somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কর্তব্য

০৪ ঠা আগস্ট, ২০২১ সকাল ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গল্পঃ সৎকার



(১)
রাত তিনটা বাজে। দেয়াল ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজটা থিতু হতেই শাহিদা বেগম আস্তে আস্তে বিছানা ত্যাগ করলেন। চৌকিটা বড্ড বেশি নড়বড়ে,উঠা নামা করতে গেলে এত বেশি ক্যাঁচকুচ আওয়াজ হয় যে, বেশ বিব্রত হতে হয়। আজকের পরে অবশ্য আর বিব্রত হতে হবে না।চৌকিই আর জুটবে কি না তার নেই ভরসা তবুও তিনি সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। অজানাই হবে তার ভবিতব্য। নিত্য অবহেলা, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতই ভালো। আপনজনের অবহেলা বড় বেশি পীড়াদায়ক।
এই বাড়িতে তাঁর আজ শেষ দিন একটু পরে মিলবে মুক্তি। আহ! শান্তি।

শাহিদা বেগম গুছিয়ে রাখা ছোট কাপড়ের পোটলাটা বুকে জড়িয়ে নিলেন। এই পোটলায় তেমন কোন মূল্যবান জিনিস নেই অবশ্য। থাকার মধ্যে আছে একমাত্র ছেলের ছোট বেলার কিছু স্মৃতি চিহ্ন আর মৃত স্বামীর দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটি উপহার। সেই সাথে নিজের কিছু ব্যবহার্য পোশাক। তাও এমন দামী পোষাক নয়।খুবই সাধারণ।
এই বাড়ি এই সংসার থেকে নিঃশব্দে প্রস্থান করলেই কি সত্যি সত্যি কি মুক্তি মিলবে ?জীবন থেকে পালালে কি মুক্তির দেখা মেলে? হয়তো হ্যাঁ অথবা না,জানা নেই তাঁর।
নাহ এসব তিনি কি ভাবছেন! নিজেকে নিজে ধমকে উঠলেন। শাহিদা তুমি সিদ্ধান্তে অটল থাকো।কোন ক্রমে দূর্বল হওয়া চলবে না।তোমার গন্তব্য অন্যত্র। এখানে তুমি অপাঙ্‌ক্তেয়।
না, তিনি মাথায় অন্য কোন চিন্তাই আর আনবেন না। মন দূর্বল হলে সব তাল গোল পেঁকে যাবে।আসলে তিনি আর নিতে পারছেন না। এখান থেকে সরে যেতেই হবে। উপায়হীন ।এ মায়াডোর ছিন্ন করতেই হবে। অল্প বয়সে বিধবার, ভবিষত্যে সুখ স্বপ্নের আশা নিয়ে জাল বোনা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। ছেলে বড় হবে মানুষের মত মানুষ হবে, নিশ্চিত জীবন হবে।কত আশা!
সব গুড়ে বালি।

