somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জনক

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কয়েকদিন ধরে ভীষণ গরম পড়ছে। তবে সে তুলনায় আজকের গরমের ভাবটা যেন আরো একটু বেশী। মুঠো মুঠো চকচকে রোদ সারা শহরটায় ছড়ানো। ভ্যাপসা গরমে মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। এই রোদেলা গরমের মধ্যেই শাকিল কিছুক্ষন আগে ওর অফিস রুমে এসে ঢুকলো। ফ্যানটা ফুল স্পীডে ছেড়ে দেয়। রিভলবিং চেয়ারে নিজের গা এলিয়ে দিয়ে স্বস্থির আমেজে চোখ বোজে। অফিসের অন্য সবাই টিফিনে গেছে। সে আজ ইচ্ছা করেই বাসায় যায়নি। মাঝে মাঝে ও এমন করে। দুপুরের লাঞ্চটা অফিসে সেরে ফেলে।
গরমের জ্বালাটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে যেন। চোখে তন্দ্রা ভাব। ঠিক এই সময় এক ভদ্রলোক দরজা ঠেলে মাথাটা ঢুকিয়ে দুই পাটির দাঁত আকর্ন বিস্তারিত করে বলে উঠলো- আই এ্যাম কামিং সার?
চট্ করে চোখ খুলে তাকালো। ভদ্রলোকের যে ভুল ইংরেজী বলার বাতিক আছে তা শুরুতেই বোঝা যায়- বিরক্তিতে ভ্র“ কুঁচকে তাকায়।
অযাচিত ভাবে এই সুস্থ্য সময়ে কারো আগমনকে সে কোন ক্রমেই মেনে নিচ্ছে না। শুধু সৌজন্য রক্ষায় তার অন্তরে জাগ্রত বিরক্তি তখনকার মত চাপা দিয়ে ভদ্রলোককে ভেতরে আসতে বললো। তড়িৎগতিতে অফিসে ঢুকেই একটা লম্বা সালাম দিয়ে অনুমতির অপেক্ষা না করে সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে- ‘ভেরী কোল্ডরুম স্যার।’ বাইরে ভীষণ হট্ স্যার। বসে চোখ দুটো বন্ধ করে বুক ভরে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিলো।
শাকিলের অনুমানটি ঠিকই। কথায় কথায় ভুল শুদ্ধ ইংরেজী সংমিশ্রনে কথা বলার বাতিক আছে। ধারণাটা আর একটু পরিস্কার হলো। পোষাকেও তার রুচির অভাব লক্ষনীয়। বেমানান একটা প্যান্টের উপর সাদা পলিয়েষ্টারের পুরানো সার্ট, কোমরে কয়েক বছরের পুরাতন রং উঠা একটা চামড়ার বেল্ট। মুখের দুই পাশে পানের লাল কস। অতিরিক্ত পান খাওয়ার বদ অভ্যাস আছে তা তার দাঁত এবং মুখ দেখলেই বোঝা যায়। শাকিল ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আসলে লোকটিকে ওর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। তাছাড়া ও ভাল করেই বুঝতে পারছে যে অযথা বকবকানিতে আজ মাধা ধরে যাবে।
- ‘ডোন মাইন্ড স্যার। কিছু মনে করবেন না। এই অসময় আপনাকে বিরক্ত করতে এলুম। কি করবো বলুন, অন্য সময় তো আপনি ভেরী বিজি থাকেন, টকিং করার জন্য একটা ক্লীন নিরিবিলি সময়ের দরকার। তাই অনেক থিংকিং এর পর জাষ্ট এই টাইমটা বার করেছি।’ - টানা এতগুলো কথা বলে থামল। তারপর অফিসের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলে- ‘গলাটা একেবারে ফুল ড্রাই হয়ে গেছে। কাইন্ডলি এক গ্লাস কোল্ড ওয়াটার খাওয়ানো যায়?’ না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আপনি বলুন আমি নিজেই নিয়ে খেয়ে নিচ্ছি।
শাকিল পানির অবস্থানটা দেখিয়ে দিতে ভদ্রলোক উঠে ঢক্ ঢক্ করে দুই গ্লাস ঠান্ডা ফ্রিজের পানি খেয়ে চেয়ারে বসে তৃপ্তি সূচক শব্দ তুললো- ‘আহ্, থ্যাঙ্ক ইউ, মেনি মেনি খ্যাংক ইউ স্যার। এখন আমি নির্বিগ্নে কয়েক ঘন্টা একটানা বকে যেতে পারব।’ শাকিল চমকে উঠে বলে কি! কয়েক ঘন্টা বকে যাবে। পাগল না কি! মনে হচ্ছে ওকে এক্ষুনি তাড়িয়ে দেয়। যেহেতু ব্যাপারটা শোভন হবে না। তাই অহেতুক বিরক্তিকর সময় ক্ষেপনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। -“আচ্ছা, যৌতুক সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? আই মিন যৌতুক আপনি কোন আই তে দেখেন?”
