রাসূল দ.'র মহান শুভাগমনের মাস হয়ত এই সন্ধ্যায় শুরু হবে। হয়ত আগামীকাল সন্ধ্যায়। রাসূল দ.'র শুকরিয়া কী করে আদায় করি? তাঁর দ. দানের কৃতজ্ঞতা কীভাবে পূরণ করি? আল্লাহ বলেছেন তো কুরআনে, হে রাসূল দ. বলে দিন, তোমরা যদি আমার নবীত্বের ঋণ শোধ করতে চাও পারবে না, বরং কিছুটা চেষ্টা করতে পারো আমার নিকটজনের ভালবাসার মাধ্যমে। বুখারী শরীফে এটাও স্পষ্ট করা আছে, বলা আছে, এখানে কুরবা বা নিকটজন মানে হলেন আহলে বাইত। রাসূল দ.'র গৃহবাসীগণ। রাসূল দ.'র পরিবার ও বংশধরের ভালবাসা অনুসরণ ও কৃতজ্ঞতা। আহলে বাইত বা নবী পরিবার বিষয়ে নয় বরং রাসূল দ.'র শিক্ষার দুটা প্রধান উপজীব্য নিয়ে আমাদের আজকের এই কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপনমূলক পোস্ট।
জীবন প্রতিদিনের বেসিসেই চলবে। এই সহজ সূত্রটা রাসূলে পাক দ. আমাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, আমরা মাসলা মাসায়েলের ভিড়ে সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে বসে আছি।
যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন আমরা খাবার খাই।
যতদিন বাঁচি ততদিন প্রতিনিয়ত অক্সিজেন গ্রহণ করি।
পানি পান করি।
রাসূল দ. আল্লাহ্'র নির্দেশ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও তাই প্রতিদিনই জারি করেছেন।
এর কোনও ব্যতিক্রম নেই। যেমন কোনদিন ঘুমের ব্যত্যয় নেই, কোনদিন সূর্য বলে না, আজকে আর উঠব না, বা বিন্দুমাত্র বিশ্রাম ছাড়া কোনদিন মানুষ থাকতে পারে না, ঠিক তেমনি আল্লাহ্ বলেছেন কুরআনে, তোমরা নামাজে দায়েম ও কায়েম থাকো। অর্থাৎ সার্বক্ষণিক নামাজে রত থাকো।
পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ মাফ নেই, এর কোনও ব্যতিক্রম নেই ঈদে মিলাদুন্নবী দ., ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরাত, শবে ক্বদর বা শবে মিরাজে।
ডেইলি বেসিসের ধারণাটা যে পর্যন্ত একজন মানুষের ভিতরে গড়ে না উঠবে, সে পর্যন্ত তার প্রাণীসত্ত্বা থেকে উচ্চতর সত্ত্বায় উত্তরণ ঘটার সুযোগ কম।
যিঁনি সফল, তিঁনি তাই দৈনিক ভিত্তিতে সবকিছু করবেন।
প্রতিদিন বিশ্বাসকে কর্মের মাধ্যমে ঝালাই করা,
প্রতিদিন সুস্থ সুষ্ঠু খাবার,
প্রতিদিন প্রায়োগিক শারীরিক পরিশ্রম তথা ব্যায়াম,
প্রতিদিন নিয়মতান্ত্রিক ঘুম ও বিশ্রাম,
