somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রমিক বাঁচলে শিল্প বাঁচবে, শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে....শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শ্রমিক বাঁচলে শিল্প বাঁচবে, শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে....শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী।

শ্রমিক আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তী, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের লড়াকু বিপ্লবী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, কমরেড সহিদুল্লাহ চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ হয়ে বারডেম হাসপাতালের ১৪০৩ কেবিনে ভর্তি রয়েছেন। তার সুস্থতা কামনা করছি।

সহিদুল্লাহ চৌধুরী
(তাঁর নিজের ভাষায় জীবন বৃত্তান্ত)

আমাদের বাড়িটা ছিল তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার নবীনগর থানার কনিকারা গ্রামে। এখন যেটা কুমিল্লা। তৎকালীন ত্রিপুরা ও পার্বত্য ত্রিপুরা নিয়ে ছিল ত্রিপুরা রাজ্য। এখন যেমন চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। আমরা ছিলাম ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে আর ত্রিপুরার বড় অংশ আগরতলার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৪২ সালের ২ জানুয়ারি আমার জন্ম হয় কনিকারা গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী ধারার এক জমিদার পরিবারে। নামের শেষে চৌধুরীটা এসেছে ওখান থেকেই।
আমার বাবার নাম আরোজ আলী চৌধুরী। মায়ের নাম নূরজাহান বেগম। আমরা ছিলাম দুই বোন, চার ভাই। জমিদারি ঠিক আমার বাবার ছিল না। এটা ছিল আমাদের বংশেরই। আমার চাচারা জমিদার ছিলেন। বাবা ছিলেন জমিদারির তহসিলদার। তহসিলদাররা জমিদারের খাজনার হিসাব রাখত। আমার দুই মা ছিল। আমার প্রথম মা খুব অভিজাত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। প্রথম মেয়ে সন্তানের পর আর কোনো সন্তান না হওয়ায় বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেটা বড় বোনের জন্মের প্রায় ৩০ বছর পর, বাবার ৬০ বছর বয়সে। সেখানে আমরা চার ভাই দুই বোন। আমার যখন জন্ম তখন আমার পিতার বয়স ৬৫। আর বড় বোনের বয়স তখন ৪০ এর মতো হবে। ভাই-বোনদের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়।

আমার যখন জন্ম তখন আমাদের পরিবারের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল হলে প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবারের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সময় আমাদের অধিকাংশ জমিজমা বাজেয়াপ্ত করা হয়।
আমাদের বাড়ি পাকা ছিল না, কাঁচা ঘর ছিল। ছন দিয়ে তৈরি অনেক বড় ছিল ঘর। আমার চাচাদের টিনের ঘর ছিল। কিন্তু আমি যে ঘরে জন্মেছি সেটা ছনের ঘর ছিল। ছনের ঘর অনেক আরামদায়ক বিধায় জমিদারদের এ ধরনের একটা বাড়ি থাকার রেওয়াজ ছিল তখন। অনেক বড় বড় ঘর ছিল তাতে। এক বাড়িতে চার পাঁচটা ঘর থাকতো।
জমিদারি প্রথা বাতিল হলে আমাদের অনেক খাসজমি মানুষ দখল করে নিয়েছিল। আমার যখন জন্ম তখন বাবার শেষ বয়স। জমিদারি প্রথা বাতিলের দরুন তহসিলদারী নাই। শূন্যের উপর দাঁড়িয়েছিল পরিবার। ব্যবসাও দাঁড়ায় না। চাকরিও করত না পরিবারের কেউ। জমিদাররা তো পরজীবী শ্রেণী ছিল। ফলে আমাদের পরিবারও পরজীবী হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বাবা এনট্রান্স পাস ছিল কিন্তু আমরা তার ছেলেরা কেউ ম্যাট্রিক বা ইনটার পাসও করি নাই। এক হতাশাজনক অবস্থার মধ্যে আমাদের পরিবার তখন এগুতে থাকে। কিছু দিনের মধ্যে সর্বহারা বলতে যা বুঝায় সেই অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম আমরা।
আমার মা পারিবারিকভাবে অনেক ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলেন। মা দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। মাকে বিয়ে করার জন্য বাবা বিশ শতক জমি দিয়েছিলেন। আরো চার বিঘা জমি দিয়ে দিয়েছিলেন মামাদেরকে। আর আমরা জন্মের পর দেখলাম আমাদের জায়গা-জমি বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে ওই অল্প বয়স থেকেই আমাদের সংগ্রামী হতে হয়েছিল।

শুরু নাই, শেষ আছে। প্রাইমারির পাঠ চুকিয়ে আর পড়ালেখা হয়নি আমার। যা পড়েছি ওই গ্রামের স্কুলেই। আমাদের পুরনো জমিদার বাড়িটাই ছিল প্রাইমারি স্কুল। ঐ সময় স্কুলের শিক্ষক বলতে আমার চাচাই ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। পুরাতন বাড়িতে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় ওই বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে আমরা চলে আসি। দুটো বাড়ি পাশাপাশিই ছিল।
আমাদের গ্রাম ছিল অনেক বড়। কৃষক, ক্ষেতমজুর, কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ছিল। এদের ছেলেমেয়েরাই পড়ত। পুরো এলাকাটা ছিল হাওর অঞ্চল। প্রচুর জমি। বিরাট মাঠ। নিচু জমি হওয়ায় তেমন একটা ফসল হতো না। ভাসা পানিতে যে আমন হতো সেটাই ছিল সারা বছরের ফসল। এখনকার মতো এত ধানের জাত ছিল না। কোনো বছর ধান পাওয়া যেত। কোনো বছর অবস্থা খুব খারাপ হতো।
১৯৪৭ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসল। আমি তখন বেড়ে উঠছি আমাদের সেই গ্রামের বাড়িতেই। ১৫-১৬ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। ছেলেবেলা থেকেই, সেই ৫-৬ বছর বয়স থেকে আমি সভা-সমিতিতে যেতাম। ৮-৯ বছর বয়সের দিকে রাজনীতিতে প্রবেশ করি। ৫৪ সালে আমার বয়স ১২। তখন তরুণ বয়স। আমি নির্বাচনে অংশ নিই কর্মী হিসেবে। যুক্তফ্রন্টের হয়ে নৌকা মার্কার পক্ষে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করি।
আমার চাচাত ভাইও আওয়ামী লীগ করত। সমর্থক ধরনের। সক্রিয় ছিলেন কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো সভা বা কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিতে দেখি নাই। তার নাম ছিল আশরাফ আলী চৌধুরী। তার মাধ্যমেই প্রথম রাজনীতির দিকে পা বাড়াই। ভাই ও তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলেই ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করি।
ওই সময় আমাদের এলাকায় জাতীয় নেতাদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেব যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারাভিযানে গিয়েছিলেন। প্লেন থেকে তাকে আমরা নামতে দেখি। তখন বর্ষাকাল ছিল। কাদা পানির মধ্য দিয়ে সভা করে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ভোট চেয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমি দূর থেকে দেখেছিলাম। আমার আগ্রহের জায়গাটাতে ছিলেন মওলানা ভাসানী। বড় নেতা এলাকায় আসবে শুনে আমি উৎফুল্ল ছিলাম। কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম ভাসানিকে না দেখতে পেয়ে।

বেশি কিছু বুঝতাম না। তবে অনেক কিছুই শুনতাম। আগ্রহ ছিল খুব। গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িটা ছিল আড্ডার কেন্দ্র। এই বাড়ির লোকেরা ছিল সব বেকার। বাপ চাচারা কোনো কাজ করত না। না ব্যবসা, না চাকরি। বসে বসে গল্পগুজব করতেন, অল্পস্বল্প লেখাপড়া। সন্ধ্যার পর পাড়ার লোকজন আমাদের বাড়িতে আসত। এসব কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা করার জন্য যে, কলকাতার কি হলো! যুক্তফ্রন্টের কি অবস্থা এসব রাজনৈতিক বিষয়ই ছিল আলোচনার বিষয়। সেখান থেকেই আমার জানাশোনা।
যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ ছিল বিপুল। যুক্তফ্রন্ট মানুষের কল্যাণের কথা বলত। কিন্তু সমস্যা বাধল যখন যুক্তফ্রন্টের দুজন প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেল। একজন নেজামে ইসলামির পক্ষে পীর মোসলেহ উদ্দিন। আমাদের গ্রামের পীরবাড়ির পীর ছিলেন তিনি। তিনি সম্ভবত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর পূর্বপুরুষ ছিলেন। আর আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলেন রফিকুল ইসলাম। মজাটা এখানেই। যে মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীর প্রতিযোগিতা হবার কথা তা কিন্তু হয়নি। প্রতিযোগিতা হলো, যুক্তফ্রন্টের দুই প্রার্থীর মাঝে। অথচ স্লোগান দিচ্ছে সবাই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে।
আমাদের গ্রামে ধর্মান্ধরা নেজামী ইসলাম পক্ষে ছিলেন। গ্রামের মধ্যে যারা একটু প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা করতেন তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিল। কিন্তু মুসলিম লীগের পক্ষে কেউ থাকল না। মানুষ অনেক আশা-ভরসা করে যুক্তফ্রন্টকে নির্বাচিত করেছিল। ১৪ দফা দাবি ও আরো অনেক কিছু মিলিয়ে যুক্তফ্রন্টের উপর মানুষের আশা-ভরসা তৈরি হয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের জয় মানুষকে হতাশার মাঝে ফেলেছিল। কারণ সরকার টিকতে পারছিল না। কিছুদিন একজনের নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলে তো আবার ভেঙে যায়। মানুষের মাঝে হতাশা বাড়তে থাকল।
৫৫ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হলো। এরপর মওলানা ভাসানীর ডাকে হলো কাগমারী সম্মেলন। ওই কাউন্সিলের সময় অনেক বয়স্ক ও শিক্ষিত লোকজনকে ডিঙিয়ে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সদস্য সংগ্রহের কাজে ছিলাম আমি। গ্রামের মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্য সংগ্রহ করতে লাগলাম। এতে করে গ্রামের মধ্যে ধীরে ধীরে আমার একটা রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে উঠতে লাগল। এর মধ্যে আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়ে নিল। তখন আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হলাম।

মার্শাল ল’ হয়েছিল তো। গ্রামে আমি যেহেতু রাজনৈতিকভাবে পরিচিত হয়ে গেছি তাই মার্শাল ল’ হবার পর এক ধরনের ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন ওই প্রেক্ষাপটে গ্রামের গুরুজনদের চাপেই ঢাকা চলে আসতে বাধ্য হই। অক্টোবর মাসে আমি একাই ঢাকা চলে আসলাম। আমার আপন বড় ভাই আব্দুল মালেক চৌধুরী ডেমরাতে থাকতেন। তিনি বাওয়ানী জুটমিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। পারিবারিক অবস্থা সামাল দিতে তিনি ঢাকা এসে কাজে যোগ দিয়েছিলেন অনেক আগেই।
ঢাকায় আসার পর ২-৩ বছর কোনো কাজ করি নাই। ঢাকায় এসে যখন ভাইয়ের কাছে গেলাম তখনও আমার কাজকর্মের বয়স হয়নি। আমার কাজ করার পক্ষে মত ছিল না ভাইয়ের। আমাকে বাড়ি যেতে বলল। কিন্তু আমি গেলাম না। গ্রামের ছেলেরা ছিল। তাদের সঙ্গে থেকে গেলাম। তাদের সঙ্গে থেকে হকারি করলাম। হকারি করে পানের জর্দা বিক্রি করতাম। কারখানা ছিল যাত্রাবাড়ী। আমাদের গ্রামের এক লোকেরই কারখানা ছিল ওটা। হকারি করে নিজে একপর্যায়ে শিখে ফেললাম জর্দা বানানোর কৌশল। এরপর নিজেই কারখানা করলাম। যা তৈরি করতাম তা আবার নিজেই বিক্রি করতাম। দাম খুব কম ছিল। একআনা দুইআনা। সমস্যা ছিল আমি বিক্রি করতে পারতাম কিন্তু বাকি টাকা উঠাতে পারতাম না। টাকা বাকি পড়ে থাকায় অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। সেই সময় একটা কাজ হয়েছিল। ব্যবসা সূত্রে জর্দা সাপ্লাই দিতে দেশের বিভিন্ন জেলা ঘোরার সুযোগ পেলাম। তখন প্রায় দেশের সব বড় জেলা যেমন- পাবনা, বগুড়া, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, সবখানেই গিয়েছিলাম। এরপর বাকি বাট্টার কারণে আর ব্যবসা বেশিদিন চালানো গেল না।


হ্যাঁ, বলছি। ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পর ৬২ সালে আবার ভাইয়ের কাছে যাই কাজের জন্য। তখন তাঁতি হিসেবে ঢুকলাম বাওয়ানী জুটমিলে। চার পাঁচদিন কাজ শেখার পরে, আমাকে বলা হলো কাজ পারব কিনা? আমি তখনও কাজটা ভালো শিখতে পারিনি। ডাইংয়ে পাঠাল পরীক্ষা দিতে। সুতা ছিঁড়ে জোড়া দিতে বলল সুপারভাইজার। কিন্তু আমি পারলাম না। আবার দুই চারদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে পরীক্ষা দিলাম। তখন আমাকে তাঁতি হিসেবে নিল।
তখন মাসিক বেতন ছিল ৩০-৩৫ টাকা। আমি অক্টোবরে কাজে ঢুকলাম, ঢোকার চার মাসের মাথায় এক বীভৎস্য ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ৬৪ সালের ১৪ জানুয়ারি কারখানায় এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। গ্রামে ইলেকশন করতে গিয়েই বিড়ি ফোঁকার অভ্যেস করে ফেলেছিলাম। তো ওই দিন কারখানার কাজ শেষ করে বাইরে গেলাম চা-বিড়ি খাওয়ার জন্য। শ্রমিকরা বলাবলি করছিল ঐ দেখ ঢাকেশ্বরীর দিকে হিন্দুরা সব আগুন লাগিয়ে কি করছে। সবাই গল্প গুজব করছে। তখনও অনেকে কিছুই জানে না। একপর্যায়ে কয়েকজন খবর নিয়ে এলো গোয়ালন্দে ট্রেন আসছে ভারত থেকে। ট্রেনে সব নাকি মুসলমানের মাথা। এজন্য ঢাকেশ্বরীর দিকে হিন্দু পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে মুসলমানেরা।
কারণটা খুব হাস্যকর ছিল সেই দাঙ্গার। পরে জেনেছিলাম। কাশ্মিরে হযরত কলি এর দরগা থেকে নবীর চুল চুরি হয়। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে দাঙ্গা শুরু হয় ভারতে। সেই দাঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। শ্রমিকরাও জড়িয়ে পড়ে তাতে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ঢাকেশ্বরীর আগুন দেখতে পাচ্ছিলাম। একের পর এক গুজব রটতে লাগল। মালিক মিল বন্ধ করে দিল। কিন্তু স্টোর খুলে দিল। শ্রমিকদের মধ্যে মালিকের যে লোক ছিল তাদের মাধ্যমে জানানো হলো, স্টোর থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বাওয়ানীরা পাকিস্তানি ছিল। শ্রমিকরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, যে কারখানায় সুতা নিলে চাকরি চলে যায়, সে কারখানায় কোটি টাকার গোডাউন খুলে দেয়া হলো। শ্রমিকরা রড, দা, বটি, ধারালো-ধাতব যা কিছু পেল তা নিয়েই দাঙ্গায় অংশ নিল। পাশে হিন্দুবাড়ি ছিল, সেগুলো জ্বালিয়ে দিল। দেখলাম, অন্যায় হচ্ছে। কিন্তু কিছু করতে পারছিলাম না। কোনো উদ্যোগ নিতে পারছিলাম না কারণ নতুন মানুষ, কোনো সংগঠনের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। মাত্র তখন কারখানাতে তিন-চারমাস হয়েছে। তার পরও চেষ্টা করলাম। কিন্তু অন্যরা বলল, আপনি এসব কথা বললে ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। কার্যত আমাকে ঘরে আটকে রাখা হলো।
তার পরেও ঘর থেকে বের হয়ে দু’একজনকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম এটা অন্যায় হচ্ছে। আশেপাশে যারা হিন্দু ছিল এই শ্রমিকদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছে। সবাই একে অপরের বন্ধু। তবু কেউ হত্যায় বাধা দিল না। আমরা যে বাড়িতে মেস করে থাকতাম, সে বাড়ির মালিকও হিন্দু ছিল। তিনি আমাদের গরুর দুধ দিতেন, খুব খাঁটি দুধ। মায়া মমতার সম্পর্ক ছিল। আমাদের চোখের সামনে তাদের পিটিয়ে, জবাই করে হত্যা করা হলো। বীভৎস অবস্থা। মানুষের চেতনা বলতে যা বুঝায় তা ছিল না। শ্রমিক অঞ্চলটা পুরাটাই আগুন দিয়ে পুড়ে গেল। নারিন্দাতে মরণচাঁদের দোকানপাট লুট হলো। আদমজী, বাওয়ানী, এই যে শ্রমিক অঞ্চল, এ অঞ্চলে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল।
প্রথম দুই দিন দাঙ্গা চলল, হিন্দুদের মারল। তৃতীয় দিন থেকে শুরু হলো লুটপাট। লুটপাট করল আবার সেই লোকেরাই যারা ধর্মরক্ষার নামে হত্যা করছিল। এরপর ‘বাঙালি রুখে দাঁড়াও’ এই স্লোগানের ভিত্তিতে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন জনমত গঠনের জন্য মাঠে নামল। কমিউনিস্ট পার্টি তখনও নিষিদ্ধ। পরে সরকার বাধ্য হলো আন্দোলনের ফলে, আর্মি নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। এই ৬৪ সালটা আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বীভৎস ঘটনার পর শ্রমিকদের ওপর আমার কোনো আস্থা ছিল না, কাউকে মানুষ মনে হতো না। কিন্তু কিছুদিন বাদেই এই মানুষগুলো যেন অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে গেল। এই মানুষই দুনিয়ার মজদুর এক হও স্লোগান দিয়ে অধিকার আদায়ে ধর্মঘট ডাক দিল। যে মালিক দাঙ্গা করার জন্য তাকে গোডাইন খুলে দিল দু’টাকা বেতন বাড়াতে সে রাজি ছিল না। শুরু হলো লড়াই।

