শেকড় থেকে শিখরে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
গালিব ভাইয়ের সাথে কোথাও যেতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। সেটা বিয়েবাড়ির মতো বিরক্তিকর কোন জায়গায় হলেও। তেল-ঝোল মাখিয়ে গলা পর্যন্ত গিলতে আমার আপত্তি নেই, শুধু একলা বসে একঘেয়ে সময় পার করাটাই যা হ্যাপা। তবে গালিব ভাই থাকলে সময়টা বেশ ভালোই কেটে যায়। এছাড়া বিয়েটা হচ্ছেও বেশ ঘরোয়া পরিবেশে, কোন কমিউনিটি সেন্টারে না। দোতলা বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল টানিয়ে উচ্চশব্দে মাইকে গান বাজিয়ে একেবারে সনাতন মফস্বলী কায়দায় বিয়ে। স্বভাববশত গাঁইগুই করলেও শেষপর্যন্ত আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে যেতে রাজী হই। এখন মনে হচ্ছে না এলে পস্তাতে হতো। অনেক চেনা মুখ, অনেক হারিয়ে যাওয়া মুখ, সবাই আনন্দনৃত্যে তৈরি করেছে জীবনের এক গতিময় প্রবাহ। ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমার চোখের পাতায়, ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমায় দূরে। এই ঢেউ আনন্দের, স্মৃতিময়তার, মৃত্যুমুখী সম্পর্কগুলোকে বাঁচিয়ে তোলার। সমুদ্রের নিয়ম মেনে চলা এই ঢেউ জোয়ারের মত এসেছে, খুব বেশি সময় থাকবে না জানি। আবার ভাটার টান শুরু হবে। তাই আমি বিলম্ব না করে আনন্দস্নানে মেতে উঠি। তবে যার কল্যাণে আমার এখানে আসা সেই গালিব ভাইকে এসবকিছুতে মোটেই উৎসাহী মনে হচ্ছে না। কোথাও যাবার তাড়া আছে তার হয়তো।
-রেজা, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চলো বেরুই।
-কেন ভাই! থাকি কিছুক্ষণ। সবাই আসছে, মজা লাগতেছে।
-তুমি থাকলে থাকো, আমার কাজ আছে।
-আজকের দিনটার জন্যে কাজ বাকি রাখা যায় না একটু?
-না। জরুরী কাজ। আচ্ছা আমি গেলে সমস্যা কী! তুমি তোমার মত করে মজা করো, অসুবিধা তো নাই!
অসুবিধা নেই কথাটি সাদাচোখে সঠিক মনে হতে পারে, গালিব ভাই চলে যাবেন, আমি আমার মতো করে আনন্দ করবো, গান গাইবো, কবজি ডুবিয়ে খাবো কেউ তো বাগড়া দিতে আসছে না! কিন্তু আমার অনুসন্ধিৎসু মন একটু নিরীখের অভিপ্রায়ে গালিব ভাইয়ের পিছু নিতে চাইলো কেন যেন। অনেকদিন পর জোয়ারের জলের স্পর্শ পাবার পর ভাটার কথাটাও মাথায় রাখা উচিত। আর কে না জানে ভাটার সময় সমুদ্রে অবস্থান করা বিপদজনক। ভাটার টানে ভেসে গিয়ে দুদিন পরে কলেজছাত্রের লাশ ভেসে ওঠার খবর এই তো সেদিনই পড়লাম পত্রিকায়। গালিব ভাই চলে যাবার উপক্রম করলে একটা তীব্র টানের ভাটার অবশ্যম্ভাবী আগমন অনুভব করছিলাম। বিপদজনক ভাটা। একেকজনের মনের সমুদ্র একেকরকম। জোয়ার-ভাটার হিসেবও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। তাই আমার পায়ের নিচ থেকে পানি সরে যাওয়া, বালু দিয়ে পায়ের পাতা ঢেকে যাওয়া অনুভব করলেও অন্যরা দিব্যি জোয়ারের জলে নিজেদের ভাসাতে থাকলো। গালিব ভাইয়ের ভেসে যাবার দিকে তাদের কোন খেয়ালই নেই। যেন তারা চায় এমনটা হোক। কেন তারা চায় আমি বুঝতে পারি না। শুধু তাকে আটকে রাখার প্রবল ইচ্ছেটাকে স্বাগত জানাই।
-থাকেন না আর কিছুক্ষণ! কাজ একটু পরে করলে কী হয়!
