যে মানুষ সব সময় একা থাকতে ভালবাসে সে হয় কোন পশু
নয়ত কোন দেবতা', এরিস্টটল এই গল্প কয়টি কথায় একই
সাথে চরম সত্য ও চরম অসত্যকে খুব ব্যতিক্রমীভাবে
প্রকাশ করেছেন। কারন যে, মানুষ অসামাজিক, যে, সমাজ
সম্বন্ধে মনে মনে ঘৃণা পোষন করে, তার মধ্যে যে খানিকটা
পশুর স্বভাব থাকবে এটা যেমন সত্য, তার
সামাজিকতার মধ্যে দেবত্ব খুঁজে পাওয়া তেমনি অসত্য।
অবশ্য এর একটা ব্যাতিক্রম আছে। কোন কোন মানুষ
প্রতিদিনের পৃথিবী থেকে দুরে গিয়ে নির্জনে নিজেকে খোঁজেন,
নিজের উত্তরনের পথ খোঁজেন, তাদের কথা আলাদা।
কিন্তু প্রাচীন সন্ন্যাসী এবং পবিত্র চার্চের যাজকদের
মধ্যে এমন দেখা গেছে। কিন্তু নির্জনতা যে আসলে কী, কত
দুরে তার বিস্তার, এটা সাধারন মানুষ কমই বোঝেন।
কারন ভিড় তো আসলে সাহচর্য নয়, চারপাশের অনেক মুখ
শুধুই সারি সারি সাজানো ছবি, আর ভালোবাসা যেখানে
নেই, সেখানে কথা শুধু যেন বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার, কোন
নৈর্ব্যত্তিক শব্দ মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। ' ম্যাগনা
সিভিটাস, ম্যাগনা সলিচিউডো ' - ল্যাটিন ভাষার এই
উক্তিটি সত্যের অনেক কাছাকাছি। এর অর্থ 'যত বড় শহর,
ততই বেশি একাকীত্ব আর নির্জনতা'। বড় শহরে বন্ধুরা
থাকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাদের প্রতিবেশী হিসেবে সব সময়
পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা আর এক ধাপ এগিয়ে
বলতে পারি, যাঁদের তেমন কোন সত্যিকারের বন্ধু নেই,
তাঁরা সর্বদাই নির্জনতার মধ্যে বাস করেন। কোন বন্ধু
ছাড়া পৃথিবী তো আসলে জঙ্গলের মতই। যে মানুষ মন-
মানসিকতা এমন যে তার সঙ্গে কারোরই বন্ধুত্ব হয় না,
তার স্বভাব আসলে মানুষের মত কম, আর পশুর মত বেশি।
জীবনের পথ চলতে গিয়ে আবেগ আর অনুভুতির কত সঞ্চয়
জমা হয়ে থাকে মনের মাঝে, জমে থাকে অনেক ব্যাথা ও
বেদনা। প্রকৃত বন্ধুর কাছে মন খুলে বলা যায় সেসব কথা।
মনের ভার অনেক লাঘব হয় তাতে। আমরা জানি
রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি শারীরিক ব্যাপারগুলি অবরুদ্ধ
থাকা, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে থাকা, শরীরের পক্ষে এগুলি
বিপজ্জনক অসুখ। মনের ব্যাপারটাও তার থেকে আলাদা
কিছু নয়।
শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরই স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি রুদ্ধ
হলে তার ওষুধ আছে, যকৃৎ, প্লিহা, ফুসফুস সব কিছুর
আলাদা আলাদা ওষুধ, কিন্তু মনের রুদ্ধতার খোলবার
জন্য, সেখানে বন্ধ হয়ে আসা প্রাণবায়ুকে ফিরিয়ে আনার
জন্য দরকার একজন সত্যিকারের বন্ধু। এমন একজন
সহানুভূতিশীল বন্ধু যাকে সকল দুঃখ, আনন্দ, ভয়, আশা
আর সন্দেহের কথা মুখ ফুটে বলা যায়। যে, সমস্ত বোঝার
ভারে অবদমনিত হয়ে থাকে, মন কোন কিছু আশঙ্কা ছাড়াই
