কিছুক্ষণ আগে ফোনটা এসেছিল.রাকিবের ফোন। ফোন শুনে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে।ওর কথাগুলো কানে লেগে আছে আমার,"বাবা মার ডিভোর্সটা বোধহয় হয়েই গেল। আমাকে
বাসা থেকে বের করে দেবে ওরা। আমার টাকার দরকার।আমায় একটু সাহায্য কর প্লিজ।"
"আমায় একটু সাহায্য কর প্লিজ" চমকে উঠলাম আমি। আমি কি করে সাহায্য করব?আমি নিজে খাই বাপের হোটেলে। মাসখানেক হল এক বন্ধুর সাথে মিলে ইংরেজি পড়ানোর স্কুল দিয়েছি। বন্ধু বিদেশে থাকে। ওখানকার চলার খরচ মেটাতে কিছু টাকা প্রয়োজন হয়। আর আমাদের ও হাত খরচ বলে একটা ব্যাপার আছে। আমি কোনদিনই খুব একটা পড়ুয়া ছিলাম না। পড়ানোর ব্যাপারটা বন্ধুই সামলায়। আমার কাজ স্টুডেন্ট ধরে আনা,তাদের স্কাইপের ব্যবস্থা করা,অফিস সামলানো। প্রথম মাসে কিছু ভুল করে ফেলেছি আমি। অনেকগুলো টাকা হাতে চলে আসায় একটু খাপছাড়া হয়ে পড়েছিলাম। ফলাফল এক মাসের মধ্যে আমাদের স্কুলের সব টাকা শেষ!অবশ্য আরও কিছু কারণ ছিল। বন্ধু রেগে গিয়ে বলেছিল এই মাসে টাকা ঠিকমতো না উঠলে স্কুলই বন্ধু করে দেবে। স্কুল বন্ধ করলে আদতে আমাদের লাভ নেই কোন। বরং প্রতিমাসে বাড়িভাড়া আর অন্যান্য খরচাপাতি বাবদ যে দশ হাজার টাকা লাভের খাতায় থাকত,তাও গেল। আমি কি করে সাহায্য করব রাকিবকে!আবার বেজে উঠল ফোনটা। একটু ভয়ে ভয়ে ধরলাম।না এবার রাকিব নয়,অনিক অর্থাৎ আমার আমেরিকান বন্ধু।
-কিরে স্কুলের কি খবর?
-এইতো চলছে ভালই। বেশকিছু নতুন স্টুডেন্ট পাব মনে হচ্ছে.
-ইনকামটা এবার লাখের ঘরে না উঠে যায় না কি বলিস?
-হ্যাঁ…আচ্ছা শোন।একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই তোর সাথে।
-আমার একটু বাইরে যেতে হবে রে। ডেট আছে ওর সাথে। বুঝিস তো দেরি হলে আবার …
এইটুকু বলেই অপরপ্রান্ত থেকে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ শুনতে পেলাম। আমেরিকা চলে যাবার পর অনিক কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। ওর ফ্লাইট ছিল অগাস্টের এক তারিখ। আগের রাতে পর্যন্ত আমরা সবাই ওর সাথেই ছিলাম।আমি,রাকিব,ক্লাবের বড় ভাইয়েরা। ব্যাগ গোছাবার সময় খেয়াল হল ব্রাশ কেনা হয়নি। আমার কি যেন মনে হল। দৌড়ে গিয়ে মোড়ের দোকান থেকে দেড়শ টাকা দিয়ে টুথব্রাশ কিনে আনলাম।এক বড় ভাই বলে উঠল "অনিকের জন্য দেড়শ টাকা দিয়ে ব্রাশ কিনসিস!এর চেয়ে তুই পানিতে ফালায় দিতি টাকাটা!" আমি বোকা বোকা মুখ করে উত্তর দিয়েছিলাম,"থাক না ভাই। কিনলাম নাহয়"
