শাহাবুদ্দিনের বাবা আজ আমাকে আবারও ফোন দিয়েছে।
লোকটাকে সিন্দাবাদের দৈত্য বলা হলে কম হবে। সে আমার ঘাড়ে চেপে বসে বছর সাতেক আগে। আমি তখন যুগান্তরে চাকরি করি। আমার চাকরি দিনে দুইবার করে যাচ্ছে, কোন রকমে ঠেক দিয়ে রাখছি। এমন সংকটময় সময়ে লোকটি এসে হাজির। সাথে চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে। ছেলের নাম শাহাবুদ্দিন। এরা আমার সাহায্য প্রার্থী। আমার চরম মেজাজ খারাপ হলো; নিজেরই দিন চলে না, অন্যকে সাহায্য করবো কীভাবে।
তারপরও ভদ্রতার খাতিরে ওদের বৃত্তান্ত শুনতে হল। শাহাবুদ্দিনের থ্যালাসিমিয়া হয়েছে। সাহায্যের ধরণ দুটি ১. এই ছেলেকে নিয়মিত কয়েক ব্যাগ করে রক্ত জোগাঢ় করে দিতে হবে। ২. এই চিকিৎসায় ম্যালা খরচ, সেই খরচের টাকাটাও জোগাতে হবে। দাবি দুটি জানিয়ে শাহাবুদ্দিনের বাবা দাঁত বের করে হাসলো। এরপর কপালের ঘাম মুছলো। এই ভর দুপুরবেলায় পিজি হাসপাতাল থেকে মতিঝিল অব্দি উনি হেঁটে এসেছেন। কপালসহ সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। শাহাবুদ্দিনের চেহারা লাল হয়ে গেছে রোদে। পৃথিবীর প্রতিটি শিশুই সুন্দর। তবুও শাহাবুদ্দিনের চেহারায় বাড়তি সৌন্দর্য্য রয়েছে। কেন কে জানে ?
আমি আরেকটু ভদ্রতা করতে গিয়ে নিজের বিপদ আরও বাড়িয়ে তুললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, দুপুরে কিছু খাইছেন ?
শাহাবুদ্দিনের বাবা আবারও হাসলো। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্বোধ মানুষও এই হাসির অনুবাদ সহজে করে নিতে পারবে। মেজাজ আবারও খারাপ হলো। শালা!!! নিজেরই দুপুরে খাওয়ার টাকা নাই। তারপরও ওদেরকে দোকানে নিয়ে কলা, রুটি, চা খাওয়ালাম। শাহাবুদ্দিনের বাবা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন, আড়ালে গিয়ে একটা বিড়িও ধরালেন।
এই শাহাবুদ্দিনের বাবার জন্য, তার ছেলে শাহাবুদ্দিনের জন্য এবং ওদের দুইজনের বোকা বোকা হাসির জন্য আমাকে অনেক কেশ স্বীকার করতে হয়েছে। অন্যের কাছে টাকা ধার চাওয়ার একটি বাজে অভ্যাস আমার আগে থাকতেই ছিল, মাসের শেষের দিকে পরিচিত জনেরা আমার ফোন ধরতে চাইতেন না পাছে আমি তাদের কাছে টাকা ধার চেয়ে বসি। তাদের জন্য বাড়তি উপদ্রব যুক্ত হল, আমার নতুন আব্দার- একটা বাচ্চাকে বাঁচাতে কিছু টাকা প্রয়োজন। এই টাকা ধার নয়, সাহায্য হিসেবে নিচ্ছি।
আমার পরিচিত জনেরা আমার ব্যাপারে আরও সতর্ক হয়ে গেলেন। রবি এখন নতুন ধান্ধায় নেমেছে। ইস্ ছেলেটা কত ভালো ছিল, অভাবে স্বভাব নষ্ঠ। আমার স্বভাব আসলেই নষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটা টাকার জন্য ডিপার্টমেন্টের টিচার থেকে শুরু করে হঠাৎ পরিচিত কোনও কন্ট্রিবিউটর কাউকে আমি রেহাই দেইনি। নানান ভনিতা করে শুরু করতাম এইভাবে... একটা ছেলে, ফেরেশতার মতো চেহারা। বুঝলেন, দেখলেই আপনার মায়া লাগবে। ছেলেটা বেশিদিন বাঁচবে না। একবার ভাবুন, আপনার যদি এমন একটা ছেলে থাকতো ... আপনি জাস্ট কয়েকটা টাকা দ্যান, দুই, চার , দশ যাই পারেন ....