নির্ভয়ে সে সব কথা জানানো যায় যাকে, কারণ এভাবে
বলতে পারলে অনেকটা দূর হবে এইসব মানসিক যন্ত্রণা।
অনেক মহান সম্রাট ও রাজারা বন্ধুত্বকে কত মূল্য
দিয়েছেন তা দেখলে অবাক হতে হয়- অনেকে তাঁদের
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও খ্যাতির ওপর ঝুঁকি নিয়েও তাঁদের
বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। একজন রাজা বা
রাজপুত্রের জীবনযাত্রা অন্য সব মানুষের থেকেই অনেক
দূরের ব্যাপার। সুতরাং অনেক সময় অসুবিধা সহ্য করেও
তেমন কাউকে আলাদা করে নিজের কাছাকাছি তাঁর
বন্ধুত্বের উপযুক্ত করে একই সঙ্গে বড় করে না তুললে
বন্ধুত্বের ফলভোগ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। সমসাময়িক
ভাষায় তাঁদের বলা হয় 'প্রিয়পাত্র' বা 'নিজস্ব
বন্ধু' (Privado)- যেন তাদের প্রতি শুধুই দাক্ষিণ্যের বশে
এমন নৈকট্য গড়ে উঠেছে। রোমানদের কাছে এমন বন্ধুত্বের
নাম ছিল 'পার্টিসিপোস কিউরেরাম' অর্থাৎ 'দুশ্চিন্তার
ভাগীদার'- এটাই বরং ছিল সত্যের অনেক কাছাকাছি
সম্বোধন। কারণ আশঙ্কার এই ভাগ নিয়ে নিশিদিন সহগমনই
ছিল তাদের আসল বন্ধন। আমরা দেখতে পাই এমন বন্ধুত্ব
যে শুধু দুর্বল ও আবেগপ্রবণ রাজপুত্ররাই করেছেন তা নয়,
সব থেকে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের মধ্যেও তা
আছে। তাঁরা অনেক সময়েই তাঁদের কোন সেবককে বন্ধু বলে
স্বীকার করে নিয়েছেন।
তারপরে দুজনেই পরস্পরকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন এবং
অপরকেও তাদের এমনভাবেই দেখতে বলেছেন, দুজন অত্যন্ত
কাছাকাছি মনের মানুষকে যেভাবে দেখা উচিত সেভাবে।
রোমের সম্রাট লুচিয়াস সীলা তাঁর সহযোগী পম্পেকে এত
স্বাধীনতা দিয়েছেন যে ক্ষমতার ব্যবহারে সে তাঁকেও
ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একবার সীলার অনুমতি ছাড়াই
একজনকে শাসক নিযুক্ত করায় তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন।
তখন পম্পে তাকে প্রায় চুপ করিয়ে দেয়। 'মানুষ সকালের
সূর্যকে অন্তগামী সূর্যের থেকে বেশি মান্য করে' সীলাকে
এই কথাই বলেছিল পম্পে। ডেমিনাস ব্রুটাসকে জুলিয়াস
সীজার এত পছন্দ করতেন যে তাঁর উইলে নিজের ভাইপোর
পরেই ক্ষমতার উত্তরাধীকারে তার নাম ছিল। অথচ এই
সেই মানুষ যে ক্ষমতাবান সঙ্গী সাথীদের নিয়ে তাঁকে
হত্যা করেছিল। যখন সীজার স্ত্রী ক্যালফুনিয়ার দেখা
এক দুঃস্বপ্নকে কথা শুনে এবং আরও কিছু কিছু অশুভ লক্ষণ
দেখে, সেনেটের অধিবেশন স্থগিত রাখতে চেয়েছিলেন, তখন
এই মানুষই ধীরে ধীরে তার হাত ধরে তার আসন থেকে
উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আর ব্যঙ্গের সুরে বলেছিল যে সে আশা
করে যে সীজার তাঁর স্ত্রী আর একটা শুভস্বপ্ন না
দেখা অবধি সেনেটের অধিবেশন বন্ধ করবেন না। সিজারের
