আজকে আমাকে একজন বললো তার না কি আমার, অর্থাৎ যারা শাহবাগ আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলো, তাদের ওপর খুব রাগ হচ্ছিলো গতকাল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেন তার এত রাগ। তিনি উত্তরে বললেন, আমরা ২০১৩ তে শাহবাগে গিয়ে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছি, কিন্তু এখন দ্রব্যমূল্য হুহু করে বাড়ছে এর প্রতিবাদে শাহবাগ অবরোধ করছি না কেন? সত্যি কথা বলতে কি, হুট করে আমার মুখে কোন জবাব আসে নি। আমি অতটা প্রত্যুৎপন্নমতি অথবা বাকপটু না। তাই লিখেই জবাবটা দেই।
প্রথমে আমার প্রশ্ন, আপনার কি আমার তথা শাহবাগীদের ওপর হঠাৎ করে রাগটা তৈরি হয়েছে, না কি অনেক আগে থেকে পুষে রেখেছেন? আপনি কি এতদিন আমাদের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন? দ্রব্যমূল্য বাড়ার প্রতিবাদে শাহবাগ অবরোধ না করায় অসন্তুষ্ট হয়েছেন? না কি আরো আগে থেকেই অসন্তুষ্ট? যদি আরো আগে থেকে হয়, সেটা কবে থেকে? শাহবাগের আন্দোলন শুরু করার সময় থেকে কি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন, না কি তখন থেকেও অসন্তুষ্ট? আর যদি তখন থেকেই অসন্তুষ্ট হন, তাহলে জানতে চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া কেন অপরাধ হবে? কেন এতে আপনার দিল নাখোশ হবে?
আমার আরো প্রশ্ন আছে। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছিলো। সেই আন্দোলনে রাজপথ উত্তাল ছিলো। প্রাণহানি হয়েছিলো। সেখানে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরাও ছিলো। ছিলো নাট্যাঙ্গন, সঙ্গীতাঙ্গন তথা শিল্প-সংস্কৃতির সাথে জড়িত অনেক মানুষজন। আপনি কি সেই সময়ে যারা আন্দোলন করেছিলো, তারা এখন আবার কেন মাঠে নামছে না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বা ক্ষুব্ধ?
কিংবা ধরেন ১৯৯৫ সালে সার, তেল, কীটনাশক ও কৃষিপণ্যের দাবিতে আন্দোলন করে প্রাণহানি হয়েছিলো যে কৃষকদের তাদের বংশধরদের ওপর কি রেগে আছেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিচ্ছে না বলে?
আবার ধরেন কিছুদিন আগে যে নটরডেম কলেজের ছাত্রের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে বিশাল আন্দোলন হলো, এখন সেই আন্দোলন তো শেষ। কিন্তু দুর্ঘটনা কি ঘটা বন্ধ হয়েছে? সড়কে মৃত্যুর মিছিল থেমেছে? সড়ক নিরাপত্তা আইন ঠিকভাবে পালন হচ্ছে? আপনি কি ওদের ওপরও রেগে আছেন প্রতিদিন এত এত দুর্ঘটনা হওয়া সত্তেও আন্দোলন করছে না বলে?
দিনাজপুরে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলো ৭ জন মানুষ। দিনাজপুরে কি ধর্ষণ থেমে গেছে? তারা আর আন্দোলন করে না কেন? রেগে আছেন তাদের ওপর?
আচ্ছা, ২০১০ এর আরব বসন্ত নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার উচ্ছ্বাস আছে? যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিলো তিউনিসিয়া থেকে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়ায়। ২০১০ এর পরে যে তারা আর কোন বসন্ত উপহার দিলো না এতে আপনার রাগ হয় না? এমন তো না যে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
এরকম চাইলে অনেক অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ আমি করি নাই। তার মানে এই না এটা নিয়ে আমার অসন্তোষ নাই। প্রতিটা ইস্যু ধরে কথা বলাটা ক্লান্তিকর লাগে। তারপরেও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ করতেই পারেন। কিন্তু আমার শাহবাগ সতীর্থ অনেকেই প্রতিবাদ করেছে, করবে। তাদের তো আর রাজভান্ডার নেই যে তুলে তুলে খাবে! সবাইকে পেটে চালাতে কষ্ট করতে হয়। কিন্তু আরেকটা শাহবাগের দাবীতে ঘ্যানঘ্যান করাটা বড্ড শিশুতোষ আবদার।
ফরাসী বিপ্লবের আগে জনগণকে স্ফুলিঙ্গে পরিণত করেছিলো রাণী মেরি এ্যান্টিনিটের বক্রোক্তি, "ওরা রুটি পায় না তো কেক খেলেই পারে"। শাহবাগের ক্ষেত্রে এই নিয়ামক ছিলো কসাই কাদেরের হাসিমুখের ভি চিহ্ন। তারা কেউ জেনেশুনে নিজের কবর ডেকে আনে নি।
সময় এবং পরিস্থিতি কীভাবে মানুষকে তাঁতিয়ে তোলে তা বলা যায় না। একটা মানবস্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে প্রয়োজন হয় বিশেষ সময়ের, বিশেষ মানুষের। সেই সময়টা বলে কয়ে কেউ তৈরি করতে পারে না। সেটা কীভাবে কীভাবে যেন হয়ে যায়। একটা ১৯৯০ বা ২০১৩ বলে কয়ে তৈরি করা যায় না। ১৯৭১ এর কথা বাদই দিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। একেকটা আন্দোলনের একেকরকম বৈশিষ্ট্য। কোনটাকেই ডুপ্লিকেট করা যায় না। আরেকটা ১৯৯০ যেমন আসবে না, আরেকটা শাহবাগও আসবে না। তবে মানবস্ফুলিঙ্গ আবার তৈরি হবে,সময়ের প্রয়োজনে। সাধারণ জনগণ থেকে প্রতাপশালী শাসক, কেউ তার হদীশ জানে না।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২২ রাত ১১:০৬