জায়গাটার নাম ছিলো জলঢাকা। নিলফামারী জেলার একটি উপজেলা। জলঢাকা থেকে সৈয়দপুর, তারপর দিনাজপুর হয়ে যখন ঢাকা এলাম, বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করতো গ্রামের কথা। আমি খুব রেগে যেতাম। গ্রামের কথা আমি কী করে বলবো! আমি কী গ্রামের ছেলে নাকি! উপজেলা আর গ্রাম এক হলো! তারা হাসতো। আমার খুব অহমে লাগতো। গ্রামে থাকাটা যেন এক ভীষণ অপমানজনক ব্যাপার! আর এখন! থাকি একেবারে রাজধানীতে, এই লাল-নীল স্বপ্নের ধূসর শহরে! একটুখানি সবুজের জন্যে বুক খা খা করে। একটুখানি তরতাজা বাতাসের জন্যে ফুসফুসটা কেঁদে ফেরে। তারপরেও কি আমি গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েছি? যদি হয়েই থাকি, তাহলে যাচ্ছি না কেন? আর যদি প্রস্তুত না হয়ে থাকি, তাহলে প্রস্তুত হচ্ছি না কেন? নাহ। গ্রামে ফেরা যা-তা ব্যাপার না। সবাই পারে না। সবার ভাগ্যে জোটে না। আমি যা পারবো তা হলো এই গ্রামের গন্ধ মাখা উপজেলা জলঢাকাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে, যেখানে আমি প্রথম ছুটেছিলাম প্রজাপতির পিছে!
আমি যখন জলঢাকায় আসি, আমার বয়স কেবল চার। সেখানে আমাকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো, প্লে গ্রুপে। স্কুলের নামটা জাঁকালো। আলহাজ্ব মোবারক হোসেন অনির্বাণ বিদ্যাতীর্থ উচ্চ বিদ্যালয়। পড়ালেখায় কেমন ছিলাম? মনে পড়ে না। তবে ফার্স্ট সেকেন্ড নাকি হতাম! সেসব কথা থাক। শৈশবের সাথে এসব প্রাসঙ্গিক না। জলঢাকায় প্রথম যে দ্রষ্টব্য জিনিসটা চোখ কাড়বে সেটা হলো পাথরের ঢিবি। আমরা বলতাম পাথরের ‘স্ট্রাইক’। স্ট্রাইক নিশ্চয়ই যথাযথ ইংরেজি শব্দ নয় এক্ষেত্রে। নিশ্চয়ই বিবর্তিত হয়ে এসেছে মুখে মুখে। আসলে কী হবে? স্টেক? সম্ভবত। কিন্তু আমি সারাজীবন পাথরের স্ট্রাইক বলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করবো। আমরা থাকতাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনিতে। আমার বাবা ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। এই পাথরের টুকরোগুলো তাদের কাজে আসতো। ঠিক কী কাজে ব্যবহৃত হত তা এখনও ঠিকঠাক জানি না। তবে আমরা পাথরগুলি ব্যবহার করতাম অন্য কাজে। প্রথম কাজটা ছিলো সন্ধ্যে নেমে এলে পাথরের টুকরোগুলিকে ঘষে আগুন জ্বালানো। অনেকদিন পর, যখন ক্লাস ফোরে উঠি, তখন জানতে পারি যে আদিম মানুষেরা এভাবেই আগুন আবিষ্কার করেছিলো। পাথর দিয়ে দ্বিতীয় যে কাজটি করতাম সেটা বড় নিষ্ঠুর। আমাদের কলোনিতে নাম না জানা এক ধরণের সাদা ফুলের গাছ ছিলো। সেখানে প্রচুর মৌমাছি ঘুরে বেড়াতো। আমরা দুটি পাথর দিয়ে চেপে ফুলের মধু পান করা অবস্থায় মৌমাছিগুলোকে মেরে ফেলতাম। মৃত মৌমাছিদের শরীর থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বের হত। সেটা এখনও ভুলি নি। হত্যাকান্ড ঘটানোর পর আমরা ফুলের মধু চুষে খেতাম। খুব মিষ্টি। আরেকবার যদি কোনদিন জলঢাকায় যাওয়ার সুযোগ হয়, আবারও সেই ফুলের মধু খাবো, তবে মৌমাছি মারবো না আর কখনও, প্রমিজ!