ওপর ব্রুটাসের প্রভাব এত বেশি ছিল যে এন্টোনিয়াস
সিজারের ফিলিপিক্সের সামনে পাঠকরা একটি লেখায়
তাকে মন বিষিয়ে দেওয়া ডাইনিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আবার নিচু বংশে জন্ম নেওয়া আগরিপ্পাকে আগাস্টাস
এমন উঁচুতে তুলেছিলেন সে যখন তিনি তাঁর মেয়ে জুলিয়ার
ব্যাপারে মেসেনার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন তখন
মেসেনা বলেছিলেন যে হয় জুলিয়ার বিয়ে আগরিপ্পার
সঙ্গেই হওয়া উচিত, না হলে আগরিপ্পা এমন ক্ষমতাবান
হয়ে উঠেছে যে এবার তাকে মেরে ফেলাই ভাল, আর তৃতীয়
কোন পথ নেই। একই রকমভাবে টিবেরিয়াস সিজারের সহচর
সীজেনাস তাঁর এত কাছাকাছি ছিলেন যে তাঁদের
দুজনকে বন্ধু বলা হত এবং ভাবাও হত তাই। টিবেরিয়াস
সীজেনাসকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেনও যে 'আমাদের
মধ্যে বন্ধুত্বের কথা বিবেচনা করে তোমাকে আমি কিছুই
লুকাই নি' তাঁদের বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান জানাতে রোমের
সেনেট তাদের দুজনের মর্মরমূর্তি একসঙ্গে অধিবেশনকক্ষের
বেদীতে রাখবার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল। এরকমই গভীর
বন্ধু সম্পর্ক এক সময় ছিল সেপ্টিমিয়াস আর প্লাটিনাসের
মধ্যে। সেপ্টিমিয়াস তাঁর বড় ছেলের বিবাহ প্রায় জোর করেই
প্লাটিনাসের কন্যার সঙ্গে দেন। কিন্তু বরের এক্ষেত্রে
কনে পছন্দ হয়নি এবং সে প্রায়ই স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার
করত। এরকম সময় সেপ্টিমিয়াস ছেলেরই বিপক্ষে দাঁড়াতেন।
তিনি একসময় প্লাটিনিয়াস সম্বন্ধে সেনেটকে লিখেওছিলেন-
'এই মানুষটিকে আমি এমন চোখে দেখি যে আমি চাই সে যেন
আমার থেকেও বেশি দিন বাঁচে।'
যদি এই সব রাজা ও রাজপুত্রেরা প্রত্যেকেই ট্রাজান
বা মার্কাস অরেলিয়াসের মত মহৎ প্রকৃতির মতন হতেন
তাহলে না হয় তাঁদের বন্ধুবৎসলতার কারণ বোঝা যেত।
কিন্তু তারা প্রত্যেকেই মহত্ত্বের অধিকারী ছিলেন না
বরং নিজেরা এত বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী এবং দৃড়প্রকৃতির
ছিলেন আর নিজেদেরই এত বেশি ভালবাসতেন তাঁদের
নিজেদের স্বার্থেই বন্ধুত্বের বন্ধনে বিশেষ বিশেষ লোককে
আটকে রাখতেন, কারণ তাঁদের অজস্র সুখ আর
বিলাসীতা শুধু একা একা উপযোগ করা হলে তা সম্পূর্ণ
হত না। তাকে পরিপূর্ণভাবে উপযোগ করতে বন্ধুর প্রয়োজন
ছিল। আরও বেশি ভাববার বিষয়- এইসব রাজা-রাজপুত্রের
নিজেদের স্ত্রী-পুত্র, ভাইপো-ভাগনে, সবই ছিল। কিন্তু
একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু যে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের সম্পর্ক দিতে
পারে না তা এদের কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এই সঙ্গে মনে করা যেতে পারে ফরাসি ঐতিহাসিক