ব্যাপার কি? মনে মনে ভাবে শাকিল, রিপোর্টার নাকি? না কি মানবাধিকার সংস্থার কেউ? হাব ভাবে তেমন হওয়ার কথা না। যা হোক অযাচিত ভাবনা না ভেবে নিজেই প্রশ্ন করে বসলো-‘আপনার পরিচয় জানতে পারি কি? কোত্থেকে, কি উদ্দেশ্যে কেন এসেছেন।’ - খ্যাক খ্যাক হেঁসে উঠলো। তারপর দুঃখ প্রকাশ করে বললো- ‘সরি স্যার। আই এ্যাম ভেরী ভেরী সরি স্যার। নিজের পরিচয় না দিয়েই অনর্থকেই কেবল টকিং করে যাচ্ছি। আসলে কি জানেন এটা আমার সেই চাইল্ড হুড নেচার বলতে পারেন। ব্যাড নেচার। একবার হয়েছিল কি জানেন? তখন মাই চাইল্ড হুড। একেবারে ছেলে বেলার ঘটনা। বাবা আমাকে পাঠিয়েছিলেন তার এক ফ্রেন্ডের বাসায়। সে কি কাণ্ড। ভদ্রলোকের বাসায় গোয়িং করে উনাকে সালাম করেই শুরু করে দিলাম আমার টকিং। কথা তো শেষ হতেই চায়না। ভদ্রলোকও বেশ ইন্টারেষ্টিং পাচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে মাঝে মাঝে হো হো করে লাফিং করে গড়াগড়ি যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে হাসতে হাসতে বললেন’- ‘তুমি তো বেশ মজার ছোকরা হে। তা তোমার বাড়ী কোথায়? কি তোমার পরিচয়? কেনই বা এখানে এসেছো? তা তো কিছু বললে না?’ ‘আমি তো লজ্জায় একেবারে কাঁচু মাচু। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম- সে কি! আপনাকে আমার পরিচয়ই দেইনি!- যা হোক পরিচয় দেয়ার পর ভদ্রলোক একেবারে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভবিষ্যতে তুমি রাজনীতিবিদ হবে বাবা।’ - “ছাই হয়েছি? অর্ধেক বয়স পার করলাম। এখন পর্যন্ত রাজনীতির ‘র’ ও বুঝতে পারিনি।”
শাকিল মনে মনে বেশ রেগে যাচ্ছে। এই ভর দুপুরে কি শেষ পর্যন্ত পাগলের পাল্লায় পড়লো না কি? কিছু বুঝতে পারছে না। ঠিক মেপে নিতে পারছে না। লোকটা কে, কি কারণে এখানে এসেছে? ওর কথার মাঝে শাকিল- আবার বলে, ‘আপনার পরিচয়টা কিন্তু এখনও দেন নি?’ ওর কথায় ভদ্রলোক জিভে কামড় দিয়ে বলে- ডোন মাইন্ড স্যার। কিছু মনে করবেন না। কি করব বলুন, ব্যাড হ্যাবিট।- চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে বসে বলে- আমি ঘটক। জলিল ঘটক। একজন সাকসেসফুল ঘটক। আমার হাতে কোন বিয়েই এখনও পর্যন্ত মিস যায়নি। সবাই তাদের সুখের সংসার নিয়ে লাইফটা ইনজয় করছে।
বাড়তি ঝামেলা। মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘটকের কথা শুনে চেতনার আকাশে ভেসে উঠে এক ঝলক সুন্দর মুখ। ঘোমটার আড়ালে সলজ্য হাসি ছড়িয়ে দুই হাঁটুর মাছে থুতনীটা রেখে রূপসী বধু যেন বসে আছে তার নতুন জীবনের একান্ত সান্নিধ্যের প্রতীক্ষায়। ভাবতে ভালই লাগে। কেমন যেন অজানা সুখ সুখ- অনুভূতি সমস্ত হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ভাবনায় ছেদ কাটে ঘটকের কথায়- ‘অনেক মেয়ে আছে স্যার আমার ষ্টকে। হাই ক্লাস থেকে শুরু করে মিডিল ক্লাস। অল-আর-বিউটি কুইন। তবে ব্যাড চেহারার মেয়ে যে নেই তা নয়। তবে ওগুলোর কেইস আলাদা।’

শাকিল মাঝ পথে থামিয়ে ঘটককে সেদিনকার মত বিদায় দিয়েছিল। ঘটক চলে যাওয়ায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এতক্ষন বকবকানিতে কানটা ভোঁ ভোঁ করছিল। নিজের অজান্তেই বললো- ‘বাব্বা। বাঁচা গেল।’ একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে শরীরটা ছেড়ে দেয় চেয়ারে। ঘটকের আগমন খোঁচা দিয়ে গেল এক দুঃসহ স্মৃতির ফলকে।

