ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। ওখান থেকে একটা হোটেলের নিয়ন আলো দিয়ে তৈরি সাইনবোর্ড দেখা যায়। হোটেল গ্রিনভিউ। ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় সাইনবোর্ডের আলোগুলি জ্বলে ওঠে। সারারাত জ্বলতে থাকে। ছেলেটা বেশিরভাগ সময়েই তার রুমের ভেতর থেকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে হোটেলের লাইটের দিকে। ঘুমের সমস্যা হচ্ছে তার। তাই রাত জাগতে হয়। আর রাত জাগতে হয় বলেই একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকা। রাতের বেলা, যখন সব শুনশান,তখন তার রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শূন্য রাজপথকে রাতের মেঘনার কালো পানি মনে হয়। অনুভূতিটা অনেকটা এরকম, সে লঞ্চে করে নদী পার হচ্ছে, সামনের বিল্ডিংগুলোও লঞ্চ বা ফেরি। আর চারিপাশের নিকষ অন্ধকার হলো নদী। ছেলেটা কল্পনাপ্রবন। তাই এই একাকীত্ব আর একঘেয়ে সময়কে সে নিজের মত কারে সাজিয়ে নিতে পারে। এজন্যেই তার সময় খুব একটা খারাপ কাটে না। বয়স কত হতে পারে ছেলেটার? সতের? কিংবা আঠারো। বিত্তশালী বাবা-মার কাছ থেকে দেদার পকেটমানি পেয়ে কনসার্টে উল্লাসনৃত্য করার পর ইয়াবা না হলে তার চলতো না? ইয়াবা সেবন করে হার্টথ্রব প্রস্টিটিউটদের এমন কী মিডিয়া জগতের নারীদের শরীরের সাথে শরীর মেলাতো। কী সব দিন ছিলো! উদ্দাম উল্লাস, টানা তিনরাত জেগে থেকে পার্টি, চেনা-অচেনা যেকোনো মেয়ে পেলেই আলিঙ্গন অথবা চুমু। হু কেয়ারস! ইয়াবাঘটিত উৎসব শেষ হলে টানা ঘুম। এভাবে বেশ কাটছিলো দিন। কিন্তু তার বাবা-মা বাধ সাধলেন। একবার মদ্যপ অবস্থায় বাসার আসবাবপত্র ভাঙচুর করার পর তারা প্রথমবারের মত বিষয়টির গুরুতর দিকটি দেখতে পেলেন। ছেলে উচ্ছন্নে গেছে এই বিলম্বিত বোধোদয়ের পর তারা তাকে দ্রুত একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। ছেলেটি তখন ছিলো নেশায় বুঁদ। তাই সে কোনো প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে নি। নিরাময় কেন্দ্রে আসার সময় সে অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছিলো। প্রথম তিনটা দিন সে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়। চতুর্থ দিনে একটু বোধ ফেরার পর সে তার বর্তমান পরিস্থিতির শোচনীয় দিকটা দেখতে পায়। বহির্গমনের সব দরোজাই তালা দেয়া। তার সাধের আইফোনটাও বাজেয়াপ্ত করেছে তারা। কারো সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। এখানে এই বদ্ধ ঘরে সময় কাটবে কীভাবে? থাকতে হবে কম করে হলেও একমাস। সে কি পাগল হয়ে যাবে? তবে মানুষের একটা গুণ হলো যেকোনো পরিস্থিতিতে অভিযোজিত হতে পারে। এক্ষেত্রে ছেলেটা তার এই দুঃসময়ে গ্রিনভিউ হোটেলের বাতি জ্বলা আর নেভা প্রত্যক্ষ করেই তার অভিযোজিত সময় কাটিয়ে দিতো। নিয়ন সাইনটা তার চোখাচোখি হবার ফলে সে ওটার ব্যবচ্ছেদ করতো আপন মনে। কোন অক্ষরের রঙটা কমে গেছে, কোনটা একটু দেরিতে আলো দেয় এসবই ছিলো তার সময় কাটানোর ব্যবস্থা। সময় বড় শক্ত জিনিস কিছু ক্ষেত্রে। তাকে কাটানো যেই সেই ব্যাপার না। তাই ছেলেটিও সময়ের টুঁটি চেপে ধরে কামড়ে, খামচে তাকে কাটার চেষ্টা করে। কষ্টেসৃষ্টে কিছু সময় কাটায়। এভাবেই সময় কাটছে ছেলেটির। অথচ আগে, আহা কী দিন ছিলো...