কোমিনিউসের লেখা তাঁর প্রথম নিয়োজক বার্গান্দির ডিউক
চার্লসের কথা। কোমিনিউস লিখেছিলেন যে চার্লস
স্পর্শকাতর বিষয়ে তার জানা কোন কথা কাউকে বলতেন
না। আর যে গুপ্তকথা তাকে কষ্ট দিচ্ছে তাকে প্রকাশ
করা তাঁর একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। আবার তিনি
লিখেছিলেন যে পরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাছাকাছি
আসাতে তাঁদের সম্পর্ক বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোমিনিউস
তাঁর দ্বিতীয় নিয়োগকর্তা একাদশ লুইয়ের কথাও বলতে
পারতেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বও শেষমেশ কোমিনিউসের
যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে পিথাগোরাসের উক্তি অনেকটাই রহস্য আবৃত-
'কোর নে এডিটো', অর্থাৎ নিজের হৃদয়কে খেয়ে ফেলো না।
কঠিন ভাষায় বলা কথাটা কিন্তু সত্য। যারা বন্ধু ভেবে
অন্যকে তাদের হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন আর এক হিসেবে দেখতে
গেলে তারা খেয়েই ফেলেন নিজের হৃদয়কে (বেকন
পিথাগোরাসের মন্তব্যের এই ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু
প্লুটার্ক আবার একই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করেছেন 'তোমার
হৃদয়কে অনর্থক চিন্তায় ভারাক্রান্ত করো না'। -
অনুবাদক)।
বন্ধুত্বের প্রশংসনীয় দিকগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করতে
গেলে একথা প্রথমেই বলতে হয় যে মন খুলে বন্ধুর কাছে
প্রকাশ করলে আনন্দ দ্বিগুণ হয় আর দুঃখ হয়ে যায় অর্ধেক।
এটা যেন প্রাচীনকালের আলকেমিস্টদের কথিত এমন
একটা পরশমণি যা অসুস্থ শরীরকে সুস্থ আর সুস্থ শরীরকে
আরও সুন্দর করে তুলত। তারা বলতেন পরশমণি প্রয়োজনে
যা অশুভ তার বিপরীত দিকে আর যা শুভ তার পক্ষে
কাজ করে, আর ফলাফল হয় সর্বদাই শুভ। কিন্তু
আলকেমিস্টদের খুব বেশি তারিফ না করেও, প্রকৃতির
স্বাভাবিক কাজ কর্মেও আমরা একই ধর্ম লক্ষ্য করতে
পারি। সংখ্যায় বেশি হলে জোর আসে বেশি আর আঘাত
লাগে কম। শরীরে যেমন, মনেও তেমনই।
বন্ধুত্বের প্রথম প্রাপ্তি যদি হৃদয়ের আবেগের ক্ষেত্রে হয়,
দ্বিতীয়টি তবে বোধ ও চিন্তার ক্ষেত্রে। বন্ধুত্ব যেমন
দুঃখের দিনে মনের মধ্যে ঝড়-
যে মানুষ সব সময় একা থাকতে ভালবাসে সে হয় কোন পশু
নয়ত কোন দেবতা', এরিস্টটাল এই গল্প কয়টি কথায় একই
সাথে চরম সত্য ও চরম অসত্যকে খুব ব্যতিক্রমীভাবে
প্রকাশ করেছেন। কারন যে, মানুষ অসামাজিক, যে, সমাজ
সম্বন্ধে মনে মনে ঘৃণা পোষন করে, তার মধ্যে যে খানিকটা
পশুর স্বভাব থাকবে এটা যেমন সত্য, তার
সামাজিকতার মধ্যে দেবত্ব খুঁজে পাওয়া তেমনি অসত্য।
অবশ্য এর একটা ব্যাতিক্রম আছে। কোন কোন মানুষ
প্রতিদিনের পৃথিবী থেকে দুরে গিয়ে নির্জনে নিজেকে খোঁজেন,
নিজের উত্তরনের পথ খোঁজেন, তাদের কথা আলাদা।
