গত ২২শে অক্টোবর ২০১৪ ভোরে ফাঁসি হয়ে যায় রেহানী জাবারীর। বয়স হয়েছিল ২৬ বছর। ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে আততায়ীর বুকে ছুরি বসানোর অপরাধে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ইরানের সুপ্রিমকোর্ট। রেহানীর ফাঁসির আদেশের বিরোধীতা করে গোটা বিশ্বের অজস্র মানবাধিকার সংগঠন। প্রাণভিক্ষার আবেদন জানায় গোটা দুনিয়া। এমনকি মেয়ের বদলে মাকে ফাঁসির কাষ্ঠে নেয়ার আবেদনও জানায় তার মা। কিন্তু কোন কিছুতেই কান দেয়নাই সরকার, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই নিভিয়ে দেয়া হয় একটা তাজা প্রদীপ।
চিঠিতে কি লিখে গিয়েছিল রেহানী জাবারী?
প্রিয় শোলেহ, আজ জানতে পারলাম এবার আমার কিসাস (ইরানের আইনব্যবস্থায় কর্মফলবিষয়ক বিধি)-এর সম্মুখীন হওয়ার সময় হয়েছে। জীবনের শেষ পাতায় যে পৌঁছে গিয়েছি, তা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি ভেবে খারাপ লাগছে। তোমার কি মনে হয়নি যে এটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল? তুমি দুঃখে ভেঙে পড়েছ জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তোমার আর বাবার হাতে চুমু খেতে দাওনি কেন আমায়?
তুমি আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছিলে। সেই অভিশপ্ত রাতে আমারই তো মরে যাওয়া উচিত ছিল, তাইনা? আমার মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলার কথা ছিল শহরের কোন অজ্ঞাত কোনে। কয়েকদিন পর মর্গে গিয়ে শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার। সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে, হত্যার আগে তোমার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল! হত্যাকারীরা অবশ্যই ধরা পড়তনা, কারণ আমাদের না আছে অর্থ, না আছে ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক আর অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হত। এটাই যে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাতের আকস্মিক আঘাত সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। শহরের কোন গলি নয়, আমার দেহটা প্রথমেই ছুঁড়ে ফেলা হল জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে, আর সেখান থেকে কবরের মতই এর রায়, কারাগারের জেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ করোনা মা....!
এটাই নিয়তির বিধান। আর তুমিতো জানো যে মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়না। মা তুমিতো শিখিয়েছিলে, অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই আমাদের জম্ম। তুমি বলেছিলে প্রত্যেক জম্মেই আমাদের কাঁধে এক বিশেষ দায়িত্ব দেয়া থাকে। মাঝে মাঝে লড়াই করতে হয়। সেই শিক্ষাতো তোমার কাছ থেকেই পেয়েছি মা। সেই গল্পটা আজ মনে পড়ছে খুব; চাবুকের ঝন্ডা সহ্য করতে করতে একবার প্রতিবাদ জানানোর ফলে আরো নির্মমতার শিকার হয়েছিল এক ব্যাক্তি, অবশেষে সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়। কিন্তু প্রতিবাদতো সে করেছিল তাইনা মা? আমি শিখেছি, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হবে। স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে, নালিশ ও ঝগড়া ঝাটির মাঝেও যেন নিজের নারী সত্ত্বাকে বিসর্জন না দেই। তোমার মনে আছে মা, কত যত্ন করে মেয়েদের সব খুটিনাটি বিষয় শিখিয়েছিলে আমাদের? কিন্তু তুমি ভুল জানতে মা! এই ঘটনার সময় তোমার দেয়া সেসব তালিম একেবারেই কাজে লাগেনি আমার।
আদালতে আমায় এক ঠান্ডা মাথার খুনি হিসেবে পেশ করা হয়, কিন্তু আমি চোখের পানি ফেলিনি, অস্থিরও হইনি। আমি কাঁদিনি, কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা ছিল। কিন্তু বিচারে বলা হল, খুনের অভিযোগের মুখেও নাকি আমি নিরুত্তাপ! আচ্ছা মা, আমিতো কোনদিন একটা মশাও মারিনি, আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড় ধরে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি। সেই আমি, সেই আমি নাকি মাথা খাটিয়ে খুন করেছি! উল্টো ছোটবেলার কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে বেশ পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেননা, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের উপর কি সুন্দর নেইলপালিশের জেল্লা ছিল, হাতের তালু কত নরম তুলতুলে ছিল। সেই বিচারকদের হাত থেকে কি সুবিচার পাওয়ার আশা করাটা অতি বড় আশাবাদী হয়েও কেউ করতে পারে কি?