বেশী দিনের কথা না। বছর দুয়েক হবে মনে হয়। ওর বন্ধু মঈনের বোনের বিয়েতে গিয়েছিল। বিয়ের তিনদিন আগে ওকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। ভালই কেটেছিল সময়টা। বড় এক ব্যবসায়ীর সাথে ওর বোনের বিয়ে হয়েছিল। ঘটক না কি বলেছিল। ওরা খুব ভাল মানুষ। এলাকায় বেশ নাম ডাক আছে। এক অনাবিল প্রশান্তির বৃষ্টিতে ওদের সবার হৃদয় সিক্ত করেছিল। মাত্র তিন মাস পরেই এক মহা বিপর্যয় ঘটে গেল। মঈনের বোনটা আত্মহত্যা করলো। যৌতুকের কাল সাপে ওকে দংশন করেছিল। কিন্তু পরে জানা গেল ওকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
মঈন যখন জানলো ওর বোনকে হত্যা করা হয়েছে। তখন ক্রোধের উন্মত্ততায় ছুটে গিয়েছিল ওর বাবার কাছে- বাবা, আমি ওদের সবাইকে খুন করে ফেলবো।
হিস হিসিয়ে উঠেছিল ওর গলার স্বর। মঈনের বাবা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের মুখের দিকে। তাঁর দু’ চোখ বেয়ে অঝোর ধরায় ঝরছিল অশ্র“। শোকে মুহ্যমান পিতা আদ্র কণ্ঠে বললেন- ‘আমিনা চলে গেছে, তুমি আছ। তুমি চলে গেলে আমাদের সব কিছুই যে হারিয়ে যাবে বাবা। আমরা যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাব।’ প্রতিশোধের আগুনকে মঈন আপন গুণে নিবৃত করেছিল।

প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও পরে অত্যন্ত সহজ হয়ে গিয়েছিল। ঘটকের সাথে মন খুলে কথা বলতো। সেও মোটামুটি তার সাফল্যের ফিরিস্তি খুলে বসতো। একবার কোন বিয়ে বাড়ি থেকে তাড়া করেছিল ঘটককে। সে কথা শুনে শাকিল হাসতে হাসতে বলেছিল- ‘তাহলে বিয়ে দিতে গেলে তাড়াও খেতে হয়।’ ‘শুধু কি তাড়া খাওয়া। মার পর্যন্ত খেতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। তবে যাই বলেন স্যার। এর মধ্যে মেন্টাল স্যাটেশফাইড আছে। যখন দেখি স্বামী স্ত্রী ছেলে মেয়েদের নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে- তখন নিজেকে কি যে হ্যাপি লাগে স্যার- তা ভাষায় বোঝাতে পারবো না।’
বছর গড়িয়ে গেছে। আজ জলিল ঘটকের মেয়ের বিয়ে। শাকিলের ডেস্ক ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেল। আসলে ওর মনে থাকার কথা না। নিজে যেমন ব্যস্ততার মধ্যে থাকে; তাতে করে কার বিয়ে কবে হবে বা হচ্ছে মনে রাখাটা ভীষণ কষ্টের ব্যাপার। একান্ত ঘনিষ্ট জন হলে একটা কথা ছিল। তথাপি ওর কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ে গেল। তাছাড়া দীর্ঘদিনে ঘটকের আন্তরিকতা গভীর হয়েছিল।
সেদিন ঘটককে বেশ খুশী খুশী মনে হয়েছিল। অফিসে ঢুকেই ওর স্বভাব সুলভ হাসি হেসে বলেছিল- ‘স্যার আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললাম। ভেরী গুড ছেলে। ঠিকাদারী ব্যবসা। ছেলের ফাদারের খুব নাম ডাক আছে। আমার মেয়েকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে ফাইনাল কথা দিয়ে দিল। একেবারে দিনক্ষণ ঠিক করে তবেই ওরা গেল। তা স্যার আপনি যাবেন তো? - ‘চেষ্টা করবো।’
