ক্লাসের মাঝে ফোন বেজে উঠাটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। এরজন্য অনেক বন্ধুকেই মাঝে মাঝে কথা শুনিয়ে দেই। ভাল ছাত্র বলে এরকম তাই না, ক্লাসে মোবাইল নিয়ে আসাই ঠিক না, আর আনলেও বাবা সাইলেন্ট করে রাখলেই তো হয়। সবসময় সবাইকে বলে আসা এই আমিই আজ কিনা স্যারের হাতে বকা খেলাম ক্লাসে ফোন বেজে উঠার অপরাধে! একবার না দুইবার না গুনে গুনে সাতবার কল করেছিল, তাও অপরিচিত নম্বর থেকে!
বাসায় এসে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখেই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অপরিচিত সেই নম্বরে ফোন দিলাম। আচ্ছা করে ঝাড়তে হবে লোকটাকে।
ফোন বেজেই চলেছে কিন্তু ফোন ধরছে না। রাগ চেপে গেল। এখন বাছাধন ধমক খাওয়ার ভয়ে ফোন রিসিভ করছ না? ওমা একবার দেখি কেটেও দিল। জিদ চেপে গেল, আরও চার পাঁচবার ফোন দিয়েও না পেয়ে থামতে হল। এখন একটু ভাল লাগছে, লোকটাকে একটু ভয় দেখানো গেল।
তুই এখনও স্কুলের শার্টটাও খুলিস নাই? চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি বড় আপু। উফ পেইনটা হাজির হইছে। কি হয় কে জানে।
-তোকে কতবার করে বলছি না স্কুল থেকেই এসে আগে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে, কি বলি নাই?
গলার স্বর সপ্তম আকাশে উঠে গেছে।
-হুম, বলছ তো।
-এইভাবে বিড়ালের মত মিনমিনিয়ে কি বলছিস। কথা কানে যায় না? তাড়াতাড়ি উঠ।
গলাটা কেঁশে ঝেড়ে নিয়ে বলার আগেই আবারও ঝড় শুরু হল,
-তুই দিনদিন এরকম খচ্চর হয়ে যাচ্ছিস ক্যান, হ্যা?তোর জন্য তো আমার নাক কাটা যাবে।
মনে মনে বললাম, বোঁচা নাকটা কাটা গেলে তো অনেক খুশি হতাম।
-আমি আবার কি করলাম?
-চোখ নামিয়ে দেখ, পায়ে কি?
পায়ে আবার কি বলে তাকিয়ে দেখি মোজাটা এখনও খুলি নাই।
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হ খচ্চর কোনখানের, বলে ঝড়ের বেগে চলে গেল।
ধুর শালার, আজকে দিনটাই খারাপ, ওই লোকটা একটা কুফা, ওর জন্যই আবার বকা খেলাম। শালারে হাতের মুঠোয় পেলে কি করতাম তা কল্পনা করে মনে মনে শান্তি পেয়ে জামাকাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
গোসল করে মাথাটা ঠান্ডা হলে খেতে আসলাম মায়ের ডাকে। কিন্তু টেবিলে গিয়েই আবারও মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল, একটা আইটেমও পছন্দের না, সারাদিন ক্লাস করে কেউ করল্লা দিয়া ভাত খায়!
-আম্মা এইগুলা কি রান্না করছ?
-কি মানে, চোখে দেখিস না কি রান্না করছি?
-জানই তো করল্লা খাই না।
-আরে একটু খা, চিংড়ি দিয়ে চচ্চড়ি করছি, শখ করে রান্না করছি।
-ধুর এগুলা আমি খাই না, জোর করে ক্যামনে খাই!
-আচ্ছা দাড়া, একটা ডিম ভেজে দেই।
-লাগবে না, খাবই না দুপুরে কিছু।
রাগ করে উঠে এলাম।ঘরে এই একটা লোকের উপরে রাগ দেখানো যায়। রাগ দেখাইলে উল্টা আইসা আদর করে রাগ ভাঙ্গায়।
রুমে ঢুকে মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়ে আসলাম।বাইরে থেকে খেয়ে আসব।
পিছন থেকে মা ডাকছে।
দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে আসলাম।
মোবাইলে Skid Row এর I remember You গানটা বাজিয়ে দিলাম। যে কোন পরিস্থিতিতেই গানটা আমার মন ভাল করে দেয়।হেডফোনটা কানে লাগিয়ে হাটা ধরলাম। রাস্তার ওপারে শরীফের দোকানে কিছু খেয়ে নিতে হবে। পিছন থেকে কিছু লোক চিৎকার করে উঠল।অস্পষ্টভাবে শুনলেও কোন দুর্ঘটনা ঘটল কিনা তা দেখার জন্য ঘুরতেই দেখি হলুদ দানবটা চোখের সামনে,হর্ন বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে প্রতিমুহূর্তেই। ধাক্কাটা লাগলে কোন ব্যাথা পেলাম না, বরং ভালই হল। নিমিষেই সব রাগ,ক্ষোভ অভিমান চলে গেল। মাথাটা একেবারে হালকা হয়ে গেল। কোন গাড়িতে একটা বাচ্চা কাঁদতেছে, মা টা কি করে কান্না থামাচ্ছে না ক্যান! বাচ্চাদের কান্না আমার সহ্য হয় না। বুঝতে পারছি না এত ঘামাচ্ছি ক্যান, কপাল থেকে ঘামের মোটা ধারা চোখ বন্ধ করে নেমে যাচ্ছে। আশেপাশের সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ক্যান তাও বুঝতেছি না। আমি কি ঘুমিয়ে পড়ছি নাকি? মনে হয়, স্বপ্নও দেখতেছি একটা। পুরোপুরি ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। আহ কি শান্তি, এত শান্তি তো এর আগে আর লাগে নি। আপুর হাতে আম্মুর করল্লার চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাচ্ছি।খাওয়াটা যদি অনন্তকাল চলত!
ওদিকে মোবাইলে বেজেই চলেছে
Remember yesterday, walking hand in hand
Love letters in the sand, I remember you
Through the sleepless nights and every endless day
I'd want to hear you say, I remember you.