প্রতিদিন ধ্যান ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ- উন্নয়ন,
প্রতিদিন পজিটিভ মনোভাব ও কর্মপদ্ধতি
প্রতিদিন ঠিক করে শ্বাস নেয়া। এ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, সারা দেহের ৩% ব্রেন, টেনে নেয় ২৫% অক্সিজেন। ব্রেনকে কার্যকর রাখতে তাই শ্বাস পদ্ধতিগতভাবে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
প্রতিদিন শিখতে থাকা, প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা ও অনুশোচনা (তওবা) করা।
প্রতিদিন প্রতি কাজকে আদর্শ ও প্রমাণ মানের সাথে মিলিয়ে করা।
এবং, সবচে বড় কথা, প্রতিদিন কাজ করা।
বারো বছরের ধ্যানের যে গুণটুকু, সেটার অনেকটাই চলে যায় মাত্র বারো সপ্তাহ ধ্যান না করলে।
সেই কথারই অনুরণন আমরা পাই জুমার নামাজ তিনবার ইচ্ছা করে ছেড়ে দিলে কুফর হয়- এই কথার মধ্যে।
সারা বছরের ব্যায়াম মাত্র এক-দু মাসের পূর্ণ বিরতিতে শরীরকে করে তোলে প্রায় জড়বস্তু।
আর তিন যুগ কষ্ট করে যে সম্পদ-সম্বল মানুষ অর্জন করে, সেদিকে তিন সপ্তাহ না তাকানোই তা হারানোর জন্য যথেষ্ট।
আরো সহজ করেই নাহয় দেখি,
কোনও আহাম্মক কি বলবে, বহু তো শ্বাস নিলাম পঞ্চাশ বছর ধরে, এবার পঞ্চাশ মিনিট অক্সিজেন ছাড়া থাকতে চাই?
শ্বাস চালানো আর কাজ চালানো একই কথা।
হ্যা, এসব কাজ কম মানুষই করে। হ্যা, উচ্চতর সত্ত্বায় কম মানুষই যায়। হ্যা, সফল কম মানুষই হয়।
বহু ঘাস গজিয়েছে, বহু ঘাস পঁচে গেছে। সার হওয়া ছাড়া তার মধ্যে সারবস্তু আর কিছু ছিল না। তবু, সূর্য তার স্থিরতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা থেকে সরেনি।
নিজেকে একজন মানুষ হিসাবে চেনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা সাধারণত নিজেকে মানুষ হিসাবে চিনি না।
হয় আমরা নিজেকে অতিমানব-মহামানব-মহাঠিক-মহাসফল-মহাজ্ঞানী ভাবি অথবা আমরা নিজেকে মহা পাপী-মহা ব্যর্থ-মহা অলস ভাবি।
যখনি নিজের ভিতরের বিশ্বাসটা নিজেকে সাধারণ মানুষ হিসাবে চিনতে দেয় না, তখনি ভুলেরা টর্নেডো হয়ে, সুনামি হয়ে আমাদের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। আমাদের প্রাপ্তিকে, আমাদের সাফল্যকে অথবা আমাদের ভবিষ্যত প্রাপ্তি ও ভবিষ্যত সাফল্যকে একেবারে বালির সাথে মিশিয়ে ফেলে।