“কোন চেষ্টা চেষ্টি নয়। নাথিং ডুয়িং ঐ দিন স্যার। ইউ মাষ্ট কামিং। তা-না হলে আমি ভীষণভাবে মাইন্ড করবো।”
ঘটকের প্রচণ্ড চাপাচাপিতে শাকিল না করতে পারিনি। কিন্তু কথা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। রীতিমত ডেস্ক ক্যালেন্ডারে নির্দিষ্ট তারিখে গোটাগোটা অক্ষরে লিখে রাখলো- ‘আজ আমার মেয়ের বিয়ে। আপনি অবশ্যই আসবেন।’ -ওর এই ছেলে মানুষিতে শাকিল না হেসে পারে নি।

সেদিনের একটা দৃশ্য ওর মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল। দাওয়াত দিয়ে চলে যাওয়ার সময় শাকিল কি ভেবে ডাক দিল- “শুনুন।” চকিতে ঘুরে বললো- ‘কিছু বলবেন স্যার?’
শাকিল নিজের আসন থেকে উঠে ঘটকের কাছে গেল- “ওর হাতে দুটো পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে বললো এটা রাখুন। কাজে দেবে।”
মুহূর্তে ঘরের পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেল। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা গ্রাস করলো। সেই সাথে ঘটকের মুখের মানচিত্রও যেন বদলে যেতে লাগলো। আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ওর চোখ দুটো ছলছলিয়ে উঠলো। এক সময় দু’ চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা অশ্র“। ত্রস্ত হাতে চোখ দুটো মুছে বলে- ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার এই মহানুভবতার কথা মনে রাখবো স্যার।’
ঘটক চলে যাবার পরও শাকিল ঐ জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবছিল। জীবনে অনেক দান সে করেছে। অনেককে বিভিন্ন সময়ে উপকার করেছে। বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজকের মত এত তৃপ্তি সে আর কোন দিনই পায়নি। তার সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে ছিল কৃতজ্ঞতার এক দূর্লভ ছাপ। যার প্রভাবে শাকিলের সমস্ত হৃদয় পরিতৃপ্তির আবেশে ভরে উঠেছিল। এত আত্মতৃপ্তি বোধ হয় ওর জীবনে এই প্রথম।

ঘড়ির দিকে তাকাল। আড়াইটা। দেরী হয়ে গেছে। এতক্ষণে বোধ হয় বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে। তড়িঘরি করে নিজেকে তৈরী করে নিল। বিয়ে বাড়ি পৌঁছেই শাকিল থমকে গেল। বেশ হট্টগোলা হচ্ছে। মনে মনে ভাবল- বিয়ে বাড়িতে এমন প্রায়ই ঘটে থাকে। অনেকে বলে না কি ঝগড়া আর দশ কথা ছাড়া বিয়েই হয় না। কখনো দেন মোহর নিয়ে তো কখনো খাওয়া নিয়ে। আবার দেখা গেল ছেলের বোনাইকে ঠিকমত আপ্যায়ন করা হয়নি তাতে তার অভিমান ভাঙ্গতে বেশ কসরত করতে হয়। আর যৌতুকের প্রশ্ন থাকলে তো কোন কথাই নেই। তেমন কিছু ঘটলো না কি? জলিল ঘটক নিজে যেমন চালাক মানুষ তাতে তো কোন ফাঁক ফোঁকর থাকার কথা না। অনেক অভিজ্ঞতার ফসল তার ঝুলিতে আছে।
ঘটকের প্রবল আকুতি আর ছেলের বাবার রন হুঙ্কারে শাকিলের ভাবনার সূত্র কেটে যায়। -“ঠগ, জোচ্চোর, ধাপ্পাবাজ। তোমার এতবড় দুঃসাহস- আমার সাথে জালিয়াতি। এই তোরা সব চলে আয়।”