-আরে তুমি বুঝতেসো না, এটা অনেক টাকার ব্যাপার। বিরাট লস হয়ে যাবে আমি সময়মত না গেলে।
গালিব ভাইকে আমার অচেনা লাগে। এই গালিব ভাই একসময় পরীক্ষার আগের রাতে সিনেমা দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে কাকার বেধড়ক পিটুনির পরেও দাঁত কেলিয়ে হাসতো। স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়ে প্রিয় দলের পরাজয়ে বুক ভাসিয়ে কাঁদতো। আমাদের সকল তুতো ভাই-বোনদের এক সূতোয় গেঁথেছিলেন তিনি। বয়েস ত্রিশ পার হবার পরেও তার ভেতরকার ছেলেমানুষী মনটা উজ্জীবিত ছিলো সবসময়, বয়সের সাথে সাথে তা আরো পরিশলীত এবং নতুন আঙ্গিকে সবাইকে স্নেহাঞ্চলে ঢেকে রাখতো। তিনি কবে থেকে এমন কাটখোট্টা হয়ে গেলেন? কবে থেকে এমন নিরেট বস্তুবাদী হলেন? কবে থেকে আনন্দের চেয়ে টাকা পয়সা তার কাছে জরুরী হলো?
নাহ, তাকে যেতে দেয়া যায় না। তাকে চলে যেতে দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি দেখতে পাচ্ছি লাইফগার্ডেরা তেড়ে আসছে হুইসেল বাজিয়ে। আনন্দসমুদ্রে স্মৃতিস্নান রহিত করার জন্যে সাইরেন বেজে চলে তাড়স্বরে।
"উঠে পড়েন, উঠে পড়েন! এই সময় সমুদ্রে থাকা নিরাপদ না। বিপদজনক। উঠে পড়েন উঠে পড়েন!"
আমি যেন চোরাবালির ভেতরে আটকে পড়েছি, হাঁসফাঁস করতে থাকি, গালিব ভাইকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে স্রোত...
"এই, থামো সবাই! গান বন্ধ করো। পরে নেচো। গালিব ভাইকে বাঁচাও আগে"
চিৎকার করে উঠি আমি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তাদের উৎসবের তান্ডব আরো বেড়ে চলে। আমার সবকিছু অসহ্য লাগতে শুরু থাকে, বিপন্নতার বোধ গ্রাস করে আমায়। আমি নৃত্যরতা কাজিনের বগলের তলা দিয়ে, গান গাইতে থাকা আত্মীয়াকে ধাক্কিয়ে, বোর্ডগেমে ব্যস্ত ছোকড়াদের গুটি এলোমেলো করে আর কয়েকটা বেলুন পা দিয়ে দলে গালিব ভাইয়ের পিছু নেই। আঁকড়ে ধরি তার কাঁধ।
-আপনি তাহলে যাবেনই?
-হ্যাঁ যাবো। কেন কী হয়েছে তোর?
খুব প্রগলভ অবস্থায় থাকলে গালিব ভাই আমাকে তুই করে বলেন। আমি আশা ফিরে পাই আবার। হয়তো তাকে ফেরানো যাবে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করি,
-আপনি চলে গেলে আমার ভালো লাগবে না মোটেও। আমাদের কারোরই ভালো লাগবে না। ডোন্ট বি সাচ আ স্পয়েলস্পোর্ট!
আমার কথা তার কানে যায় কী যায় না, তড়িঘড়ি করে ঘড়ি দেখে যবার চুড়ান্ত প্রস্তুতি নেন তিনি।
-নাহ বড্ড দেরী হয়ে গেছে।
আমিও বুঝতে পারি বড্ড দেরী হয়ে গেছে। গালিব ভাই চলে যাচ্ছেন ভাটার টানে। এত দূরে, যেখানে লাইফগার্ডরাও যেতে সাহস করবে না। কে বাঁচাবে তাকে? উজবুক কাজিনেরা সব মূর্খের মত নেচেই চলেছে এখনও। আমাকেই উদ্যোগ নিতে হবে তাকে বাঁচিয়ে তুলতে। প্যান্টের ভেতরে গোঁজা বাকানো ছুরিটা বের করি আমি। প্রয়োজন হবে মনে করে নিয়ে এসেছিলাম উৎসবমন্ডপ থেকে। প্রয়োজন হচ্ছে এখন। গালিব ভাইকে বাঁচাতে প্রচুর রক্ত দরকার। অন্য কারো রক্ত দিয়ে হবে না। তার নিজের রক্ত চাই। যে রক্ত শীতকালের সরিসৃপদের মত জমে গিয়েছিলো, শীতল হয়ে গিয়েছিলো, সেই রক্তকে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া আমিই দিতে পারি। তার গলা বরাবর ছুরিটা চালিয়ে দিলে রক্ত বেরুতে থাকে সুন্দর ধারায়। তাকে আর টেনে নিতে পারেনা ভাটার জল। রক্তদেয়ালে বাধা পেয়ে ফিরে যায়। তার দেহটা কাঁধে করে আমি উৎসবস্থলে উপস্থিত হই।
-এ্যাই তুই কী করেছিস! মেরে ফেলছিস গালিব ভাইকে!