কিন্তু প্রাচীন সন্ন্যাসী এবং পবিত্র চার্চের যাজকদের
মধ্যে এমন দেখা গেছে। কিন্তু নির্জনতা যে আসলে কী, কত
দুরে তার বিস্তার, এটা সাধারন মানুষ কমই বোঝেন।
কারন ভিড় তো আসলে সাহচর্য নয়, চারপাশের অনেক মুখ
শুধুই সারি সারি সাজানো ছবি, আর ভালোবাসা যেখানে
নেই, সেখানে কথা শুধু যেন বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার, কোন
নৈর্ব্যত্তিক শব্দ মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। ' ম্যাগনা
সিভিটাস, ম্যাগনা সলিচিউডো ' - ল্যাটিন ভাষার এই
উক্তিটি সত্যের অনেক কাছাকাছি। এর অর্থ 'যত বড় শহর,
ততই বেশি একাকীত্ব আর নির্জনতা'। বড় শহরে বন্ধুরা
থাকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাদের প্রতিবেশী হিসেবে সব সময়
পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা আর এক ধাপ এগিয়ে
বলতে পারি, যাঁদের তেমন কোন সত্যিকারের বন্ধু নেই,
তাঁরা সর্বদাই নির্জনতার মধ্যে বাস করেন। কোন বন্ধু
ছাড়া পৃথিবী তো আসলে জঙ্গলের মতই। যে মানুষ মন-
মানসিকতা এমন যে তার সঙ্গে কারোরই বন্ধুত্ব হয় না,
তার স্বভাব আসলে মানুষের মত কম, আর পশুর মত বেশি।
জীবনের পথ চলতে গিয়ে আবেগ আর অনুভুতির কত সঞ্চয়
জমা হয়ে থাকে মনের মাঝে, জমে থাকে অনেক ব্যাথা ও
বেদনা। প্রকৃত বন্ধুর কাছে মন খুলে বলা যায় সেসব কথা।
মনের ভার অনেক লাঘব হয় তাতে। আমরা জানি
রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি শারীরিক ব্যাপারগুলি অবরুদ্ধ
থাকা, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে থাকা, শরীরের পক্ষে এগুলি
বিপজ্জনক অসুখ। মনের ব্যাপারটাও তার থেকে আলাদা
কিছু নয়।
শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরই স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি রুদ্ধ
হলে তার ওষুধ আছে, যকৃৎ, প্লিহা, ফুসফুস সব কিছুর
আলাদা আলাদা ওষুধ, কিন্তু মনের রুদ্ধতার খোলবার
জন্য, সেখানে বন্ধ হয়ে আসা প্রাণবায়ুকে ফিরিয়ে আনার
জন্য দরকার একজন সত্যিকারের বন্ধু। এমন একজন
সহানুভূতিশীল বন্ধু যাকে সকল দুঃখ, আনন্দ, ভয়, আশা
আর সন্দেহের কথা মুখ ফুটে বলা যায়। যে, সমস্ত বোঝার
ভারে অবদমনিত হয়ে থাকে, মন কোন কিছু আশঙ্কা ছাড়াই
নির্ভয়ে সে সব কথা জানানো যায় যাকে, কারণ এভাবে
বলতে পারলে অনেকটা দূর হবে এইসব মানসিক যন্ত্রণা।
অনেক মহান সম্রাট ও রাজারা বন্ধুত্বকে কত মূল্য
দিয়েছেন তা দেখলে অবাক হতে হয়- অনেকে তাঁদের
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও খ্যাতির ওপর ঝুঁকি নিয়েও তাঁদের
বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। একজন রাজা বা
রাজপুত্রের জীবনযাত্রা অন্য সব মানুষের থেকেই অনেক
দূরের ব্যাপার। সুতরাং অনেক সময় অসুবিধা সহ্য করেও