এক এক করে বলছি সব। দাঙ্গার আগে থেকেই শ্রমিকরা তাদের কিছু দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে সংগঠিত হচ্ছিল। ১৪ জানুয়ারি দাঙ্গা শুরু হলে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে মে মাসে সিদ্ধান্ত নিয়ে বড় আন্দোলন করার প্রস্তুতি চলছিল। তখন সব পাটকলে, আলাপ আলোচনা করে বড় একটা ধর্মঘট হয়। কিন্তু সেই ধর্মঘটটা আমাদের কারখানায় হলো না।
দাঙ্গা থামাতে যখন আর্মি নামানো হলো তখন মালিকের কারসাজিতে সমস্ত শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দেয়া হলো। জেলে পাঠানো হলো সবাইকে। উসকানি দিয়ে দাঙ্গা করালো মালিক। আবার জেলেও পাঠালো। শ্রমিকদের বিভক্ত করে ঐক্য বিনষ্ট করতেই মালিক এটা পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছিল। শ্রমিকদের মধ্যে বিভক্তি ঘটে গেল। একদল বলল, ঘর্মঘট করা যাবে না আর অধিকাংশ শ্রমিকরা ধর্মঘটের পক্ষে অবস্থান নিল। ফলে অনেকগুলো মিলে ধর্মঘট হলো কিন্তু বাওয়ানী জুটমিলে কোনো ধর্মঘট হলো না।
আমাদের কারখানাতে মুসলিম লীগ আর শ্রমিক ফেডারেশন, এই দুই শ্রমিক সংগঠন ছিল। তখনও কমিউনিস্ট পার্টির কোনো শ্রমিক সংগঠন ছিল না। পার্টি যেহেতু গোপন ছিল। তবে বামপন্থি যারা ছিল তারা ঐ শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। মুসলিম লীগ ছিল আইয়ুব খানের সমর্থক, আজকে যেমন, আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন, শ্রমিক লীগ, ঠিক তেমনি। কিন্তু ফেডারেশনের মধ্যে কোনো দলবাজি ছিল না।
বাওয়ানীতে ফেডারেশনের নেতা ছিলেন মকবুল হোসেন। মুসলিম লীগের মুসলিম ভূঁইয়া বলে একজন ছিলেন, নোয়াখালী বাড়ি। মকবুল হোসেন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিন্তু পার্টির মেম্বার হননি তখনও। কিন্তু এটা দেখাশুনার দায়িত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড নাসিম আলী। পরে উনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। মকবুল হোসেনকে কেন্দ্র করেই বাওয়ানীতে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইউনিয়নের নির্বাচেনে জিতে মুসলিম ভূঁইয়া ও মকবুল হোসেন ছিলেন সভাপতি-সেক্রেটারি। সব পাটকলে ধর্মঘট কিন্তু লতিফ বাওয়ানী চালু। কারণ ছিল ইউনিয়নের সভাপতি পদে থাকা ওই মুসলিম লীগের দালাল। এই ধর্মঘটের মধ্য দিয়েই চটকল ফেডারেশন গড়ে ওঠে। নির্মল সেনরা চটকল ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এ ধর্মঘট শুরু করেছিলেন হাসেম মোল্লা। মাঠের আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা। তাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক মিলের নেতারা কর্মসূচী পালন করত। লেবার ফেডারেশনের আফতাব আলী সাহেব ছিলেন হাসেম মোল্লার মূল নেতা। আফতাব আলী ভারতের খুব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ফলে প্রথমদিকে তিনি দেশভাগের পর পাকিস্তানে আসতে পারেননি।
যাই হোক, আন্দোলন চলছিল হাসেম মোল্লার নেতৃত্বেই। তখন তার সেকি নামডাক। বিরাট নেতা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শ্রমিকদের মধ্য থেকে হাসেম মোল্লা আউট হয়ে গেলেন। ২১ দিনের ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। হাসেম মোল্লা দালাল হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। ফলে সে আর থাকতে পারেনি। সে সমোঝতা করে ধর্মঘট আন্দোলন বন্ধ করল। ফলে দাবিটা আর আদায় হলো না। শ্রমিকরা তার বিপক্ষে অবস্থান নিল। সে শ্রমিক আন্দোলন থেকে ছিটকে পড়ল। হাসেম মোল্লাহ ও আব্দুল মজিদ দুইজন আদমজীর প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি ছিল। এভাবে তারা বাদ পড়লেন।
চট্টগ্রামে তখন আবুল বাসার সাহেব ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের নেতা। এই ধর্মঘটের সময়েই খুলনার খালিশপুরে আরেকটা বড় দাঙ্গা হয়েছিল। সবুর খান তো মুসলিম লীগ। তখন সে শিল্পমন্ত্রী। খুলনার পাটকলগুলোতেও মুসলিম লীগ ও অন্যান্য শ্রমিক ফেডারেশনের মাঝে ধর্মঘট করা না করা, পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে খালিশপুরে দাঙ্গা শুরু হয়। এতে পুরো শ্রমিক কলোনি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনেক শ্রমিক নিহত হন। দ্বন্দ্বটা পরে নোয়াখালী, বরিশাল এরকম আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। বরিশালের লোকরা সব সবুর খানের পক্ষে চলে গেল, আর অন্যান্য জেলা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত যে নেতৃত্ব তারাও ছিটকে পড়ল। খুলনার বেলায়েত আর সোলায়মান হক নেতা ছিল। তারাও বাতিল হয়ে গেল। নতুন নেতৃত্ব সামনে আসল।
এদিকে আদমজীর হাসেম মোল্লাও বাতিল হয়ে গেল নেতৃত্ব থেকে। তার জায়গায় আসল মওলানা সাঈদুর রহমান আর আব্দুল মান্নান। এই মান্নান এখন আওয়ামী লীগের নেতা। এদের নেতৃত্বে পরে একটানা ৫৬ দিন আবার ধর্মঘটের ডাক দেয়া হলো। ৫৬ দিনের ধর্মঘটের ফলে এই প্রথম একচেটিয়া ২২ পরিবারকে শ্রমিক বাধ্য করল দাবির কাছে নতিস্বীকার করতে। এর আগে অনেকগুলো শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল কিন্তু ফলাফল ছিল না। বিজয় ছিল না। তখন দাবিগুলোর মধ্যে ছিল চাকরি স্থায়ীকরণ, ১২৫ টাকা মজুরি দাবি, বোনাসের দাবি। তখন চালের দাম ছিল ১৫-১৬ টাকা মণ।

ধর্মঘটে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলাম। ৫৫ দিন ধর্মঘট চলার পর একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী বেতন বেড়ে ৮১ টাকায় উত্তীর্ণ হয়। এই আন্দোলন ভাঙার জন্য মালিকরা চেষ্টা করেছিল অনেক। কিন্তু ভাঙতে পারেনি। শ্রমিকরা প্রতিরোধ করে। আমার কাজ ছিল এই দলে। ধর্মঘটী শ্রমিকদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা। মালিকের কোনো লোক যাতে কারখানায় ঢুকে কোনো ক্ষতি করে আমাদের ওপর চাপিয়ে না দেয় তার দিকে নজর রাখা।
এই ধর্মঘটে শত শত শ্রমিকের সাহায্যে এগিয়ে আসে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। আশেপাশের গ্রামবাসী তাদের খাবার জোগাড় করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে। পুলিশ হামলা করলে তাদের আশ্রয় দেয় গ্রামবাসী। শ্রমিকদের আশেপাশের গ্রামের মানুষ, কৃষক ও অন্যান্য সাধারণ মানুষ খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখত। তাদের কথা ছিল এই শ্রমিকরাই তো শাসকদের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। এরাই তো লড়াই করতে পারে। এদের শক্তি সামর্থ্য আছে। ৬৪’র শ্রমিক আন্দোলনের সময়ে শ্রমিকের প্রতি এই রকম একটা আস্থার জায়গা ছিল কৃষক ও জনগণের।

এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমি পার্টির নজরে আসি। মকবুল ভাই আমাকে নিয়ে গেল পার্টি অফিসে সদস্যপদ দেয়ার জন্য। মজার বিষয় হলো ৬৬ সালে আমি সদস্যপদ পেলাম। কিন্তু মকবুল ভাই পেল না। যদিও শ্রমিকদের মোটিভেট করার ক্ষেত্রে সে আমার চেয়ে বেশি দক্ষ ছিল।

সে সময় পার্টি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আন্দোলন সংগ্রামে সম্পৃক্ততা। প্রাথমিক পড়াশোনারও দরকার হতো। ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, বইগুলো পড়া। গোপনে লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। আর সংগঠন চলত লেনিনীয় নীতিতে। সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে খুব কড়াকড়ি ছিল। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে পার্টি কেন জানি না খুব সদয় ছিল। যে কারণে এক বছরের মধ্যেই পার্টির সদস্যপদ পেয়ে গেলাম।

ওই শ্রমিক আন্দোলন তখন সমগ্র বাঙালি জাতির মাঝে একটা উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। আন্দোলনটা পাটকলের তিন-চার লাখ শ্রমিকের আন্দোলন। কিন্তু এ বিষয়টা সমস্ত বাঙালির মাঝে আস্থা তৈরি করল। তখন তো রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগ আর মুসলিম লীগ। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ভেতর দিয়ে যে সরকার গঠন হয়েছিল তা টিকতে না পেরে হতাশার জন্ম দিয়েছিল। তারা যে ২১ দফা দিয়েছিল তা বাস্তবায়ন করতে পারল না। সামরিক শাসন এসে গেল।
সামরিক শাসকরা রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাতে থাকল। সামরিক সরকার এবডো ট্রাইব্যুনাল গঠন করল। এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শেখ মুজিবসহ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের বা অসৎ যারা তাদের রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করার জন্য এবডো ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। যুক্তফ্রন্টের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল এর মধ্যে আইয়ুব খান প্রচারটা এভাবে নিয়ে আসলো, আইয়ুব খান আল্লাহর প্রেরিত মানব, সে লৌহমানব। তাকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন। সে মানুষের কল্যাণের জন্য এসেছে। তাকে কখনো সরানো যাবে না। একনায়কত্বটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই প্রচারগুলো নিয়ে আসা হয়।

লোকজন রাজনীতিবিদদের উপর বিক্ষুব্ধ। জনপ্রিয়তা নাই। সরকারি প্রচারে তখন রাজনীতিবিদদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। তখনই কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে শেখ মুজিবের গোপনালাপ হয়। ৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু ৬৪ সালের শ্রমিক আন্দোলনের মতো এত ব্যাপক না, কারণ শ্রমিকরা ২২ পরিবারকে পরাজিত করতে পেরেছিল। শ্রমিকরা তাদের সংগ্রামী মনোভাব দিয়ে জনগণের মাঝে আন্দোলনমুখী অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছিল। ৬৫ সালে আবার যুদ্ধ শুরু হলো। এই যুদ্ধের মধ্যে মানুষ দেখল, আমরা বাঙালিরা অবরুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। তখন মানুষ বলল, এ কোন দেশের সঙ্গে আমরা যুক্ত হলাম? ভারত তো হেঁটে গেলে আমাদের দখল করে নিতে পারে। কারণ এখানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নাই। পরে তাসখন্দ চুক্তি হলো, পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে। যুদ্ধ শেষ হলো।
তখন আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ভুট্টো। যখন ভুট্টো আইয়ুব খানকে ছেড়ে পৃথক অবস্থান নিল তখন রাওয়ালপিন্ডিতে তীব্র ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো। ৬৫ সালের যুদ্ধের পরিণতিতে পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে পাঞ্জাবের জনগণ। এর মধ্য দিয়ে হাওয়া বদলাতে লাগল। রাজনীতিবিদরা আবার জনগণের মধ্যে জায়গা পেলেন। ৬৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হলো।
৬ দফার মাধ্যমেই শ্রমিকরা জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করল। ৭ জুন শ্রমিকরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে হরতাল পালন করে। হরতাল কর্মসূচির পক্ষে শ্রমিকরা ফাইট করল ইপিআর-এর সঙ্গে। তার আগে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন মওলানা ভাসানী। মওলানা সাহেব তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর সভাপতি। ন্যাপ তখন একটি শক্তিশালী জনপ্রিয় পার্টি। তার ডাকে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টা যুদ্ধের পর মানুষের মাঝে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হরতালের পর আন্দোলনের নেতারা সব গ্রেপ্তার হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতারাও গ্রেপ্তার হয়ে গেল। ফলে রাজনৈতিক সংগ্রাম কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে।

এটা আমাদের পার্টির ক্ষেত্রে একটা বিরাট ঘটনা। মতাদর্শগত বিতর্কটা নামাঙ্কিত হলো চীনপন্থি ও মস্কোপন্থি বলে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল তোয়াহা সাহেব, সুখেন্দু দস্তিদার- তারা চীনা পার্টির মতবাদিক দলিলের পক্ষে অবস্থান নিল। বারীন দত্ত, খোকা রায়, কমরেড আমজাদ হোসেন এই অংশটা মস্কোপন্থি হিসেবে পরিচিত হলো। এই বিরোধ থেকেই কিন্তু পার্টিতে ভাঙন হয়ে গেল। তোয়াহা, আব্দুল হক, মতিন সাহেব, আলাউদ্দিন সাহেব প্রমুখ নেতা পরিচিতি পেলেন পিকিংপন্থি হিসেবে। এরা সবাই ছিলেন আত্মগোপনে। ৬৭ সালে পার্টি ভাগের পর এদের ৪ জন ৬ দফার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া। ফলে তোয়াহা সাহেবদের দীর্ঘদিন আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যে প্রভাবটা গড়ে উঠেছিল সেটা নষ্ট হয়ে গেল। এদিকে, মোজাফফর সাহেব ভাসানী সাহেব থেকে আলাদা হয়ে রিকুইজিশন মিটিং ডেকে ন্যাপের কাউন্সিল সভা করেন। ফলে ন্যাপ বিভক্ত হয়ে গেল। এ বিভক্তির ফলে তাদের জাতীয় শক্তিটা খাটো হয়ে গেল। এ সুযোগে পূর্ব বাংলার আন্দোলনের নেতৃত্ব একচ্ছত্রভাবে তখন শেখ সাহেব এবং আওয়ামী লীগের হাতে সম্পূর্ণ চলে যায়। আমি মূল পার্টির সঙ্গেই রয়ে গেলাম।

৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সেই অর্থে কোনো শ্রমিক সংগঠন ছিল না। শ্রমিক সংগঠন বলতে বুঝাতো বামপন্থিদের। গণসংগঠনগুলো কমিউনিস্টদের দখলে ছিল। ন্যাপ তখন কমিউনিস্টদের প্রকাশ্য সংগঠন হিসেবে চলছিল। কমিউনিস্টদের তখন প্রধান দাবি ছিল গণতন্ত্র আর স্বায়ত্তশাসন। পূর্ব পাকিস্তানের চার কোটি লোকের প্রতিনিধি যে কয়জন হবে পশ্চিম পাকিস্তানের তিন কোটি লোকের প্রতিনিধি ততজন হবে- এটার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। পূর্বে-পশ্চিমে সমান ভাগে ১৫০ জন করে সংসদ সদস্য হবে- এটা কমিউনিস্টরা মানেনি। দাবি ছিল জনসংখ্যার অনুপাতে সদস্যপদ ভাগ করা। তাহলে রাষ্ট্র কাঠামোতে আমরা বরাবর এগিয়ে থাকতাম। আরো দাবি ছিল পাকিস্তানের অধীনে থাকা পাঁচটা প্রদেশের প্রত্যেকের স্বায়ত্তশাসন থাকবে। অর্থাৎ ফেডারেল রাষ্ট্রর মতো হবে। এই স্বায়ত্তশাসনের দাবিটা একটানা কাজ করে জনপ্রিয় করে তুলেছিল কমিউনিস্টরা। মানুষও এই গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে অবস্থান নিল। তখন পরিস্থিতি বিবেচনা করে ৬৫ সালের যুদ্ধের পরে শেখ সাহেব ৬ দফা দাবি উত্থাপন করল।
৬৫ সালের যুদ্ধ থেকে বাংলার মানুষ বুঝল পূর্ব পাকিস্তান বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নাই। এটা যে কোনো সময় ভারতের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে। নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কটা শুধু কাগুজে। মানুষ তাই স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দাঁড়াল। এই আন্দোলনটা কিন্তু বামপন্থিদের করার কথা ছিল। পার্টির ভাঙন না হলে এ স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে কমিউনিস্টদের বাদ রেখে আন্দোলনে যাওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব হতো না। একটা ঐক্য হতো এবং ঐক্যের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হতো বাংলাদেশের নেতৃত্ব। জেল খাটল, নির্যাতিত হলো বামপন্থিরা কিন্তু ফলাফল নিয়ে চলে গেল আওয়ামী লীগ।

ওই সময় আমরা পার্টিটাকে রক্ষা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। শ্রমিক সংগঠন আমাদের থাকল না। শ্রমিকদের প্রায় পুরোটাই চলে গেল চীনপন্থিদের হাতে। কৃষক সংগঠনের হাতেম আলী আমাদের সাথে ছিল আর বাকি অংশ চলে গেল চীনপন্থিদের সঙ্গে। তোয়াহা সাহেব তো পরে আলাদা পার্টি করলেন। আগে তিনি শ্রমিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। আর আব্দুল হক কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পার্টি ভাঙনের আগ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় বিপ্লব প্রশ্নে কমিউনিস্ট কর্মীরা আশাবাদী ছিলেন। পার্টি ভাঙনের ফলে সেই আশাটা আর থাকল না।
আমার কাছে বার বারই মনে হয়েছে, এটা আমাদের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ভুল। যখন আমরা সর্বেসর্বা, সবখানে আমাদের জয়জয়কার, যখন ছাত্র ইউনিয়ন সবচেয়ে বড় সংগঠন, যখন শ্রমিক, কৃষক, সব ক্ষেত্রেই আমরা শক্তিশালী ঠিক তখনই নেতারা পার্টি ভাঙলেন। নেতারা তখন একগুঁয়েভাবে মতবাদিক বিতর্ক চালালেন। কিন্তু তারা জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা বিবেচনা করলেন না। পার্টি না ভেঙে তখন উচিত ছিল পূর্ব বাংলা মুক্ত করার লড়াইটা এগিয়ে নেয়া। সেই লড়াই সম্পন্ন হলে মতবাদিক বিতর্ক শুরু করা যেত। জনগণ যেসব দাবিতে পার্টির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এটার কোনো মূল্য কমিউনিস্ট নেতারা দিল না। এর ফল ভোগ করছেন সবাই আজ অবধি।

৬২ সালে আমি বাওয়ানী মিলের ইউনিয়ন কমিটিতে সদস্য হই। ৬৭ সালে আবার কারখানাতে বড় শ্রমিক ধর্মঘট হলো। যখন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয় তখন ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হলো জামাতি সমর্থনপুষ্ট ওয়াজেদ খান। আর মকবুল ভাই দ্বিতীয়বার সেক্রেটারি পদে নির্বাচিত হলেন। এ ধর্মঘটেও বিরোধ হয়ে গেল আমরা ছিলাম ধর্মঘটের পক্ষে মকবুল ভাইয়ের নেতৃত্বে। আর প্রেসিডেন্ট ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। মালেক সাহেব, ফজর আলী, মকবুল ভাই, ইউনিয়নের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা গ্রেপ্তার হয়ে গেল। তখন ইউনিয়নের কোনো তহবিল নাই। বাস্তবে পুরো ধর্মঘটটা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার উপর পড়ল।
আমি তখন ইউনিয়নের কোনো বড় পদেও না। সাধারণ সদস্য। তারপরও আমি অন্য শ্রমিকদের সংগঠিত করে দায়িত্ব নেই আন্দোলন চালিয়ে যাবার। শ্রমিকরা বলল কি করব আমরা? পার্টিকে জানালাম। এদিকে ধর্মঘটের বিপক্ষের প্রসিডেন্ট গ্রুপ ডিস্টার্ব করছে। পার্টি পরামর্শ দিল ধর্মঘট চালিয়ে যেতে। অনেক কর্মীর প্রয়োজন তখন। ভলান্টিয়ার গ্রুপ তৈরি করলাম। প্রথমেই তহবিল সংগ্রহের জন্য আশপাশের বাড়ি গিয়ে দশ-বারো মণ চাল উঠানো হলো। আর স্বেচ্ছাসেবকরা বস্তা নিয়ে বের হতো আশপাশের গ্রামে চাল সংগ্রহ করার জন্য। গ্রামের প্রচুর মানুষ আমাদের সাহায্য করল। এ দিয়ে আর কয়দিন চলে!
তখন পার্টি ছাত্র সংগঠনকে এবং তার নেতাদের ডেকে সহযোগিতা করতে বলল। তখন আমরা সন্ধ্যার সময় ঢাকায় চলে আসতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রদের রুমে রুমে গিয়ে চাঁদা তুলতাম। টিফিনের পয়সা থেকে বাঁচিয়ে ছাত্ররা যে যা পারে দিতো। পাঁচ-ছয় শ টাকা উঠালাম। তখন তো পাঁচ-ছয় শ টাকা অনেক টাকা। ছাত্র নেতাদের সাথে আমরা মিলে লাল কাপড় নিয়ে পুরান ঢাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুললাম যাতে পরবর্তী কর্মসূচি পালন করা যায়।
৪৬ দিনের ধর্মঘট হবার পর একটা বিভক্তি হয়ে গেল। এ ধর্মঘটে অংশ নিল দুইটা মূল ফেডারেশন। একটা হলো চট্টগ্রামের বাশার ভাইয়ের নেতৃত্বে জুটমিল ওয়ার্ক ফেডারেশন আর মান্নানের নেতৃত্বে চটকল শ্রমিক ফেডারেশন। এটার সাথে নির্মল সেনরা সম্পর্কিত অর্থাৎ আরএসপি যুক্ত ছিল। দুইটা ফেডারেশনই কোনো জায়গায় একক অবস্থানে কোথাও যৌথ অবস্থানে ছিল সবাই মিলে ধর্মঘট করলাম। রাশেদ খান মেননের ভাই চট্টগ্রামের ডিসি ওবায়দুল্লাহ খানের সম্পৃক্ততায় একটা ঘটনা ঘটল।
তখন চট্টগ্রামের জুটমিল ওয়ার্ক ফেডারেশনের নেতা বাশার ভাই। তিনি চীনপন্থি অংশের বড় নেতা। চীনের প্রভাবে এখানকার চীনপন্থিদের তখন পাকিস্তানের সরকারকে ডিস্টার্ব না করার একটা সাধারণ লাইন ছিল। এটা যদিও চীনপন্থিদের সবাই অনুসরণ করতো না। তবে বাশার ভাইরা এই লাইনে ছিলেন। ওবায়দুল্লাহ খানকে দিয়ে ধর্মঘট বন্ধ করার জন্য একটা চুক্তি স্বাক্ষর করল। যদিও এই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে ধর্মঘটের আরেকটা পক্ষ চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের কোনো মত নেয়া হলো না। দুই ফেডারেশনেরই কিন্তু সমান সমান শক্তি শ্রমিকদের মধ্যে। ঢাকাতে চটকল ফেডারেশনের প্রাধান্য আর চট্টগ্রামে বাশার ভাইয়ের ফেডারেশনের প্রাধান্য। কিন্তু চুক্তিটা করল বাশার ভাইরা একাই।
জুটমিল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনে তখনো মকবুল ভাই যুক্ত। তিনি তো জেলে। আমাদের সাথে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে জেলগেটে মকবুল ভাইকে ডেকে বাসার ভাই চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়ে নিল। ওই চুক্তিতেও কিছু দাবি আদায় হলো। ১৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি ও বোনাস ৬০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ হলো। কিন্তু শ্রমিকদের বিভক্তিটা পাকাপাকি হয়ে গেল এই যে একটা অংশকে বাদ দিয়ে আরেকটা অংশ চুক্তি করল এ কারণে। ফলে কোথাও কোথাও ধর্মঘট বন্ধ হলো না। বাওয়ানীতে তখনও ধর্মঘট চলছে আমার নেতৃত্বে। আদমজীতেও ধর্মঘট চলছিল। আমাদের লোকজন যখন জেল খেটে বের হলো। যখন তারা ডেমরা গেল শ্রমিকরা তাদের উঠিয়ে নিয়ে গেল। তারা কেন চুক্তিতে সই করল এর জবাব চাওয়ার জন্য। আমাদের মধ্যে এই হানাহানির ফলে মালিকরা পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে ধর্মঘট স্থগিত করালো চুক্তি দেখিয়ে। আদমজীতে সমাবেশ ডাকা হলো। খবর পেয়ে আমি গেলাম। বক্তৃতায় আমাকে থামিয়ে দেয়া হলো দালাল বলে।
শ্রমিক আন্দোলনে ভুল করলে তার খেসারত নগদে দিতে হয়। যে মকবুল ভাই এত জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা ছিলেন, দুইবার সেক্রেটারি নির্বাচিত হলেন, সে আর ইউনিয়নে থাকতে পারল না। কিন্তু যে ওয়াজেদ খান বাইরে থেকে আন্দোলন-ধর্মঘট ভাঙার চেষ্টা করল সে রয়ে গেল। আর মকবুল ভাই দালাল হিসেবে পরিচিত হলেন। পরে ৭০ সালে আবার ইউনিয়ন নির্বাচন দেয়া হলো। ঐ নির্বাচনে মকবুল ভাই সেক্রেটারি হিসেবে দাঁড়ালেন। আর মালিকদের পক্ষ থেকে কুদ্দুস কনট্রাক্টর বলে এক লোক দাঁড়াল। সে ব্যবসায়ী ছিল। মালিকের তত্ত্বাবধানে এসে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াল। নির্বাচনে মকবুল ভাই দারুণভাবে পরাজিত হলেন। তাদের তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগও ভোট পেল না মকবুল ভাই। মানিক নামে একজন সেক্রেটারি নির্বাচিত হলো। সেও জেল খাটা নেতা ছিল। একজন কনট্রাক্টর ইউনিয়নের সভাপতি হয়ে গেল।
নির্বাচনের ৬০ দিনের মাথায় কারখানাতে একটি ঘটনা ঘটল, শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার কারণে, একজন অবাঙালি অফিসারের মাথা ফাটিয়ে দিল শ্রমিকরা। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মালিকরা ১১ জন শ্রমিককে বহিষ্কার করে দিল। এর প্রতিবাদে শ্রমিকরা ১৩ দিন ধর্মঘটের ডাক দিল। কোনো ফয়সালা হচ্ছে না। যাই হোক এই ধর্মঘট সফল করার একটি প্রচেষ্টা আমরা নিলাম। আমি মেডিকেল ছুটিতে ছিলাম। শ্রমিকরাও অনড়। মালিকও তাই। পরে মার্শাল ’ল এর সময় কয়েক প্লাটুন পুলিশ নিয়ে এসে ধর্মঘট ভেঙ্গে দেয়া হলো। এদিকে ইলেকশনে প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু কমিটি হয়নি। ধর্মঘট ভাঙার ফলে এক ধাক্কায় ১৪০০ শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে গেল। মকবুল হোসেন থেকে শুরু করে সব লোক বাইরে চলে গেল। মালিকরা এই সুযোগে আমাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিল। এই ঘটনাগুলো ঘটল ১৯৬৮ সালে।