মানুষজন নির্দয় নয় ....তারা দিতো ...
কার কাছে না রক্ত চেয়েছি। বাঁধন, রেডক্রস এমনকি আমার দেমাগী খালা শাশুড়ির কাছেও। আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল যেদিন দেখেছিলাম যে খালা শাশুড়ি ঘৃণায় আমার সাথে কথা বলেন না, তিনিও দুই বান্ধবী নিয়ে রক্ত দিতে নির্দিষ্ট দিনে পিজি হাসপাতালে চলে এসেছেন।
একবার টাকা দিতে দেরি হয়েছিল দেখে পিজির ডাক্তার ভর্তি করাবেন না। আমি গেছি তার সাথে তর্ক করতে। উনি আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে উনার রুম থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
আমার মাঝে মাঝে শাহাবুদ্দিনের বাবার উপর রাগ হতো। কী কুক্ষণেই না এই লোকটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। উনাদের বাড়ি কুমিল্লা। চিকিৎসা নিয়ে কুমিল্লা চলে যেতেন। উনি যেদিন পুত্রকে নিয়ে বাড়ি চলে যেতেন, সেদিন খুব আনন্দ লাগতো। যাক আপদ বিদেয় হল। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হতো না ... মাস না যেতে আবার ফোন, ভাইজান আমি অহন ডাকায়, শাহাবুদ্দিনের শইল খুব খারাপ ... ডাকতার রক্ত দিতে কইছে ... কিছু টেস্টও কইরতে অইবো .... আর কিছু ওষুধ ....
উহ্ এইভাবে আর কয়দিন ।
পাঁচ পাঁচটা বছর এভাবে কাটার পর ... একদিন শাহাবুদ্দিনের বাবা আর রক্ত চাইলেন না .... খুব খুশি ...ডাক্তার কইছে অসুখ ভালো হইয়া গেছে ... আমি ছুটে গেলাম পিজিতে ...রিপোর্ট দেখে কিছুই বুঝলাম না ... লেখা থ্যালাসিমিয়া ট্রেট বা এই জাতীয় কিছু ...... ডাক্তাররা বললেন, আপাতত সেফ ...রক্ত কয়েকদিন না দিলেও চলবে ....দুইমাস পরে এসে আবারও পরীক্ষা করে দেখতে হবে কন্ডিশন কী ...
মাঝে টানা এক বছর খুব ভালো ছিলাম। শাহাবুদ্দিনের বাবা আর ফোনটোন দিতেন না ....
ইদানীং হঠাৎ করে আবার ফোন দেয়া শুরু করেছেন ... শাহাবুদ্দিনের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ...শাহাবুদ্দিনের মায়ের বুকে ক্যান্সার ধরা পড়েছে ...সারা রাত যন্ত্রণায় ছটফট করে ... আর বলে আমি আর পারতাছি না .... আমারে একটু বিষ আইনা দাও ...
শাহাবুদ্দিনের বাবা কেন তাকে বিষ এনে দ্যাননি, এটা আমি জানিনা। বিষ এনে দেবার বদলে উনি তাকে এনে ঢাকা মেডিকেলে শুইয়ে রেখেছেন ... ঢাকার মানুষদের উপর উনার অনেক ভরসা ... বাংলাদেশের মানুষদের উপর উনার অনেক ভরসা ...
যারা শাহাবুদ্দিনের বাবার দুভার্গ্যের সাথে নিজেকে জড়াতে চান ... তারা সরাসরি যোগাযোগ করে দেখতে পারেন ... এটা শাহাবুদ্দিনের বাবার মোবাইল নাম্বার .....০১৭৩ ২৫৫ ১১৪৯
(রিপোস্ট)