তেমন কাউকে আলাদা করে নিজের কাছাকাছি তাঁর
বন্ধুত্বের উপযুক্ত করে একই সঙ্গে বড় করে না তুললে
বন্ধুত্বের ফলভোগ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। সমসাময়িক
ভাষায় তাঁদের বলা হয় 'প্রিয়পাত্র' বা 'নিজস্ব
বন্ধু' (Privado)- যেন তাদের প্রতি শুধুই দাক্ষিণ্যের বশে
এমন নৈকট্য গড়ে উঠেছে। রোমানদের কাছে এমন বন্ধুত্বের
নাম ছিল 'পার্টিসিপোস কিউরেরাম' অর্থাৎ 'দুশ্চিন্তার
ভাগীদার'- এটাই বরং ছিল সত্যের অনেক কাছাকাছি
সম্বোধন। কারণ আশঙ্কার এই ভাগ নিয়ে নিশিদিন সহগমনই
ছিল তাদের আসল বন্ধন। আমরা দেখতে পাই এমন বন্ধুত্ব
যে শুধু দুর্বল ও আবেগপ্রবণ রাজপুত্ররাই করেছেন তা নয়,
সব থেকে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের মধ্যেও তা
আছে। তাঁরা অনেক সময়েই তাঁদের কোন সেবককে বন্ধু বলে
স্বীকার করে নিয়েছেন।
তারপরে দুজনেই পরস্পরকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন এবং
অপরকেও তাদের এমনভাবেই দেখতে বলেছেন, দুজন অত্যন্ত
কাছাকাছি মনের মানুষকে যেভাবে দেখা উচিত সেভাবে।
রোমের সম্রাট লুচিয়াস সীলা তাঁর সহযোগী পম্পেকে এত
স্বাধীনতা দিয়েছেন যে ক্ষমতার ব্যবহারে সে তাঁকেও
ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একবার সীলার অনুমতি ছাড়াই
একজনকে শাসক নিযুক্ত করায় তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন।
তখন পম্পে তাকে প্রায় চুপ করিয়ে দেয়। 'মানুষ সকালের
সূর্যকে অন্তগামী সূর্যের থেকে বেশি মান্য করে' সীলাকে
এই কথাই বলেছিল পম্পে। ডেমিনাস ব্রুটাসকে জুলিয়াস
সীজার এত পছন্দ করতেন যে তাঁর উইলে নিজের ভাইপোর
পরেই ক্ষমতার উত্তরাধীকারে তার নাম ছিল। অথচ এই
সেই মানুষ যে ক্ষমতাবান সঙ্গী সাথীদের নিয়ে তাঁকে
হত্যা করেছিল। যখন সীজার স্ত্রী ক্যালফুনিয়ার দেখা
এক দুঃস্বপ্নকে কথা শুনে এবং আরও কিছু কিছু অশুভ লক্ষণ
দেখে, সেনেটের অধিবেশন স্থগিত রাখতে চেয়েছিলেন, তখন
এই মানুষই ধীরে ধীরে তার হাত ধরে তার আসন থেকে
উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আর ব্যঙ্গের সুরে বলেছিল যে সে আশা
করে যে সীজার তাঁর স্ত্রী আর একটা শুভস্বপ্ন না
দেখা অবধি সেনেটের অধিবেশন বন্ধ করবেন না। সিজারের
ওপর ব্রুটাসের প্রভাব এত বেশি ছিল যে এন্টোনিয়াস
সিজারের ফিলিপিক্সের সামনে পাঠকরা একটি লেখায়
তাকে মন বিষিয়ে দেওয়া ডাইনিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আবার নিচু বংশে জন্ম নেওয়া আগরিপ্পাকে আগাস্টাস
এমন উঁচুতে তুলেছিলেন সে যখন তিনি তাঁর মেয়ে জুলিয়ার
ব্যাপারে মেসেনার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন তখন
মেসেনা বলেছিলেন যে হয় জুলিয়ার বিয়ে আগরিপ্পার
সঙ্গেই হওয়া উচিত, না হলে আগরিপ্পা এমন ক্ষমতাবান
