লেখক পরিচিতিঃ
বাট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল, সংক্ষেপে বাট্রান্ড রাসেল। জন্ম ১৮ মে ১৮৭২ সাল। রাসেলের জীবন যেমন দীর্ঘ তেমনি বিচিত্র। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইংরেজ দার্শনিক এবং যুদ্ধবিরোধী শান্তি-আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। এছাড়াও তিনি বিজ্ঞান, শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব আরো অসংখ্য বিষয়ে ছিলেন মনন স্পর্শ। রাসেলের চরিত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই ছিলো যে, জীবনের কোনো নীতিকে বিনা প্রশ্নে স্বীকার করেন নি এবং কোনো নীতিতে অবিচলও থাকেন নি। যুক্তিবাদী রাসেলের মতে, দর্শনের মর্ম বস্তু হলো যৌক্তিক বিশ্লেষণ।
প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধের সময় যুদ্ধ-বিরোধিতার দায়ে ছ’মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয় রাসেলকে। এই ছ মাসের মধ্যেই লিখে ফেলেন ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথম্যাটিক্যাল ফিলজফি। তার আগে প্রকাশিত হয়েছিলো প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমিটিকা।১৯৫০ সালে নোবেল পুরস্কার পান রাসেল।১৯৫৪ সাল থেকেই পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলনে অক্লান্ত যোদ্ধার ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬১ সালে তাকে আবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন রাসেল। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামের যুদ্ধ অপরাধের জন্য সংগঠিত করেন আন্তর্জাতিক বিচার সভা। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে আটানব্বই বছর বয়সে মারা যান বাট্রান্ড রাসে।
সূচনাঃ
পৃথিবীতে টিকে থাকার সংগ্রামে প্রথম দিকে মানুষ মোটেই খুব সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলোনা। সে ছিলো এক বিরল প্রজাতি। সেই সূচনালগ্নে তার একমাত্র সম্বল ছিলো একটাই জিনিস-মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কই ধীরে ধীরে উন্নত হয়ে বিনির্মাণ করেছে তাকে। সে পরিণত হয়েছে সারা দুনিয়ার অধীশ্বরে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছিল সে- আজকের দিনে পারমানবিক শক্তির মতো একই ধরনের বিপদের উৎস ছিলো এই আগুন, যদিও তা অনেক মাত্রায় কম। আগুনের ব্যবহার তার খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতিকে উন্নত করলো, বন্য প্রাণীর আকস্মিক আক্রমণ থেকে তাকে নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তা দিতে পারলো। তারপর তার উদ্ভাবন শক্তি জন্ম দিল বর্শা আর তীর-ধনুকের। বন্য প্রাণীকে পোষ মানালো সে, তারপর ইতিহাসের ঊষালগ্নে আবিষ্কার করলো কৃষির পদ্ধতি। কিন্তু এই সব কিছুকে ছাপিয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তির স্থানটি দখল করে নিয়েছে আর একটি জিনিস- ভাষা। ভাষার মাধ্যমে এক প্রজন্ম তার অভিজ্ঞতাকে অন্য প্রজন্মকে জানিয়ে যেতে পারতো। পরবর্তীতে জ্ঞানের স্থায়ী ভাণ্ডার হিসেবে শুরু হয় লিখিত ভাষার প্রচলন। এর ফলে মানব প্রগতির ধারা অব্যাহত থাকে। ধূসর অতীতের সেই সুদীর্ঘ পর্যায়ে ধীরেধীরে সে উঠে এসেছে প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে,নিজের ভেতরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সহজাত প্রবৃত্তি আর অভ্যাস নিয়ে। টিকে থাকার জন্য তার দরকার ছিলো প্রচণ্ড কঠোরতা, তীব্র জেদ, এবং নিয়ত সতর্কতা। এসব কিছুই যা সে পরিচালিত করতো বাঘ-সিংহের বিরুদ্ধে এবার সে পরিচালিত করতে শুরু করলো অন্য মানুষদের বিরুদ্ধে। আমাদের আজকের জগত মূলত বিগত ৬ বছরের সংগঠিত যুদ্ধবিগ্রহের ফল। এবং পৃথিবীর সর্বত্র জাতীয় গৌরব ও হিংস্রতার প্রদর্শনী বেড়েই চলছে। ব্রিটেনে সবচাইতে চমৎকার স্মৃতিস্তম্ভ নেলসন আর