অর্জনকারীর জন্য একদিনের অহংকারই যথেষ্ট। ওভার কনফিডেন্স সব ধ্বসায় এবং মুহূর্তে ধ্বসায়। আর অর্জনহীন তো আসলে একই রাতে আটকে আছে। তার অর্জনহীনতার রাত কেটে সূর্য আজ পর্যন্ত ওঠেইনি।
নিজেকে সিম্পলি মানুষ ভাবতে হবে।
আমার এক হাজারটা ঠিক থাকতে পারে এবং একটা ভুল হতে পারে। যদি আমি হাজার দিন এই জানাটা রাখি, তাহলে আমার হাজার ভুলও ঠিক হতে থাকবে। জীবন আসলে একটা যাত্রা। জীবন থামে মরণ দিয়ে। তাই জীবনে কোথাও থামতে নেই। কেননা, জীবন থাকতে মরতে নেই। প্রতিনিয়ত নিয়মবদ্ধতাই জীবন।
আমরা মানুষ, আমরা ঠিক করব, ভুল করব, কিন্তু আমরা আর সাতশো কোটি মানুষের মতই মানুষ। এর বেশি কিছু না, এর কম কিছু না। সাতশো কোটি মানুষের প্রত্যেকেই মহামানবের বীজ যেমন নিয়ে আসে তেমনি দুনিয়া থেকে কুড়িয়ে নেয় মহা অভিশপ্তের বীজও।
আমরা যখনি জানছি, আমরা মানুষ, তখনি আমরা প্রত্যেক মানুষকে এবং নিজেকে পরিপূর্ণ সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছি। যে মাপতে জানে না, সে কিছুই জানে না।
আমরা যে মানুষ, আমরা যে ঠিক করতে পারি এবং ঠিক করলেও মরার আগ পর্যন্ত ঠিকটুকুই করে যেতে হবে- এই বাধ্যবাধকতা নিজের ভিতরে ফুটিয়ে তুলতে পারাই একমাত্র সাফল্য। আমরা মানুষ, আমরা সফল হয়ে থাকতে পারি এবং মরার আগ পর্যন্ত সফলতার মধ্যেই থাকতে হবে।
আত্মবিশ্বাস থাকবে এভারেস্টের চেয়েও উচু, কিন্তু জানতে হবে, আমরা এভারেস্ট নই, আমরা মানুষ। বিশ্বাস বাদেই আমরা এভারেস্টের চেয়ে উচু। আর এভারেস্ট তার জায়গায় অনড়, এক্ষেত্রে আমরা একটা ঘাসের চেয়েও সমস্যাপূর্ণ, কারণ ঘাসও নিজের জায়গায় স্থির। আমরা স্থির থাকতে পারি না, তাই যত বড়ই হই, স্থির থাকা এবং যদি সঠিক ক্ষেত্রে না থাকি তবে ধীরে ধীরে সঠিকে গিয়ে সেখানে স্থির থাকা আমাদের জন্য জরুরি।
স্থির থাকা মানে হল চর্চা চালিয়ে যাওয়া। বাঁশিওয়ালা বাঁশিতে স্থির থাকবে শুধুই বাঁশি বাজিয়ে। নামাজি প্রতিদিন নামাজ পড়ে। ধ্যানী প্রতিদিন ধ্যান করে। ভালবাসায় আহত প্রতিদিন ভালবেসেই ভালবাসাতে স্থির থাকতে পারে, অন্যভাবে নয়।
আর মানুষ যখন নিজেকে ও অন্যকে মানুষ ভাবতে শিখবে, তখন ভাঙবে সব দেয়াল। সাদা-কালোর দেয়াল, হিন্দু-মুসলিমের দেয়াল, ইহুদি-নাস্তিকের দেয়াল, মালিক-শ্রমিকের দেয়াল, ধনী-দরিদ্রের দেয়াল।
মানবতা তখনি প্রতিষ্ঠিত হবে যখন মানুষ জানবে যে সে মানুষ ছাড়া কিছু নয়।
আরে মানুষ তো নিজেকেই মানুষ জানে না, অন্যকে জানবে কী করে?