সেই দিনটা, যেদিন সে ঠিক করেছিলো লাস্ট স্টেশন অফ ড্রাগে পৌঁছাবে, এই দিনটার কথা কখনও ভুলতে পারবে না সে। ফেনসিডিল, ইয়াবাতে তার নিরাশক্তি ধরে গিয়েছিলো। বোতল বোতল ফেনসিডিল খেতো, পঞ্চাশ-ষাটটা করে ইয়াবা নিতো তারপরেও যেন আরো কিছু দরকার ছিলো। অবশেষে পেয়েই যায় এলএসডি;লাস্ট স্টেশন অফ ড্রাগ বলে যার সুপরিচিতি আছে। তারপর তিনটা দিন কী যে কাটলো তার! রিকশায় করে এ্যারাম বারের কাছে নামার সময় তার মনে হচ্ছিলো সে যেন একজন হেলিকপ্টারের পাইলট। তার কানে যেন ঢাউস আকৃতির হেডফোন লাগানো। হেলিকপ্টারের ডানা ঘুড়ছে, প্রচন্ড শব্দ। আর রিকশা থেকে নামার সময়টা যেন প্যারাসুটে করে অনেক উঁচুতে থাকা বিমান থেকে লাফ দেয়া! এইতো জীবন! মাদকের রঙে রাঙানো উড্ডয়নশীল উদ্দাম জীবন। এ যেন এক সমান্তরাল জীবন। নেশাবিহীন জীবনটা তখন শুষ্ক, শুকনো, পরিত্যাগকৃত একটি নিরামিষ বেঁচে থাকা। সমান্তরালে চলা নেশাগ্রস্থ জীবনের কাছেই সে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পায়। অনেক উঁচুতে উঠছে সে এখন। সাত আসমান পার হয়ে যাবে বোধ হয়। আরে এইতো, চলে এসেছে! জলমেঘ, শব্দমেঘ, মিথ্যা মেঘ, হাওয়াই মিঠাই মেঘ, গম্ভীর মেঘ, চপল মেঘ, মেঘেদের রাজ্যে তার অলীক উড্ডয়ন। তবে এই আনন্দ বেশিক্ষণ থাকলো না। শুরু হলো পতন। সে নামছে, নামছে, অভিকর্ষজ ত্বরণের সূত্র মিথ্যা প্রমাণিত করে তার চেয়েও তুমুল জোরে নামছে। পতন কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদিত হবার পর সে নিজেকে আবিষ্কার করে তার শোবার ঘরে। ঘরটা কেমন যেন দুলছে! দুলছে টেবিলল্যাম্প, টেবিল, চেয়ার, বই, কম্পিউটার। দুলুনিটা তার ভালোই লাগে। সে নিজেকে কুঁকড়ে হাঁটুটা মাথার কাছে এনে হাত দিয়ে গিঁট দিয়ে দেয়। এভাবে থাকতে বেশ লাগছে তার। চোখ বন্ধ করলেই আলোর বর্ণালী আর সিডি প্লেয়ারে বাজতে থাকা গানগুলো যেন ঠিক ঠিক তার মস্তিষ্কের মধ্যে পৌঁছে গেছে। তার মাথার ভেতর গান বাজছে। প্রতিটা শব্দ সে আলাদাভাবে বুঝতে পারছে। শব্দগুলো যেন জ্যান্ত! তাদের প্রত্যেকের আলাদা চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য আছে। রিনিঝিনি শব্দ, মাতাল শব্দ, দুঃখী শব্দ, দুষ্ট শব্দ, সেক্সি শব্দ, গম্ভীর শব্দ। তার মস্তিষ্কটাকে যেন প্লেগ্রাউন্ড বানিয়ে ইচ্ছেমতো ছোটাছুটি করছে শব্দেরা। তার মাথাটা হালকা লাগতে থাকে। সে শুয়ে পড়ে। একটু চোখ বন্ধ করেছে কী করে নি নতুন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। শব্দগুলো হঠাৎ করে চলে যায়। আর তাদের স্থানে হুড়মুড় করে আসতে থাকে স্মৃতিরা। ভালো স্মৃতি, মন্দ স্মৃতি, যেন টাইম ট্রাভেলে বের হয়েছে সে। মায়ের বকুনি, বাবার শাসন, দুজনের সাথে সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যাওয়া, বন্ধুর সাথে মারামারি, গলাগলি, আড়ি, ভাব, প্রেমিকা, প্রথম চুম্বন, তারপর ব্রেকআপ...তারপর ব্রেকআপ...তারপর ব্রেকআপ! এলএসডি পুরোনো স্মৃতি গভীর গহন থেকে তুলে আনতে পারে জানে সে। কিন্তু হঠাৎ করে দুঃখের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থেকে যন্ত্রণা দেয়ার কাজটা যে এমন অবর্ণনীয় কষ্টের হবে তা ছেলেটি জানতো না। এখন তার মাথার মধ্যে ঘুরছে, শুধু ঘুরছে তার প্রাক্তন প্রেমিকার কথা। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। কেন তুমি চলে গেলে? আর আমিই বা কেন মাসখানেক পরে একটা মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করা শুরু করলাম? আমি কি তাহলে লোফার? লুচ্চা? হায় খোদা! আমি এত খারাপ কেন? হুহু করে কাঁদতে থাকে সে। আর তারপর! অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে মস্তিষ্কের স্মৃতির এ্যালবাম থেকে। এখন সে আছে শহরের প্রসিদ্ধ একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে।
সে এখানে এসেছে দশদিন হলো। কমপক্ষে নাকি তিনমাস থাকতে হবে, এটা কল্পনা করতেই তার ভয় লাগছে। এতদিন এখানে থাকবে কীভাবে? নিরাময় কেন্দ্রের অন্যান্য রোগীদের সাথে তার তেমন একটা মেলে না। মিশ খায় না। সে প্রায় সারাক্ষণ জানলা দিয়ে উদাস নয়নে হোটেল গ্রিনভিউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশেষ করে রাতের বেলা। যেন বিশাল সাগরে সে একজন জাহাজযাত্রী আর হোটেল গ্রিনভিউ একটা বাতিঘর যার আলো আসছে দশতলার ছাদের একটা নিয়ন সাইন থেকে।
ডায়েরি
"ওরা আমাকে এখানে পাঠিয়েছে, বেশ ভালো কথা। তিন মাসের আগে এখান থেকে যাওয়া যাবে না এটা খুব খারাপ কথা। এখানকার খাবার-দাবার অবশ্য বেশ ভালো। নিয়মের নিগড়ে বেঁধেছে দিন। সকাল নয়টায় নাস্তা। সকাল এগারটায় আবার হালকা নাস্তা এবং প্রেসার মাপা। দুপুর দুইটায় ভাত। বিকেল পাঁচটায় নাস্তা। সাতটায় প্রেসার মাপা। নয়টায় রাতের খাবার। এখানে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার আছে। একজন কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করে মুরগী ডিম পাড়ার সময় যেমন শব্দ ব্যবহার করে তেমন করে কককককককক ডাকতে থাকে। আরেকজন আছে, কথাপ্রসবা। দুইটা মিনিট সে চুপ করে থাকতে পারে না। অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে, কীভাবে যে পারে! আরেকজন মাদার সুপ্রিম! দশ বছর ধরে সে এমন কোন নেশা নাই যা করেনাই। হেরোইন, পেথেডিন, কোকেইন, মরফিন... অথচ সে দিব্যি ভালো স্বাস্থ্যের একজন প্রাণবন্ত মানুষ। আমি এত নেশা জীবনেও করতে পারবো না। নির্ঘাৎ মারা পড়বো। আমার জন্যে ফেন্সিডিল আর ইয়াবাই ভালো। এলএসডি নিয়ে সেবার যা অবস্থা হয়েছিলো না! পুরো তিনদিন ধরে অতীতের দুঃখের কথা মনে করে শুধু কেঁদেছি। মানসম্মান আর থাকবে না। সেদিন ডাক্তার এসেছিলেন গ্রুপ কাউন্সেলিংয়ের জন্যে। সবার সাথেই তিনি আলোচনা করলেন। আমার সাথে কথা বলার সময় আমিও খুব আবেগ দিয়ে বলে ফেললাম ড্রাগসের কারণে আমার কী কী ক্ষতি হয়েছে, এবং এসব অনুধাবন করে আমি কী পরিমাণ অনুতপ্ত, এইসব হাবিজাবি। শালারা আমাকে ছাড়ুক না, বের হয়ে প্রথমেই যাবো ইয়াবার পিনিক নিতে।"
সন্ধ্যা ছটা বাজে। এখনই গ্রিনভিউ হোটেলের নিয়ন সাইনটা জ্বলে উঠবে। ছেলেটা নিবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে থাকবে সেদিকে। এতটুকু আলো না পেলে কি চলে!