ওয়েলিংটনের। যাদের শ্রদ্ধা করা হয় বিদেশীদের হত্যা করার ব্যাপারে তাদের অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য। অথচ বাইরের লোকেরা ব্রিটেন বলতে শেক্সপিয়ার, নিউটন এবং ডারউইনের নামই উল্লেখ করে থাকে। এখান থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, পরস্পর-বৈরী জাতিতে মানব জাতির বিভাজন জাতিগত মূল্যবিচারের ওপর রীতিমত কুপ্রভাব বিস্তার করেছে। কে শ্রদ্ধার যোগ্য এবং কে নয় তার এক বিকৃত মাপকাঠি তৈরি হয়েছে। নরহত্যার জন্য মানবজাতি কখনো সম্মান দাবি করতে পারেনা।
"I am become Death, the destroyer of worlds"
পারমানবিক বোমার আবিষ্কারক বলা হয় ওপেন হেইমারকে। উপরের উক্তিটি তার। সম্ভবত পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের কিছু পরেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবীকে অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই থেকে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল বিবেচনা করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ হিসাবে দেখানো হয় জার্মানদের উগ্র জাতীয়তাবাদ নীতিকে। এই যুদ্ধে মিত্রশক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয় ব্রিটেন, ফ্রান্স, সার্বিয়া, বেলজিয়াম এবং রাশিয়াকে। এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতেই গঠন করা হয়ে “ লীগ অব নেশনস”। পরাজিত জার্মান বাহিনীকে শাস্তি প্রদান ও ক্ষতিপূরণের জন্য করা হয় “ভার্সাই চুক্তি”
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর এডলফ হিটলারে কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয়। এবারের যুদ্ধের প্রধান কারণ হিসাবে দেখানো হয় জার্মানির নাৎসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবকে। জার্মানদের সাথে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো ইতালি এবং জাপান। মিত্রশক্তি হিসাবে ছিলো ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান মার্কিন নৌ-ঘাটি আক্রমণ করে। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হেনরি ট্রুম্যান।
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর এডলফ হিটলারে কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয়। এবারের যুদ্ধের প্রধান কারণ হিসাবে দেখানো হয় জার্মানির নাৎসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবকে। জার্মানদের সাথে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো ইতালি এবং জাপান। মিত্রশক্তি হিসাবে ছিলো ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান মার্কিন নৌ-ঘাটি আক্রমণ করে। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হেনরি ট্রুম্যান।
অনুমান করা হয় যে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের এই বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক মূহুর্তেই মারা যান। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন। জাপানের আসাহি শিমবুন-এর করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।
জাপানের আত্মসমর্পণের পেছনে এই বোমাবর্ষণের ভূমিকা এবং এর প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে অধিকাংশের ধারণা এই বোমাবর্ষণের ফলে যুদ্ধ অনেক মাস আগেই সমাপ্ত হয়, যার ফলে পূর্ব-পরিকল্পিত জাপান আক্রমণ (invasion) সংঘটিত হলে উভয় পক্ষের যে বিপুল প্রাণহানি হত, তা আর বাস্তবে ঘটেনি। অন্যদিকে জাপানের সাধারণ জনগণ মনে করে এই বোমাবর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল, কেননা জাপানের বেসামরিক নেতৃত্ব যুদ্ধ থামানোর জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল।