জলঢাকার কলোনিতে ছিলো বিস্তীর্ণ মাঠ। একবার খুব বৃষ্টি বাদল হলো। সারা কলোনি পানিতে থৈ থৈ। মনে হচ্ছিলো আমরা একটা দ্বিপে আটকা পড়ে গেছি। শ্রাবণের সেই ঘনঘটা, সেই মন্দ্র জলছাপ এখনও কোন এক হাঁসফাঁস করা প্রবল দুপুরে বৃষ্টির প্রার্থনা জাগাতে রয়ে গেছে মনের গহীনে। মনে আছে, আমাকে কে যেন কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে দিয়েছিলো। আমি সেই ভেলা দিয়ে সারা পাড়া চষে বেড়ালাম। জীবনে ঐ একবারই ভেলায় চড়া।
বাসার চারপাশে ছিলো আম, পেয়ারা আর কাঁঠাল গাছ। ফল কিনে খাওয়া ব্যাপারটার সাথে তখনও পরিচিত হতে পারি নি। গাছ থেকে দেশী ফল পেড়ে খেতাম। মাঝে মধ্যে আব্বু রংপুর থেকে আপেল নিয়ে আসতেন। ভারী বড়লোকি ব্যাপার ছিলো সেটা। কিংবা রোযার মধ্যে খেজুড় নিয়ে আসাটাও কম বিশেষ ছিলো না। মনে পড়ে, কাঁঠাল গাছে উঠে ছোট ছোট কাঁচা কাঠাল চিবিয়ে খেতাম। কষটা কিন্তু মজার স্বাদ ছিলো তার। আমরা ওগুলিকে বলতাম মুচি। ঐ জিনিসটা আর কখনও খাওয়া হয় নি।
আমাদের বাসায় একবার একজন চিনা মহিলা এসেছিলেন। তিনিও একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আমরা তাকে খেতে দিয়েছিলাম লাউয়ের মোরব্বা। লাউটাও আমাদের গাছেরই ছিলো। তিনি খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিলেন। গর্বে আমাদের বুক ফুলে গিয়েছিলো!
আমার বাবা সেকশনাল ইঞ্জিনিয়ার হলেও থাকার বাসা খালি ছিলো না বলে আমাদের থাকতে হয়েছিলো পিয়ন কোয়ার্টারের এক বাসায়। সেখানে চাল থেকে ইট সুড়কি ভেঙে ভেঙে পড়াটা ছিলো খুব সাধারণ ব্যাপার। বাথরুমে কলের লাইন ছিলো, কিন্তু পানি ছিলো না। চাপকলই ছিলো ভরসা। তবে এতকিছুর মধ্যেও বাসার ভেতরে একটা উঠোন ছিলো। কাঁচা উঠোন। সেখানে আমরা নানারকম ফুলের গাছ লাগিয়ে লেগেছিলাম। এতসব ফুলের মধ্যে আমার কেন যেন সন্ধ্যামালতীর কথাটাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। সন্ধ্যামালতীকে আমি ভুলতে পারি না। এই ফুলটাকেও আর কোথাও দেখি নি পরে।
জলঢাকা থেকে যখন সৈয়দপুরে এলাম, সেখানে বাথরুমে বেসিন আছে, কল টানলে জল আসে, তা দেখে আমার ডাঁট খুব বেড়ে গেলো। এ যে ভীষণ বড়লোকি কারবার!
জলঢাকায় মাঝেমধ্যে খুব আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতো। একদিন দেখি রংপুর থেকে আমাদের বাসায় একটা ফুনাই ফ্রিজ উপস্থিত। ফুনাই কোম্পানি এখনও আছে কি না জানি না, তবে ফ্রিজটা ঠিকঠাক চলছে এখনও! জাদুর দেশের জিনিস না! আরেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি একটা চৌদ্দ ইঞ্চির রঙিন নিপ্পন টিভি এসে গেছে! টিভিতে কোন একটা নাটক হচ্ছিলো, সেখানে তরতাজা হলুদ কলা আর চিকন সাদা পাউরুটি খাচ্ছিলো পাত্র পাত্রীরা। যেসব দৃশ্য দেখে আমি জীবনে সবচেয়ে মোহিত হয়েছি, তার মধ্যে এটা অবশ্যই থাকবে!
জলঢাকা ছেড়ে এসেছি সেই ত্রিশ বছর আগে। এখন চারিদিকে কত বিস্ময় জাগানিয়া যন্ত্রপাতি, দালান, মার্কেট, মল...কিন্তু সেই চৌদ্দ ইঞ্চির নিপ্পন টিভির ভেতরের বিস্ময়বোধ হারিয়ে গেছে। আর কোনদিন ফিরে আসবে না।
(প্রথম প্রকাশ- অনলাইন ম্যাগাজিন বেয়ারিং )
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১১:৪৪