হ্যাঁ। লেবার কোর্টে মামলা করে চাকরিতে বহাল হলাম। ধর্মঘটের পর মিল চালু হলো। আবার ইলেকশন হলো তখন আমি প্রার্থী হলাম। খুব প্রতিকূল অবস্থা। সংগ্রামী মানুষের চাকরি চলে গেল। কিন্তু কঠিন অবস্থার মধ্যেও আমি পাস করে গেলাম। ৬৭ সালে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। ওই ৬৭ সালে পার্টির দলিল হলো। আর ৬৮ সালে পার্টির প্রথম কংগ্রেস হলো। সেই কংগ্রেসে আমি প্রতিনিধি ছিলাম।
মকবুল ভাইসহ যাদের চাকরি গেল তাদের থেকে মালিকরা কোনো সময়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়। তখনও তো শ্রমিক আন্দোলন পরিপক্ব হয়নি। সাদা কাগজের সেই স্বাক্ষর হয়ে গেল তাদের স্বেচ্ছা অবসরের দলিল। তিনজন নেতা একসঙ্গে ছিটকে গেল। ফলে কারখানাতে কোনো প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব নেই। এই পর্যায়ে নেতা হিসেবে থাকলাম আমি ও প্রেসিডেন্ট- সেই কনট্রাক্টর। সে মালিকের লোক হবার পরও নেতাদের চাকরি যাওয়ার ঘটনায় আমাদের, শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিল। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ইউনিয়নে আমি কাজ শুরু করলাম।
৬৮ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও অন্যান্য সংগঠন মিলে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করল। এটা ছিল ঐতিহাসিক এক রাজনৈতিক জোট। এর মধ্যে জামায়াত, নিজামে ইসলাম, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, সবই ছিল। দুটো দাবি ছিল এই জোটের। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি। এ দাবিতে তারা হরতাল আহ্বান করে পুরো পাকিস্তানে। তখন হরতালের সমর্থনে আমরা শ্রমিকরা মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। শ্রমিক বেল্টে সমস্ত দায়িত্বটা আমার কাঁধে এসে পড়ল। কারণ সভাপতি তো আন্দোলনের মানুষ না। আমরা হরতাল সমর্থন করে কারখানা বন্ধ করলাম। ১৪৪ ধারা ছিল। আমরা ভাঙলাম। বিপুল জনগণ আমাদের সঙ্গে আসল।
এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা ছিল। যখন সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম শ্রমিক এলাকায় সংগঠিত করার বিষয়ে মিটিংয়ে বসলাম কেউ কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না। যদিও অনেক প্রবীণ নেতা সেখানে ছিল। সংগ্রাম কমিটিতে টেক্সটাইল মিলে আব্দুল আজিজ, করিম জুট মিলে ফটিক সর্দার প্রমুখ নেতা ছিল। নানান দলের লোকদের নিয়ে মিটিং হলো। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার মানুষ রইল না। সব আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো। আমি দায়িত্ব নিলাম। এরপর শুরু হলো ১১ দফার আন্দোলন। কিন্তু নভেম্বরের হরতালের পর ডাক আর কোনো কর্মসূচি দিল না। তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সামনে চলে আসে।
১৯ তারিখ আসাদ শহীদ হলো। ২০ জানুয়ারি হরতাল ডাকা হলো। ২৪ জানুয়ারি আবার হরতাল ডাকা হলো। পল্টনে সেদিন সমাবেশও হবে। আমরা হরতাল করছিলাম। আদমজী থেকে খবর এলো তারা হেঁটে ঢাকা আসছে। আদমজী থেকে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক তারা হেঁটে ঢাকা আসল। এক দেড় ঘণ্টার রাস্তা হেঁটে শ্রমিকরা আসল। আমরাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। শ্রমিকদের মিছিল ছিল সবচেয়ে বড়। সব মিল মিলে প্রায় এক থেকে সোয়া লাখ লোকের মিছিল হলো। শ্রমিকরা আসার পরই, সচিবালয়ের দক্ষিণের গেট ভেঙে ফেলল। আর্মি চার্জ শুরু করল। সমস্ত ঢাকা শহর মানুষের ঢল। দৈনিক বাংলা, রাজারবাগ প্রভৃতি এলাকা জনগণের দখলে চলে গেল। এসবকেই এখন বলা হয় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান।
১১ দফায় পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়। ব্যাংক বীমা, জাতীয়করণসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার দাবিই তোলা হয়। জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। গণমুখী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। অনেক গণমুখী কর্মসূচি আসল। যেমন সর্বজনীন ভোটাধিকার, বন্দী মুক্তি, সিয়ার্টে সেন্টেন, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শ্রমিক কৃষকের জন্য প্রগতিশীল একটা গণমুখী কর্মসূচি আসল। সেখানে শ্রমিক কৃষকদের দাবিও সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসে। জনগণও এতে সাড়া দেয়। মানুষ যখন একত্রিত হয় তার শক্তিটা যে কী পরিমাণে বেড়ে যায় তা আমাদের জীর্ণশীর্ণ শ্রমিক শ্রেণী বাস্তবে প্রমাণ করে দেখিয়েছিল। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস আসলে শ্রমিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস।
ছোট ছোট ৫-৬ হাত বাঁশের খুঁটি সকলের হাতে হাতে। হাতের কাছে যে যেভাবে পারছে গাছের ডাল ভেঙে অস্ত্র বানাচ্ছে। মিছিল যখন ডেমরা পার হলো তখন মিছিলে লাখ লাখ লোক। মিছিল ঢাকায় ঢুকতেই পারল না। একটা অংশ পল্টন এলাকায় আসার পরেই জায়গার অভাবে আর এগোতে পারেনি। টঙ্গী, তেজগাঁওর শ্রমিকরাও বের হয়ে আসল। ঢাকায় অভ্যুত্থান বা ওই সমাবেশে তখন শ্রমিকদেরই প্রাধান্য ছিল। কিন্তু নেতৃত্ব ছিল ছাত্র নেতাদের হাতে। পল্টনের পশ্চিম দেয়ালের কোণে এক জায়গায় বালির বস্তা দিয়ে আর্মিরা অবস্থান নিয়েছিল। এক ধাক্কায় সেটা কোথায় চলে গেল। বর্তমান শিক্ষা ভবনের নিকটবর্তী প্রাদেশিক রেলমন্ত্রী সুলতান আহমেদ এর বাসভবনে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালাল। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা ভবনেও আগুন লাগানো হয়। পরবর্তীতে এটার নাম হয় দৈনিক বাংলা। ডেইলি অবজারভার ভবনেও আগুন লাগানোর চেষ্টা করা হয়।
অভ্যুত্থানে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি। আইয়ুব খানের পতন হলো। এর মধ্যে দিয়ে শ্রমিকরা রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশীদার হয়ে গেল। ঢাকা শহরে তখন ছাত্র সংখ্যা ২০ হাজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ৫ হাজার। আর সারা শহরের জনসংখ্যা ১০ লাখ। শুধু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে কিছু হয়নি। মূল শক্তি সমাবেশ করেছিল কিন্তু শ্রমিকরাই। সচিবালয়ের কর্মচারী, কর্মকর্তারা নেমে এসেছিল। অফিস আদালত থেকে কর্মচারীরা নেমে এসে মিছিলে শরিক হয়েছিল। পুরো প্রশাসন তখন স্থবির হয়ে পড়ল। আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে নির্বাচন ঘোষণা করল।

শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ তখন আন্দোলন সংগ্রামে থাকলেও শ্রমিক আন্দোলন তখন নেতৃত্বশূন্য ছিল। পার্টি এ নিয়ে একটা পরিকল্পনা দাঁড় করায়। ছাত্র সংগঠনের মধ্যে শ্রমিক এলাকায় কাজ করতে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়। প্রচুর ছাত্র নেতা এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাইফুদ্দিন মানিক, মোর্শেদ আলী, চপল বাসার, শরিফুল বাসার। এ রকম আরো অনেকে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে ছিলেন অগ্রণী।
আওয়ামী লীগের তখনো কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠেনি। তখন তারা ঢাকায় প্রথম সম্মেলন করে। সেই সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো, আমি গেলাম। কারণ পার্টি ভাগ হওয়ার পর আমাদেরও কোনো শ্রমিক ফেডারেশন নেই। যেহেতু ইউনিয়ন করি ফলে কোনো না কোনো কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের সঙ্গে থাকতে হবে। তাই গেলাম। শ্রমিক লীগের কমিটি হলে তার ৮ নম্বর মেম্বার হিসেবে আমাকে রাখা হলো। আহ্বায়ক হলো নূরুল হক মিয়া। আর সেক্রেটারি হলেন আব্দুল মান্নান। কিন্তু পরে পার্টি থেকে বলা হলো যেহেতু আমাদের ফেডারেশন নাই ফলে আমরা একটা গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিব। আমি আর শ্রমিক লীগের সঙ্গে কাজ করলাম না। ৩-৪ মাস থাকার পর আমি সম্পর্ক ছিন্ন করি শ্রমিক লীগের সঙ্গে। ওই সময় আমাদের তরুণ ছাত্র কমরেডরা শ্রমিক সংগঠনের মাঝে আসছিল।
৮ ফেব্রুয়ারি কর্মি সভা করলাম আমাদের কর্মীদের নিয়ে। এই শ’খানেক কি দেড়’শ জনের হবে। প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। আমরা ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটা কমিটি করলাম। নামকরণ করলাম ট্রেড ইউনিয়ন যোগাযোগ কেন্দ্র। এর আহ্বায়ক করলাম সাইফুদ্দিন মানিককে বাকিরা হলো সদস্য। সেখানে আমিও সদস্য হয়েছিলাম। আমরা শ্রমিকরা দক্ষতার সঙ্গে অনেক পথ পাড়ি দিলেও কিন্তু শ্রমিক সংগঠন করার সময়ে পার্টি ছাত্র বুদ্ধিজীবীদের প্রাধান্য দিল। এটাকে কিন্তু আমরা তখন সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এতে ভালো হবে। কিন্তু এখন আমার মনে হয় শ্রমিকের মধ্যে নেতৃত্ব থাকলে শ্রমিককেই প্রাধান্য দেয়া উচিত।

সাইফুদ্দিন মানিক পার্টির লোক ছিলেন। তিনি শ্রেণীচ্যুত হয়েই তো কমিউনিস্ট হয়েছেন। সে হিসেবে তিনিও শ্রমিক শ্রেণীর একজন। তাছাড়া তিনি তো আমাদের ইউনিয়নেও নেতা হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৪ এপ্রিল ছিল পহেলা বৈশাখ। তুমুল ঘূর্ণিঝড় হলো সেদিন। সে ঘূর্ণিঝড়ে ডেমরা থেকে মহাখালী পর্যন্ত এ অঞ্চলটা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল। ডেমরাতে ৬-৭ শ’লোক মারা গেল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। দুর্যোগের সময় আমার নেতৃত্বে ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাত্রদের কয়েকশ কর্মী নিয়ে ওখানে ক্যাম্প করে তিনমাস পর্যন্ত তারা সেখানে কাজ করল। লোকজনের বাড়িঘর বানিয়ে দিল। এ কাজগুলোর মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে সাইফুদ্দিন মানিকের পরিচিতি বেড়ে গেল। তখন আমরা পার্টির কাছে প্রস্তাব করলাম মানিক ভাইকে ইলেকশনে সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করার। ফেডারেশনের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তখন সেভাবে পার্টি এগুতে চায়নি। দুটো মত হলো পার্টির মধ্যে এ নিয়ে। এক দল বলল সে বড় নেতা। হেরে গেলে বদনাম হয়ে যাবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বের মুখে চুনকালি পড়বে। আরেক দল বলল হারার কোনো সুযোগ নেই। শেষে পার্টি অনুমতি দিল।
আওয়ামী লীগের শ্রমিক লীগ তখন নির্বাচনে দাঁড়ায়নি। কিন্তু আমাদের জয় বুঝতে পেরে তারা বিনা কারণে অপপ্রচার শুরু করল। তারা প্রচার চালালো, কমিউনিস্টরা নাস্তিক আল্লাহ মানে না। এই প্রথম দেখলাম নির্বাচনে এ ধরনের নোংরা অপপ্রচার। নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর তো এলাকার চেহারাই পাল্টে গেল। আমরা জয়ী হবার পর কারখানাতে মালিক পক্ষ বলল বেসরকারি রিলিফ শ্রমিকদের দেয়ার দরকার নেই। শ্রমিকদের দায়িত্বটা মালিক পক্ষ নেবে। ঘূর্ণিঝড়কবলিত এই এলাকাটা ছিল অনেক ছোট। কিন্তু মানুষের সহানুভূতির ফলে বিপুল পরিমাণে রিলিফ এই এলাকায় আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় সব নেতা ওয়ালী খান আসলেন। এটা সারাদেশের মধ্যে একটি আলোড়ন তৈরি করেছিল।
সাইফুদ্দিন মানিক শ্রমিক নেতা হিসেবে বেশ কিছু সংগ্রামের অগ্রভাগেও ছিলেন। মালিকরা যে আশ্বাস দিল তা তারা রাখল না। তখন বাধ্য হয়ে আমাদের ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এক মাসের বেতন সমপরিমাণ রিলিফ হিসেবে দেয়ার দাবি আসল। আর সকল শ্রমিকরা বলল আমাদের এখানে দুটি ইউনিয়ন কোনো রাস্তা নেই। জনগণ দাবি করল, আমরা ইউনিয়ন দাবি পাস করলাম। এটা নিয়ে বড় আন্দোলন করলাম। শ্রমিকরা লকআউট করল। পরে চুক্তি করে লকআউট প্রত্যাহার হলো। শ্রমিক নেতা হিসেবেও তার সফলতা ছিল। পার্টি তাকে শ্রমিক ফ্রন্টের নেতৃত্বে আনাটা তাই স্বাভাবিক ছিল। আমরাও তখন সেটা সমর্থন করেছিলাম। কিন্তু এখনকার কথা বলা হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইব, নেতৃত্ব শ্রমিকের মধ্য থেকেই কেউ হোক।

সামরিক আইনে দুটা মামলার মধ্যে পড়েছিলাম। ৬৯’এর সামরিক আইন ভাঙার ফলে মামলা দুটি দেয়া হয়। একটি মামলাতে ট্রায়াল দিয়েও আমাদের কিছু করতে পারল না। কিন্তু অন্য মামলায় মিল থেকে আমাদের দুজনকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। সাইফুদ্দিন মানিকরা তখনও নির্বাচিত হননি। নির্বাচনের আগেই ৬৯ সালে অ্যারেস্ট হয়ে ৪৬ দিন আমি হাজতে ছিলাম। নারায়ণগঞ্জ জেলে ছিলাম। আর যেহেতু মার্শাল ল’, ফলে রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা পাইনি। দ্বিতীয় মামলাতে স্থানীয় গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তিকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করে দিল। এটা ছিল খুবই ঝামেলার। এ মামলায় স্থানীয় লোকজনদের যদি সাজা হয়ে যায় তাহলে আমাদের পক্ষে ভবিষ্যতে এখানে সংগঠন গড়ে তোলা কঠিন হবে। তখন পার্টি সিদ্ধান্ত দিল, রায়ের দিন আমি উপস্থিত থাকব না। গণ্যমান্য স্থানীয় ব্যক্তিরা আমাদের নামে সকল দোষ চাপিয়ে বের হয়ে যাবে। তারা খালাস হবে। সাজাটা আমাদের কাঁধে থাকবে।
এটা নিয়ে খুব চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম কারণ এমনি উপস্থিত থাকলে ৭-৮ বছর জেল হতো। কিন্তু অ্যাবসকন্টাক্ট হলে যখনই ধরা পড়বে তখনই সাজা খাটতে হবে। আমাদের পাঁচজনের সাজা হলো। আমাদের অনুপস্থিতির কারণে ৬৪ বছর করে জেল দিল। আর এদের ৪-৫ মাস করে জেল দেয়া হলো। এ সময়ই আমার ব্যক্তিগত জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। আমি তখন আধা আত্মগোপনে। আমি তো গণনেতা ছিলাম, এলাকার লোকজন আমাকে চিনত। ফলে তারা ধরিয়ে দেয়নি বরং সহযোগিতা করল। ফলে এলাকার ভেতরেই থাকতাম। এ সময়েই আমার স্ত্রীর সঙ্গে সখ্য তৈরি হয়। তার নাম শাহিদা চৌধুরী। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কাজ করতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয়।

তখন যে পরিপ্রেক্ষিত ছিল- পার্টি, বিপ্লব...। আমার শরীর তো টগবগ করত। তখন তো এতদিক এত চিন্তা করিনি। সংগঠনটা কিভাবে হবে মাথার মধ্যে এ চিন্তাই কাজ করতো সারাক্ষণ। বারবার মনে হচ্ছিল যে, সংগঠন করার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা ছিল স্থানীয়-অস্থানীয় দ্বন্দ্ব। স্থানীয়রা সঙ্গে না থাকলে কিন্তু আমি টিকে থাকতে পারব না। এটা ছিল একটা, আর তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল। পরে পার্টিকে জানালাম এ সম্পর্কে। অ্যাবসকন্টাক্ট হলে তো বিয়ে হবে না। বিয়ে হতে হলে রায় হওয়ার আগেই বিয়ে করতে হবে। কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী খুব ধমকালেন- ‘এগুলো কয়দিন থাকে? কয়েক দিন পর সম্পর্ক ভেঙে যাবে। তখন পার্টির দুর্নাম হবে।’ পরে রাজি হলো। কিন্তু আমার পরিবারের কেউ এতে যুক্ত ছিল না। আমার ভাই ছিল ডেমরাতে। ভাই বিয়েতে সম্মতি দেননি।

কনে তো রাজি। কিন্তু তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিরোধ হলো। একপক্ষ বলল, এত ভালো বংশের ছেলে, এত সম্ভাবনাময়। আরেক পক্ষ বলল, এই ছেলের এক পা জেলে, এক পা কবরে। বিয়ে দিলে মেয়ে পরে স্বামীহারা হবে। তারপরও ঠিক হলো সন্ধ্যার পর বিয়ে হবে। সময় ঠিক হলো। বাজারে বসে চা খাচ্ছিলাম আমি। পাশে গোয়েন্দা সংস্থার লোক। ভালো লোক, বাঙালি, পরিচিত ছিলেন। তিনি বললেন, আপনি বসে আছেন? পুলিশ আসছে আপনি দৌড় দেন। দৌড়ালাম। নদী পার হয়ে ওপারে চলে গেলাম। পুলিশ নৌকা নিয়ে ওদিকেই আসছে মনে হলো। পুলিশ আমার পেছনেই লেগেছে ভেবে আবার দুই কিলোমিটার দৌড়ালাম। পরে রাতে এলাকায় ফিরে আসি। পরে শুনলাম এরা লঞ্চ ধরতে পারেনি। তাই তাড়াতাড়ি করে এই পথে যাচ্ছিল।
এ ঘটনা শুনে তো, মেয়ের পরিবার আরো ক্ষিপ্ত হলো। তর্কবিতর্ক, রাত দশটার সময় বিয়ে হবে সিদ্ধান্ত হলো। তিন-চার জন মিলে বর যাত্রী হলাম। বাজার সদাই করা হলো। একটা বেনারসি কিনে আনলাম। বিয়ে হলো। বিয়ের পর আমি ওদের বাড়িতেই থাকতাম। এর মধ্যেই চলে এলো ৭ মার্চ।

