ইন্টারনেটের মাধ্যমে বা অনলাইনে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার দুর্বৃত্তরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফাঁদ পেতে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এদিক থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের দুর্বৃত্তরা। তারাও নানা রকমের ফাঁদ পেতে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি বাংলাদেশের অনলাইন সন্ত্রাসীরা দেশের মধ্যে বড় বড় হাঙ্গামা বাধিয়ে দিয়েছে। মানুষের ধর্মীয় চেতনায়, রাজনৈতিক চেতনায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করে, উস্কানি দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। কথায় কথায় তারা মানুষের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করেছে, করছে। সমাজের এই নষ্ট মানুষরা এখন টার্গেট করছে প্রবাসীদের। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌন ফাঁদ পেতে প্রবাসীদের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর দ্বারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। প্রতারিত হচ্ছে প্রবাসীরা। সামাজিক অবক্ষয় এবং পরিবারিক কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যৌন ফাঁদে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেকে।
আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করি তাদের কারোরই নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়, বাংলাদেশের এক শ্রেণীর যুবতী, মধ্য বয়সী নারীরা ফেসবুক, ইউটিউবসহ ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে খোলামেলাভাবেই যৌন আবেদন জানায়। মোবাইল ফোনে ব্যবহারিত বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে তারা ভিডিও কল করে, গভীর রাতে ফেসবুক লাইভে এসে নিজেদের শরীর দেখায়। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে, যৌন আবেদন জানায়। এদের প্রধান টার্গেট প্রবাসীরা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী প্রবাসীদের টার্গেট করে এরা যৌন ব্যবসার ফাঁদ পাতে। আপন পরিজন ছেড়ে বছরের পর বছর প্রবাসে পড়ে থাকা প্রবাসীদের একটা বড় অংশ তাদের একাকীত্ব ঘোঁচাতে এদের ফাঁদে পা দেয়। কেউ কেউ কৌতূহলবশত এদের আহ্বানে সাড়া দেয়। এক সময় টাকা পয়সা, বিদেশের চাকরিসহ সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
অনলাইন যৌন আবেদনে সাড়া দিয়ে অনেক প্রবাসী মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। পরিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। সামাজিকভাবে হেয় হয়ে এক সময় বিপথগামী হয়ে যায়। বিভিন্ন অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। দেশের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যার পরিণতি হয় খুবই ভয়াবহ।
অনলাইন যৌন আহ্বানে সাড়া দিয়ে চূড়ান্ত প্রতারিত হওয়া কজন প্রবাসী যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের কিছু যুবতী এবং মধ্য বয়সী নারী নিয়মিত অনলাইনে যৌন প্রতারণা করে। তারা ফেসবুকের বিভিন্ন প্রবাসী গ্রুপ বা পেইজে নিজেদের ফোন নাম্বার দিয়ে যৌন আবেদন জানায়। ফেসবুক লাইভে বা ইউটিউব ভিডিওতে নিজেদের শরীর দেখিয়ে প্রবাসীদের আহ্বান জানায়। কৌতূহলবশত অথবা একাকীত্ব ঘোঁচাতে প্রবাসীরা তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়। ফোন করে। ভয়েজ কল বা ভিডিও কলে যৌন প্রতারকদের সঙ্গে কথা বলে। যৌন প্রতারকরা শরীর দেখিয়ে, নোংড়া কথা বলে প্রবাসীদের সুড়সুড়ি দেয়। বিনিময়ে তারা ঘণ্টা প্রতি মোটা অঙ্কের টাকা নেয়। সাধারণত তারা টাকা লেনদেন করে বিকাশের মাধ্যমে। প্রবাসীরা দেশে থাকা কোনো আত্মীয়, বন্ধুদের দিয়ে প্রথমে যৌন ব্যবসায়ীদের বিকাশ নাম্বারে টাকা পাঠায়। পরে ভয়েজ কল বা ভিডিও কলে তারা কথা বলে। অনেক সময় বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাওয়ার পর যৌন প্রতারকরা ফোন ধরে না। নেট কানেকশনে সমস্যা দেখিয়ে এড়িয়ে যায়। নিত্যনতুন প্রতারণা করে প্রবাসীদের সঙ্গে।
আশঙ্কার বিষয় হলো, এই যৌন ফাঁদে শুধু যে প্রবাসী যুবকরা জড়ায় তা নয়, অনেক বয়স্ক প্রবাসীদেরও জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। কেউ কেউ যৌন আবেদনে এতটাই উন্মাদ হয়ে ওঠে যে দেশে থাকা নিজের বউকে দিয়ে যৌন ব্যবসায়ীদের বিকাশ নাম্বারে টাকা পাঠায়। গ্রামে থাকা সহজ সরল বৌ হয়তো কোনো দিন জানতেও পারে না কোথায় টাকা পাঠালো, কী জন্যে টাকা পাঠালো!
মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীদের একটা বড় অংশ প্রতিমাসে তাদের বেতনের মোটা অংশ এ ভাবে যৌন প্রতারণার ফাঁদে নষ্ট করে ফেলে। এই ফাঁদে পড়ে তারা নিয়মিত দেশে টাকা পাঠাতে পারে না। অনেক সময় ধার-দেনা করে অনলাইন যৌন আবেদনে সাড়া দেয়। কেউ কেউ সরাসরি বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে প্রবাসী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে নষ্ট মেয়েদের বিকাশ নাম্বারে টাকা পাঠায়। তারা মাদকের মতো ভয়াবহ প্রতারণা নির্ভর বিকৃত যৌন নেশায় জড়িয়ে পড়ে। অলিক আদিম ঘোরের মধ্যে হাবুডুবু খায়। এতে তাদের পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। যে স্বপ্ন নিয়ে ছেলে বা স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন বাবা-মা, স্ত্রী, সে স্বপ্ন ধুলায় মিশে যেতে থাকে।
কেউ কেউ যৌন ব্যবসায়ীদের আবেদনে এতটাই মত্ত হয়ে যায় যে, কর্মস্থল থেকে জরুরি ছুটি নিয়ে দেশে ছুটে যায়। ওই মেয়েদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে, ডেট করে। এসব করতে গিয়েও প্রবাসীরা প্রতারণার শিকার হয়। নষ্ট মেয়েরা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে প্রবাসীকে আটক করে। সামাজিক সম্মানের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়।
অনলাইনে শতভাগ প্রতারণা নির্ভর বিকৃত যৌন আবেদনের নেশায় পড়ে অনেক প্রবাসী সারা রাত ওই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে। সকালে তারা যথাসময়ে কাজে যেতে পারে না। এক সময়ে তাদের চাকরি চলে যায়। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। তখন বেঁচে থাকার জন্য, নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিভিন্ন অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। তখন চুরি ছ্যাচরামি বা ঠগ বাটপারি করতেও তাদের বাধে না। এতে একদিকে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে বিদেশে বাংলাদেশি কম্যুনিটির সুনাম বিনষ্ট হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশের অনলাইন যৌন প্রতারক মেয়েরা দেশে-বিদেশে বেশ বড় নেটওয়ার্ক মেনটেইন করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বসবাসকারী যেসব প্রবাসী তাদের ফাঁদে জড়িয়ে যায় তারা কোথায়, কোন কোম্পানিতে কাজ করে, মাসের কত তারিখে বেতন পায় প্রবাসী দালালদের মাধ্যমে সে খবরও রাখে ওই নেটওয়ার্ক। প্রতিমাসে বেতন পাওয়ার পর ফাঁদে জড়িয়ে যাওয়া প্রবাসীদের তারা বাধ্য করে যৌন আবেদনে সাড়া দিতে। ইচ্ছা করলেও তাদের খপ্পর থেকে সরে আসতে পারে না অনেকে। সামাজিক পারিবারিক সম্মানহানির ভয়ে বাধ্য হয় প্রতারকদের যৌন আবেদনে সাড়া দিতে। নয়তো বিভিন্ন সময়ে গোপনে রেকর্ড করে রাখা ভিডিও, ভয়েজ অনলাইনে প্রচার করে দেয়ার ভয় দেখায় ওই প্রতারক নেটওয়ার্ক।
উল্লেখ্য, প্রবাসীরা প্রথমে যখন কৌতূলে তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের আহ্বানে সাড়া দেয় বা দেশে গিয়ে ডেট করে, তখন ওরা কৌশলে অডিও, ভিডিও রেকর্ড করে বা ছবি তুলে রাখে। পরে ওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে নিয়মিত প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়।
অনলাইন যৌন প্রতারণার সঙ্গে জড়িতরা যে শুধু নিম্ন বা সাধারণ ঘর থেকে আসে তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও আছে। বখে যাওয়া এই ছাত্রীরা মূলত নেশার টাকা সংগ্রহ করতে এই পথ বেছে নেয়। কেউ কেউ পেশাগতভাবেই এ পথে জড়িয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেক সেলিব্রেটিও আছে। যারা অনলাইন সেলিব্রেটি হিসাবে পরিচিত। তাদের রেটও একটু বেশি। তাছাড়া ঢাকার সিনেমার কোনো কোনো সাইড নায়িকা, দুই একটা মিউজিক ভিডিও করা কথিত মডেল মেয়েরাও এই তালিকায় আছে। এদের এসব নৈরাজ্য, অসামাজিক যৌন অপরাধ চলছে খোলাখুলিভাবে। কিন্তু প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নেই। কারো কোনো আগ্রহ নেই। প্রশাসনসহ কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না এদের নিয়ন্ত্রণ করতে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোয় যেমন ফ্ল্যাটে ফ্য¬াটে যৌন ব্যবসা হয়, কিন্তু সবাই জেনেও না জানার ভান করে, ঠিক তেমনই অনলাইনে প্রবাসীদের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত যৌন প্রতারণা করা হচ্ছে দেখার কেউ নেই। নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। সবাই কেমন যেন উটপাখি হয়ে আছে। সবার মধ্যে একটা উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমাজের এসব অপরাধ কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। যা খুবই আশঙ্কাজনক।
অনলাইন যৌন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে এখনি আইনি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। নয়তো প্রবাসীরা ব্যাপক হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, হচ্ছে। এই ক্ষতির চাপ পড়বে দেশের অর্থনীতিতে, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রায়। প্রবাসীরা পড়বে ব্যাপক হারে সামাজিক এবং পরিবারিক নৈরাজ্যের ভেতরে। স্বাস্থ্যহানি এবং হতাশায় বাড়বে অপরাধ প্রবণতা। যা প্রবাসে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের সুনাম বিনষ্টের বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১০:০৬