সাধারণত ইসলামোফোবিক (ইসলাম-আতঙ্কিত) দের কথার কোন জবাব দিই না।
এই বর্ণবাদাক্রান্ত মানুষগুলোর কথার জবাব না দেয়ার তিনটা কারণ আছে-
১. আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল দ.'র নিষেধ। কুরআন ও সুন্নাহ্ তে বারবার বলা আছে, ভালভাবে বলতে পারলে বলো, নাহয় সরে যাও, উঠে যাও, চুপ করে থাকো। এই আদেশটাকে বাস্তবে শিরোধার্য করে নিয়েছি। যারা ফোবিয়ায় আক্রান্ত নন এবং তীব্র সাম্প্রদায়িক নন, তাদের বেলায় একটু আধটু ইন্টারাক্ট করি।
২. তাদের নিরাপত্তা। তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম এবং তারা আক্রান্ত। আক্রান্ত সম্প্রদায়বিদ্বেষী মানুষকে জবাব দিলেও যদি তার বিরুদ্ধে আরো রোষ তৈরি হয়, এটা নৈতিক মনে হয়নি। এজন্যও বলি না।
৩. তাদের বেশিরভাগ কথাই লজিকের খুবই বাইরে দিয়ে যায়। তাদের সাথে যুক্ত হলে তাদের লেভেলে নেমে কথা বলতে হবে। নির্বোধের সাথে যুক্ত হয়ে আলাপচারিতা করতে গেলে অবশ্যই আলাপচারিতা নির্বোধতার কাছাকাছি হতে হয়... এ থেকে দুরেই থাকি। এ বিষয়টা আত্ম-অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর।
একটা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিলাম, কিছু কথা বলব।
একজন সম্প্রদায়বিদ্বেষী সম্প্রতি বলেছেন, একটা টিভি চ্যানেল, একটা পত্রিকা, একটা প্রকাশনী, লেখকদের নিরাপত্তা এবং দেশব্যাপী সর্বস্তরে লেখা প্রচার করতে দিলে তারা পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অন্তত অর্ধেক মানুষকে ইসলাম-বিদ্বেষী এবং ধর্মমুক্ত করে ফেলবেন। শুধু তাই নয়, চোদ্দশ বছরের সংস্কার তাঁরা সরিয়ে ফেলবেন।
বাগাড়ম্বর সবচে বড় আড়ম্বর।
এই বাগাড়ম্বর নিয়ে দুটা কথা না বললে শান্তি পাচ্ছি না।
আমরা যে কমুনিস্ট দেশগুলোর আলোচনা করব, সে আলোচনা মূলত এই অসাড় বাগাড়ম্বর এর বাস্তবতা তুলে ধরবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা যে পৃথিবীর সবচে বেশি সময় ধরে টিকে থাকা বর্তমান নন-মার্ক্সসিস্ট-লেনিনিস্ট-মাওয়িস্ট সমাজতন্ত্রী (কমুনিস্ট) রাষ্ট্র এটা কি আমরা জানি?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটার ক্ষমতায় যে এই বর্তমান মুহূর্তেও কমুনিস্টরা যূথবদ্ধতায় ক্ষমতাসীন, এবং সেই যূথবদ্ধতায় মার্ক্সসিস্ট, লেনিনিস্ট, মাওয়িস্টও আছেন, তাও কি আমরা সচেতন?
আমরা, বাংলাদেশের মানুষ কমুনিজমের এক ধারায় পৃথিবীর সবচে সিনিয়র।
এটা মুখের কথা না, এটা কম কথা না।
বাংলাদেশ ছাড়াও গিনি বিসাউ, গায়ানা, ভারত, উত্তর কোরিয়া, পর্তুগীজ রিপাবলিক, সাও তোমে, শ্রীলঙ্কা ও তানজানিয়া বর্তমানে নন-মার্ক্সসিস্ট-লেনিনিস্ট-মাওয়িস্ট সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র।
আগে আলজেরিয়া, বার্মা, কেপ ভার্দে, মিসর, ইরাক, লিবিয়া, মাদাগাস্কার, সুদান ও সিরিয়া এই ধরনের সমাজতন্ত্রী ছিল।
এবার আসি পরের বিষয়ে,
বর্তমানে পৃথিবীতে মার্ক্সসিস্ট-লেনিনিস্ট মতক্রম থেকে উদ্ভুত কমুনিস্ট রাষ্ট্র মাত্র চারটা।
চীন, কিউবা, লাও এবং ভিয়েতনাম।
পতিত মার্ক্স ও লেনিনবাদী রাষ্ট্রর সংখ্যা এর আলোকে পর্যালোচনা করি?
আলবেনিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার তিনটি রাষ্ট্রীয় নাম সহ তিনটি রাষ্ট্রকাঠামো।
কম্বোডিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, ইথিওপিয়া, আফগানিস্তান ও রোমানিয়া এই প্রতিটা দেশের দুইটি করে রাষ্ট্রীয় নামের দুইটি করে কমুনিস্ট রাষ্ট্রকাঠামো। পাঁচটি।
অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, বুলগেরিয়া, কঙ্গো, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরী, উত্তর কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, মোজাম্বিক, পোল্যান্ড, সোমালিয়া, উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ইয়েমেন। তেরোটি।
পতিত রাষ্ট্রের সংখ্যা মোট একুশটি।
এখানে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যে রাষ্ট্রগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলোকে হিসাবেই আনা হয়নি।
এবার আমরা দেখব সম্পূর্ণ ব্যর্থরাষ্ট্র'র তালিকা।
যেসব রাষ্ট্র কখনোই লম্বা শাসন জারি করতে পারেনি। যেসব রাষ্ট্রতে সমাজতন্ত্রী বিপ্লব ক্ষমতা দখল করেও কিছু করতে পারেনি।
প্যারিস কমিউন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, এস্তোনিয়া, বাভারিয়ান, চিলি, চাইনিজ, অস্ট্রিয়ান, ফিনিশ, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া, আজারবাইজান, মাহাবাদ, উত্তর কোরিয়ার প্রভিশনাল সরকার, দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রভিশনাল সরকার, জাম্বিয়ার কাউন্সিল, ইয়েমেন। সতেরটি।
সোভিয়েত: রিপাবলিক অভ নাইসারার, ওডেসা, দন্তেস্ক-ক্রিভয়, আলসেস, স্যাক্সনি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়ান-বেলারুশিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান, মুঘান, লিমেরিক, বেসারাভিয়ান, স্লোভাক, পার্শিয়ান, গ্যালিসিয়ান, হুনান, ঙে-থিন, চাইনিজ। সতেরটি।
দুইপক্ষ মিলে ড্র। উভয় ব্যর্থ।
সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ায় সূফিপন্থী ইসলাম সবচে বেশি অগ্রসর, সরকার কর্তৃক স্বীকৃত এবং সহায়তাকৃত।
বর্তমান কমুনিস্ট চীনেও সূফিপন্থী ইসলাম সরকার কর্তৃক স্বীকৃত এবং সহায়তাকৃত।
এবার দেখি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়টা মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র'র জন্ম হয়েছে।
উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, আজারবাইজান। এই ছয়টা সম্পূর্ণ মুসলিম-গরিষ্ঠ রাষ্ট্র।
আজারবাইজানের ৯১.৬% মুসলিম। সিআইএ বলছে। ২০১২ সালে বার্কলে বলছে, ৯৩.৪%, ২০০৯ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে ৯৯.২%। বাকীদের মধ্যে নাস্তিকও আছে। এই হল সোভিয়েত রাষ্ট্রের ১৯২২-১৯৯১ সাল পর্যন্ত ধর্মহীন করার সার্বিক প্রয়াসের সাফল্য। এই হল সমস্ত সোভিয়েত টিভি, সংবাদপত্র, প্রকাশনা, লেখকদের নিরাপত্তা, স্কুলে স্কুলে নাস্তিকতা ও ইসলাম বিদ্বেষ প্রচার করার বাস্তব ফলাফল।
স্বপ্নের পরোটা যখন ভাজবেন, ঘি দিয়েই ভাজেন।
তাজিকিস্তানে ৯৮% মুসলিম যার মধ্যে আবার ৯৯% হানাফি সুন্নি সূফিপন্থী মুসলিম। তুর্কমেনিস্তানের ৯৩% এরও বেশি মুসলিম। উজবেকিস্তানের ৯০% মুসলিম এবং ৫% রাশিয়ান অর্থোডক্স, এত সাধের নাস্তিকতার চিহ্ন নেই। কিরঘিজস্তানে ৮৩% এর বেশি, কাজাখস্তানে ৭০% এর বেশি মুসলিম।
সাবেক সোভিয়েত অঞ্চল জর্জিয়া, যে দেশের পতাকা ক্রুসেডের পতাকা, সেখানেও ১০% মুসলিম রয়েছেন। সেখানেও ২০১১ সালে মুসলিমদের সাংবিধানিকভাবে অধিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
খোদ্ সোভিয়েত অঞ্চলের কী দশা, সেটা দেখা যাক। রাশিয়ার মেইন মাদারল্যান্ডে রয়টার অনুযায়ী ১৪% মুসলিম। সেখানে জারদের আমলে কি ২% ও মুসলিম ছিল? কমুনিস্ট শাসন, ইসলামোফোবিক এলিমেন্ট, সোভিয়েতের এত এত চ্যানেল, পত্রিকা, প্রকাশনা, লেখক, শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থা জারের পরে ইসলামের ১,০০০% প্রবৃদ্ধি করেছে।
কল্পনা ভাল। কল্পনা খুবই ভাল।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাশিয়া সহ মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ থেকে জন্মানো কমুনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা এবং শতাংশ প্রতিটাতেই জারপূর্ব সময়ের চেয়ে কমুনিস্ট-পরবর্তী সময়ে বেড়েছে।
কোন্-টা সত্যিকার "ধর্মনিরপেক্ষ"?