আর্তনাদ করে ওঠে তার সহোদর ছোট ভাই।
-না মেরে উপায় ছিলো না। এটা অবশ্য এক রকমের বাঁচিয়ে তোলাই। সে ভেসে যাচ্ছিলো ভাটার স্রোতে। তোরা তো কেউ খেয়াল করিস নি তখন, এখন খামোখা বিতন্ডা করছিস!
-করবো না? সে যাচ্ছিলো টেন্ডার সাবমিট করে একটা বিশাল দাঁও মারতে। আমরা সবাই লালে লাল হয়ে যেতাম। আর তুই তাকে মেরে ফেললি!
-তোদের কম আছে নাকি! ব্যবসায় নামার দুই বছরের মাঝে পাঁচতলা বাড়ি উঠিয়ে দিয়েছে, আরো দিতো ধীরে ধীরে। এত তাড়াহুড়ো কেন? এত লালচ কিসের? আজকে এই উৎসবের দিনেও তোরা তাকে একটু কাছে থাকতে দিবি না? কতদিন পরে আমরা এক হলাম বলতো?
আমার কম্পিত গলার আবেগ তাকে আরো শোকাতুর এবং হিংস্র করে তোলে। জিঘাংসু কন্ঠে তার অন্যান্য ভাই-বোনদের ডেকে ঘটনা বিবৃত করে আমাকে আক্রমনের মাধ্যমে প্রতিহিংসা চারিতার্থ করারা আহবান জানায়। তারা সক্রোধে চিৎকার করে গালিব ভাইয়ের নিথর দেহটা মাড়িয়ে আমার পিছু ধাওয়া করে। কারো হাতে বটি, কারো হাতে ছুরি, সবার কাছেই ধারালো সব অস্ত্র। সম্ভাব্য অর্থপ্রাপ্তির সুফলা ক্ষেত্রটি বিনষ্ট হবার শোকে তারা হাহাকার করে ওঠে। তবে আমার সাথে দৌড়ে তারা পেরে ওঠে না। হয়তোবা অধিক আনন্দ উদযাপনের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। সহজেই তাদেরকে নাগালের বাইরে ছিটকে দিয়ে আমি একটা রিকশায় উঠে হুড তুলে দেই। ব্যস, নিরাপদ এবার!
রিকশাঅলা আমার পরিচিত। ছোটবেলায় আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতো।
-কী হইছে, হাঁপাও কেন?
-খুন করছি চাচা। গলায় ছুরি চালায়া দিছি। ওরা আমার পিছু ধাওয়া করতাছে।
-কিয়ের খুন করলা, কারে খুন করলা? কোন শব্দ পাইলাম না তো।
-এইগুলা নিঃশব্দ খুন চাচা। সবাই শুনতে পায় না এই আর্তনাদ।
-হ! আমারে শিখাও তুমি। আমি সাউন্ড না হইলেও সব শুনবার পারি। কারে খুন করছো, গালিবরে?
-আপনে কেমনে বুঝলেন?
-তুমি যে অরে খুন করবা এইটা অনেকদিন আগে থিকাই বুঝতাসিলাম। ছোটবেলা থেইকা তোমগো দেইখা আইতাছি। এরকম কতো খুন-খারাবি দেখলাম!
-এখন আমার কী হইব চাচা? আমারে এই এলাকা থিকা বাইর করেন। ডেঞ্জারাস জায়গা এইডা। ওরা ওৎ পাইতা আছে। প্রতিশোধ নিবেই।
-আমি তো এই এলাকা ছাড়া অন্য কোন জায়গা চিনি না।
-কী কন?
-চিনতাম, তয় ভুইলা গেসি। বয়স হইছে না? বয়স হইলে মাইনষে অনেক কিছু ভুইলা যায়। নতুন কিছু মনে রাখতে পারে না। তাই চেনা জায়গাতেই ঘুরঘুর করতে থাকে। বয়স হইলে মানুষ ভীতু হয়া যায়। গালিব তোমারে ভয় পাইতো। তাই তোমার কাছ থিকা পালাইতে চাইতো।
-আমারে ভয় পাইতো!