এ থেকেই তো সহজ সরল সত্যকে না বোঝার সূত্রপাত। এ থেকেই তো হাজারো ধর্ম, লক্ষ ফির্কা, কোটি ইন্টারপ্রিটেশন।
রাসূল দ. মানবজাতির জন্য এসেছেন। মানবজাতি এক জাতি। ভাষা রঙ আর বিশ্বাসের পার্থক্য মানবজাতিকে পৃথক করে না। যে বিশ্বাস করে না, তার কাছে সরল বিশ্বাস নিয়ে যাওয়া আর যে বিশ্বাস করে কিন্তু কর্ম করে না তার কাছে কর্ম নিয়ে যাওয়াটাই তো মানবতা নিয়ে সবার সাথে সুখে থাকার বাইরে একমাত্র করণীয়।
এই হল মধ্যপন্থা। এটাই রাসূল দ. শেখাতে চাইছিলেন। সঠিক মূল্যায়ন আমাদের দুর্বলতা বা সবলতাকে মাত্রার বাইরে যেতে দেয় না। মানুষ যখনি মানুষকে মানুষ ভাবে, তখনি সে মানুষের চোখে নিজেকে মাপতে পারে, এবং নিজের চোখে মানুষকে। তার আগে বা পরে নয়। প্রতিনিয়ত করণীয় পূর্ণ করাই সাফল্য।
আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না, রাসূল দ. তেইশ বছরের নুবুয়ত শেষ করে তার নির্যাস দিয়েছেন বিদায় হজ্বের ভাষণে। সেই ভাষণে মানুষকে তিনি মুসলিম, মুমিন, মুনাফিক, কাফির বলে ডাকেননি। মানুষকে তিনি মানুষ বলে ডেকেছেন। মানুষকে তিনি বলেছেন, যে তিনি মানুষের জন্য মানুষের কাছে এসেছিলেন। মানুষকে জানানোর জন্য। হায়, যারা মেনেছে তারাতো বিশ্বাসী ও মুসলিম নাম পেয়েছে, যারা মানেনি তারাও তো সেই মানুষই। তাঁকে মানার নাম করে মানুষ কেন শিয়া-সুন্নি কলহে লিপ্ত হবে, মুসলিম কাফির কলহে লিপ্ত হবে?
মুক্তিকে মানুষ কেন বদ্ধতায় রূপান্তর করবে? যে মেনেছে এবং যে মানেনি উভয়ের কাছে তো তিনিই এসেছেন। উভয়ের জন্যই তো তিনি এসেছেন।
তিনি রহমাতাল্লিল আলামীন। অর্থাৎ যত ভুবন আছে সকল ভুবনে আল্লাহর রহমত। ভুবনে মুসলিম কাফির নাস্তিক থাকবে- সকলের জন্যই তিনি রহমত। সকলের জন্যই তিনি রহমাতাল্লিল আলামীন। সকলের পথপ্রদর্শক।
তিনি বলেছেন, ইয়া আইয়ুহান না-স্! হে মানবজাতি!
তিনি বিধান দিয়েছেন আইয়ুহান না-স্ এর জন্য।
পথ দিয়েছেন আইয়ুহান না-স্ এর জন্য।
এই মানুষেরা আমরা তাঁর এই সরল বিষয়টাকে পাশ কাটিয়ে মানুষকে এত বেশি শ্রেণীবিভক্ত এবং এত বেশি জটিল করেছি যে, মানুষকে মানুষ হিসাবে সহজ অ্যাপ্রোচ না করে সবকিছু দিয়েছি ধ্বসিয়ে।
মানুষের রক্তপাতকে মানুষের জন্য হারাম করেছেন। মানুষের সম্পদ হরণকে মানুষের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। মূর্খতাকে পদপিষ্ট করতে তিনি এসেছেন। তিনি মূর্খতাকে পদপিষ্ট করেছেন। মূর্খতার যত দেয়াল যত ঘৃণা বিদ্বেষ জাত্যাভিমান সব বিনাশ করেছেন। মানুষে মানুষে ভেদকারী কৃত্রিম পদ পদবী সম্মান অহংকার তিনি করেছেন রহিত। মানুষ নিজে যা খাবে অধীন মানুষকে তাই খাওয়াবে। মানুষ নিজে যা পরবে অধীন মানুষকে তাই পরাবে। নারীকে পুরুষের উপর এবং পুরুষকে নারীর উপর ক্ষেত্রভিন্নে প্রাধান্য দিয়েছেন। পরম সতর্ক করেছেন নারীদের সাথে ভুল করার বিষয়ে।
সাদার উপর কালো ও কালোর উপর সাদার, আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব কৌলিন্য নেই।
মানবতার নবী মানবের নবী এ বাণী পৌছে দিতে বলেছেন। এজন্যই তিনি এসেছিলেন। মানুষের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৮