পরশুরাম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত ফেনী জেলার একটি পৌরসভা। তো ঐ পৌরসভাতে সাতকুচিয়া নামক একটা বিশাল দিঘি আছে। থাকতেই পারে। এ নিয়ে এত মাতামাতির কি আছে? সে বিষয়েই আসছি।
অনেক বছর আগে (যতটুকু শুনেছি প্রায় ৫০-৬০ বছর আগে) বিয়ে শেষে পালকি করে নতুন বৌকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল বরপক্ষ। চলতে চলতে তারা সাতকুচিয়া দিঘির কাছাকাছি চলে এলো। হঠাত্ নতুন বৌ বলল তার পানির তেষ্টা পেয়েছে। এজন্য বৌকে দিঘির পাড়ে নামালো। সময়টা তখন বিকেলের সর্বশেষ ভাগ অর্থাত্ কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আযান দিবে। এই সময়টা এমনিতেই মহিলাদের জন্য খুব একটা ভালো নয়। এছাড়া দিঘিটা নিয়েও এলাকাবাসীরা হ্যাজিটেড ছিল। ঐ দিঘিতে নাকি খারাপ কিছু আছে। তো যাইহোক, নতুন বৌ দিঘির পানিতে নামল এবং পানি পান করল। বিষয়টাকে বরপক্ষের অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি এবং তারা বৌকে পানিতে নামতে না ও করেছিল। কিন্তু তখন পানি পান করাটা খুবই জরুরি ছিল। নতুন বৌ যখন পানি পান করে দিঘি থেকে পাড়ে উঠছিলো তখন তার পায়ে কিছু একটা অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছিল। পাড়ে উঠে দেখে যে তার পায়ের কনিষ্ঠা আঙ্গুল একটা শিকল আটকিয়ে ফেলেছে। তখন তো সবাই সকড। ইতোমধ্যে বোধয় মাগরিবের আযান দিয়ে ফেলেছে। বরপক্ষের লোকজন তখন শিকলটাকে ধরে টানতে শুরু করলো। টানছে তো টানছেই! টানতে টানতে সবাই ক্লান্ত। পাড়ে বিশাল এক শিকলের স্তুপ হয়ে গেছে। কিন্তু ঐ শিকলের যেন শেষ নেই, নেই কোনো কূল কিনারা। পরে দক্ষ কামার নিয়ে আসা হলো। কিন্তু কামার কর্তৃক শিকলের বন্ধন ছিন্ন করার চেষ্টা যেন অরণ্যে রোদন ছিল। এরপরে আরো যা যা সম্ভব ছিল সবই করলো কিন্তু মুক্তি পেল না বধু। রাতে সিন্ধান্ত নেওয়া হলো শিকলাবদ্ধ আঙ্গুলটি সকাল বেলায় কেটে ফেলা হবে। তো রাত্রে কিছু লোক বৌকে পাহারা দিল এবং কিছু লোক ঘুমালো। যারা ঘুমালো তাদের সবাই স্বপ্ন দেখল, কাল সময়ে বধুর দিঘিতে নামাতে দিঘিস্থ পরী টরী বা খারাপ যা কিছু ছিল তাদের কু-নজর পড়েছে বৌয়ের উপর। তারা নতুন বৌটাকে চায় এবং যদি কেউ বৌয়ের শিকলাবদ্ধ আঙ্গুলটি কাটার চেষ্টা করে তাহলে তার চৌদ্দ গোষ্ঠী নির্বংশ করে দেওয়া হবে। স্বপ্নের ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পরে কেউ আর আঙ্গুল কাটার সাহস করলো না। পরদিন গ্র্যাজুয়ালি শিকলটা নতুন বৌটাকে টেনে টেনে দিঘিতে ডুবিয়ে ফেলতে লাগল। অশ্রুবন্যা বইয়ে দেওয়া ছাড়া কেউ কিচ্ছু করতে পারলো না। ডুবে গেল বৌটা। সেই থেকে দিঘিটার হররিটি আরো বাড়তে লাগল। এর কিছুদিন পর অতিবৃষ্টির ফলে দিঘির পানি অতিমাত্রায় বেড়ে গেলো। তখন প্রতক্ষদর্শীদের মতে, দিঘির মাঝখান থেকে উদ্ভত দানবের মতো কিছু একটা বিধ্বংসী রূপে দিঘির পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের পাড়টা ভেঙে দিঘি থেকে বেরিয়ে গেছে। লোকেরা ভাবল দিঘিতে যে খারাপ কিছু ছিল তা দিঘি থেকে বিদায় নিয়েছে। শীতকালে যখন দিঘির পানি কিছুটা কমে গিয়েছিল তখন এলাকাবাসীরা ভাবল দিঘিটা সেঁচে ফেলা যাক। যেমন কথা তেমন কাজ। দিঘিটা সেঁচার জন্য পাড়ের চারপাশে প্রচুর পরিমাণে মোটর পাম্প বসানো হলো। সারাদিন ধরে পানি সেঁচা হচ্ছে বাট দিঘি থেকে একটুকু পানিও কমছে বলে মনে হচ্ছে না। রাতে মোটর পাম্পগুলো পাহারা দেওয়ার দিঘির পাড়ে টঙ বানিয়ে মোটর পাম্প এবং দিঘি সংশ্লিষ্ট লোকেরা সেখানে থাকল। গভীর রাতে তারা সবাই অনুভব করলো যে কেউ যেন তাদের গলা চেপে ধরলো এবং বলল আজকে সারাদিন কেন যদি সারাবছরও পানি সেঁচতে থাকিস তাহলেও দিঘির পানি এতটুকু কমবে না। আরো বলল, মোটর পাম্প গুলা বন্ধ না করলে তোদের বংশ নির্বংশ করে দিব। তারপর তারা সবাই ভয় পেয়ে মোটর পাম্পগুলো সরিয়ে নিল এবং দিঘি সেঁচার চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁড়ে ফেলে দিল।
উল্লেখিত ঘটনাগুলো অনেক আগের। এখন দিঘির পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। দিঘির পাশে মসজিদ মাদ্রাসা আছে। দিঘিতে মানুষরা এখন গোসল করে, মাছ ধরে। দুই মাস আগে আমিও সাতকুচিয়া দিঘিটিতে নেমেছিলাম।
এই দিঘি সম্পর্কে আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যে পাড়টা ভেঙেছিল সেটা এখন পর্যন্ত জোড়া নেয়নি। বেশ কয়েকবার অনেক মজবুত করে পাড় তৈরি করা হয়ে কিন্তু টিকেনি। আমি নিজও পাড়ের ভাঙা অংশটি প্রত্যক্ষ করেছি।
এই ছিল পরশুরাম পৌরসভার বিখ্যাত সাতকুচিয়া দিঘির ইতিহাস।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪০