈতিক উইং এ তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমার ধারণা মীর কাসেমসহ বাকি যারা জেলে আছেন তাদের সবাইকে একই ভাবে হত্যা করা হবে। সব শেষে কোনো না কোনো উছিলা ধরে সাইদীর মামলা আবার সামনে আনা হবে এবং কাদের মোল্লার মতো তাকেও হত্যা করা হবে।
ছোট সময় থেকে শুনে এসেছি বাংলাদেশের দুইটা দল যারা করে তারা গড়ে সবাই মেধাবী হয়, বিশেষ করে নেতারা দারুণ মেধাবী। কোনো অমেধাবী গবাজ লোক এই দুই দল করে না, নেতাও হয় না। দল দুটি হলো বাম ধারার রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি। যে কেউ জামায়াতের সমর্থক হতে পারে, ভোটার হতে পারে, কিন্তু নেতা হতে হলে তাকে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, মেধার পরিচয় দিয়ে নেতা হতে হয়। কিন্তু আমি যখন থেকে রাজনীতি বুঝতে শিখেছি তখন থেকে কোনো দিনই এই দুই দলের (বাম ধারাকে একটি দল ধরা হয়েছে) নেতাদেরকে মেধাবী মনে হয়নি। বাংলাদেশে যারা বাম ধারার রাজনীতি করেন তারা যে কতোটা মেধাবী তা তাদের আমলনামায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়। তাদের দলের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। পাকা পাকা কথা বলা ছাড়া আমার জীবনে এই রাজনৈতিক এতিমদের আর কোনো মেধার পরিচয় দেখিনি। এরা এক সময় নকশাল, সর্বহারা, পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা, লাল বাহিনী, নীল বাহিনী, বিপ্লবী, বিদ্রোহী ইত্যাদী নামে সন্ত্রাসের রাজত্ব কামেয় করেছে। শেখ মুজিবের শাসনামলকে এরাই অস্থির করে তুলেছিল। এদের মধ্যে যে ক'জন মেধাবী (এখানে মেধাবী না বলে ধূর্ত বলা উচিৎ) ছিলেন তারা সবাই ডুব সাঁতার দিয়ে নৌকায় সওর করেছেন। পাকা পাকা কথা আর কথিত বাম আদর্শের কবর দিয়ে তারা এখন ক্ষমতার স্বাদে বুদ হয়ে আছেন। এই হলো তাদের মেধার পরিচয়।
বহুবার শুনেছি জামায়াতের নেতা হতে হলে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। হয়তো হয়ও, কিন্তু এই কাঠ-খড় পোড়ানোর সুফল কি? জামায়াতের নেতারা যদি এতই মেধাবী হবেন, এতই ঝানু রাজনীতিবীদ হয়ে থাকবেন তবে কেনো স্বাধীনতার পরেই তারা বুঝলেন না- আজ হোক আর ৫০ বছর পরে হোক বিচারের মুখে একদিন দাড়াতেই হবে। কেনো তারা বুঝলেন না- যে দল স্বাধীনতার বিরোধীতা করে সেই দলকে কোনো দিনও স্বাধীন দেশের মানুষ মেনে নেয় না, ভালো চোখে দেখে না। স্বাধীনতা বিরোধী দল কোনো দিন স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় না, করা যায় না। জামায়াত বাংলাদেশে যেটুকু অগ্রসর হয়েছে তা জামায়াত নেতাদের মেধার কারনে হয়, ইসলামি ধারার রাজনীতির কারনে। যে যুবকরা দলে দলে জামায়াত শিবিরে ভিড়েছে তারা ইসলামের দাওয়াতে সাড়া দিয়েছে। জিহাদের আহবান তাদের আকৃষ্ট করেছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু। ধর্মের নামে কষে ধমক দিয়ে এ দেশে অনেক কিছু করা যায়। গ্রামের অনেক মানুষ ভোটের সময় আল্লাহর পথ মানে দাড়ি পাল্লা বুঝতো, এ জন্যেই জামায়াত একবার ১৭ টা আসনে জয় লাভ করেছিল এবং ওই ১৭টা আসনের প্রায় সব ক'টাই ছিল মফস্বলে।
এই দলটি বাংলাদেশে আজীবন রাজনীতি করেছে, করছে যাত্রাপালার ঢুলিদের ভুমিকায়। তারা একবার আওয়ামীলীগের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে, আরেক বার বিএনপির সাথে। অবাক হওয়ার বিষয় হলো তারা যে ধারার রাজনীতি করে বাংলাদেশে সেই ধারায় তাদের কোনো বন্ধু নেই, বরং শত্রু আছে। জামায়াত নেতারা কৌশলে বাংলাদেশের অন্যান্য সকল ইসলামি দলকে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে রেখেছে। সখ্যতা গড়েছে তাদের বিপরীত ধারার বা আদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। আমি বুঝতে পারি না এ আবার কেমন মেধার পরিচয়!? হরিণ যদি তার গোত্র ছেড়ে হিংশ্র বাঘের সাথে সখ্যতা করতে যায় সেখানে কি সত্যিকারের কোনো বন্ধুত্ব তৈরী হয়? বিপদের সময় কি বাঘ হরিণের পাশে দাড়ায়? স্বার্থের প্রয়োজনে বাঘ কি হরিণের ঘাড় মটকাতে একটুও দ্বিধা করে? জামায়াত ইসলামের রাজনীতি করে অথচ ইসলামি ধারার কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের সখ্যতা নেই, এর চেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় আর কি থাকতে পারে?
আমি মনে করি জামায়াতের নেতাদের আমরা যতোটা মেধাবী মনে করি তারা আসলে তা ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন ক্ষমতা লোভী, চরম অহংকারী। আর যদি তাদের মেধাবী বলতেই হয় তবে বলতে হবে তারা ছিলেন আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতো মেধাবী, বুদ্ধিমান। ক'দিন পরেই যে তাদের হত্যা করা হবে তা বোঝার মতো বুদ্ধি যেমন আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছিল না, তেমনই আজ হোক বা কাল, স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীতার খেসারত যে দিতে হবে, দিতে হয় তা বোঝার মতো মেধা জামায়াত নেতাদের ছিল না। তারা ক্ষমতার লোভে ক্ষমতাবাজ দলগুলোর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছেন। মন্ত্রী হয়েছেন। ক্ষমতার অংশিদারিত্ব নিয়েছেন। তারা ক্ষমতার লোভ, নেতৃত্বের লোভ প্রতিষ্ঠিত করতে হুদায়বিয়ার সন্ধিসহ নানা বিষয় টেনে কর্মীদের বুঝ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা যদি সত্যিই মেধাবী হতেন তবে স্বাধীনতার পরে কোনো ভাবেই স্বাধীনতার বিরোধী দল জামায়াত নিয়ে যাত্রা শুরু করতেন না। তারা যদি সত্যিই মেধাবী হতেন তবে সবার আগে সমমনা, সমধারার রাজনৈতক দলগুলোর সাথে সখ্যতা তৈরী করতেন। তারা যদি সত্যিই নিঃস্বার্থ ইসলামের রাজনীতি করতেন তবে স্বাধীনতা বিরোধীতার সময় যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা কোনো অবস্থাতেই স্বাধীনতার পরেও নেতৃত্বে থাকতেন না। তারা ইসলামি আন্দোলনের স্বার্থে নেতৃত্ব থেকে সরে দাড়াতেন। কিন্তু তারা তা করেন নিই। তারা তা না করে বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির বা ইসলামি আন্দোলনের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করছেন। তাদের ভুল রাজনীতির কারনে, তাদের নেতৃত্বের লোভের কারনে আজ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ইসলামি রাজনীতি বা ইসলামি দল মানে রাজাকারের দল, স্বাধীনতা বিরোধী রাজনীতি মনে করে। তাদের ভুল রাজনীতির কারনে কোটি কোটি ধর্মভীরু মুসলমানের বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোনো ইসলামি দল কোমর সোজা করে দাড়াতে পারেনি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ইসলামি রাজনীতির প্রধান অন্তরায় হলো জামায়াতের স্বাধীনতা বিরোধীতা এবং এর নেতাদের ভুল রাজনীতি। তাদের কারনেই সাধারণ মানুষ ইসলামি রাজনীতি, রাজাকার, স্বাধীনতার বিরোধীতা, এই বিষয়গুলো গুলিয়ে ফেলে। যারা ইসলাম বিরোধী তাদের এখন পর্যন্ত অন্য কোনো হাতিয়ার দরকার হয়নি জামায়াতের ভুল রাজনীতির কারনে।
আমি মনে করি স্বাধীনতা পরবর্তী যে জামায়াত প্রজন্ম আছে তাদের উচিৎ আনুষ্ঠানিক ভাবে জামায়াত ত্যাগের ঘোষনা দেয়া। সরকার কবে জামায়াত নিষিদ্ধ করবে সেই আশায় বসে না থেকে এখনি তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। তারা যদি ইসলামি ধারার রাজনীতি করতে চায় তবে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে সমমনাদের সাথে সখ্যতা, সমধারার সাথে বন্ধুত্ব তৈরী করে রাজনীতি করা উচিৎ। তারা কেনো জামায়াত বা জামায়াত নেতাদের স্বাধীনতা বিরোধীতার দায় নেবে? পরিষ্কার ভাবে বলা উচিৎ স্বাধীনতা বিরোধী দল এবং স্বাধীনতা বিরোধী নেতাদের ভুল রাজনীতির কারনে তারা জামায়াত ত্যাগ করে মূলধারায় ফিরে এসেছে।
ধরে নিলাম আওয়ামীলীগ জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রমান করে হত্যা করছে তা সব মিথ্যা, কিন্তু জামায়াত এবং জামায়াতের এই সব নেতারা যে স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিলেন এ কথা তো মিথ্যা নয়। তবে কেনো স্বাধীনতা বিরোধীতার দায় নতুন প্রজন্ম নেবে? কেনো তারা বাংলাদেশের মানুষকে ইসলামি ধারার রাজনীতি মানেই রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী এসব চিন্তা করার সুযোগ দেবে? তারা যদি মনে করে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি হয়ে গেলেই তারা কলঙ্কমুক্ত হয়ে যাবে তা কিন্তু না, জামায়াতের ওইসব নেতারা যেমন স্বাধীনতা বিরোধী তেমনি জামায়াতও স্বাধীনতা বিরোধী দল এ কথা মনে রাখতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, জামায়াত না করে অন্য কোনো ইসলামি দল করলেই কি সব আপদ-বিপদ দুর হয়ে যাবে বা যেতো? না, দুর হতো না, হবে না। যারা ইসলাম বিরোধী তারা কোনো না কোনো ছুতা বের করে ইসলামি ধারার রাজনীতি বন্ধ করার চেষ্টা করতো, নির্যাতন করতো, হত্যা করতো। পৃথিবীর অনেক দেশে এর অনেক নজির আছে। কিন্তু আর যাই হোক বাংলাদেশে ইসলামি ধারার রাজনীতির বিরোধীতা করা, সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝানো, বিনা বাধায় ইসলামি ধারার এতগুলো মানুষ হত্যা করা এতটা সহজ হতো না, যতোটা সহজ করে দিয়েছে জামায়াত।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৫৬