-হ। তোমার মাঝে সে নিজেরে দেখতে পাইতো। তুমি ছিলা আয়নার মতো। নিজেরে দেইখা সে ভয় পাইতো। সে বুঝবার পারছিলো যে আগের মতো হইতে পারবে না কখনও। অবশ্যি আর কেউ তাকে আগের মত চাইতোও না। তুমি চাইতা। তাই সে পালাইতো।
-একসময় আমিও কারো কাছে এমুন হয়া যামু। তখন সে আমারে খুন করতে চাইবো! আচ্ছা সেটা পরে চিন্তা করা যাইবো। আপনি আমারে বর্তমান বিপদ থিকা রক্ষা করেন। ওরা আইবো আমারে ধরতে। খুন করতে।
-ওরা কেউ আইবো না। ওরা জানে যে তুমি বেশিদূর যাইতে পারবা না। আটকা পড়বা এই এলাকায়। আমার রিকশায়। যতক্ষণ ঘুরতে ইচ্ছা করে ঘোরো। কিন্তু একসময় তো ফিরতে হইবো ঘরে, তাই না? তোমার বাসার সব মানুষ এখন ওই বিয়াবাড়িতে। তোমার না ফিরা উপায় কী?
-ধুরু বুইড়া, তুমি বড় বেশ ফাউ প্যাচাল পারো! নামায় দাও আমারে রিকশা থিকা!
বুড়োর এত শক্তি এলো কোথা থেকে! সে তীরবেগে রিকশা চালাতে থাকে। প্রমত্ত গতিতে অতিক্রম করে পাড়ার অলিগলি, পথঘাট। সন্ধ্যাবাতির আলোয় তার পিঠে অলীক ছায়াচিত্র তৈরি হয়, দৃশ্যগুলো আমার কাছে অশ্লীল লাগলেও আমোদ পেয়ে দূর থেকে সিটি বাজায় বিয়েবাড়ির স্বজনেরা। ওরা আসছে! আমি রিকশা থেকে নেমে পড়ার চিন্তা স্থগিত করে দেই। এই যানটার মত দ্রত ছোটা আমার পক্ষে সম্ভব না।
সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি আমার রিকশাভ্রমণ চলতে থাকে পলায়নের নিমিত্তে। পালানো হয় না আমার। বারবার আটকে দেয় মধ্যরাতের ট্রাফিক পুলিশ। ব্যারিকেড দিয়ে রাখে প্রতিটি প্রস্থান পথে। টলতে টলতে টহল দেয় পাড়ার ডেঁপো ছেলেরা। চক্র তৈরি করে আমাকে আটকে রাখে। একসময় আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার অনুভূতি পরাজিত হয় ক্ষুধার কাছে।
-রিকশাটা থামান চাচা। কোথাও নাইমা কিছু খায়া নেই।
-কোথায় নামবা তুমি? সব দোকান বন্ধ। এত রাতে কেউ ব্যবসা খোলা রাখে নাই আমি ছাড়া।
-আমারে আপনার বাসায় নিয়া যান। আপনার কাছে যা আছে তা দিয়া দুইমুঠ খায়া প্রাণডা বাঁচাই।
-ঘরের মানুষের কাছে ফিরা যাও বাবা। পরের মাইনষেরে বিশ্বাস নাই।
-কী যে কন চাচা! আপনি আবার পর হইলেন কবে থিকা! নিয়া যান আমারে আপনের বাসায়।
-আমার বাসায় যা আছে তা তোমার ভালা লাগবো না।
-আরে চলেন তো চাচা!
সে স্মিত হেসে রিকশার গতি কমিয়ে দিক পরিবর্তন করে। পাড়ার এ অংশে আমি কখনও আসি নি। বড্ড অপরিচিত ঠেকে সবকিছু।
-আস্তে আসো। পা পিছলাইবা।
-এই জায়গায় আমি তো আগে কখনও আসি নাই চাচা!
-চেনা জায়গাই। হয়তো খেয়াল করো নাই।
শ্যাওলা জমে পিছল হয়ে আছে পথ। দেয়ালে মাকড়সাদের অবাধ যাতায়াত। অত্যন্ত নোংরা পরিবেশ। গা গুলিয়ে আসে এখানে খাবার কথা ভাবলে। কিন্তু কিছু তো খেতে হবে! বিয়েবাড়িতে ফিরে যাবার প্রশ্নই আসে না। ওরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাকে কাটবে। বারবার পিছলে পড়ে পথ চলতে থাকি আমি। পথ আর শেষ হয় না। বোঁটকা গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসে।
-আর কতদূর?
