আমি কি আসলেই আমার করে কোনো কিছু কখনও পেয়েছিলাম, এই একটা প্রশ্নই সব থেকে বেশি খেলা করে আদিত্যের মাথায়। জীবন কি এতটাই কঠিন যতটা আমার চোখে। শব্দ গুলো কি এতটাই দুর্ভোদ্য যতটা আমি ভাবি। অর্থের খোজেই এত পথ পারি দিয়েছি জীবনে। বস্তুগত আর অবস্তুগত অর্থ এ দুটোর মাঝে পার্থক্য তৈরী করতে পারছিনা বলেই কি এত কঠিন মনে হচ্ছে সব কিছু। অনেক বার আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার নিজের সাথে নিজেই বাহাস করে পরাজিত হয়ে তার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে হয়েছে বারবার আদিত্যকে।
তেইশের প্রথম প্রহর আদিত্যের। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজকের রাতটাই শেষ রাত হবে আদিত্যের জীবনের। বিমান বন্দর রেল স্টেশনের একটু আগে একটা ফাকা জায়গা দেখে রেল লাইনের পাশে বসে আছে সে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে এখানটাতেই রেল লাইনের উপর মাথা দিয়ে তার জীবনের শেষ নিদ্রায় শায়িত হবে আদিত্য। পর পর তিনটা ট্রেন চলে গেলো কিন্তু কিছুতেই আদিত্য ট্রেনের লাইনে মাথা দিয়ে নিদ্রার প্রস্তুতি নিতে পারছে না। বারবার চৌদ্দ,ষোল কিংবা আঠারো ফিরে আসছে। তাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করছে। আদ্যিত্য চৌদ্দ,ষোল কিংবা আঠারোর কাচে যে অনেক পাবে। সে মারা গেলে এই পাওনা আদায় করার মতোও যে কেউ অবশিষ্ট থাকবে না আর। প্রচুর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলেও গভীর চিন্তায় মগ্ন হলে আদিত্য সিগারেট খেতে পারে না। তার চিন্তা দূর করার কৌশলটাও অন্য সবার থেকে আলাদা। চিন্তাগ্রস্ত হলে কাগজ ছিড়ে টুকরো টুকরো করে বাতাসে ওড়াতে ভালোবাসে আদিত্য। এই রেললাইনের পাশে কোথাও কাগজ পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই, দু একটা বৃষ্টিতে ভিজে মাটিতে মিশে যাওয়া সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া গেলেও সেগুলো ছিড়ে টুকরো করার মতো অবস্থায় নেই আর সিগারেটও প্যাকেটে রাখে না আদিত্য। তার প্রিয় মানুষের দেয়া শেষ উপহার সিগারেট বক্সটা হাতে নিয়ে চিন্তা করছে আদিত্য কি ছেড়া যায়। না হলে যে হিসেব মেলাতে মেলাতে সকাল হয়ে যাবে।
নিজের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করলো আদিত্য যদি মানিব্যাগে ছেড়ার মতো কোন কাগজ পাওয়া যায়। মানিব্যাগে একটা ভিজিটিং কার্ডও খুজে পেলো না আদিত্য। পুরোনো হয়ে যাওয়া ছেড়া মানিব্যাগটার দিকে গভীর ধ্যানে তাকিয়ে আছে আদিত্য, ছেড়ার মতো যে একটা কাগজ খুজে পাওয়া গিয়েছে সেটাও একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি। ফাল্গুনের পূর্ণিমার জ্বলমলে আলো থাকলেও গাছের আবছা ছায়ায় ছবিটা বেশ চেনা চেনাই মনেই হলো আদিত্যের। তার চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই এই ছবিটা মানিব্যাগে বহন করে চলছে আদিত্য। মানিব্যাগ পরিবর্তিত হলেও ছবিটা বদল হয়নি। এস এস সির সময়ে স্কুলে জমা দেয়া আদিত্যের মায়ের ছবি এটা। এসএসসির পরে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলো, যেদিন ফিরে এসেছিলো সেদিন চৌদ্দ পূর্ণ হয়েছিলো আদিত্যের। ফিরে এসে তার মাকে আর বাসায় পায়নি আদিত্য। তাদের বাসার নীচের ভাড়াটিয়া ম্যানেজারের সাথে তার মা চলে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। অনেক বছর ধরে মানি ব্যাগে বয়ে বেড়ালেও কোনদিনই ভালোভাবে দেখা হয়নি ছবিটা আদিত্যের। জোস্নার আবছা আলোতে নিজের মাকেই বেশ অচেনা মনে হচ্ছে আদিত্যের। মা ডাকটা ভুলেই গিয়েছে আদিত্য। একদৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে আদিত্য, চৌদ্দের হিসেব মেলাতে হলে যে মায়ের সাথেও একটা হিসেব মেলাতে হবে আদিত্যের। পরীক্ষার ফলাফলে গোল্ডেন এ প্লাস আসলেও ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারেনি সে। মফস্বলের কলেজ থেকেই এইচএসসি শেষ করেছিলো। মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আদিত্য নিজেকে খুজছে। পরিবারের সবার আদরের আদিত্য কতবছর হয়ে গেলো একরকমের পরিবার ছাড়াই। তার মা চলে যাওয়ার বছর খানেক পরে তার বাবাও আর একটা বিয়ে করে। তার পরেই আদিত্যের জীবনের কঠিনতম দিন গুলোর শুরু হয়। তার ফুফুর সহযোগিতায় কোন মতে বিস্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আদিত্য টিউশনি করে করে বিশ্ববিদ্যালয়ও পাশ করে ফেলেছে। আজ ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরেই রেল লাইন ধরে হেটে হেটে এখানটায় চলে এসেছে আদিত্য। জীবনের সাথে সংগ্রাম করতে আর ভালো লাগছে না তার।
হাত ঘড়ি জানান দিলো রাত দুইটা পার হয়েছে। তেইশের প্রথম রাত। সেলফোনটার সুইচও অফ করা। হয়তো অনেকেই তাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানিয়েছে। আদিত্যের কাছে সেই সব ভার্চুয়ালিটির কোন মূল্যই নেই। একুশের দিকে অধীর আগ্রহ নিয়েই জন্মতিথির প্রথম রজনীতে সেলফোনের ধরে অপেক্ষা করতো আদিত্য কখন তার সেলফোনে তার প্রেয়সীর শুভ কামনার বার্তা আসবে। একুশের সেই রাতেই আদিত্যের শ্রেয়ষী দেশ ছেড়ে বিদেশে পারি জমিয়েছিলো। আর দেখা হয় নি আদিত্যের সাথে তার, এমনকি কথাও হয়নি কোনদিন। বাম হাতে ধরে রাখা ছবিটার দিকে এখনও তাকিয়ে আছে আদিত্য। মা মা বলে ডাকতে খুব ইচ্ছে করলেও প্রবল একটা ঘৃনার রেশ আদিত্যের ইচ্ছাশক্তিকে দমন করে দিচ্ছে বারবার। পৃথিবীকে ছেড়ে যাওয়ার আগে আদিত্য পৃথিবীর তার কাছে কি কি পাওনা থাকতে পারে সে হিসেবটা আর একবার দেখে নিতে চাচ্ছে। পৃথিবীর হয়তো ইচ্ছে ছিলো আদিত্য বড় প্রকৌশলী হবে, নতুন নতুন আবিষ্কারে পৃথিবীর গতিকে আরও গতিময় করে তুলবে। নোবেল কিংবা ব্রিটিনিকার লোভ তো তাকে দেখিয়েছিলো পৃথিবী, তাকে বাসযোগ্য একটা আবাস স্থলও দিয়েছিলো। তাহলে কোন অধিকারে পৃথিবীর পাওনা শোধ না করে গ্রহ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আদিত্য। সেই প্রশ্নটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আদিত্যের। কিন্তু আদিত্যেরও যে পৃথিবীর কাছে অনেক পাওনা ছিলো। পৃথিবী হয়তো অনেক গুলো বিকেল নির্মলতায় ভরিয়ে দিতে বাতাস দিয়েছে কিন্তু তার রাতগুলোকে যে কেড়ে নিয়েছিলো তার কাছে থেকে।
রাত তিনটা ঘড়ি আর একবার জানান দিলো। এর মধ্যে আরও দুই তিনটা ট্রেন চলে গিয়েছে। চিন্তা বেড়েই চলছে। কাগজ ছেড়া দরকার জরুরী ভাবেই। চিন্তাগুলো মাথায় জমাট বাধতে শুরু করেছে, নিউরনের ছোটাছুটিও বেড়ে গিয়েছে। ছোট বেলা থেকেই মাথায় একটা টিউমার বয়ে বেড়াচ্ছে যে সে। যেটা নিউরনের ছোটাছুটিকে বাধাগ্রস্ত করে মাঝে মাঝে তাকে অবচেতন করে দেয়। তাই চিন্তা দূর করা জরুরী। মায়ের ছবিটা এখনও হাতেই ধরা আদিত্যের, হাতের কাছে ছেড়ার মতো কাগজ বলতে ফটো পেপারের এই ছবিটাই অবশিষ্ট রয়েছে। আচ্ছা মারা যাওয়ার পর যদি দেখা যায় বিজ্ঞানকে উল্টোপিঠ দেখিয়ে সৃষ্টিকর্তা তার কৃত কর্মের হিসেব নিতে চলে এসেছে। তখন কি জবাব দিবে, সেটাও ঠিক করে নিতে চায় সে। এটা ভাবতে গিয়ে সাহস বেড়ে গেলো আদিত্যের বরং সে নিজেই প্রশ্ন করে সৃষ্টিকর্তাকে কুপোকাত করে দিবে। যদি চিরায়ত সুখ বন্টনে এতই বৈষম্য থাকে তোমার তবে সৃষ্টি করেছিলে কেনো? যদি তুমিই সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে থাকো তবে শ্রেনী বৈষম্য করেছিলে কেনো? প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় বিশ্ব সবই যদি তোমার সৃষ্টি হয় তবে বৈষম্য তৈরী করেছিলে কেনো? আর যদি তাকে সৃষ্টিকর্তা তার অর্পিত দায়িত্বের হিসেব দিতে বলে তখন কি বলবে সে সেটা নিয়ে কিছুক্ষন চিন্তায় পরে গেলেও পরে ভাবে বলবে আমি তো তোমার সব ইবাদতই করতাম কিন্তু আমার উপর থেকে তুমি চোখ সরিয়ে নেয়ায় আমিও তোমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যদি জানতে চায় আমি তোমাকে সুন্দর পরিপূর্ণ একটা পৃথিবী দিয়েছিলাম তুমি সেই পৃথিবীকে কি দিয়েছিলে?
মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে আদিত্য। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আজ। মনে পরছে আগে তার জন্মদিনে কত উৎসব হতো তাদের বাসায়। রাত প্রায় সাড়ে তিনটা, আচ্ছা সে যদি তেইশেই চলে যায় তাহলে তার কাছে যে পৃথিবীর অনেক বকেয়া থেকে যাবে। চৌদ্দ,আঠারো কিংবা একুশের জন্য হয়তো ওপারে যদি কেউ থেকেও থাকেন তাকে বুঝ দেয়া যাবে কিন্তু পচিশ,ত্রিশ,চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশের ঋণ আদিত্য কিভাবে শোধ করবে? আকাশের চাঁদটা আদিত্যের কাছ থেকে ছুটি প্রার্থনা করছে। কিন্তু আদিত্যের কাছে চাঁদটা এখন অনেক ভালো লাগতে শুরু করছে। আরও একবার সিদ্ধান্তটা বদল করলো আদিত্য। তাকে বেঁচে থাকতে হবে অনেক বছর। চৌদ্দ,আঠারো,একুশের শোধ নিতে হবে; ত্রিশ,চল্লিশ,পঞ্চাশের দায় মেটাতে হবে। তেইশের প্রথম সকাল থেকেই জীবনটাকে নতুন করে শুরু করতে হবে আদিত্যের। মায়ের ছবিটা এখনো বাম হাতে ধরা আদিত্যের। বক্স থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালালো আদিত্য। মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে, রেল লাইনের পাশে বসে সিগারেট খাচ্ছে আদিত্য।আজ চিন্তার সময় একটা কাগজও ছেড়া হয় নি মাথা ব্যাথাটা বেড়ে গিয়েছে অনেক। আদিত্যের ডান হাতে সিগারেট, বাম হাতে মায়ের ছবিটা। হুইসেল বাজিয়ে রাতের শেষ ট্রেন আসছে।এই ট্রেনটা চলে গেলেই হলে ফিরে যাবে আদিত্য। হঠাৎই সব কিছু অন্ধকার মনে হলো আদিত্যের কাছে। মাথা ঘুরিয়ে রেললাইনের উপর পরে গেল সে। ট্রেনের হুইসেল প্রবল শব্দে খুব দ্রুতই নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। রেল লাইন থেকে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে আদিত্য। কিন্তু সেই শক্তিটা সে পাচ্ছে না। হেল্প হেল্প বলে আদিত্যের চিৎকার কোথাও প্রতিফলিত না হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। কেবল মাত্র আদিত্যের শেষ চিৎকার মা......মা...... প্রতিফলিত হয়ে বার বার প্রতিধ্বনিত হলো পৃথিবীর বুকে।
তেইশের প্রথম প্রহরেই সংবাদে প্রচারিত হতে থাকলো “রেল লাইনে অজ্ঞাতনামা তরুনের আত্নহুতি” । বিমান বন্দর রেল ষ্টেসনের কিছুটা আগে বাম হাতে এক মহিলারর ছবি আর ডান হাতে সিগারেট সহ এক অজ্ঞাতনামা তরুনের লাশ পাওয়া গিয়েছে। মুখমন্ডল সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় লাশ সনাক্ত করা যাচ্ছে না। পুলিশ মামলাটিকে আত্নহত্যা হিসেবেই প্রাথমিকভাবে নথিভুক্ত করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৫ রাত ২:২২