পৃথিবীর সবচে সিনিয়র সমাজতন্ত্রী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ? না, এটা সহি ধর্মনিরপেক্ষ না। এখন বাংলাদেশে একটা টিভি, একটা প্রকাশনা, একটা পত্রিকা পেলে কী করতেন তারা, যারা সাত বছর যা খুশি তা লিখে গেছেন ব্লগে এবং তাদের কেশ স্পর্শ করেনি বিম্পি-জামাত-সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক-আওয়ামীলীগ এই তিন তিনটা সরকার? এই সাত বছরের নিরাপদ তম্বির প্রাপ্তি কী?
ঠিকাছে। সোভিয়েত? না, তাও না। সোভিয়েত ঠিকমত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে নাস্তিকতা ছড়াতে পারেনি, তাই সাবেক সোভিয়েত রাজধানী পৃথিবীর সবচে বড় মুসলিমপ্রধান ইউরোপিয় রাজধানী। ইউরোপের সবচে বড় নামাজের জামাতগুলো খোদ মস্কোকে ব্যর্থতার প্রমাণস্বরূপ জ্বাজল্যমান করে। পাঁচ বছর? সমগ্র শক্তি নিয়ে ১৯২২-১৯৯১ এ যা করা হয়েছে তার ফলাফল এই?
তাহলে চীন? চীনের কোরান বেল্টের মানুষ কীভাবে মুসলিম আছে এবং কী পরিমাণে আছে তা বুক কাঁপায়। জিংজিয়াং, নিংজিয়া, গাঙসু, কুইঙহাই, তিব্বত ও মঙ্গোল অঞ্চলে যারা পারিবারিকভাবে মুসলিম ছিলেন তাঁরা এখনো তা-ই আছেন। সেখানে চীনের সকল টিভি, পত্রিকা, রেডিও, সার্চ ইঞ্জিন, বই, লেখক, প্রকাশনা ব্যর্থ। পাঁচ বছর তো দূরে, সত্তর বছরের কড়ানাড়া পৃথিবীর দ্বিতীয় অথবা প্রথম পরাশক্তি চীন, ওটাও সহি না?
মিসর, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, সোমালিয়া, ইয়েমেন, তানজানিয়া, আলজেরিয়া, সিরিয়া- এই চোদ্দটা মুসলিমপ্রধান দেশে ধর্মহীনতা সর্বশক্তি নিয়ে প্রবেশ করেছিল। এখনো এই চোদ্দটা দেশ মুসলিম জনসংখ্যা প্রধান দেশই আছে। সাবেক সোভিয়েতের সাতটা দেশে ধর্মহীনতার সমগ্র শিক্ষা সমগ্র শক্তি নিয়ে প্রবেশ করেছিল, তখন তো তখনি, এখনো সেগুলো মুসলিম জনসংখ্যা প্রধান দেশই আছে।
পাঁচ বছরে অর্ধেক মুসলিমকে ধর্মহীন করা আর দেশ থেকে চোদ্দশ বছরের সবকিছু ধুয়ে দেয়া?
শুধু শুধু আমরা বলি না, জগতে সবচে বেশি ব্রেনওয়াশড শ্রেণী হল দুটা, চরমপন্থী কমুনিস্ট আর চরমপন্থী জিহাদিস্ট। উভয়ের কোনও বাস্তব বোধ নেই, উভয়ে নিজ ধরনের মানুষকে হাওয়ায় ফুলানো বেলুন দেখায়, সেই বেলুনকে বড় করে পরিচয় করে দেয় ভবিষ্যত পৃথিবী হিসাবে। একটা সুঁইই এর জন্য যথেষ্ট।
সাহিত্য আর বাস্তবতা এক নয়। আবেগ আর বাস্তবতা এক নয়। সাহিত্য আর পরিসংখ্যান এক নয়। ফুঁ দিয়ে ফোলালে তা সুঁইয়ের ডগার কাছে টিকে থাকার সমান নিরাপত্তাও রাখে না, কারণ তা বেলুন হয়- যত বড়ই হোক। ফুঁ দিয়ে ফোলানো ১৪,০০ বছর লুপ্ত করার কথা উহু আহা করার মত কোন কথা না, বরং লজ্জার কথা।
গণিত কথা বলে। এই ধরনের মুখপাত্ররা বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের কথা বলা বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবে মানানসই। বাস্তব কথক হিসাবে কখনো নন।
বাংলাদেশের সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, সমস্ত টিভি-রেডিও-পত্রিকা-প্রকাশনা যদি সম্পূর্ণ নিরাপদে ধর্মহীনতার হাতে তুলে দেয়া হয় তাহলে একশো বছর পরও মুসলিম শতাংশ ৫% কমানো যাবে না। আবেগ থেকে বলছি না, অতীতের সারা পৃথিবীর রেকর্ড থেকে বলছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:১১