(১)
ধরুন, আপনাকে আমি প্রশ্ন করলাম, মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব কত। উত্তর হিসেবে চারটি অপশন দিলাম। চারটি সংখ্যাই খুব কাছাকাছি। আপনি চোখ বন্ধ করে একটি উত্তর দিয়ে দিলেন। সেটা সঠিক হয়েও গেলো। ধরুন এরকম মোট ৫০টি প্রশ্ন আপনাকে দেয়া হলো, যার কোনটারই সঠিক উত্তর আপনার জানা নেই। এভাবে অনুমানের ওপর দিয়ে আপনি কয়টি উত্তর সঠিক করতে পারবেন? সম্ভাব্যতার সূত্র অনুযায়ী আপনার প্রতি চারটি প্রশ্নের একটি সঠিক হবার কথা। সেক্ষেত্রে আপনার স্কোর হবে ১২ বা ১৩। ভাগ্য খারাপ থাকলে এর চেয়ে কম হবে, ভাগ্য ভালো থাকলে এর চেয়ে বেশি হবে। কিন্তু সেটা কত বেশি? ১৫? হতে পারে। ২০? অনুমানের ওপরে ৫০ এ ২০ পাওয়া বেশ কঠিন। সেখানে ২৫ বা ৩০ পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আচ্ছা ধরলাম আপনি একটি বিষয়ে ৫০ এ ২৫ পেলেন ভাগ্যের জোরে। আপনাকে এখন ১০টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। ১০টির মধ্যে প্রতিটিতেই আন্দাজের ওপর উত্তর করলে আপনি একবার ৫০ এ ২৫ পেলে পরেরবার পাবেন ১০। শেষতক দেখবেন সম্ভাব্যতার অংকই জয়ী হবে। অর্থাৎ প্রতি চারটিতে একটি। হেরে যাবেন আপনি।
(২)
ওপরের প্রশ্নটির ক্ষেত্রে যে উদাহরণ দিয়েছি সেটা হলো তথ্যমূলক। মানে আপনি তথ্য জানলেই পার পেয়ে যাবেন। কিন্ত বহুনির্বাচনী প্রশ্ন কিন্তু শুধুমাত্র তথ্যমূলক প্রশ্ন দিয়ে সাজানো যাবে এমন না। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তরে মাথাও খাটাতে প্রয়োজন হতে পারে, বিশ্লেষণের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন-
পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব জানা কেন প্রয়োজনীয়?
১/ তাহলে আমরা মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠানোর ন্যায্যতা অনুধাবন করতে পারবো
২/ মঙ্গল গ্রহে প্রাণ আছে কি না সে ব্যাপারে গবেষণা জোরদার করতে সুবিধা হবে
৩/ সৌরজগৎ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে
৪/ মঙ্গল গ্রহে রেডিও সিগন্যাল পাঠানোর জন্যে
আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আমার উল্লেখ করা বিকল্পগুলি ভালো নয়, তবে চাইলে এ ধরণের প্রশ্ন তৈরি করা যায় যেগুলো শুধু মুখস্থ করে এসে উত্তর করা সম্ভব হবে না।
আবার এমন প্রশ্নও হতে পারে, যেগুলির উত্তর করতে হলে সূত্র জানতে হবে, মান সঠিকভাবে বসাতে হবে, এবং হিসেব করতে হবে। যেমন, 600 kg ভরের একখানি গাড়ি 20 m/sec বেগে সরল পথে চলতে চলতে 1400 kg ভরের একখানি স্থির ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়ে আটকে গেল। মিলিত গাড়ি দুটি একই সরলরেখা বরাবর একটি নির্দিষ্ট বেগে চলতে থাকল। মিলিত গাড়ি দু’টির শেষবেগ কত হবে তাহলে?