আওয়ামী লীগ নিজেই তো তখন ঠিক বলতে পারছে না কি হবে। একটা অনিশ্চয়তা কাজ করছিল সবার মধ্যে। ইয়াহিয়া খান আসল সমাধানের জন্য। কিন্তু সমাধান হলো না। ৭ মার্চের ভাষণের সময় আমরা শ্রমিকদের নিয়ে হেঁটে চলে আসলাম উদ্যানে। পার্টিও যোগদান করার জন্য আমাদের বলল। ৭ মার্চের পর পার্টি বলল এটা আর কোনো শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা হবে না। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে আমরা প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি আমাদের ডেমরা-শিল্পাঞ্চল এলাকায় ট্রেনিং নেয়া শুরু করল। এগুলো এখন হাস্যকর ব্যাপার মনে হবে। মরিচের গুঁড়া কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, তীর ধনুক দিয়ে টার্গেট প্রাকটিস করেছি। তখনও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। যুদ্ধের বাস্তবতা কি।
তখন পাশা উল্টে গিয়েছিল। জাতি বলতে তো তখন শেখ মুজিব। রাজা। সে যা বলবে তাই। বিনা খাটুনিতে শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছিল। মালিক, সে নিজের টাকা উঠাবে কিন্তু আমরা শ্রমিকরা স্বাক্ষর না দিলে টাকা উঠাতে পারত না। ক্ষমতা ৭ মার্চের পর ২৬ মার্চ পর্যন্ত জনতার হাতে ছিল। গণক্ষমতা কি, তা ওই কয়দিনের ইতিহাসে পাবেন। অনিবার্যভাবে একটা যুদ্ধের দিকে গেল দেশ। কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি বলতে, কোথায় হবে কিভাবে হবে কেন ধারণা কারো ছিল না।
২৬ মার্চ রাত ১১টার সময় ঢাকা থেকে খবর আসল আর্মি মুভ করে গেছে। আমাদের সেই মিলের কন্ট্রাকটর, যে সভাপতি হয়েছিল, তার কাছে গেলাম। বললাম কিছু টাকা দেন। অস্ত্র কিনব। কি অপরিপক্ব চিন্তা। কোথায় অস্ত্র পাওয়া যায়, কে বিক্রি করে কিছুই জানি না। শুধু জানতাম চট্টগ্রামে অস্ত্র কিনতে পাওয়া যায়। এরপর ভাবলাম আর্মি তো এদিকেও আসতে পারে। প্রতিরোধ হিসেবে তখনই এলাকার লোকজনকে খবর দেয়া হলো। রাস্তা ৬ কি.মি কেটে জনতা খাল তৈরি করল যাতে ওরা গাড়ি নিয়ে না ঢুকতে পারে। সারা রাত হাজার হাজার শ্রমিক পাকা রাস্তা কেটে খাল তৈরি করল। রাস্তা বন্ধ করল। রাস্তা বন্ধ করে ফিরে আসছি সকালের দিকে। তখন দেখলাম মানুষের ঢল। সকাল থেকেই তো পালানো শুরু হলো। তখন প্রথম কাজ হলো এই লোকজনকে সাহায্য করা। এই যে হাজার হাজার লোক আসছে, তাদের জন্য ক্যাম্প করে মুড়ি, চিড়া দেয়া হলো। মানুষও দিতে থাকল। সবই দিচ্ছে। অনেককে দেখলাম শরবত করে খাওয়াচ্ছে। নানা ধরনের লোক। কেউ কাউকে চেনে না। তারপরও সহযোগিতা করছে একে অপরকে।
ডেমরা অঞ্চলটা ছিল নিরাপদ রাস্তা। ঢাকায় সে সময় যারা আসত- নোয়াখালী, বরিশাল, কুমিল্লা অঞ্চলের লোকজন বেশি আসত। উত্তরাঞ্চলের লোকজন কম ছিল তখন। এই রাস্তাটাই ব্যবহার করতো তারা। এ কাজগুলোর মধ্যে থাকলাম সারা দিন। এর মধ্যে দেখলাম আদমজীর সাঈদুল হক সাদু ভাই আসল। সে আদমজীর সভাপতি ছিল। তিনি বললেন অনেক মানুষ মারা গেছে। কত মানুষ বলতে পারব না। স্তব্ধ হয়ে গেছে ঢাকা শহর। ২৭ তারিখে খবর পাঠাল পার্টি থেকে- এখন যে অবস্থা তাতে পশ্চিম পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সবাই নিরাপদ অবস্থানে থাকো। একটা গ্রামের নাম বলা হলো। সেখানে আমাদের কমরেড নাজিমুদ্দীন থাকবেন। তার কাছে তথ্য থাকবে কি করতে হবে। এ খবর পাওয়ার পর ২৭ তারিখে আমার বউ আর দুই শালিকে নিয়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নিলাম। তারা তখন একজন ক্লাস নাইনে, আরেকজন ক্লাস টেনে পড়ে। আমরা চলে আসার আগেই খবর পাচ্ছিলাম যে আর্মি আসছে।

না। আর্মি আসছে, এই খবরটাই পাচ্ছিলাম। যাকে দেখছে তাকেই গুলি করছিল তারা। আর্মি এরপর আমাদের বাড়িতে আসে। আমাদের বাড়িসহ অন্যদের বাড়িতে হামলা করে। সবকিছু তছনছ করে দেয়। ১৯৭০ এর ২০ ফেব্রুয়ারি ডেমরা চৌরাস্তায় আমরা একটা শহীদ মিনার তৈরি করেছিলাম, সেটা তারা গুঁড়িয়ে দেয়। শহীদ মিনারটি এক রাতের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল। আর্কিটেক্ট ছিল মাজহারুল ইসলাম। আলমগীর কবীর ছিল ডিজাইনার। কামান দিয়ে তারা শহীদ মিনার উড়িয়ে দিল। গোয়ালন্দ গিয়ে এক রাত থাকলাম। সম্ভবত ২৮ তারিখে আমার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।
নদী পার হলাম, কোনো গাড়িঘোড়া নেই, নরসিংদী কেমনে যাব। ট্রাকে উঠলাম, নরসিংদী সন্ধ্যার আগে পৌঁছলাম। আমার গ্রামের এক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পরদিন সকালে নৌকায় করে আমরা গ্রামের উদ্দেশে রওনা করলাম। সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছালাম। নৌকাতে যখন যাচ্ছি, সে সময় অন্য নৌকাতে একজনের সঙ্গে দেখা। মেডিকেল ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ছিল সে। আমরা তাকে শফি ভাই বলে ডাকতাম। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র ছিল। তিনি বললেন, আপনি একদিন পর সরাইল আসেন। কি করা যায় আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। আমি বড় শালিদের রেখে পরদিন হেঁটে সরাইল গেলাম। একরাত থাকলাম। ঠিক হলো আমরা পরদিন আগরতলার দিকে রওনা দেব। আমরা আগরতলা পৌঁছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর আগরতলা অফিসে গেলাম। সিপিআই ও সিপিএম মিলে তখন ক্ষমতায় রয়েছে তারা। তাদের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিবৃতি দিল রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে এবং শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা বিধান যেন করা হয়। এই বিবৃতি থেকে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনাটা স্পষ্ট হলো।
৬ তারিখে আগরতলা থেকে ফিরে আসলাম। তখন এপ্রিল মাস চলে আসল। আমি যেখানে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল সেখানে গেলাম। সেখানে একটা চিরকূট রাখা ছিল। পার্টির সেন্টার আগরতলার রায়পুরে শিফট করা হয়েছে। সেখানে কাদির মাস্টারের বাড়িতে যোগাযোগ করতে বলা হলো। চিরকূট পেয়ে আবার পরদিনই আগরতলার উদ্দেশে রওনা দিলাম।

আমি যখন আবার আগরতলার দিকে যাচ্ছি, তখনই একটা লড়াইয়ের প্রস্তুতি দেখলাম। নরসিংদীর ওখানে একটা ব্রিজ আছে। সেখানে আমাদের আনসার বিডিআর যারা ইপিআরে ছিল, তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের কাছে খবর ছিল আর্মিরা এদিক দিয়ে আসছে। তারা একটা ফাইট দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমরা ছিলাম খালি হাতে। আমাদের কিছু করার ছিল না। তারা আমাদের এগিয়ে যেতে বলল। পরে আমরা আগরতলা রায়পুরায় পৌঁছালাম। পার্টির নেতাদের সঙ্গে দেখা হলো।
পার্টি সিদ্ধান্ত নিল, পার্টির নেতৃত্ব পরিবর্তন হবে। ওখানে ফরহাদ ভাই, খোকা রায়, সালাম ভাই, পুরা টিমই ছিল। মণি সিংহ তখন রাজশাহী জেলে ছিলেন। জেল থেকে পরে, কয়েদিরা মিলিতভাবে উনাকে নিয়ে পদ্মা পার হয়ে কলকাতায় যায়। পরে পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

পার্টি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিল। সেটা তো সেই ৭ মার্চের পরেই। এখানে আমাকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার কাজ ছিল, আগরতলা-ঢাকার মধ্যে যোগাযোগের দায়িত্ব নেয়া এবং তথ্য পৌঁছে দেয়া। ঢাকা অঞ্চলে আটকেপড়া কমরেডদের পরিবার পরিজনকে উদ্ধার করে ভারতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও ছিল আমার কাঁধে। কাজটা অনেক কঠিন ছিল। সুফিয়া কামাল, ন্যাপের মহীউদ্দীন, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো। তাদের অভিমত, আমাকে আগরতলায় পৌঁছাতে হতো। তখন আমাকে ১০-১২ বার ঢাকা-আগরতলা যাতায়াত করতে হয়। আমাকে বলা হলো, তোমার সশস্ত্র যুদ্ধ করার দরকার নেই, তুমি অন্য যুদ্ধ কর।
আমাদের যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাদের মধ্যে যেমন, মালেকা বেগম কাপাসিয়া চলে যান মতিউর রহমানের গ্রামে। সেখান থেকে তাকে নিয়ে গেলাম আগরতলায়। কমান্ডার সাহেব এক সময় নৌ-বাহিনীতে ছিলেন। তার ফ্যামিলি এক বাড়িতে আটকা পড়েছিল। তাদেরকেও আগরতলা নিয়ে যাই। প্রথমে আগরতলা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে থাকতাম আমরা। পরে আমাদের ভকেশনাল ট্রেনিং এর একটা হোস্টেলে তোলা হলো। অনেকেই তখন আমাদের হোস্টেলে আসত। খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান, আওয়ামী লীগের তোফায়েল, আমু, রাজ্জাক প্রমুখ নেতারা যাতায়াত করত। তখন কমিউনিস্ট পার্টির অফিস যোগাযোগের একটা বড় কেন্দ্র ছিল। ভারতের সাপোর্ট, রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাপোর্ট এগুলোর জন্য কমিউনিস্ট পার্টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমে পার্টি আগরতলায় ছিল। পরে কলকাতায় চলে গেল। সিপিএম কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয়ভাবে নামেনি। সিপিআই এবং কংগ্রেস নেমেছিল। আগরতলার যে জনগোষ্ঠী ছিল, তার তুলনায় আমরা বাঙালিরা বেশি ছিলাম। সবাইতো বাঙালি শরণার্থী। এক দেড় কোটি লোক শরণার্থী। তার মধ্যে অধিকাংশই ছিল আগরতলায়।

৭১-এর অক্টোবর মাসের ঘটনা। ঢাকা থেকে চিঠিপত্র, তথ্যাদি নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মতামতসহ চিঠিপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে পুনরায় আগরতলা যাবার পথে গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি কসবা থানার তিতাস নদী থেকে উঠে যাওয়া একটা জায়গায়। সেখানে একটা বড় ব্রিজ আছে। নাম ভুলে গেছি ব্রিজটার। জায়গাটা আমাদের চলাচলের উপযুক্ত ছিল। কারণ দু-দিকে হাওড়, মাঝখানে একটা ব্রিজ। এর নিচ দিয়ে নৌকা যাতায়াত করত। এ জায়গাটা নিয়ন্ত্রণ করত রাজাকাররা। রাজাকাররা থাকলে এত সমস্যা নেই। যতটা না আর্মি থাকলে। এ জায়গাটা গঙ্গা সেতুর বিপরীতে। অর্থাৎ গঙ্গা সাগরের হাওড়ের পর সিএন্ডবি বোর্ডের মাঝামাঝি একটা জায়গা। আমার ব্যাগের মধ্যে তখন ঢাকা থেকে সংগৃহীত চিঠিপত্র ও বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র রয়েছে। নৌকায় করে পার হবার জন্য সেদিন সবেমাত্র এখানে এসে পৌঁছেছি। পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা ছিল। রাস্তায় ওঠার দু-শ গজ আগে হুট করে আর্মিরা আমাকে হল্ট করলো। আর্মিরা ডাক দিলে প্রথম দিকে শরীর শিউরে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই। এরপর আর ভয়ভীতি কিছু হয়নি। আমি ওদের কাছে গেলাম।
যাওয়ার পর কি ঘটনা ঘটল বুঝলাম না। ওরা আমাকে দাঁড় করিয়ে পাশের গ্রামে ঢুকলো। কেন ঢুকলো জানি না। এ সুযোগে আমি আমার কাছে রাখা টাকা পয়সা, চিঠিপত্র কয়েকটা আশপাশের বাচ্চা ছেলেরা ছিল তাদের কাছে দিয়ে দিলাম। ভেতর থেকে এসে আমাকে চেকপোস্টে নিয়ে গেল। সেখানে রাজাকাররা আমার হাত দুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে, অকথ্য গালিগালাজ করল। এদের অনেকে আমাকে গ্রামের বাড়ির কথা জেনে কিছুটা সদয় হলো। তাদের এলাকার পীরের শ্বশুরবাড়ির লোক আমি। তারা আমাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করতে থাকে।

আর্মিরা আমাকে জিজ্ঞাসা করল তুমি কোথা থেকে এসেছো? তখন উর্দু তো খুব একটা বলতেও পারতাম না, বুঝতামও না। এরা ছিল বেলুচ আর্মি। বাঙালিদের মতো তারাও তো পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীদের দ্বারা জাতিগত নিপীড়নের শিকার ছিল। বেলুচ আর্মিদের বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি থাকাই স্বাভাবিক। তাছাড়া মুসলমান, মুসলমানদের সঙ্গে মারামারি করে মরছে- এটা যে অন্যায় সেটা বেলুচ আর্মিরা বুঝতে পেরেছিল বলে মনে হয়। আর্মি আর রাজাকারদের সাত-পাঁচ বুঝিয়ে এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম কোনো রকমে। এখানেই আমার দুই দিন দেরি হয়ে গেল। বেলুচ আর্মির এক অফিসার এখানে আমাকে বলল, ‘বাঙালিরা এই যুদ্ধে জিতবে। কিন্তু তারা দেশ চালাতে পারবে না।’ আমি তাদের মধ্যে স্পষ্ট মানসিক পরাজয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে কথাটা এখনো আমার কানে বাজে।

আমার লোকজন আনানেয়া ছাড়াও আরেকটা কাজ ছিল। যে বাহিনীর ট্রেনিং শেষ হতো আমি তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় এনে পৌঁছে দিতাম। যখন আমি আর্মির হাতে গ্রেপ্তার হলাম তখনই এ রকম একটা দলকে দেশে আনার দায়িত্ব ছিল। আর্মির হাতে আটকা পড়ায় আমার দুই দিন নষ্ট হলো। এই সময় ট্রেনিং শেষ করে দেশে ঢোকার পথে কুমিল্লাতে একটা গ্রুপ অ্যাম্বুশের মধ্যে পড়ে গেল। ভুল পথে আসার জন্য তারা সবাই জীবন দিল। এই দলটাকে আমার নিয়ে আসার কথা ছিল। কুমিল্লা হয়ে রায়পুরে পৌঁছে দেয়াটা ছিল আমার দায়িত্ব।
যে গ্রুপটা অ্যাম্বুশের মধ্যে পড়ল তারা আসলে জায়গাটা ৪০০-৫০০ গজ রেকি না করে ঢুকেছিল। এদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র ছিল, কিন্তু ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি। কারণ গেরিলা যুদ্ধের সরঞ্জাম সব ভাঁজ করে আনতে হতো, কিছু হাতে থাকত। অতর্কিত হামলায় কিছু করার ছিল না। পরে যারা ধরা পড়ল তাদের গায়ের চামড়া ছিলে গাছে ঝুলিয়ে রাখল আর্মিরা। আমাদের ১১ জন কমরেড শহীদ হয়েছিল ওখানে। বেতিয়ারা শহীদ দিবস পালন করি আমরা এই শহীদদের উদ্দেশেই। এটা আমার ব্যর্থতা বা ভুল বা যে কোনো কিছু। এজন্য যে দুঃখ হয় তা কাউকে বোঝাতে পারব না।

নভেম্বরে আমি আগরতলা গেলাম। আমাকে ও কমরেড তাজুলকে যুক্ত করে একটা দায়িত্ব দেয়া হলো। রুট পরিবর্তন করে চৌদ্দগ্রামে ঢুকে নোয়াখালী হয়ে, নোয়াখালী থেকে হাইমচর হয়ে মুন্সীগঞ্জ- এই একটা রুট তখন। আগের রুটটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কসবা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে মেইন রুটটা দিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধারা আসা-যাওয়া করত- এইটা ছিল প্রধান রাস্তা। প্রত্যেক জায়গায় ক্যাম্প করে রাস্তাটা পাক আর্মি ব্লক করে ফেলে। যদিও সীমান্ত থেকে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করছিল। মতলব থেকে হাইমচর হয়ে মুন্সীগঞ্জ এই রুটটা নতুন করে বের করার জন্য আমাদের দায়িত্ব দেয়া হলো।
ঢাকা থেকে যাওয়ার জন্য রাস্তাটা যেটা বের করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, সেটা হলো হোমনা, মুরাদনগর, নবীনগর। নবীনগর গেলে দুটি পাশাপাশি থানা পড়ে, ডান দিকে গেলে কসবা থানা হয়ে যেতে হয় আর বাম দিক দিয়ে গেলে আরেকটা থানা পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যাতায়াতটা ছিল কঠিন। কোথাও তো সোজা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা যেত না। এক কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে কোথাও পাঁচ কিলোমিটারও ঘুরতে হতো। আমার সুবিধা ছিল, বাওয়ানী, আদমজী, করিম জুট মিলের প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিকের এলাকা ছিল এটা। ফলে আমি এই এলাকার যেখানেই যাই না কেন, আমার পরিচিত শ্রমিক বা লোকজন পেতাম। তাদের কাছ থেকে সাহায্য পেতাম।
শেষ দিকে একবার খুব দক্ষ একটা গেরিলা গ্রুপ নিয়ে ঢুকলাম। এই গ্রুপটা নিয়ে রায়পুরা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। এর মধ্যে ছিল খন্দকার ফজলুল হক, আরেক জন ছিল ওসমান গনি- কমান্ডার ছিলেন তিনি। এই গ্রুপের মধ্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম থেকে শুরু করে অনেক লোকজন ছিল। আমরা এই ৭০-৮০ জনের গ্রুপটা নিয়ে গঙ্গাসাগরের পাশ দিয়ে মনিহন্দ নামের একটা পাহাড়ি এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম। গঙ্গাসাগরের মাঝে একটা জায়গা ছিল। সে জায়গাটা তার পাশের অঞ্চলটার দায়িত্বে ছিল আইনুদ্দিন ক্যাপ্টেন। তিনি ছিলেন সীমান্তের দায়িত্বে। আর মেজর হায়দার ছিল, ঢাকার সেক্টর কমান্ডার। এদুজনের কমান্ডের অধীনে ছিলাম আমরা। অক্টোবর মাসে শেষের দিকে আমরা দুটা ডিঙি নৌকা নিয়ে এগুচ্ছিলাম। গঙ্গাসাগর নদীর পাশ দিয়ে একটা ছোট হাওড়ের মতো আছে। সেখানে দুটা কালভার্ট। প্রথম কালভার্টের পাশের গ্রামের নাম সতহুরা গ্রাম। আমরা নৌকা নিয়ে এই কালভার্টের নিচ দিয়ে যাচ্ছি তখন একটা লোক কোষা নৌকা নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, আপনারা আর একটুও এগুবেন না তাহলে ফায়ার অবধারিত। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম কেন? সে বলল আর্মি এসে পুরো গ্রাম দখল করেছে। আমি পালিয়ে আসতে পেরেছি। আর্মি কালভার্টের উপর অবস্থান নিয়ে আছে।
তখন যা অবস্থা, এই তথ্য বিশ্বাস করতেও পার নাও পার কারণ লোকটা ছিল রাজাকার। নাম ছিল হাশেম মেম্বার। এই রুটটা তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশে সব মিল কারখানা বন্ধ। ভারত থেকে এই পথেই নানা জিনিসপত্র আসতো। যারা দেশে ছিল তারা এর ওপর নির্ভর করেই বেঁচেছিল। দেশে যা কিছু উৎপাদন হচ্ছে, তাও এই পথেই ভারতে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে তখন এফএফ-এর কয়েকজন ছিল। তরুণ যুবকদের ১৫ দিনের একটা ছোট ট্রেনিং দিয়ে যোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করা হতো- এদের এফএফ বলতো। এদের তৈরি করার উদ্দেশ্য ছিল, মুসলিম লীগ, জামায়াত বা অন্যান্য রাজাকারবাহিনীদের সরিয়ে গ্রামগুলোর দখল নেয়া। এদের অ্যাকশনটা ছিল অস্থায়ী অ্যাকশন। যেমন আমার গ্রামের বাড়িতে আমার চাচা মুসলিম লীগ করত। এফএফ তার ওপর গ্রেনেড চার্জ করল। যদিও উনি মারা যাননি। মুক্তিযুদ্ধে এরকম বিশেষ আরো কিছু বাহিনী ছিল। মুজিব বাহিনী, কাদেরীয়া বাহিনী। কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনী, মেনন ভাইদের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী ছিল। বরিশালের পেয়ারা বাগানের বাহিনী ছিল স্বতন্ত্র বাহিনী।
আমাদের মধ্যে থাকা এফএফ-এর ছেলেরা হাশেম মেম্বারের সতর্কবাণী শুনে বসে থাকতে চাইল না। তারা ছিল অন্য একটি নৌকায়। তারা রওনা দিল। কয়েক গজ যাবার পর একটা বাঁকের কাছে যেতেই তারা ফায়ারে পড়ল। আমাদের তিনটা নৌকার মধ্যে একটা নৌকা যেটার নেতৃত্বে খন্দকার ফজলুল হক ছিলেন সেটা কিন্তু আগেই পার হয়ে চলে গিয়েছিল। এফএফ-এর সদস্যরা যারা বেঁচে গেলেন আমরা তাদের উদ্ধার করলাম। তখন আমাদের উপর মর্টার শেল ফেলা হলো। দশবার মর্টার শেল ফায়ার করল। সকলেই অপ্রস্তুত থাকার কারণে যে যেদিকে পারল লাফ দিয়ে পড়ে, দৌড়ে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করল। অসংখ্য অস্ত্র পড়ে রইল। একজন শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেন। সে হলো ওসমান গনি সাহেব।
পরে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো, ওই কালভার্টের ওপর টহল গাড়ি কত সময়ের জন্য থাকে, কতক্ষণ সময় আমরা পাব এই জায়গাটা পেরোনোর জন্য তা রেকি করে আসতে। আমরা উদ্ধার করলাম আর্মির গাড়িগুলো ব্রিজের ওপর দিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে প্রায় ২৫ মিনিট লাগে। আমরা জানতাম, রাত দুটার দিকে মানুষের একটু ঝিমুনি আসে। এ সুযোগে আমরা নৌকা দুটি রাস্তা দিয়ে পার করে এপারে এসে নদীতে নামালাম। এদের রায়পুরা পৌঁছে দিয়ে আবার আমি আগরতলা চলে আসি। পরে আমাকে পার্টি আবার পাঠিয়ে দিল। বলল, এলাকায় যাও। দুটো মানুষকে বাঁচাতে পারলেও তো বেশি। এখানে কোনো কাজ নেই।

আমি যখন ফিরে আসছি তখন ১৫ ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বরেও আমি রাস্তায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে ডেমরা এলাকাতে আসলাম। তখনও নবীনগর যুদ্ধ চলছে। অথচ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ঘোষণা হয়ে গেল। কারণ, নবীনগরের পাকিস্তান আর্মি কোনো ক্রমেই বাঙালিদের কাছে আত্মসর্পণ করতে রাজি না। পরে ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৭ তারিখ পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। আমার এলাকা ডেমরায় যখন পৌঁছালাম, কারখানায় এক শ্রমিক আমাকে চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরল। বলল আপনি চলে যান। নইলে আপনাকে হত্যা করবে। আমি বললাম, দেশ স্বাধীন। কে মারবে আমাকে? বলল, হামিদ মাতুব্বরকে তো মেরে ফেলছে। পরে জানলাম, এই লোক এলাকার কমান্ডার। ফেনীর লোক ছিল সে। আব্দুল আউয়াল। হামিদ মাতুব্বরকে সে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কারণ ওই এলাকা দিয়ে যে মালপত্র আনানেয়া হতো, তাতে সে চাঁদা উঠাতো। প্রতিবাদ করায় তাকে হত্যা করা হয়। মাতুব্বর মূর্খ হলেও ছিল দেশপ্রেমিক। আউয়ালের হিসাব হলো হামিদ মাতুব্বর বেঁচে থাকলে, তার নেতৃত্ব থাকবে না। মাতুব্বর না থাকলে সে হবে এলাকার একচ্ছত্র নেতা। মাতুব্বরকে মেরে ফেলার পর এলাকাতে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হলো।

হামিদ মাতুব্বরের ঘটনায় আমি একটু সন্ত্রস্ত ছিলাম। গিয়ে উঠলাম শ্বশুরবাড়িতেই। সব জ্বলেপুড়ে একাকার। পরের দিন দেখলাম, মিলে আগুন জ্বলল। কামানের গুলিতে বাওয়ানী জুটমিলের অনেক কিছু জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। আমরা সকলে মিলে কারখানাতে ঢুকতে চাইলাম। কিন্তু কারখানার গেটে এফএফ-এর লোকজন, আমাদের ঢুুকতে দিল না। চেতনাটা দেখুন, আমরা বললাম, মিলে আগুন জ্বলছে এগুলো নিভাতে হবে। কারখানা বাঁচাতে হবে। তারা বলল, জ্বলুক! এটা তো শত্রুসম্পত্তি। মানে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু তখনও মনে করতে পারছে না যে, দেশটা তার।
পরে আমরা মিলের দখল নিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা গ্রুপ জিপ-অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এদিক আসছিল। তাদের কাছে সাহায্য চাইলাম। অস্ত্র দেখিয়ে আমাদের মিলে ঢুকতে হলো। মিলে গিয়ে দেখলাম আগুন জ্বলছে। প্রাথমিকভাবে পুরো মিলের দায়িত্বই কিন্তু আমাকে নিতে হয়। কিছু শ্রমিকদের তাবু খাটিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। বলা হলো যে তোমরা এখানে থাক, খাও, আর কাজ কর। মিলের পুঁজি বলতে তখন গোডাউনে। কিছু চাল আর গম। মিল অনানুষ্ঠানিকভাবে টেক অফ করতে হলো আমাকেই। কোনো মালিক নেই, ইঞ্জিনিয়ার নেই। দু’চারজন অ্যাসিটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিল শুধু।
প্রাথমিক কাজ বলতে, আগুন নেভানো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, রক্ষণাবেক্ষণ এগুলো করতে লাগানো হলো। শ্রমিকদের কলোনি পুড়িয়ে দিয়েছিল। এর আগে ১৭-১৮ তারিখের দিকে, মিল, স্টাফ কোয়ার্টার লুট হয়ে গেল। কলোনিতে তাঁবু টানিয়ে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। এভাবে আবার মিলের কাজটা শুরু করলাম।
সাপ্তাহিক : যুদ্ধের পরপর কি অনুভূতি হলো আপনার? স্বাধীন দেশ! কি পেলেন, কি পেলেন না?
সহিদুল্লাহ চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত এরাই তো শাসক শ্রেণীতে পরিণত হলো। ধনী মালিকদের ব্যবস্থাপনার একটা রাষ্ট্র। কিন্তু সেই ধনী মালিক বা বুর্জোয়া নেই। মানুষ এই মধ্যবিত্তদের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করল। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব বিশ্বাসঘাতকতা করল। আমাদের স্বাধীনতা যেমন বীরত্বের-গৌরবের, তেমনি স্বাধীনতা হলো বিশ্বাসঘাতকতারও। বিশ্বাসঘাতকতা হলো, শ্রেণী বিশ্বাসঘাতকতা। এখানকার মেহনতি মানুষ, কৃষক সমাজ, যারা এই যুদ্ধের মূল ভিত্তি, তাদের মুক্তিটা এলো না। সংবিধানে চারটা মূল রাষ্ট্রীয় নীতিÑ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, এই কথাটা ছাড়া আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার কোনো সুফল পায়নি। যা পেয়েছে তা একটা বিশেষ শ্রেণী, বড় মালিকরা আর তাদের সহযোগীরা।

আমি সে সময় পার্টির নীতিনির্ধারণীতে ছিলাম না। কিন্তু নীতি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা ছিল। দেশ স্বাধীনের পর পার্টির কাজের ধারা ও চিন্তা-চেতনার জায়গাটা পরিবর্তন হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের আগে পার্টি বলতো, পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে মুক্ত করা এবং ২২ পরিবারের হাত থেকে মুক্ত করা। কিন্তু ৭২ এ নতুন নীতি গ্রহণ করা হলো, দেশ পুনর্গঠনকেই পার্টি প্রধান কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করল। অর্থাৎ যে নীতিটাকে রাষ্ট্র গ্রহণ করছে সেটা ধরে পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য অগ্রসর হওয়া। ফলে যে মধ্যবিত্তরা ক্ষমতায় আসল, তাদের সহযোগিতার নীতি নিল পার্টি।
৭৩ এর কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে পার্টির কর্মসূচিতে পরিবর্তন আসল। এখন কর্তব্য হিসেবে ধরা হলো, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। অর্থাৎ বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন করে এগোতে হবে। মস্কোপন্থি পার্টি যারা ছিল তারা সকলেই তখন এ নীতি গ্রহণ করে। প্রথমে ৭৩-এর কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে বলা হলো যে বিপ্লবী প্রক্রিয়া আরম্ভ হচ্ছে। পরে আমরা এটা বলেছি যে, এটা আমাদের ভুল ধারণা ছিল। এটা বিপ্লবী প্রক্রিয়া নয়, এটা প্রগতিশীল প্রক্রিয়া। এরা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল ধারা ছিল। এই ৭৩ এর কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে আমি প্রথম পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হলাম।

যখন গোপন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল তখন ৫-৬ জনের একটা কমিটি ছিল। আমি প্রথম কংগ্রেসেরও প্রতিনিধি, ৬৮ সালে গোপনে যে কংগ্রেস হলো সে কংগ্রেসের কংগ্রেস মেম্বার ছিলাম আমি। সাইফুদ্দিন মানিক ৭৩ এর কংগ্রেসে সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হলো। তখন প্রেসিডিয়াম ছিল না। সম্পাদকমণ্ডলী। ৭৩ সালে যখন কংগ্রেস করল, তখন সদস্য বেশি হয়ে গেল। ৩০ এর উপরে সদস্য ছিল। এ কমিটিতে পুরনো তো ৫-৬ জন। সবই নতুন লোকজন আসল। নতুনের মধ্যে অধিকাংশই আসল, যারা ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা। সাইফুদ্দিন মানিক, নূরুল ইসলাম নাহিদ, নূহ উল আলম লেনিন প্রমুখ।

একথা অনস্বীকার্য যে, দেশ স্বাধীনের পরেই আমাদের পার্টি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার মধ্যে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তার মধ্যে ছিল পার্টি গোপন থেকে প্রকাশ্য করা আর পার্টিটাকে দ্রুত বড় করার যে সাধারণ লাইন। পার্টি দেশব্যাপী একটা বড় পার্টি হয়ে উঠবে এ লক্ষ্য থেকে এগুতে গিয়ে সাংগঠনিকভাবে লেনিনবাদী যে মূলনীতিগুলো পালন করার কথা ছিল, নীতিগতভাবে তা থাকলেও এগুলোর খুব কমই পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। মধ্যবিত্তের একটা অংশ শ্রেণীচ্যুত হয়ে পার্টিতে আসবে- এটা স্বাভাবিক। মণি সিং, বারীন দত্ত এরা মধ্যবিত্ত থাকে নাই। কারণ সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব স্বীকার করার মধ্য দিয়েই যখন একজন মানুষ কমিউনিস্ট পার্টিতে আসে তখন সে আর মধ্যবিত্ত থাকে না।
কিন্তু আমাদের যে নেতারা পরে বেরিয়ে আসল তখন পার্টি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অর্থাৎ আদর্শ হিসেবে তারা কমিউনিজমকে গ্রহণ করে পার্টিতে আসল। কিন্তু তাদের স্বভাবের মধ্যে মধ্যবিত্ত ভাবধারা রয়ে গেল এবং ব্যক্তিজীবনে ওই স্বভাব বৈশিষ্ট্য বহাল থাকল। এগুলো তারা পরিত্যাগ করতে পারেনি। ফলে যখন পার্টি সঙ্কটে পড়ল তখন তারা পার্টি ছেড়ে চলে যেতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ৭৩-এর কংগ্রেসে আমরা আওয়ামী লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল বলি নাই, বলেছি মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের দল। তখন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে সম্ভাবনার জায়গাটা রয়ে গেছে সেটাকে চিহ্নিত করতে চাচ্চিলাম। তা না হলে আমরা আওয়ামী লীগকে সে সময় উচ্ছেদের লাইন নিতাম। আমরা তা করিনি। আমরা সহযোগিতার লাইন নিয়েছি। আওয়ামী লীগকে শ্রেণী হিসেবে প্রগতিশীল বুর্জোয়া হিসেবে আমরা দেখেছি। যেহেতু জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুর্জোয়াদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে তাই লাইনগত কারণেই তাদের আমরা পাশে রাখতে চেয়েছিলাম। এ ছিল আমাদের মূল্যায়ন। আমরা তাদের জাতীয় বুর্জোয়া চরিত্রের দল হিসেবে দেখতাম।
পার্টিতে যে মূল সমস্যার জায়গাটা তা হলো, শ্রমিক থেকে আগত লোকজন অত্যন্ত কম। লেনিন বলেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে শ্রমিকদের সংখ্যা সবসময় বেশি হবে। কিন্তু আমাদের এখানে শ্রমিক শ্রেণী সবসময় সংখ্যালঘিষ্ঠ। আর নেতৃত্ব সবসময় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে ছিল। আমাদের শ্রমিকরা, শ্রেণী হিসেবে ও চিন্তা-চেতনার দিক থেকে এখনো সে রকম উন্নত না। এবং সাধারণভাবে যারা এখানে আসে তারা কাজকর্মের দিক থেকে অনেক অগ্রসর কিন্তু চিন্তা-চেতনার দিক থেকে তেমনটা না। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে, নীতিনির্ধারণী স্তরে গিয়ে ভুল করে। এসব কারণে তারা সামনে আসতে পারে না।
শ্রমিক কৃষকের মধ্য থেকে যারা আসছে তারা তো মার্কস লেনিন বুঝে বা আত্মস্থ করে যে পার্টিতে এসেছে তা তো নয়, একটা প্রত্যক্ষ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা পার্টিতে এসেছে। ফলে, তারা কমিউনিস্ট কিন্তু পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য যে ত্বত্তীয় জ্ঞান থাকার দরকার তা তাদের ছিল না বা নেই। আমাদের পার্টিতে এ রকম অনেক শ্রমিক নেতা ছিলেন, যেমন সুনীল রায়, মকবুল হোসেন শ্রমিক ছিলেন, সে অবস্থা থেকে তারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে এসেছিলেন। এদের রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এ শ্রমিক নেতারা পার্টিকে নেতৃত্ব দিতে পারেননি।

৫ম কংগ্রেসেই একটা কমিশন করা হয়, কমরেড অজয় রায় কমিশন। ঐ কমিশনে যারা বেরিয়ে গেল তারা মত দিল যে, ধর্মের উপর যে মানুষের প্রবল বিশ্বাস, এর ফলে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে জনগণের আস্থা নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা কম। যদি ক্ষমতায় যেতে হয় তাহলে কর্মসূচি ভিত্তিক, নাম পরিবর্তন করে অন্য নাম দিয়ে বিপ্লবী ধরনের পার্টি অর্থাৎ মার্কসবাদ থাকবে তবে লেনিনীয় মূলনীতিগুলো থাকবে না। এ প্রস্তাবটা নিয়ে আসল আমাদের যে ৬ জন সংসদ সদস্য ছিল তারা। নেতা ছিল শামসুজ্জোহা। প্রথমে মানিক ভাইরা সাহস পায়নি। জোহা সাহেবই প্রস্তাব নিয়ে আসল যে বিকল্প একটা পার্টি করে আশু কর্মসূচি ভিত্তিক একটা পার্টি করা যায় কিনা। সাইফুদ্দিন মানিক তখনও কোনো অংশে যাননি। পার্টির অধিকাংশ মেম্বার তার দিকে তাকিয়ে ছিল যে, সে কোন দিকে অবস্থান নেয়। এ অবস্থান যতক্ষণ ছিল, জোহা সাহেবেরা মাইনরিটি ছিল পার্টির মধ্যে। মানিক ভাই যখন পার্টির বিপক্ষে অবস্থান নিল, তখন আমরা মাইনরিটি হয়ে গেলাম। শামসুজ্জোহারা ছিল সুবিধাবাদী। এরা কমিউনিজমের আদর্শ ছেড়ে দিয়ে সুবিধাবাদীদের দলে চলে গেল।
মানিক ভাই, তার সঙ্গে তো আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তিনি কিন্তু আমাকে কখনো পার্টি ছাড়তে বলেননি। আমার মনে হয় উনি ভয় পেয়েছিলেন। কারণ সে সময় রাশিয়ান পার্টি কোনো কোনো নেতাদের অর্থ সহায়তা করত। তার তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছিল বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন বিদেশি দেশি এজেন্সি এ নিয়ে অপপ্রচার চালায়। তৎকালীন রাশিয়ান পার্টির সাথে আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল। তারা নানাভাবে আমাদের সাহায্যও করেছিল। যেমন ছাত্র টিউশন, ছাত্র বৃত্তি, কোটি কোটি টাকার বই ইত্যাদি সহযোগিতা পেতাম আমরা। টিইউসি সে সময় কোনো না কোনো ধরনে ৬ হাজার ডলার মাসিক সহযোগিতা পেত। এটা তো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানিক ভাই পার্টিতে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলল। পরে বেরিয়ে যান।

আমি ব্যক্তিগত জীবনে অর্থাৎ আমার রাজনৈতিক জীবনে, তত্ত্বীয়ভাবে পরিপক্ব হওয়ার কোনো সুযোগই পাইনি। ব্রিটিশ আমলে বা পাকিস্তান আমলে, শিক্ষাটা হতো জেলখানায়। কিন্তু আমি তো কখনোই একটানা জেলে থাকি নাই। ফলে, সে সুযোগটা হয়ে ওঠেনি কখনো। এ রকমও কমরেডরা ছিলেন যারা বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। কিন্তু আমার সংগ্রামী জীবনে ৪৬ দিন মাত্র হাজতবাস করেছিলাম।
১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির মেম্বার ১৫ জন, ১৫ জনের মধ্যে ১০ জন প্রেসিডিয়াম মেম্বার বেরিয়ে গেলেন। তখন কিন্তু আমিই কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। কঠিন অবস্থা ছিল সেই সময়। আমি আর কমরেড সেলিম ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে আরও ১১ জন ছিল। ৭৫-এর মধ্যে মাত্র ১৩ জন আমাদের সঙ্গে ছিল। এ রকম কঠিন সময়ে আমি পার্টির হাল ধরলাম। আবার মনজুরুল আহসান খান এবং জসীমউদ্দীন মণ্ডলকে অতিক্রম করে আমি পার্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হই। এটাও চ্যালেঞ্জের ছিল।
আমি কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সরে যাই। আমার কোনো সমালোচনা ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে দায়িত্ব পালন করতে হয়, করা দরকার সে ভূমিকা আমি নিতে পারিনি। কারণ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়ভার বহনের জন্য যে পারিবারিক অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকা দরকার সেটা আমার ছিল না। পরিবারের ন্যূনতম সামর্থ্য যদি না থাকে, তবে এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এ দুর্বলতার কারণে একটা ভীতি কাজ করে। যেমন আজ একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার অনুভব করছি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলে সেটা পালন বা বাস্তবায়নের জন্য যে ন্যূনতম সম্পদ প্রয়োজন সেটা আমাদের হাতে নেই। তাহলে কিভাবে হবে? কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তাই নিজস্ব সামর্থ্য থাকতে হয়। এ সমস্যাটা একটা সময় পর্যন্ত আমাদের মতো দেশে থাকবেই। কথা হলো আমাদের পার্টিগুলো তো অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না। এখন বাসদ গণমুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহ করে- এটা একটা উপায়। কিন্তু তারপরও খুব প্রয়োজনীয় বিষয় মেনটেইন করা সম্ভব হয় না। তার মধ্যেও যাদের পারিবারিক বা সাংসারিক জীবন নেই তাদের বিষয়টা আলাদা। অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী এরা তো আর ঘরসংসার করেন নাই। এদের বিষয়টা ভিন্ন। যেমন আমার সংসার আছে, আমি যে খুব ভালোভাবে সংসার করছি তা না। আবার পরিবারের সে সামর্থ্য নেই যে সেখান থেকে অর্থ নিয়ে পার্টিতে দেব।
৯৯ সালে আমি স্বেচ্ছায় সভাপতি পদ থেকে সরে দাঁড়ালাম। আমি মনে করি যে, পার্টিতে নতুন মানুষ, নতুন নেতৃত্ব আসা দরকার। আমি পরে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের দায়িত্ব নিলাম দেখলাম, এটাও শ্রমিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আর আমি শ্রমিক আন্দোলন করে আসা মানুষ।

এক নম্বর হলো, পার্টি শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল হলে এটা হতো না। শ্রমিকদের ফেডারেশন, ইউনিয়ন থাকে। অর্থ সঙ্কুলান কঠিন হয় না। কিন্তু এখন এই সমস্যাটা থাকবেই। একজন শ্রমিক চাকরি বাদ দিয়ে পার্টির দায়িত্ব পালন করলে তার পরিবার কে দেখবে? সে নেতা হতে পারবে না। এই সমস্যা আমাদের দেশে আরো কিছুকাল চলবে।
আরেকটু বলি, এর মধ্যেই আমার মাথায় ১২টা ক্রিমিনাল মামলা জুটলো। ১২টা মামলা মানে সারা দিন কোর্টে পড়ে থাকা। সবগুলো মিথ্যা মামলা। আবার ঘর থেকে বের হলে আক্রমণ। তখন পার্টির কমরেডরা বলল, ডেমরাতে আপনার আর থাকা উচিত হবে না। তখন পরিবার নিয়ে চলে আসলাম হাজারীবাগ। ছোট্ট একটা রুম আরেকটা ডাবল রুম নিয়ে উঠলাম। পার্টি আমাকে তখন ৬০০ টাকা সহযোগিতা দিত। ৬০০ টাকা বাড়ি ভাড়াই লাগে। আমার চার সন্তান, আর সংসারের খরচ কোথা থেকে আসবে তা জানতাম না। ডেমরার বাড়ি ভাড়া থেকে যা পেতাম তাই দিয়ে সংসার কোনোক্রমে চালাতাম।
সে সময় জাসদের এক আপা ছিল। উনি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। আমাদের কষ্ট দেখে ওনার রেশন কার্ডটা আমাদের দিয়ে দিলেন। ফলে এ রকম অবস্থার মধ্যে পার্টিকে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব ছিল না। তা আমি যতই পরিবর্তনকামী হই না কেন? কিন্তু এটা যদি শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, যদি শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মধ্যে থাকা পার্টি হতো, তবে শ্রমিকরাই এ সহযোগিতাটা করতে পারত। যেমন আমাদের বাওয়ানীতে শ্রমিক জমায়েতের জন্য পার্টিকে কোনো অর্থ খরচ করতে হতো না। আমাদের বাসার সাহেব সারাজীবন শ্রমিকদের টাকায় চলেছেন। সংগঠন থাকলে সেটা সম্ভব। কিন্তু না থাকলে সেটা সম্ভব নয়।

একটু পেছন থেকে বলি। স্বাধীনতার পরপর ৭৩ সালে সম্ভবত, আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণঐক্য জোট করলাম। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ আর আমরা ছিলাম জোটে। জোট মানেই তো সামষ্টিক কাজ ও সক্রিয়তা। জোট হলো একটা। কিন্তু কোনো কিছু হতো না। বছরে একটা মিটিং হতোÑ আর কিছু হতো না। এবং পুরো জোটে, সমস্ত সিদ্ধান্ত বুর্জোয়া পার্টি হিসেবে আওয়ামী লীগ তার মতো করে চালাত, এখানে কমিউনিস্ট পার্টি, জোটের যত বড় অংশীদারই হোক না কেন নীতি প্রণয়নে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সে সময় এ ধরনের জোটে যাওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।
কমিউনিস্ট পার্টি যদি জোটে না গিয়ে স্বাধীন অবস্থানে থেকে আওয়ামী লীগের পজেটিভ কাজের সমর্থন, অন্যায় কাজের সমালোচনা অর্থাৎ বিরোধী দলের ভূমিকাটা নিতে পারত তবে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। এটা কমিউনিস্ট পার্টির একটা মারাত্মক ভুল ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। এটা দেশের গণতন্ত্রের জন্য এবং জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের জন্য একটা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। সে সময় সিরাজ সিকদাররা যে আন্দোলনে ছিলেন বা হক, আলাউদ্দিনরা যে নকশাল বাড়ির লাইনে এগোচ্ছিলেন তাও সঠিক ছিল বলে আমরা মনে করতাম না। তা সত্ত্বেও সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে তাদের আন্দোলন ধ্বংস করার মতো কোনো লাইনে বা নীতিতে আমরা ছিলাম না।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকার ফলে, উভয় সঙ্কটে পড়ল পার্টি। তাদের যে কর্মকাণ্ড, সেটাকে সমর্থনও করা যায় না, আবার তারা যে নির্যাতন চালাচ্ছে এটার প্রতিবাদও করা যায়নি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অনীল মুখার্জির প্রধান ও তাত্ত্বিক ভূমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা ছিল দক্ষিণপন্থি বিচ্যুতি। ওই লাইন নিয়েই কিন্তু আমাদের এক সময়ে মূল্যায়ন দাঁড়ালো জিয়া দেশপ্রেমিক। এটাতো পরোক্ষভাবে জিয়াকে সমর্থন করা।

অনীল মুখার্জি ছিলেন জমিদার বাড়ির লোক। সেখান থেকে চির বিপ্লবী। তিনি এ ধরনের ঝোঁকের মধ্যে পড়ার কারণ হলো- রানদৌভের থিসিস। ১৯৪৭ সালে যে ভুলটা কমিউনিস্ট পার্টি করল, তাতে আমাদের অনেক কমরেডকে জীবন দিতে হয়েছিল। অনেককে জেলে যেতে হয়েছে। পার্টি নিষিদ্ধ হয়। এই উগ্রপন্থা থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে, পার্টিকে নিরাপদ করতে গিয়ে তিনি লড়াইয়ের লাইন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। ৪৭ সালে অনেক নামকরা বিপ্লবী কোলকাতায় চলে গেল। ফলে ১২ হাজার পার্টি মেম্বারের মধ্যে থাকল মাত্র তিনশ। এখান থেকেই তৈরি হলো রক্ষণশীলতা। মা যেমন তার বাচ্চাকে কোলের মধ্যে রাখতে চায়, তেমনি কোন ধরনের বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে অনিল মুখার্জী তখন যেতে চাননি। ফলে দক্ষিণপন্থি বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে পার্টি এগিয়েছে। আর এ কারণে পার্টি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আরো একটা দিক আছে। ’৬০-এর দশকে বিপ্লব করতে যারা মুসলিম ঘর থেকে আসল তারা চীনপন্থার নেতৃত্ব দিলেন। মুসলিম লিডারদের বড় অংশ বেরিয়ে গেল। থেকে গেল মাইনরিটি। অর্থাৎ সিপিবিতে ওই সময়ে হিন্দু পরিবার থেকে আসা বিপ্লবীদের বড় অংশ থেকে গেল। যেমন দীপন দত্ত, মুকুল বোস, মনি কৃষ্ণ সেন, পাবনায় আমিতাভ লাহীড়ি। ধারাটা হলো, বিপ্লবীবাদী আন্দোলন, তারপর আন্দামানের দ্বীপান্তর জেল থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান সেখান থেকে ৪৭ সালে উগ্রলাইন। সেখানে আবার ধাক্কা খাওয়া। ঐ ধারারই নেতা ছিলেন অনিল মুখার্জি। আর হক বা তোয়াহা সাহেবরা তো অনেক পরে আসলেন। ফলে সিপিবির মধ্যে এই বিচ্যুতির বীজ ছিলই। এই দক্ষিণপন্থা নিয়ে, সঠিক বুঝাটা না নিয়ে ৯০ পর্যন্ত পার্টি এগিয়ে গেল। এর সাধারণ পরিণতিতে, ৯০-এ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটল, কমিউনিস্ট পার্টির সামনের সারির নেতারা, যারা তিন দশকে গড়ে উঠল, যারা মূল নেতৃত্ব অর্থাৎ পরীক্ষিত নেতৃত্ব ছিল, তারা একযোগে নাই হয়ে গেল।

জাসদকে আমরা সিপিবি জন্মলগ্ন থেকে নেগিটিভলি দেখি। জাসদের মধ্যে অনেক ত্যাগী নেতা ভালো লোক ছিল কিন্তু তার যে লিডারশিপ তার যে রাজনৈতিক বক্তব্য এটা কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য। এক সময় তারা যে সেøাগান দিয়েছিল, আজ তাদের উল্টো সেøাগান দিতে হচ্ছে। এটা নেগেটিভ ফোর্স ছিল। সিরাজ সিকদারের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
৭৪ সালে বাকশাল হয়, গণঐক্য জোট ব্যর্থ হলে তখন কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নিল, এই ঐক্যে জোটের কোনো কার্যকারিতা নেই। সেই সময় যে পরিস্থিতি দাঁড়াল, দুর্ভিক্ষ-বাকশাল, সব মিলিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নিল প্রগতিশীল ধারাটাকে রক্ষা করতে হবে। এটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনোভাবেই রক্ষা হবে না। এখন, নতুন একটা মৈত্রী জোট করে যে পার্টি যেখানে থাকুক না কেন! কিন্তু শেখ সাহেব বললেন, না মৈত্রী জোট করে হবে না এক দলে এসে পড়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিন্তু বাকশালকে সমর্থন করেনি। মৈত্রীজোটের যে প্রস্তাব করেছিলাম সেটাকে তারা সমর্থন করেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে আলাদা একটা জোটে যাওয়ার পক্ষে ছিল তারা। বাকশাল নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। বাকশাল যারা সমর্থন করেছিল তারা কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে থাকল না।
এরপর মুজিবের হত্যাকে আমরা প্রতি বিপ্লব হিসেবে দেখি। এবং সে সময় স্বাভাবিকভাবেই এর বিপক্ষে অবস্থান নেই। আমরা তো এটার প্রতিরোধ করার চিন্তা করি। অনেকে বলেন যে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সিপিবির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মুজিব হত্যার পর আওয়ামী লীগ কিন্তু দাঁড়াতে পারেনি। আমরা কিন্তু মাঠে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে মিছিল বের হলো, সেখানে খালেদ মেশাররফ এর মা যুক্ত হয়ে যান। এই প্রথম মিছিল হলো নভেম্বরের তিন তারিখে। ওই দিন রাতে খালেদ মোশাররফরা ক্যু করল।
মোশতাক যুদ্ধের সময় থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার জন্য প্রচুর মুভ করেছিল। এক সময় ভাসানীও তাই মনে করল। এই কনফেডারেশনের প্রশ্নে ভাসানীকে অন্তরীণ করা হয়। আওয়ামী লীগের ভেতরে মোস্তাকসহ অনেক লোকজন ছিল, যারা কনফেডারেশন চাইত। তাছাড়া আপসের লাইনে অনেকেই ছিল। ভাসানী অন্য আর একটা পক্ষ ছিল। মোস্তাক সরকারকে আমরা প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করি। জিয়া যখন আসল আমরা এটাকে একটা ব্যালেন্স মনে করলাম। ৩ মার্চ যে ঘটনাগুলো ঘটল, জিয়া আসার পর কিন্তু একটা ব্যালেন্স হলো। যদিও সে জামায়াতকে নিয়ে গেল রাজনৈতিক মঞ্চে। সে সময়ে মোস্তাক যে অবস্থানে চলে গিয়েছিল, মোস্তাক সরকারকে উচ্ছেদ করা ছিল আমাদের এক নম্বর টার্গেট।
জিয়া সম্পর্কে আমাদের অবজারভেশনটা খুব সঠিক প্রমাণিত হয়নি। আমাদের ধারণা ছিল, জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ধারাটাকে ধারণ করবে। কিন্তু আপস করে তো সে অন্য পক্ষে চলে গেল। এবং এ ধারণাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। সে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি তার স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করতে ব্যস্ত থাকল। বামপন্থিরা আর সামনে আসতে পারল না।

৯৩-এর পর পার্টি একটা কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। পার্টির সে অর্থেই যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় পার্টির গণসংগঠনগুলো সব শুকিয়ে যাচ্ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি হতো গণসংগঠন। একজন কমিউনিস্ট হাজার মানুষের নেতা সে যোগ্যতা যদি না থাকে কমিউনিস্ট পার্টি কখনও বিপ্লব করতে পারবে না। সবাই কি কমিউনিস্ট হবে? কোনো কালেই হবে না, সংখ্যা কম থাকবে কিন্তু তার চরিত্র তার প্রভাব দিয়ে গুণ দিয়ে সমাজকে নেতৃত্ব দিবে। তার হেজিমনিটা হলো তার যোগ্যতা। শুধু কথা দিয়ে নয়, কাজের মধ্য দিয়ে সে মানুষকে সংগঠনে টানে। এটা যদি করা যায় তবে রিক্রুটমেন্ট স্থায়ী হবে।
৯৩ সালে আমরা লাইনটা চেঞ্জ করলাম। কৃষক সম্মেলনে কমিউনিস্ট পার্টিকে পুনর্গঠিত করার পর আমরা আওয়ামী লীগ বুর্জোয়াদের সঙ্গে জোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন যেটা দরকার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলা, কর্তব্যটা গণতন্ত্রের জন্য কিন্তু এখানকার বামপন্থিরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হয় শক্তি সঞ্চয় না করে তাহলে বিকল্প সম্ভব না। পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা যদি এক জায়গায় দাঁড়াতে পারে তাহলে আমাদের দেশে, এখনও সম্ভাবনা আছে। রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ করে একটা ঐক্যবদ্ধ জায়গায় দাঁড়ালে জনতার আস্থার জায়গাটা পাবে। এখনও যা আছে, আমরা যদি একত্রিত তবে যে কোনো চ্যালেঞ্জ নেয়ার মতো শক্তি হতে পারি। কিন্তু বিচ্ছিন্নতার কারণে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।

রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি বার বার সিপিবিকে সতর্ক করেছিল এ বিষয়ে। তারা বলেছিল পার্টিতে সন্দেহভাজন লোক অবস্থান করে কি না। অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত লোক পার্টিতে আছে কি না! নাম বলতে চাই না তবে পরে আমরা ধরতে পেরেছিলাম। সে তো কমিউনিস্ট পার্টি পুরোটাই তার ক্যাপচারে নিয়ে নিয়েছিল। ৫ম কংগ্রেসে, সে ফরহাদ ভাইকে আউট করে দেয়ার জন্য মুভ করেছিল। পরে আমরা এটা ধরতে পারলাম। পরে তাকে বহিষ্কার করা হয়। সিআইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এখনও আছেন এদেশে। স্বনামধন্য ব্যক্তি তিনি। এখনো লোকে তাকে সিআইয়ের লোক হিসেবেই চেনে।

রাজনৈতিক আদর্শের মানুষ হিসেবে মণি সিংকে আমি প্রিয় মানুষ হিসেবে এগিয়ে রাখব। আর জাতীয় পর্যায়ে সাইফুদ্দিন আহমদ মানিককে যোগ্য মানুষ হিসেবে সামনে রাখব। সমালোচনা করতে পারি, তবু সাইফুদ্দিন মানিককে আমার আজো পছন্দ। তারা যে দল বিলুপ্ত করে চলে গিয়েছিলেন, সেখানেও অনেক ঘটনা আছে। তারা ছিল মেধাবী ও পরীক্ষিত নেতৃত্ব। তারা চলে যাওয়ার পর যারা পার্টিজান, দেশপ্রেমিক তাদের যোগ্যতা কম হলেও তারাই পার্টিতে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। একদিক থেকে দেখতে গেলে তো এরাই যোগ্য। অনেক যোগ্যতা নিয়ে তারা থাকতে পারল না। অল্প যোগ্যতা নিয়ে থেকে গেল। এগুলোকে মূল্যায়ন করার অনেক দিক আছে।
সেলিমকেও আমার পছন্দ। সে সময়ে সেলিমের প্রতি দিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেলিমের চিন্তার সঙ্গে যদিও আমার একটু বিরোধ ছিল। আমার চিন্তা ছিল, পার্টিটা যদি সাংগঠনিকভাবে একটু শক্তি নিয়ে না দাঁড়ায়, যত সাংগঠনিক সঠিক সিদ্ধান্তই নেই না কেন সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে আমি সাংগঠনিকভাবে মুভ করলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয়কাজে সেভাবে ভূমিকা থাকল না। এটা তার একটা সমালোচনা আমার সম্পর্কে। আমার মূল্যায়ন ছিল আমি শুধু কর্মসূচি দেব, কিন্তু বাস্তবায়ন করবে কে? তার জন্য তো সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনও আছে। খুব মাইনর ডিফারেন্স ছিল। এর ফলাফলটা এখন সেলিম মূল্যায়ন করবে কি না জানি না। এত কিছুর মধ্য দিয়ে যে পার্টিটাকে রক্ষা করতে পারছে এটাও কম কি!
তবে পার্টির যে শক্তি, যতটুকু জামায়েত ক্ষমতা, মিলিটেন্সী আমার সময়ে ছিল এর পরবর্তীতে কমরেড মঞ্জুু ৯৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে সেই জায়গাটায় খুব ভালো করতে পারেননি। তেমন একটা সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় পেলাম না। কিন্তু যুবকদের মধ্যে মঞ্জু খুবই জনপ্রিয়। সে দ্রুতই একজনকে লড়াইয়ে নামাতে পারে। বিপ্লবী হিসেবে ব্যাপক উদ্দীপনা যোগাতে পারে। কিন্তু পরে আর সেটা সেভাবে থাকে না। ব্যক্তিগত কিছু চটকের মাধ্যমে এভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়। মধ্যবিত্তদের মাঝে এ সমস্যা রয়েছে- নিজেকে জাহির করা। মানে অসত্য জিনিস দিয়ে চটক সৃষ্টি করা। এটা আমি আগাগোড়া কখনও পছন্দ করিনি। এর ফলে হঠাৎ উত্তেজিত হবে, আবার হঠাৎ নিভে যাবে।

আমার স্ত্রীর কথা তো আগেই বলেছি। আমার চার ছেলে। কোনো মেয়ে নাই। বড় ছেলে বিএ পাস করে এখন ব্যবসা করে। কম্পিউটারের ট্রেনিং সেন্টার, বিয়ে করেছে। পরে বালি পরিবহন ট্রলার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বড় ছেলের নাম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী সুমন । ২য় ছেলে মাজহারুল ইসলাম চৌধুরীর সে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক। ৩য় ছেলে আরিফুল ইসলাম চৌধুরী, সে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। সে এখন এনার্জি প্যাক-এ কর্মরত। ৪র্থ ছেলে মুনিরুল ইসলাম চৌধুরী। বিএ অনার্স। ফ্যাশন টেকনোলজি, সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার।
আমার ছেলেরা খুব সাধারণভাবে মানুষ। ছেলেরা মানুষের ক্ষেত্রে বড় অবদান ওদের মার। শাহিদা চৌধুরী। আমি চিন্তা করতে পারি না কিভাবে আমাদের পরিবার এই জায়গায় আসল। এই ছেলেরা ম্যাট্রিক পাস করে টিউশনি শুরু করে পড়াশুনা করেছে। আমি তাদের কোনো যতœ করতে পারিনি। কিন্তু খুব কম পয়সায় এরা লেখাপড়া করেছে।
আরেকটা বিষয় হলো, আমি চাকরি করার কারণে, এরা ভালো রেজাল্ট করলে, মিল থেকে বৃত্তি দেয়া হতো। তবুও ছেলেদের যোগ্যতা থাকার পরও বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেনি। অনেক কাহিনী আছে তাদের পড়ালেখা নিয়েও। আমি জানি না কিভাবে তারা কোন ফাঁকে এতকিছু করল।
সেজ ছেলেটা ভালো রেজাল্ট করল। ম্যাট্রিকে ৮২২ নম্বর পেয়ে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হতে গেলে প্রথম জেলে গেল। ঐ দিন দৈনিক বাংলায় জাতীয় পার্টি অথবা আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে ঝামেলা হয়, পুলিশ ধরপাকড় চালায়। সে কলেজ থেকে ফেরার পথে তাকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সন্ত্রাস দমন আইনে অন্যায়ভাবে তাকে ৪৫ দিন জেল খাটতে হয়। পরে পুলিশ ভেরিফাই করে তাকে ছেড়ে দেয়। সে পরে আর নটর ডেম কলেজে ভর্তি হতে পারল না। কারণ সময় শেষ হয়ে গেল।
আমার আরেক ছেলে, মেডিকেলের কোচিংয়ের জন্য ফার্মগেটে যেত, সেখান থেকে ফেরার পথে বাংলামোটরে ছাত্রশিবির এক সাংসদের গাড়ির উপর হামলা করলে ধরপাকড়ে সেও গ্রেপ্তার হয়, প্রায় ৪০ দিন জেল খেটে সে বের হলো।

না। মৃত্যু আমাকে একেবারেই ভাবায় না। মরে যাব এ নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। শ্রমিক হিসেবে জীবন শুরু করেছিলাম। আজ যেভাবেই শেষ হোক না কেন বলতে পারব যে, আমি কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমি অনেক মার্ক্সবাদ পড়ে মার্কসিস্ট বা কমিউনিস্ট হই নাই। কাজের মধ্য দিয়ে আমি কমিউনিজমকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি। এ রকম কর্মী কম, যে তৃণমূল থেকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত আসতে পারে। ভালো-খারাপ ভিন্ন বিষয়, কিন্তু একটা সঙ্কটের কালে, পার্টি বিলুপ্তির সময়, সেটাকে ধরে রেখে এগিয়ে নেয়া কঠিন একটা কাজ। ওই সময়ে আমি কেন্দ্রীয় কমিটির হাল না ধরলে পার্টি অন্যরা ধরে রাখতে পারত না। যে আস্থার জায়গায় পার্টি কমরেডদের বিশ্বাসের জায়গাটা আমার প্রতি ছিল সেটা দিয়েই আমি পেরেছি। আমার যে খুব যোগ্যতা আছে তা না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস ছিল।
একজন নগণ্য কর্মী থেকে পার্টির সভাপতি হিসেবে, একেক সময় একেক ভূমিকায়, পার্টির প্রথম থেকে দশম কংগ্রেস পর্যন্ত সবগুলোতেই উপস্থিত ছিলাম। আমার মতো একজন মানুষের এর চেয়ে আর কি পাওয়ার আছে। স্বজাতির মুক্তি সংগ্রামের লড়াইয়ে যে ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছি সেটা আমার জীবনের বিরাট পাওয়া।
তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত এই যে একটা রাজনৈতিক জীবন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সব দিক থেকে নানানভাবে সহযোগিতা পেয়েছি। দুঃখ হলো, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি সে লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বুর্জোয়া দল হিসেবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি পারল না, কিন্তু কমিউনিস্টদের দায় কিন্তু কম নয়। নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারলাম না। বিকশিত করতে পারলাম না। জনগণের মুক্তির লড়াই এগিয়ে নিতে সত্যিকারার্থে আমাদের ত্যাগ কতটুকু তা আজ পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। এখান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

***(বিঃ দ্রঃ এই জীবনীটি গত ঈদে সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকার হিসেবে প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারের আলোকে চির লড়াকু এই মানুষটার জীবন সংগ্রামের বিস্তারিত উপাখ্যান সাজিয়েছেন আনিস রায়হান। তাকে সহযোগিতা করেছেন সাব্বির আহমেদ।)

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×