এই যুদ্ধের পরপরই সমগ্র ইউরোপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়; এক অংশ হয় পশ্চিম ইউরোপ আর অন্য অংশে অন্তর্ভুক্ত হয় সোভিয়েত রাশিয়া। পরবর্তীতে এই রাশিয়ান ইউনিয়নই ভেঙে অনেকগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত হয় ন্যাটো আর সমগ্র ইউরোপের দেশসমূহের সীমান্তরেখা নির্ধারিত হতে শুরু করে। ওয়ারস প্যাক্টের মাঝে অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ নিয়ে দানা বেঁধে উঠে স্নায়ুযুদ্ধ। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বমঞ্চে অভিনব এক নাটকের অবতারণা করে।
এরপর সত্যিই যদি অদূর ভবিষ্যতে পারমানবিক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সম্ভবত আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা কল্পনা করছি যা সংগঠিত হলে ধারণা করা যায় মানুষের সভ্যতা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচাইতে বেশি।
১৯৫৮ সালের পেন্টাগনের একটা রিপোর্টের সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র-সচিব বলেছিলেন ন্যাটো এবং ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যদি যুদ্ধ বাধে আর সেই যুদ্ধে যদি পারমানবিক অস্ত্র ব্যাবহত হয়, তাহলে ১৬০ মিলিয়ন আমেরিকান, ২০০ মিলিয়ন রাশিয়ান এবং পশ্চিম ইউরোপ ও ব্রিটেনের প্রতিটি মানুষ মারা যাবে।
দ্যা হিউম্যানিস্ট পত্রিকার মার্চ-এপ্রিল ১৯৬১ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিনাস পাউলিং বলেছেন, ‘ ছয় মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর অস্ত্র নির্মাণ খাতে যা ব্যয় তার কুড়ি ভাগের এক ভাগ খরচ করলে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কোবাল্ট বোমা বানিয়ে ফেলা যাবে।
১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পারমানবিক অস্ত্রের যত পরীক্ষা তা ক্যানসারে মৃত্যু ও বিকৃতাঙ্গ শিশুদের জন্মের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৫৪ সালে, যে বছর যুক্তরাষ্ট্র হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা করা হয়, যত শিশু জন্মেছে তাদের মধ্যে ১৮০০ জন উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আমেরিকার প্রাণিবিদ কুর্ট স্টার্ন বলেন, “ হাইড্রোজেন বোমার বিগত পরীক্ষাগুলির ফলে এই মূহুর্তে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর দেহেই কিছু তেজস্ক্রিয় উপাদান আছে-হাড়ে আর দাঁতে উষ্ণ স্ট্রনটিয়াম, থাইরয়েড গ্রন্থিতে উষ্ণ আয়োডিন।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা যেভাবে নৈতিক বোধকে বিকৃত করে দিচ্ছে, তা এক অস্বাভাবিক ও হতাশাজনক ঘটনা। আমি যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে একজনের শরীরে ক্যানসার সৃষ্টি করি, তাহলে আমাকে ন্যায়নীতি হীন দানব বলা হবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে কয়েক হাজার মানুষের শরীরে ক্যানসার সৃষ্টি করলে আমাকে বলা হবে মহান দেশপ্রেমিক। স্টালিন কিংবা হিটলারের চাইতেও জনপ্রিয় কোনো ব্যক্তিত্ব।
সে যুদ্ধের শেষে হয়তো ভাগ্যক্রমে অল্প কিছু মানুষ টিকে থাকবে কিন্তু এটা নিশ্চিত তাদের হাতে সভ্যতার কোনো উপকরণ থাকবেনা। বেচে থাকলে তাকে হয়তো আমাদের বিগত এক লক্ষ বছরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই করতে হবে। তারপর এক সময় আমাদের বর্তমান প্রজ্ঞার স্থানে পৌঁছে আমাদের মতই আবার কোনো মূর্খতার শিকার হয়ে নিজেদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করে তুলবে। মানুষের বোকামির এমন পুনরাবৃত্তি আদৌ স্বস্তি দায়ক নয়।