_____________________________________________
একদিন হঠাৎ! হোটেলটির ছাদে একটা পরী দেখতে পেলো ছেলেটা। অদ্ভুত ব্যাপার! এখানে পরী আসবে কোথা থেকে! শুভ্র দুটি ডানা আর হরিণচোখের পরীটি কি ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে আছে? নাহ, হ্যালুসিনেশন হবার তো কথা না। ওসব সাইকোডেলিক ড্রাগস নেয়া হয় না এখন আর। ধুর ছাই! কোনো মেয়ে হয়তো ডানা লাগিয়ে ছাদে উঠে মজা করছে। কিন্তু...আরে আরে এ কী! পরীটা উড়ছে! সত্যি পরী! উড়ে তার জানলার কাছেই আসছে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, অন্য কেউ তাকে দেখছে না। পরীটা ক্রমশ তার দিকে আসছে। এসেই গেলো শেষতক! মিষ্টি করে হাসলো পরী ছেলেটির দিকে চেয়ে।
-এই ছেলে, বলোতো আমি কে?
-তুমি... পরী! এখানে আসলে কীভাবে?
-তোমরা তো পরীরাজ্যের নিয়মকানুন জানো না। কখনও কখনও কোন পরীকে মর্ত্যের মানবদের সাথে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়। আমি সুযোগটা পেয়ে গেছি! আর তোমাকেই পছন্দ করলাম। আশা করি আমরা খুব ভালো বন্ধু হবো।
-ভালো বন্ধু হবে ভালো কথা। কিন্তু আমার ওপর ওসব খবরদারী করতে যেয়ো না যেন। ড্রাগস আমি অত সহজে ছাড়ছি না।
-আরে বোকা আমি তো জানিই তুমি এমন। তোমার ড্রাগস তোমার কাছেই থাকুক। আমার কী। পরীদের সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যে ওরা খুব ন্যাকা-বোকা হয় আর বিড়ালের মত মিউমিউ করে আহ্লাদী কথা বলে, তাই না?
-হাহা! বিড়ালের মত মিউমিউ! তোমাকে অবশ্য অমন লাগছে না।
-এই আমি যাই। তোমার ছুটি কবে?
-এই তো সপ্তাহখানেক আছে আর।
এই সপ্তাহটা ওদের খুব ভালো কাটে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পরী চলে আসে ছেলেটার জানলায়। তারপর তারা গল্পে মেতে ওঠে। অফুরান তাদের গল্পের সম্ভার, পরীরাজ্য থেকে চাংখারপুল, ফুচকা থেকে আপেল, ফুটবল থেকে ইচিং বিচিং কত গল্প! গল্পের আর শেষ নাই। এক সপ্তাহ পরে যখন ছেলেটি ছাড়া পেলো রিহ্যাব থেকে পরীটি আকাশ থেকে তাকে ছুড়ে দিলো উড়ন্ত চুম্বন, যা শুধু ছেলেটিই দেখতে পেলো।
পরী বিষয়ক ফ্যান্টাসি বা হ্যালুসিনেশন যাই হোক না কেনো, ছেলেটা এসব নিয়ে তেমন ভাবে নি আর। এত মাদক তার শরীরে ঢুকেছে, তার ওপর আবার হাইডোজের ঔষধ! হ্যালুসিনেশন তো হতেই পারে। এখন এই কথা কাউকে বললেও সমস্যা। নির্ঘাৎ পাগল ঠাউরে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানীর কাছে পাঠিয়ে দেবে। অত ঝামেলার কী দরকার! পরীকে নিয়ে তো ভালোই চলছে, চলুক!