তাইতো নারিত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জন বাসের হুকুম দেয়া হল। দেখেছ মা, তোমার ছোট্ট রেহানী এই কয়েকদিনে কতটা বড় হয়ে গিয়েছে।
এবার আমার অন্তিম ইচ্ছাটা বলি শোন; কেঁদনা মা....! এখন সুখের সময়, ওরা আমায় ফাঁসি দেয়ার পর আমার চোখ, কিডনি, হৃদযন্ত্র, হাঁড় আরো যা যা কিছু দরকার যেন আর কারো জীবন রক্ষা করতে কাজে লাগানো হয়। তবে যিনি এসব পাবেন, তিনি যেন কখনোই আমার নাম না জানতে পারেন। আমি চাইনা এর জন্য আমার সমাধীতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক, এমনকি তুমিও নও! আমি চাইনা আমার কবরের সামনে বসে কেউ কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ুক। বরং আমার দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও।
এই পৃথিবী আমাদের ভালবাসেনি মা চায়নি আমি সুখি হই। এবার মৃত্যুর আলিঙ্গনে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার এজলাসে আমি সুবিচার পাবোই। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগের আঙ্গুল তুলবো সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারের দিকে, বিচারকদের দিকে,আইনজিবীদের দিকে, আর তাদের দিকে যারা আমার অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে। বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞতার কুঁয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে। একবারও বুঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায়, সেটাই সর্বদা সত্যি নয়! মা মনে রেখ সেদিন তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়।
দেখিনা সৃষ্টিকর্তা কি চান?
তবে একটাই আরজি; মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই মা...
মাগো তোমায় যে খুব ভালবাসি মা..., খুব খুব ভালবাসি মা...!
ভাল থেক মা..................!
মধ্য প্রাচ্যের ধর্মান্ধ পুরুষ মানুষ কুকুর গুলোকে আমি জেনেছি মদের বোতলে ডুব মেরে থাকতে । নারী প্রানিদের শরীরের ওপর সাদা চামড়া দের সুযোগ করে দিয়ে নষ্টামির চিৎকার করে বলেছে " আল্লাহু আকবার" । কোন আইন কিছু করতে পারে নাই ওদের। অথচ "রেহানী জাবারি" কে ফাঁসি দেয়া হয়ে গেল । যে সম্ভ্রম বাঁচাতে আর সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে আত্মরক্ষার্থে ছুরি চালিয়েছিল ধর্ষণকারীর বুকে।
প্রিয় রেহানী জাবারি,
আমি কি আজ কাঁদব? শুধু জেনে রেখ- তোমার জন্যে মনটা ভাল নাই। তুমি একাধারে আমার কাছে অনেকদিন ধরে বেঁচে থাকবে কখনো আমার মায়ের মত, কখনও আমার বোনের মত কিংবা কখনও আমার গুরুজনের মত। যাদের সম্ভ্রম হানিতে আমার চেতনা নিজেকে অপরাধী বানিয়ে তোলে। ক্ষমা করে দিয়ো। তোমার চিঠির শেষ লাইনটার সাথে দারুণভাবে একমত "এই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে সর্বদাই"।
ইতি
তোমার রেহানী
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৪২