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাইরে বের হলাম। বাসার মোড়ে এলাকার দুই ভাইয়ের সাথে দেখা। কিছু টাকা ধার নিয়েছিলাম মাসখানেক আগে। অল্প কিছু না,বেশ কিছু। এতই বেশি যে গত মাসের স্কুলের প্রফিটের পুরো টাকাটাই ঢেলে ফেলেছিলাম সেখানে। এছাড়া উপায় ও বা কি ছিল?মাথার ওপর একগাদা হুমকি নিয়ে বেচে থাকা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল। অনিক খুব ক্ষেপে গিয়েছিল। ওর রাতজেগে স্কাইপে পড়ানোর টাকাগুলো এভাবে হাওয়া হয়ে যাওয়ায়। এদিকে সেদিক বেশ কিছু বাজে খরচ দেখিয়ে বুঝিয়েছিলাম ওকে। বাড়িভাড়া তিনমাস এডভান্স দিতে হবে কিংবা স্কুলের জন্য ভাল ল্যাপটপ.এই মাস থেকে আর কিছু এদিক সেদিক করা যাবেনা। আমারই বা কি প্রয়োজন?একটুখানি এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে ভাইয়েরা ডাকলেন."এ্যাই শুনে যা এদিকে। পার্টি দিচ্ছিস কবে?"
-কিসের পার্টি?
-খবর কি আর আমরা রাখি না?এক মাসের মধ্যে অতগুলা টাকা শোধ দিলি। পার্টি দিবি না?
-দিব ভাই দিব।
পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসি। এ ধান্দায় আমি আর নেই।একবারে শিক্ষা হয়েছে আমার।
বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি রাকিব বসে আছে ড্রয়িংরুমে। বিধ্বস্ত এলোমেলো চেহারা। দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র গাজায় টান দিয়ে এলো। সিগারেট আর নেশাই নষ্ট করল ওকে।তবু বন্ধু বলে ছাড়তে পারিনি এতদিনেও।
-রাকিব কি খবর তোর?
-বাবা বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। পকেটে পয়সা নাই। আমার খবর জানতে চাস তুই?
হাউমাউ করে কেদে উঠল ছেলেটা।
-রাকিব রাকিব শান্ত হ। আমি দেখছি কি করা যায়।
অনেক রাত এখন। রাকিব আমার বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। কি করব আমি?অনিককে জানানো যায়। ফোনের ডায়াল ঘোরাই আমি। ও পাশ থেকে কোন শব্দ নেই। ফেসবুকে মেসেজ দেব?ছোট করে লিখলাম,"আমায় কিছু টাকা ধার দিতে পারবি অনিক?"
কিছুক্ষণ পর উত্তর এল,"হাই আমি নিশা। অনিকের প্রেমিকা।চোর কোথাকার। আমাদের স্কুলের পুরো টাকাটা মেরে দেয়ার পর এখন আবার …পুরুষ মানুষ হয়ে থাকলে অনিকের এক লাখ আটাত্তর হাজার টাকা সাত দিনের মধ্যে ফেরত দাও"
মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার। অনিকের প্রেমিকা ভাবে আমি চোর?অনিক ও কি তাই ভাবে?ঘুমন্ত রাকিবের দিকে তাকাই আমি।ছেলেটা জীবনে প্রথমবার সাহায্য চেয়েছে।
রাত বাড়ছে।না,সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি। পুরুষ মানুষের মত কাজই করব আমি। রাকিবকে সাহায্য করব।আরও এক মাসের স্কুলের টাকা রাকিবের হাতে তুলে দেব আমি।আরও একমাস অনিকের সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করব আমি।টাকাটা আমাদের দরকার।হাতে আবার ফোনটা তুলে নেই,"হ্যালো অনিক দোস্ত। কাল সকালের ক্লাসের টাইমটা ঠিক আছে তো? …"
এই বোধহয় অন্ধকারের যাত্রা শুরু হল আমার।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৪৪