পরী ইদানিং ঘনঘন আসে তার কাছে। এসে সেই ফালতু আলাপ, খাওয়া দাওয়া হয়েছে না কি, আজকের আবহাওয়াটা কেমন, নতুন পোষাক... খুব ধীরলয়ে সে মাঝেমধ্যে ছেলেটির মাদকাসক্তি ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়। তেমন করে বলা হয়না দেখে ছেলেটাও তেমন গা করে না। তবে দিনদিন পরীর চাহিদা বাড়তে থাকলো। সে ছেলেটির হাত ধরতে চায়, তাকে চুমু খেতে চায়, আলিঙ্গন করতে চায়। এসবই অবশ্য তার মনের কথা। মুখ ফুটে বলা হয় নি কখনও। তবে সে বলবে একদিন নিশ্চয়ই। সাহস করে সে একদিন বলেই ফেললো,
-এই যে ছেলে, তোমার সামনে সবার আরাধ্য একটা আস্ত পরী দাঁড়িয়ে আছে অথচ তোমার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। তোমার কি ইচ্ছা করে না আমার হাত ধরতে?
-ওহ, আসলে হয়েছে কী... তোমাকে খুলেই বলি। আমার সেক্সুয়াল আর্জ অনেক কমে গেছে ড্রাগস আর ঔষধের প্রভাবে।
-শুধু সেক্সটাই কী সব? একটু হাত ধরলে কী হয়?
-কিছুই হয় না। দাও ধরি।
-এরকম মরাকাঠের মত ধরে আছো কেন? যাকগে, থাক। লাগবে না।
ছেলেটির এখন আর এসব ন্যাকামি ভালো লাগে না। রিহ্যাব থেকে ফেরার পর সে মাদকের প্রতি আরো আকৃষ্ট হয়েছে। নতুন নতুন ড্রাগস নিচ্ছে দেদারসে। এসব দেখে পরীটার ইচ্ছে হয় তাকে নিষেধ করতে। কিন্তু সাহস পায় না। আর বলেই বা লাভ কী! সে শুনবে এই কথা? তারপরেও একদিন সে সবকিছু তাকে খুলে বলার সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘ বক্তব্য হবে। ছেলেটির কাছে যাবার আগে সে বেশ কয়েকবার আউড়ে নেয়।
ছেলেটি তখন কোকেইন স্নিফ করছিলো। বিমর্ষ মনে তা দেখে পরী বললো,
-তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।
-বলে ফেলো।
-তুমি কি বুঝতে পারো, তুমি কি পেয়েছো? আমি কে জানো তো? আমি পরী। সত্যিকারের পরী। আমি তোমার কোন হ্যালুসিনেশন বা অন্যান্য মানসিক রোগের দ্বারা সৃষ্টি হইনি। আমি নিখাঁদ পরীরাজ্যের পরী। কখনও কখনও কোন পরীকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় কারো ত্রাতা হতে, অথবা স্রেফ খেলাচ্ছলে উড়ন্ত অবস্থায় কাউকে দেখানোর জন্যে, যার এই অভিজ্ঞতা বর্ণনের অভিজ্ঞতা হাসি তামাশার বিষয়ে পরিণত হয় অন্যদের কাছে।। কিন্ত কখনও কখনও কোন পরী মর্ত্যে এসে কোন এক যুবকের প্রেমে পড়ে যায়। পরীদেরও মন আছে। তারা শুধু ফেইরি টেলের ঝকঝকে ছবি না, অথবা পরীরাজ্যে নৃত্য-স্নান-গানের মাধ্যমে মাতোয়ারা হয়ে জীবনের সার্থকতা খোঁজে না। পরী আর মানুষের মধ্যে মিলন সম্ভব না, তবু পরীরা কাউকে বেশি ভালোবেসে ফেললে তার প্রতি আজীবন ভালোবাসা বজায় রাখে। যেমন আমার তুমি। তুমি প্লিজ আর নেশা করো না।
ছেলেটির তখন হেরোইনে ওভারডোজড হয়ে টালমাটাল অবস্থা। সে জেনেছে নেশাই তার প্রকৃত, বিশ্বস্ত প্রেমিকা। তার কাছে পরী বা নারী কোনকিছুরই মূল্য নেই।
-কী বললে তুমি?
ভয়ংকর রক্তাভ চোখে তাকিয়ে আছে সে। পরী ভয় পেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-তুমি নেশা ছেড়ে দাও।
-নেশা ছাড়লে তোমার কী? পরী-নারী এসব কিস্যু না আমার কাছে।
-ভুল ভেবো না ছেলে! তোমার প্রথম প্রেমিকা তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলো তোমার মাদকঅভ্যাসের জন্যে। সে ছিলো একজন নারী। তোমাদের মর্ত্যের নারীদের মন বোঝা আসলেই দায়। তবে পরীরা কিন্তু যাকে একবার ভালোবাসে, তাকে কখনই ছেড়ে যায় না। বলতে কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে, তবুও মিলিয়ে দেখো। তোমার আশেপাশের যেসব সুন্দরী মেয়ে আছে তাদের চেয়ে আমি কতগুণ সুন্দরী। আমার মুখের দিকে তাকাও। একবার। পূর্ণদৃষ্টিতে।
ছেলেটির চেহারায় একটা বুনোভাব ফুটে উঠেছে। পরী-নারী, নারী-পরী কেউ কি এলএসডির এক হাজার ভাগের একভাগ আনন্দ দিতে পারবে? এসব ফালতু কথা অনেক শুনেছে। এখন এটার একটা সমাপ্তি দরকার। পরীটাকে সে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। পরীটা ভগ্ন হৃদয়ে উড়ে চলে যায়। অনেক দূরে, ওপরে।
ছয় মাস পর। ছেলেটির খুব উড়তে ইচ্ছে করছিলো। উড়তে চাইলে ওড়া অবশ্য কোন ব্যাপার না তার জন্যে। গাঁজা, মদ, ফেন্সিডিল, কোকেইন... কত কী আছে! কিন্তু ইদানিং আর তার ওরকম ওড়াউড়ি ভালো লাগে না। ফুটো হওয়া লিভার আর নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা কিডনি প্রপেলার হিসেবে মোটেও উপযোগী না। আর তাই সে ফিরে যায় উৎসমুখে। গ্রিন ভিউ হোটেলের দিকে যেতে থাকে সে। এই সেই হোটেল, যেখানে সে দেখেছিলো একটা সত্যিকারের পরীকে। দেখেছিলো নিয়ন সাইনের বাতিঘর। এখানে যাবে সে। একদম ছাদে উঠে গিয়ে একটা লাফ। ব্যাস, শেষ!
পরিচিত লোকের সুপারিশের সুবাদে সে হোটেলটির ছাদে উঠতে সক্ষম হয়। রেলিংয়ে উঠে দাঁড়ায়। আশেপাশে দেখে, কোথাও পরীটাকে খুঁজে পাওয়া যায় কী না। নাহ, নেই সে। হয়তোবা পরীরাজ্যে অন্য কারো জন্যে বীণা বাজাচ্ছে। হায় নেশা! নারীরুপ পরী, পরীরূপ নারীর সম্মিলিত ভালোবাসাও যখন তাকে ঠেকাতে না পারে তাহলে আর তার পতন ঠেকাবে কে? রেলিংয়ের ওপর টলোমলো পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। জীবনের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পিনিক; মৃত্যু, এই গন্তব্যে নিয়ে আসার জন্যে বস্তগুলো; এলএসডি,ইয়াবা, ফেন্সিডিল সোৎসাহে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটাকে একটা আলতো ধাক্কা দিয়ে তারা মরণের উদ্দেশ্যে চিয়ার্স করে। আর ছেলেটি পড়তে থাকে, তার লেদার জ্যাকেট, কব্জির ব্রেসলেট, শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঁকা নানারকম ট্যাটু সব একসাথে থেবড়ে লেপটে চুবড়ে গ্ল্যামারাস বা ‘কুল’ নেশাখোড়ের বায়োগ্রাফির শেষ অংকে পৌঁছে খুব বিচ্ছিরিভাবে নাড়ি-ভুড়ি আর মল-মূত্রের সাথে মিশে যায়।
আর তখন, কোন একজন মমতাময়ী তরুণী, যার সাথে ছেলেটার ভীষণ ভাব ছিলো, নতুন প্রেমিকের সাথে চুম্বনে ব্যতিব্যস্ত, আর সেই পরীটা? গোলাপ ফুলের পোষাক আর মাথায় সবুজ ঘাসের টুপি পড়ে নৃত্যরত অবস্থায় ভাবতে থাকে, ছেলেটার সাথে কী আদিখ্যেতাই না করেছিলো সে!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:১৪