ক) 6m/sec
খ) 12m/sec
গ) 18m/sec
ঘ) 21m/sec
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ক্ষেত্রে অনেক রকম বৈচিত্র আনা সম্ভব, এটি মোটেও অনুমানে দিলাম,আর হয়ে গেলো, এত সহজ না।
তবে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ এর এস এস সি পরীক্ষায় যে পদ্ধতিতে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন করা হয়েছে তেমন কিছু হলে কিছু বলার নেই। সেখানে ছিলো ৫০০ প্রশ্নের প্রশ্নব্যাংক। ৫০০ উত্তর মুখস্থ করে পাস করার সেই মহোৎসবের কথা মনে পড়লে হাসিই পায়।
(৩)
এখন কথা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন কেন জরুরী? অনেক কারণ আছে। লিখিত প্রশ্নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাত থেকে দশটি প্রশ্ন করা যায়। আর সেগুলির উত্তর কী হলে সর্বোত্তম হবে, তার সংবিধান একেক শিক্ষকের কাছে একেকরকম। খাতা দেখা বিষয়ক বিভিন্ন অনিয়মের কথাও শোনা যায়। খাতা চ্যালেঞ্জ করে রেজাল্ট চেঞ্জ হয়েছে এমন ঘটনা বহু। এদিকে লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখা শিক্ষকদের জন্যে অনেক সময়সাপেক্ষ। অবজেকটিভ প্রশ্ন এমন ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে দেবে, সাম্য আনবে এ কথা বলা যায়।
লিখিত পরীক্ষার আরেকটি অসুবিধা হলো, এখানে বইয়ের সব জায়গা থেকে প্রশ্ন করা সম্ভব হয় না। চাইলেই একজন শিক্ষার্থী বইয়ের কিছু চ্যাপ্টার বাদ দিতে পারে। এভাবে বেছে বেছে অধ্যায় পড়ে, বাছাবাছা কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে যে সনদ তারা পাচ্ছে, সেটা আসলে কতটা অর্থবহ? ছেলে-মেয়েগুলো বিপাকে পড়ে যায় এ্যাডমিশন টেস্টের সময়। এ কারণে দেখা যায়, ভালো রেজাল্ট করা অনেক ছেলেমেয়ে ভালো জায়গায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
(৪)
এবার একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গে কথা বলবো। বলা হচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে এই অসুবিধাগুলি দূর হয়েছে। আসলেই কি তাই? আমাদের শিক্ষকেরা কজন প্রশিক্ষিত? কজন সৃজনশীল প্রশ্ন সঠিকভাবে তৈরি করতে এবং মূল্যায়ন করতে পারেন?
Directorate of Secondary and Higher Education (DSHE) পরিচালিত একটি জরীপে পাওয়া গেছে পিলে চমকানো তথ্য। ২০১৭ সালে মোট ৬,৫৯৪টি স্কুলে জরীপ চালিয়ে দেখা যায় যে প্রায় ৪০% শিক্ষকেরই নিজ থেকে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করার দক্ষতা নেই। ১৬% শিক্ষক বাইরে থেকে প্রশ্ন তৈরি করে আনেন, এবং ২৩% শিক্ষক কে অন্যদের সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করতে হয়।
(সূত্র- Click This Link)
এখন তবে বলুন, আমরা কি নৈর্ব্যক্তিককে বাদ দিয়ে পুরোপুরি সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের দিকে যেতে প্রস্তুত হয়েছি এখনও?
(৫)
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি ফিনল্যান্ডের মত হতো, তাহলে আমরা সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারতাম। কিন্তু ফিনল্যান্ডে একজন শিক্ষক তৈরি করার জন্যে যে সময় এবং শ্রম খরচ করা হয়, আমাদের ক্ষেত্রে কি তা হয়? ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পুরোবিশ্বে অনুকরণীয় স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হচ্ছে। ফিনল্যান্ড একদিনে এই অবস্থায় আসে নি। তারা সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করেছে, শিক্ষক এবং শিক্ষাকাঠামো গড়েছে, এখন তার ফল পাচ্ছে।
কিন্তু এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে যদি আমরা আমাদের শিক্ষাকাঠামো উন্নয়ন না করে শুধুমাত্র সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেই, এবং নৈর্ব্যক্তিক পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেই, তাহলে যে বিশৃঙ্খলা এবং সিস্টেম লস তৈরি হবে, সেটা আমরা সামলাতে পারবো তো?