-পথ ভুইলা গেছি!
-মানে!
-মানে কী! তোমারে কইছিলাম না, বুড়া বয়সে কিছু মনে টনে থাকে না। স্মৃতিনাশ হয়।
-তাই বইলা নিজের ঘর ভুইলা গেছেন?
-আমার ঘর নিয়ে এত দরদ কিল্লিগা তোমার? সারাজীবন তো রিকশায় চড়ছো, কখনও আমার ঘরে আসছো? খবর নিছো? এটা নিয়া আমার কোন অভিযোগ নাই। না নেয়ারই কথা। আর আমার মতো মানুষের ঘর থাকাও যা না থাকাও তা। তাই মনে রাখার চেষ্টাও করি নাই। যাদের ঘর থাকা দরকার তাদের ঘরে পৌঁছায় দেয়াই আমার কাম। চলো। ওঠো।
সে আমাকে হাত ধরে টেনে তোলে শ্যাওলাবাগান থেকে।
-আমাকে কোথায় নিয়া যান?
*
বিয়েবাড়ির তীব্র রঙিন আলোয় শুকিয়ে গেছে গালিব ভাইয়ের রক্ত, বাস্পীভূত হয়ে গেছে তার দেহ। তার চিহ্নটি কোথাও নেই। শুধু জেগে আছে তার স্বজনেরা রক্তের পিপাসা নিয়ে। আমাকে দেখে তারা হুল্লোড় করে ওঠে তারা।
-কী রে এতক্ষণে আসলি? তোর জন্যে খাবার রেখে দিয়েছি। খেয়ে নে।
তাদের কথার আন্তরিকতা আমাকে বিস্মিত করে।
গালিব ভাইয়ের বাবা কাছে এসে আমাকে আদর করে বসান। খাবারের তদারকি করতে থাকেন। ক্ষুধার্ত আমি গোগ্রাসে গিলে চলি অন্যসব চিন্তা বাদ দিয়ে। খাবারটা বড় চমৎকার হয়েছে।
-আর কিছু লাগবে তোমার?
-আমি নিয়ে নিয়ে খাবো। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না!
-খাও।
-রেজা তোর খাবার হলে একটু চিলেকোঠার ঘরে আসিস তো। কথা আছে।
গালিব ভাইয়ের ছোটভাই আমাকে বলে।
-কী ব্যাপার?
হাতমুখ ধুয়ে আয়েশ করে একটা পান চিবুতে চিবুতে তার কাছে যাই আমি।
-খুব ঘরকুনো হয়ে গেছিস তুই। ঘর ছাড়া থাকতে পারিস না একদম। ভালো। আমরা জানতাম তুই ফিরে আসবি। তাই আর পরিশ্রম করি নি অযথা। এটা ভাঙনের সময় ভ্রাতা! একান্ন কেটে সতের। সতের কেটে সাত। এসময় এমন গোঁয়ার আবেগে কাউকে ধরে রাখতে চাওয়াটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আনন্দ ভালোবাসা আর বিষয়বুদ্ধিকে একসাথে জড় করলে ভজঘট ছাড়া কিছু হয় না।
আমার গলায় ধাতব ফলার শীতল স্পর্শ অনুভব করি।
-আমাকে আরেকবার সুযোগ দে!
-তুই গালিব ভাইকে সুযোগ দিয়েছিলি?
-সুযোগ দেয়ার সুযোগ পাই নি। অত সময় ছিলো না।
-এক্সাক্টলি! আমাদের সময়ের বড়ই অভাব! আর সত্যি কথা বলতে কী, বড় হয়ে ওঠা পরিবারের বৃদ্ধি রোধে তোর প্রচেষ্টা ভালো ছিলো। এপ্রিসিয়েটেড। সেই একই কাজ আমি করবো এখন।
-তাড়াতাড়ি করো ভাইয়া, গালিব ভাইয়ের জায়গায় তোমাকেই তো যেতে হবে।
পাশ থেকে তাগাদা দেয় একজন।
চামড়া কাটার শব্দে রিকশাঅলা বুড়োটা ঘুম থেকে উঠে মাথা নাড়ায়, সবকিছু ঠিকঠাকমত চলছে দেখে আশ্বস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে আবার।
৬২টি মন্তব্য ৬২টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?
মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন
অভিনেতা
বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)
সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?
আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন