এক:
ইরা মাঠ পেরিয়ে নদীর কাছে গিয়ে দেখল কেউ নেই। অবশ্য এত সকালে এই শীতের দিন কেউ থাকার কথাও না। ঢাকায় থাকতে তার ঘুম ভাঙতেই চায় না। ক্লাশ থাকলে তো কথাই নেই। ঘুম ১০ টা ১১ টার আগে ভাঙেই না। আর এই তিন দিন। প্রতিদিনই সকাল না হতেই ঘুম ভেঙে যায়। ইরা তার নানুবাড়িতে আসল প্রায় ৫ বছর পর। যখন সে ছোট ছিল তখন প্রতিবছরই পরীক্ষা হবার পর সে নানুবাড়িতে আসত। তখন ইরার বাবা অবশ্য ছোটখাট চাকরি করতেন। এখনকার হিসাব আলাদা। তার বাবা বিশাল বড় কোম্পানীর মালিক। ইরাদের নিজেদের ব্যাবহারের জন্যই তিনটা গাড়ি আছে। তার বাবা, হাবিবুর রহমান এর বাবা মা ছোটবেলায় গাড়ি এক্সিডেন্টে এ মারা যায়। তারপর থেকে সে ইরার মামাবাড়িতেই বড় হয়। সে ইরার মায়ের খালাতো ভাই হয়। আাগে প্রতিবছর ইরা বাবা মাকে নিয়ে এখানে আসত। এখন বাবা আর আসতে পারে না। বিনা নোটিশে তিনি এক ঘন্টা সময় ও বের করতে পারেন না। এই আগের বারের কথাই ধরা যাক। ইরার খালতো বোনের বিয়ে। ইরার মা ফিরাজুন্নেসা তাকে দুই দিন আগে বলে রেখেছিল। অথচ সে অনুষ্ঠানের দিন বলল, আগে থেকে জানানো হয়নি কেন, সে তো এখন যেতে পারবে না। অবশ্য ইরার ধারণা অন্য। তার ধারণা বাবা বড়খালাকে পছন্দ করে না। কারণ এমনিতেই ইরার বাবা মার বিয়ে নিয়ে নানুবাড়িতে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। বড়খালা বাবাকে সামনাসামনি বলেছিলেন বিয়ে করবি , খাওয়াবি কি ? তাও না হয় বুঝলাম শ্ৱশুরের টাকায় বউ পালবি। তোর মত এতিম ছেলেকে করুণা করা যায়, কিন্তু বোন দেয়া যায় না। হাবিবুর রহমান তখন চুপচাপ সব শুনে গেছেন। একটা কথারও উত্তর দেন নি। বিয়ে টা হতও না। ইরার মা এই ঘটনার পর খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেন। ফিরাজুন্নেসা তার বাবা মায়ের আদরের ছোট মেয়ে । জেদও সেই রকম বেশী। শুধুমাত্র সেই কারণেই তাদের বিয়ে হয়। হাবিবুর রহমান সেই সময় কোন উত্তর না দিলেও এখন কথায় কথায় উত্তর দিচও সেই রকম বেশী। শুধুমাত্র সেই কারণেই তাদের বিয়ে হয়। হাবিবুর রহমান সেই সময় কোন উত্তর না দিলেও এখন কথায় কথায় উত্তর দিচ্ছেন। তবে সরাসরি না। এই যেমন কি কারণে যেন বড় খালুর চাকরি চলে গেল, বাবা তাকে তার অফিসে একটা চাকরি দিয়ে দিলেন।
-আপামনি , এত সকালে কি করেন?
ইরা হঠাৎ করে চমকে উঠল। ছেলেটা সাপের মত চলাচল করে নাকি। ইরা আগেও লক্ষ্য করেছ এই ছেলেটা হঠাৎ করে কাছে এসে প্রশ্ন করে। ইরাদের নানুবাসায় অনেক কাজের লোক। ইরা প্রায় সবাইকেই চেনে। তবে এই ছেলেটাকে সে আগে দেখে নাই। এবারই প্রথম। বয়স ও বেশী না। ইরার চেয়ে বড়োজোর দুই তিন বছরের বড় হবে।
-কুদ্দুস, তুমি কখন আসলে?
-এই তো আপামনি, এখনই
-তোমাকে কতবার বলেছি, এভাবে হঠাৎ করে এসে চমকে দেবে না
-কি করব, ছোটবেলার অভ্যাস। একবার শব্দ করে হাঁটি জন্য হেডস্যার মারছিল। সেই থেকে অভ্যাস করছি
-তুমি কোন ক্লাশ পর্যন্ত পড়ছ?
-ক্লাশ টেন। আরও পড়ার ইচ্ছা ছিল। গরীব মানুষ তো......
ইরা ভেবে দেখল , গ্রামে মানুষ হয়েছে। ক্লাশ টেন পর্যন্ত পড়ছে তাও কথাবার্তা মোটামুটি শুদ্ধ।
-চল যাই।
-আপনি যান, আমারে একটু নৌকা নিয়া যাইতে হবে।
ইরা পেছন ফিরে এমন চমকে গেল যে বলার মত নয়। তার পেছনে ফাওয়াজ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজের চোখকে বিশ্ৱাস করতে পারছে না। সে অবশ্য মুখচোখে যতটা পারা যায় বিরিক্তি ধরে রাখল। যেন দেখে নি এইভাবে বাড়ির দিকে যেতে লাগল।
-কই যাস?
-বাড়িতে
-থাম থাম , একসাথে গল্প করতে করতে যাই
-তোমার সাথে গল্প করার আমার কোন ইচ্ছা নাই
ইরা ফাওয়াজ ভাই এর উপর রেগে আছে। রেগে থাকার কারণ অবশ্য বেশ বড়ই। ছোট থেকে সারাজীবন ইরা নিজের রূপের এত প্রশংসা শুনেছে এবং এত ছেলে এতভাবে তাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছে আর সে জীবনে যাকে প্রথম প্রেমপত্র লিখল সে তাকে পাত্তা দেবেনা সেটা সে ভাবতেই পারেনি। কিন্তু তারপরও ফাওয়াজ ভাই এর উপর তার টান একটুও কমে নি, বরং একটু বেরেছে। সেই ঘটনার পর ফাওয়াজ ভাই তাদের বাড়ি আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। আগে প্রতি সপ্তাহে দুইদিন তাদের বাসায় আসত।
-তোর নাই, কিন্তু আমার আছে
-বল
-তুই আরও সুন্দর হয়ে গেছিস
-ভাল, এখন আসি
ফাওয়াজ কিছু বলল না। ইরা ভেবেছিল ফাওয়াজ তাকে আটকাবে। কিন্তু কই, তার তো কোন লক্ষণ নেই। ইরার নিজের উপর মেজাজ খারাপ হল। কি দরকার ছিল। ফাওয়াজ ভাই তো ভাল মতই কথা বলছিল।