যার নসীব খারাপ হয় তার কপালে আর সুখ!
এতকাল যে জীবনের আশায় প্রতিনিয়ত তিনি নানা স্বপ্ন বুনে এসেছেন।ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ সেই জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান তিনি।ক্ষোভ থেকে মনের ভিতর জটিল চিন্তার মনস্তাস্তিক দ্বন্দ্ব একদিনে তৈরি হয়নি।বহুদিনের অপমান ,লাঞ্ছনা,তিরস্কার, গঞ্জনা অবহেলা থেকে সৃষ্টি।এই কাঁকর জীবন তার আর ভালো লাগছে না।এবার আসবে মুক্তি। আর মাত্র কয়েক মিনিট।এই কথা ভাবতে ভাবতে শাহিদা বেগমের মনটা মুক্তির আনন্দে ফুরফুরে হয়ে উঠল।
যদিও সিদ্ধান্ত নিতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে বার বার দ্ধিধা এসে ভর করছে। ভরা সংসার তাঁর ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি। কিন্তু এদের মাঝে তিনি যেন থেকেও নেই।
নাহ! সব মায়াজাল, শহিদা বেগম সব দূর্বলতা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন।অপমান অবহেলা অনাচার এমন পর্যায়ে গেছে যে এখন আর খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। মন কাঁদলে নিজেকে শক্ত করতে হবে। তাকে যেতেই হবে।
নিজেই নিজেকে শোনালেন কিসের মায়া, কিসের দয়া! দুনিয়াটাই অদ্ভুত এক মরিচিকার খেলা।
সব ফাঁকি! সব ফাঁকি!! সব ফাঁকি!!!
দরজা খুলে ঘরের বাইরে বের হয়ে এলেন শাহিদা বেগম। দেরি করা মানে দূর্বল হয়ে পড়া।এখন থেকে নতুন করে পথ চলা শুরু করতে হবে যে। সামনে অনেক কাজ।
এই ঘরে দরজা খোলার সময় বিশ্রি শব্দ হয়। বিশেষ কৌশলে সেই শব্দকে আয়ত্ত্বে আনতে হয় তবুও একটু শব্দ হয়ে গেল। বের হয়ে এলেন তিনি সন্তপর্নে।দোতলা বাড়ির নীচতলার এক স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে তার বাস। বাকি ঘরগুলোয় আগে এক পরিবার বাস করতো।এখন গোডাউন হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।লোকজন কেউ থাকে না। নিচ তলাতে তিনি একমাত্র প্রাণী। ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি দোতালায় থাকে।সেখানে তাঁর ঠাঁই নাই।যাওয়ার অনুমতি নেই।
গেটের তালা খুলতে উদ্যত হতেই শাহিদা বেগমের মনে হলো দোতালার সিঁড়িতে তিনি সন্দেহজনক পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন।
মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু... একটু ভেবে তিনি ভালো করে কান পাতলেন।
নাহ! সিড়ি ভাঙার আওয়াজই।এত রাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠবে কে? নিচের গেটে তো তালা দেওয়া! তাহলে ?হঠাৎ মনে হলো চোর নয় তো! চিলেকোঠা দিয়ে পালাচ্ছে হয়তো! দেখতেই হয়।
তিনি কোলের মধ্যে রাখা পোটলাটাকে আস্তে করে নামিয়ে রেখে খালি পায়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলেন।উপরে এসে যা দেখলেন তাতে তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা এক স্রোত বয়ে গেল।
একি!
একজন অচেনা একটি লোক ভারি একটা লেদার বয়ে নিয়ে চিলেকোঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চিলেকোঠার দরজা হাট করে খোলা।
পরক্ষণেই শাহিদা বেগমের কর্তব্যবোধ উদয় হলো তিনি পেছন থেকে গিয়ে নিজের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে চোরকে জাপটে ধরলেন।শুরু হলো প্রবল বেগে ধ্বস্তাধস্তি। তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ঠ হচ্ছে তবুও তিনি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চোরকে ধরে রাখলেন আর বুদ্ধি করে জোরে চেঁচাতে লাগলেন।
- ওরে জামাল চোর আমাদের বাড়ি থেকে চুরি করে পালাচ্ছে।শিগগির আয়! শিগগির আয়!!...
গভীর রাতের সামান্য শব্দও বহুদুর পর্যন্ত যায় আর এতো চিল চিৎকার।
অচিরেই জামাল আর জামালের বউ রোজী বেরিয়ে এলো। জামাল প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে তাঁর মাকে এমন অদ্ভুত অবস্থায় দেখে তাঁর নিজের রক্ত নেচে উঠলো।ততক্ষণে চোর প্রায় শাহিদা বেগমকে কব্জা করে ফেলেছে। এই পালায় সেই পালায় অবস্থা। জামাল ছুটে গিয়ে তাকে দমাদম কয় ঘুষি মেরে দিলো।
মুহুর্তে চোরের নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো ,রোজী কোথেকে এক গাছা দড়ি আনতেই তিনজন মিলে চোরকে বেঁধে ফেলা হলো।
অবশেষে চোর চুরি যাওয়া মাল সমেত ধরা পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে বোঝা গেল কত বড় একটা ক্ষতি হতে যাচ্ছিলো। রোজীর সব গয়না, নতুন জমি রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা রাখা ছিল গোপন ড্রয়ারে, সব গুছিয়ে নিয়ে চোর চিলেকোঠা দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল।কি ভয়ংকর!
জামাল তার মাকে অনেক ধন্যবাদ দিল।বলতে ভুলল না এ যাত্রায় কত বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেল তাঁর জন্য ।
শাহিদা বেগমের ছোট নাতিও ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে চিল্লাচিল্লিতে।
তাঁর দাদীজান চোর ধরেছে।দাদীজানের জন্য তার গর্ববোধ হচ্ছে। বন্ধুদের সাথে কখন এই ঘটনা শেয়ার করতে পারবে এই চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠলো।সেল ফোনে ছবি তুলতে লাগলো।
ছেলেও মাকে বারবার বাহবা দিল। আর বলল পুলিশের কাছে চুরি যাওয়া জিনিসের কথা যা বলার সে নিজে বলবে। শাহিদা বেগম যেন উল্টা পাল্টা কোন কথা না বলেন। টাকা পয়সা গয়নাগাটির কথা উল্লেখ্ করার দরকার নেই। কয়েকটা কাপড়চোপড় দিয়ে পুলিশের কাছে
চোরকে ধরিয়ে দিলেই হবে।

শাহিদা বেগমের আজ আর যাওয়া হলো না।

তিনি ঘরে ফিরে যেতে শুনতে পেলেন ছেলের বৌ রোজী এই রাতে কাকে যেন ফোন দিয়ে একটু আগের ঘটনাটার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছে।তার মধ্যে একটা কথা তাঁর একটু খট করে কানে বাজলো।
-আরে খাওয়ার কি কমতি আছে নাকি। সব খায়, রাক্ষস না। শক্তি হবে না আবার।বুড়ির গায়ে প্রচুর শক্তি। আমি তাই ভয়ে ভয়ে থাকি।..।
ভয়ে ভয়ে থাকি মানে কি?একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি, কিছুই করার নেই অবহেলা তাঁর জীবনের সঙ্গী। আজকের দিনটা একটু অন্য রকম হলে কি হতো। অন্তত একটা দিন.....
হাতটা মনে হয় মচকে গেছে। বেশ ব্যথা করছে। সরষের তেল দিয়ে মালিশ করলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। কোমরেও কিছুটা লেগেছে ,ব্যথা করছে।ক্লান্তিতে শাড়ির আঁচল দিয়ে শাহিদা বেগম মুখ মুছলেন।
ফজরের আযান দিচ্ছে।পুলিশে খবর দিয়েছে জামাল। শাহিদা বেগম নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে আবার তার নিজের ঘরে ফিরে এলেন।
নাহ আজও হলো না তার যাওয়া
আসলে চাইলেই কি সংসারের বাঁধন থেকে মুক্তি মেলে? কর্তব্য বোধ বারবার আরও এটে কষে তাকে বেঁধে ফেলে যে।
সমাপ্ত
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক।


কিছু বানান ভুল থাকতে পারে পরে সময় করে ঠিক করে দেওয়া হবে। দয়া করে বিষয়টি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২২ সকাল ৯:১৩
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×