পারমানবিক যুদ্ধের সময় মানুষের প্রাণ বাঁচানো যাবে কিভাবে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। হের্মান কাহন তার সুবৃহৎ গ্রন্থ অন থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ার এ বলেছেন, মাটির নিচে বিশাল আশ্রয় বানানো গেলে বহু মানুষকেই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যাবে যা বাস্তবতার আলোয় যাচাই করা সম্ভব নয়। সব থেকে যুক্তিসম্মত কথাটি বলেছেন জন এমন ফাউলার তার ফল-আউট গ্রন্থে “ উপযুক্ত দক্ষতা ও সংগতিপূর্ণ কোনো পরিবার যদি সম্পূর্ণ ধ্বংসের বৃত্তের বাইরে থাকে তবে তারা হয়তো দুঃসপ্নময় প্রথম কয়েকটা সপ্তাহ বেচে থাকতে পারবে। বাড়ির ভিতর দেয়ালে গর্ত করে অথবা কোন চটজলদি বানানো কোনো আশ্রয়ে গাদাগাদি করে ঢুকে পড়ে প্রাণ বাঁচানো যেতে পারে, তবে বাড়ির বাইরেটা সুনিশ্চিত চুল্লিতে পরিণত হবে। সমস্ত খাদ্য আর জল বিষাক্ত হয়ে যাবে, পরিবহন-ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকবে না, হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং ধরে নেওয়া যায় যে জীবিত দের অনেকেই বিকৃতমস্তিষ্কের এবং ধ্বংসোন্মাদ হয়ে উঠবে।
বর্তমান দুনিয়া
সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রথমবারের মতো পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম অগ্নি-৫ এর সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। ৫০০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রটি। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি চীন এবং পাকিস্তানের ভেতরে আঘাত হানতে সক্ষম। এর মাধ্যমে ভারত চীনের যে কোন স্থানে পরমাণু হামলা চালানোর ক্ষমতা অর্জন করলো। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের কাছেই কেবল এতো দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক দূর-নিক্ষেপণ ও অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি হচ্ছে মিসাইল। পারমানবিক প্রযুক্তি বহন করে এ মিসাইলের মাধ্যমে নিমিষেই গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হাজার হাজার বছরের সাধনায় গড়ে তোলা মানব সভ্যতাকে। তাই বর্তমান বিশ্বে পরাশক্তির মেরুদণ্ড হচ্ছে এ মিসাইল। রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম আলোচিত মার্কিন প্যাট্রিয়ট মিসাইল । সম্প্রতি ইরানও মার্কিন প্যাট্রিয়ট মিসাইলের অনুরূপ একটি মিসাইল তৈরি করেছে যেটি রাডার ফাঁকি দিয়ে দুরের লক্ষ বস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম । এটির নাম নাসর ।
উত্তর কোরিয়ার তৃতীয় দফা পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালনায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৭ মার্চ দেশটির ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার অভিযোগ, তাদের ওপর হামলা করাই দক্ষিণ কোরিয়ার মার্কিন সামরিক কার্যক্রমের লক্ষ্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি উত্তর কোরিয়ার ওপর নতুন অবরোধ আরোপের জন্য জাতিসংঘকে প্ররোচিত করে, তাহলে পিয়ংইয়ং আরো পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে। উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মদদ-পুষ্ট যে কোন আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে আগাম পরমাণু অস্ত্রের হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। দেশটির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কয়েক ঘণ্টা আগে ৭ মার্চ হুমকি দিল পিয়ংইয়ং। উত্তর কোরিয়া এর আগেও দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন সৈন্যদের ওপর হামলা চালানোর হুমকি দিলেও দেশটি এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঘাত হানার সরাসরি হুমকি দিল। পিয়ংইয়ংয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়া দুই দেশের মধ্যে বিশাল সামরিক মহড়া বাতিল করেনি।
ভবিষ্যতে টিকে থাকার দীর্ঘমেয়াদী শর্ত
প্রথমত, যুদ্ধের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে হবে আমাদের। বর্তমানে স্নায়ুযুদ্ধে প্রবৃত্ত দেশগুলো গণহত্যার প্রস্তুতির জন্য ত্রিশ হাজার মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে অর্থাৎ প্রতি মিনিটে পাঁচশ পঁচাত্তর পাউন্ড। যেখানে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ অপুষ্টির স্বীকার। ধনী দেশ গুলো চায় গরীব দেশগুলো কোনোভাবে বেচে থেকে তাদের আরো সমৃদ্ধ করে তুলুক। স্নায়ুযুদ্ধে তাদের সমর্থন চাওয়াই জেনো মুখ্য উদ্দেশ্য। অথচ উন্নত রাষ্ট্র গুলো তাদের সম্পদের বিনিময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দরিদ্র দেশগুলোর সম্মতি পাওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে।
নিরস্ত্রীকরণের পরেও পৃথিবীতে যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর তার প্রতিরোধ নিরূপণে গড়ে তুলতে হবে বিশ্বসরকার। এই বিশ্বসরকারের সঠিক ভাবে প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে আমাদের বর্তমান এই বিজ্ঞান নির্ভর মানব সভ্যতাকে টিকে থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
এই গঠিত বিশ্বসরকারকে তার নিজ দায়িত্ব পালন করতে হলে কয়েকটি অর্থনৈতিক শর্ত অবশ্যই পালন করতে হবে। এদের মধ্যে, অনুন্নত দেশগুলোকে এই মুহূর্তে পশ্চিমা দুনিয়ার সমৃদ্ধশালী দেশগুলোর সমকক্ষ করে গড়ে তোলা। অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা না হলে হিংসাত্মক মনোভাব থাকবেই। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত তেল ও ইউরেনিয়ামে খনি শিল্প খাতে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিগত এমনকি রাষ্ট্রর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিশ্বসরকারকে প্রয়োজন অনুসারে বিলি-বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
যেহেতু বিশ্বশান্তি সুনিশ্চিত না করেও একধরনের বিশ্বসরকার গড়ে উঠার সম্ভাবনা থেকে যায় তাই এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্বসরকারের গড়ে তোলা সৈন্যবাহিনীকে হতে হবে নিরপেক্ষ ও এর প্রতি আনুগত্য শীল। এই সামরিক বাহিনীকে হতে হবে অপ্রতিরোধ্য। এই প্রেক্ষিতে, প্রতিটি দেশকে তাদের জাতীয় সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা কমাতে বলা হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নিরস্ত্রীকরণ সফল হলে বিশ্বসরকারের নিজেরো অবশ্য সৈন্যবাহিনীর উপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে।
বিশ্ব-বিধান মণ্ডলের হাতে কি কি ক্ষমতা থাকবে? প্রথমত এর সাক্ষর ছাড়া কোনো চুক্তিই বৈধতা পাবেনা। নতুন পরিস্থিতিতে পুরাতন কিছুর সংশোধন আবশ্যক হয়ে উঠলে তা করার অধিকারো থাকবে তার। একটি কার্য-নির্বাহী পরিষদ থাকবে যারা নিজেরাও বিশ্ব-সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। এদের মূল কাজ হবে বিশ্বের সর্বত্র বিশ্ব-সংবিধানের কোনো আইন লঙ্ঘন হলে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা।
ভবিষ্যৎ সেই সুস্থির পৃথিবীতে বহুক্ষেত্রেই আজকের চাইতে বেশি স্বাধীনতা থাকবে। যুদ্ধ সৃষ্টি করতে পারে এমন কিছুর প্রতি বিধি-নিষেধ আরোপ করা ছাড়া। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং অবাধ ভ্রমণের স্বাধীনতা পূর্ণ মাত্রাতে বজায় থাকবে। তরুণদের আর শেখানো হবেনা কিভাবে নিজের দেশের গুণাবলীর উপর অতিরিক্ত জোড় দিতে হয়। ইতিহাসের শিক্ষাকে তুলে ধরতে হবে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনার চাইতে বরং সাফল্যগুলির উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে উগ্র স্বাদেশিকতা প্রচার কারার বন্ধ করা হবে এটি ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বজায় থাকবে। শিক্ষার মূল আরেকটি উদ্দেশ্য হবে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা হ্রাস করে বরং সহযোগিতা মূলক কর্মোদ্দীপক জাগ্রত করা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৭