হয়ে উঠেছে যে এবার তাকে মেরে ফেলাই ভাল, আর তৃতীয়
কোন পথ নেই। একই রকমভাবে টিবেরিয়াস সিজারের সহচর
সীজেনাস তাঁর এত কাছাকাছি ছিলেন যে তাঁদের
দুজনকে বন্ধু বলা হত এবং ভাবাও হত তাই। টিবেরিয়াস
সীজেনাসকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেনও যে 'আমাদের
মধ্যে বন্ধুত্বের কথা বিবেচনা করে তোমাকে আমি কিছুই
লুকাই নি' তাঁদের বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান জানাতে রোমের
সেনেট তাদের দুজনের মর্মরমূর্তি একসঙ্গে অধিবেশনকক্ষের
বেদীতে রাখবার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল। এরকমই গভীর
বন্ধু সম্পর্ক এক সময় ছিল সেপ্টিমিয়াস আর প্লাটিনাসের
মধ্যে। সেপ্টিমিয়াস তাঁর বড় ছেলের বিবাহ প্রায় জোর করেই
প্লাটিনাসের কন্যার সঙ্গে দেন। কিন্তু বরের এক্ষেত্রে
কনে পছন্দ হয়নি এবং সে প্রায়ই স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার
করত। এরকম সময় সেপ্টিমিয়াস ছেলেরই বিপক্ষে দাঁড়াতেন।
তিনি একসময় প্লাটিনিয়াস সম্বন্ধে সেনেটকে লিখেওছিলেন-
'এই মানুষটিকে আমি এমন চোখে দেখি যে আমি চাই সে যেন
আমার থেকেও বেশি দিন বাঁচে।'
যদি এই সব রাজা ও রাজপুত্রেরা প্রত্যেকেই ট্রাজান
বা মার্কাস অরেলিয়াসের মত মহৎ প্রকৃতির মতন হতেন
তাহলে না হয় তাঁদের বন্ধুবৎসলতার কারণ বোঝা যেত।
কিন্তু তারা প্রত্যেকেই মহত্ত্বের অধিকারী ছিলেন না
বরং নিজেরা এত বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী এবং দৃড়প্রকৃতির
ছিলেন আর নিজেদেরই এত বেশি ভালবাসতেন তাঁদের
নিজেদের স্বার্থেই বন্ধুত্বের বন্ধনে বিশেষ বিশেষ লোককে
আটকে রাখতেন, কারণ তাঁদের অজস্র সুখ আর
বিলাসীতা শুধু একা একা উপযোগ করা হলে তা সম্পূর্ণ
হত না। তাকে পরিপূর্ণভাবে উপযোগ করতে বন্ধুর প্রয়োজন
ছিল। আরও বেশি ভাববার বিষয়- এইসব রাজা-রাজপুত্রের
নিজেদের স্ত্রী-পুত্র, ভাইপো-ভাগনে, সবই ছিল। কিন্তু
একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু যে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের সম্পর্ক দিতে
পারে না তা এদের কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এই সঙ্গে মনে করা যেতে পারে ফরাসি ঐতিহাসিক
কোমিনিউসের লেখা তাঁর প্রথম নিয়োজক বার্গান্দির ডিউক
চার্লসের কথা। কোমিনিউস লিখেছিলেন যে চার্লস
স্পর্শকাতর বিষয়ে তার জানা কোন কথা কাউকে বলতেন
না। আর যে গুপ্তকথা তাকে কষ্ট দিচ্ছে তাকে প্রকাশ
করা তাঁর একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। আবার তিনি
লিখেছিলেন যে পরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাছাকাছি
আসাতে তাঁদের সম্পর্ক বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোমিনিউস
তাঁর দ্বিতীয় নিয়োগকর্তা একাদশ লুইয়ের কথাও বলতে
পারতেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বও শেষমেশ কোমিনিউসের
যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে পিথাগোরাসের উক্তি অনেকটাই রহস্য আবৃত-
'কোর নে এডিটো', অর্থাৎ নিজের হৃদয়কে খেয়ে ফেলো না।
কঠিন ভাষায় বলা কথাটা কিন্তু সত্য। যারা বন্ধু ভেবে
অন্যকে তাদের হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন আর এক হিসেবে দেখতে
গেলে তারা খেয়েই ফেলেন নিজের হৃদয়কে (বেকন
পিথাগোরাসের মন্তব্যের এই ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু
প্লুটার্ক আবার একই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করেছেন 'তোমার
হৃদয়কে অনর্থক চিন্তায় ভারাক্রান্ত করো না'। -
অনুবাদক)।
বন্ধুত্বের প্রশংসনীয় দিকগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করতে
গেলে একথা প্রথমেই বলতে হয় যে মন খুলে বন্ধুর কাছে
প্রকাশ করলে আনন্দ দ্বিগুণ হয় আর দুঃখ হয়ে যায় অর্ধেক।
এটা যেন প্রাচীনকালের আলকেমিস্টদের কথিত এমন
একটা পরশমণি যা অসুস্থ শরীরকে সুস্থ আর সুস্থ শরীরকে
আরও সুন্দর করে তুলত। তারা বলতেন পরশমণি প্রয়োজনে
যা অশুভ তার বিপরীত দিকে আর যা শুভ তার পক্ষে
কাজ করে, আর ফলাফল হয় সর্বদাই শুভ। কিন্তু
আলকেমিস্টদের খুব বেশি তারিফ না করেও, প্রকৃতির
স্বাভাবিক কাজ কর্মেও আমরা একই ধর্ম লক্ষ্য করতে
পারি। সংখ্যায় বেশি হলে জোর আসে বেশি আর আঘাত
লাগে কম। শরীরে যেমন, মনেও তেমনই।
বন্ধুত্বের প্রথম প্রাপ্তি যদি হৃদয়ের আবেগের ক্ষেত্রে হয়,
দ্বিতীয়টি তবে বোধ ও চিন্তার ক্ষেত্রে। বন্ধুত্ব যেমন
দুঃখের দিনে মনের মধ্যে ঝড়-ঝঞ্ঝা ও দুর্যোগকে শান্ত
করতে পারে, তেমনই বন্ধুর সমস্যাসঙ্কুল মনকে অন্ধকার
থেকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে পারে সে। বিশৃঙ্খল চিন্তাকে
শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে এক বন্ধু অপরকে সাহায্য করতে
পারে। একজন বন্ধু যে ভাল পরামর্শ দেবে সেটাতো আশাই
করা যায়। তাছাড়াও যে মানুষের মন নানা চিন্তা
ভাবনায় বিপর্যস্ত সে আর একজনের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে
আলোচনা করলে তার নিজের চিন্তা ভাবনাও অনেক
পরিস্কার হয়। বন্ধুদের ও দুর্যোগকে শান্ত
করতে পারে, তেমনই বন্ধুর সমস্যাসঙ্কুল মনকে অন্ধকার
থেকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে পারে সে। বিশৃঙ্খল চিন্তাকে
শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে এক বন্ধু অপরকে সাহায্য করতে
পারে। একজন বন্ধু যে ভাল পরামর্শ দেবে সেটাতো আশাই
করা যায়। তাছাড়াও যে মানুষের মন নানা চিন্তা
ভাবনায় বিপর্যস্ত সে আর একজনের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে
আলোচনা করলে তার নিজের চিন্তা ভাবনাও অনেক
পরিস্কার হয়।