আমার স্ত্রী, দুঃখিত প্রাক্তন স্ত্রী, বিনীতা তার নাম। নামের মতোই চমৎকার একটা মানুষ ছিলো সে। সুন্দরী কিন্তু বিনয়ী, মিষ্টভাষী, মিশুক। কে তাকে পছন্দ না করে পারে! তাকে আমি ডিভোর্স দিয়েছি কদিন আগে। ডিভোর্স দেয়ার কারণ, দ্বিচারীতা। সে আমার সাথে চিট করেছিলো। চিট করার পরেও অনেকদিন আমার সাথে হাসিমুখে সংসার করে গেছে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে। সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে যখন সে আমাকে হাসিমুখে চা দিতো, তাকে মনে হতো একটা সূর্যমুখী ফুল। রোদ, আলো আর রং এসে তাকে সাজিয়ে দিতো সুন্দর করে। বেঁচে থাকাকে সুন্দর মনে হতো।
ভালোই হয়েছে হয়তো একদিক দিয়ে তার অবিশ্বস্ততার খবর দীর্ঘদিন না জেনে। মাঝখানের সময়টা ভালো কেটেছে। জীবনকে পরিপূর্ণ আর আশীর্বাদপুষ্ট মনে হয়েছে। কজন মানুষ এই অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে পারে? সবাই তো ব্যস্ত থাকে আকাঙ্খা আর আক্ষেপের অসম সমীকরণ মেলাতে। বিনীতা আমাকে দিয়েছিলো মাংসল, পরিপুষ্ট জীবনের স্বাদ।
অজ্ঞানতার চেয়ে সুন্দর আর কী আছে! কে বলেছে সত্যই সুন্দর? সত্য সবসময় সুন্দর না। সত্যকে জানতে না চাওয়ার নির্বিকারত্বে যদি কাটিয়ে দিতে পারতাম আস্ত একটা জীবন! আর এভাবেই যদি একদিন সম্পূর্ণতার অনুভূতি নিয়ে মরে যেতাম, সেটা কি ভালো হতো? হতো না। বিনীতা অপরাধ করেছে, এটা একদিন জানাটাই উচিত হতো হতো। সে যে অপাপবিদ্ধ ফুলকুমারী না, এই তথ্যটা যে আমি জেনে গেছি এবং এটা যে তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে এই বিচারকার্যটা হয়ে যাওয়া দরকার ছিলো। যদিও বিনীতার মতো আমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছি। তবুও, যা হয়েছে,ভালোই হয়েছে।
জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করে না অতটা, আগের মতো। তাই সে যার সাথে শুয়েছিলো তাকে গিয়ে খুন করে আসার ইচ্ছে আমার হয় না। কেন যাবো অতটা পথ! তবে সে যদি আমার সামনে এসে পড়ে, তবে কী হবে জানি না। হত্যাপ্রচেষ্টা? হতেই পারে। তা নাহলেও একটা বা দুটো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি করার জন্যে আন্তরিক অভিপ্রায় তো অবশ্যই থাকবে। ক্ষোভ, ঘৃণা,জিগীষা কখনও মরে না। আমি ধারণা করেছিলাম এতদিনে আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছে ঋষিসুলভ প্রশান্তি। আসলে তা নয়। বাকি জীবন বিনীতাকেও জ্বলতে হবে,আমিও জ্বলবো। এটাই সুন্দরতম সমাধান।
বিনীতা এমন না করলে কী হতো? একটা সার্থক জীবন কাটিয়ে আমরা সন্তুষ্টির সাথে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে পারতাম এখন। আমার বয়স তিরানব্বই, বিনীতার একানব্বই। আর দুই-চার বা পাঁচ বছর হয়তো বাকি আছে আমাদের জীবনে। কিংবা কে জানে মরে যেতে পারই আজ রাতে ঘুমের ভেতরেও! যে ক্ষয় শুরু হয়েছে তা অপ্রত্যাগামী। একটু হাঁটলেই হাঁফ ধরে যাওয়া অথবা কোনোকিছু মনে রাখতে না পারা, সকালবেলা জেগে ওঠা দেহের ভিন্ন ভিন্ন অংশে অস্বস্তি নিয়ে, এইসবের কোনো সমাধান নেই। একটা সময় শরীরের ক্ষত বা ব্যথা উপশম হয়ে আবার নতুন করে পুনর্নির্মিত হতো কোষ। এখন আর এসব হয় না। একটা একটা করে দেহের বিভিন্ন অংশ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা সুন্দর কিছু না। কারো সাধ্য নেই এই সময়ে সহায় হবার। না ঈশ্বরের না ঔষধের না অনুজ বংশধরদের। শুধুমাত্র একজন ছিলো আমার জন্যে। তার নাম বিনীতা। আমার প্রাক্তন স্ত্রী।
আনন্দের অনুভূতি তৈরি করতে না পারলে মানুষ বাঁচার মানে খুঁজে পায় না। বিনীতার সাথে সকালে বসে কেতলি থেকে চা ঢালতে ঢালতে আমার শরীরে ডোপামিন তৈরি হতো। বাগানে হাঁটতে গিয়ে কখনও তার চুলে গুঁজে দিতাম ফুল, কখনও দোকান থেকে নিয়ে আসতাম চকলেট। অর্থাৎ,বেঁচে থাকা কখনই অর্থহীন ছিলো না। কিন্তু একদিন… যখন তার প্রতিবেশী বান্ধবীর সাথে কথা বলার সূত্রে বৃদ্ধ বয়সের অসংলগ্নতায় সে বলে ফেলে তার গোপণে জমা রাখা স্মৃতি আমার সামনেই, তখন বুঝতে পারি দুজনের একসাথে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করার শান্ত, সমাহিত দিনগুলি শেষ হতে চলেছে।
বিনীতাকে আমি ডিভোর্স দিলাম, কারণ তাকে আমি ভালোবেসেছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:১০