-“খান সাহেব। আপনার পায়ে পড়ি। আমার এতবড় সর্বনাশ করবেন না। অপরাধ আমার হয়েছে। শাস্তি আমার মেয়েকে দিবেন না।” - কথাগুলো বলতে যে তার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। তার দু’ চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্র“র স্রোত বয়ে চলেছে। দুই হাত জোড় করে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে অনুনয় বিনয় করে খান সাহেবের মন গলাবার চেষ্টা করছে, ‘জীবনে কোনদিন মেয়ের দাবি নিয়ে আপনাদের কাছে যাব না। আত্মীয় বলে কারো কাছে পরিচয়ই দেব না। শুধু আমার মেয়েটাকে আপনাদের ঘরে তুলে নেন। ওকে দাসী বাদীর মত রাখবেন। আমি কোনদিন দেখতেও যাব না। আল্লার দোহাই লাগে খান সাহেব, যে শাস্তি আমাকে দিতে চান আমি মাথা পেতে নেবো।’

ঘটকের আহাজারিতে ওখানকার বাতাস যেন ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিল। কিন্তু খান সাহেবকে এতটুকুও গলাতে পারেনি। তিনি ধাক্কা দিয়ে ফেলে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন- “শুয়রের বাচ্চা। আমার এত বড় ক্ষতি করে এখন আবার ন্যাকামি হচ্ছে। শালা তোকে পুলিশে দেব, হাজত বাস করাব, তারপর আমার মেজাজ ঠান্ডা হবে।”
শাকিল এর সব কিছুই প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। কি এমন ঘটনা ঘটলো যে কারণে এত বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে ওদের উপর। কার কাছে শুনবে। সবার চোখে উৎকণ্ঠার ছাপ। সবাই যেন বিচ্ছিন্ন ভাবে খন্ড খন্ড জটলার সাথে মিশে যাচ্ছে। হয়ত ওরাও এর একটা সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। অন্দর মহল থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।

অনেক কষ্টে জানতে পারল যা। তার সারমর্ম এই যে, নিজের পরিচয় গোপন করে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিল খান সাহেবের ছেলের সাথে। উনি জানেন মেয়ের বাবা কানাডায় থাকেন। বড় চাকরী করেন। সেই সূত্রে তিনি রাজি হয়ে যান। কিন্তু বিয়েতে যখন জানতে পারলেন একজন সামান্য ঘটকের মেয়ের সাথে তাঁর ছেলের বিয়ে হচ্ছে তখনই ঘটলো বিপত্তি।
এমন কাজ করা আসলেই ওর উচিৎ হয়নি। ওর মত একজন বুদ্ধিমান লোক হয়ে এমন ভুল কেন করল এ তার বুঝে আসে না। এত বড় অন্যায়ের পরও তার বিবেক সহানুভূতির দ্বার উন্মুক্ত করেছে। অজানা ব্যাথায় শাকিলের বুকটা হু হু করে ওঠে। অসহায়ত্বের এই করুণ পরিণতি নিজ চোখে সে কোনদিন প্রত্যক্ষ করেনি। এক সময় বরযাত্রী ফিরে যায়। অথর্বের মত বসে থাকে জলিল ঘটক। কান্নার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। যদিও ভেতর থেকে মেয়েদের কান্নার আওয়াজ মাঝে মাঝে ভেসে আসছে। এই মুহূর্তে শাকিল কি করবে ভেবে পায়না। খুঁজে পায়না শান্তনার ভাষা। তবুও ধীরলয়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। তার কাঁধে হাত রাখে শাকিল। ঘটক চোখ তুলে ওকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে বলে- স্যার এ আমার কি হয়ে গেল। আমি কেন আমার মেয়ের এত বড় সর্বনাশ করলাম। কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো ওর সামনে। আমার যে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোন পথ দেখছি না।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় শাকিল। ওকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। দুই বাহু ধরে উঠালো ঘটককে। ওর অশ্র“ঝরা চোখের দিকে চেয়ে অনেকটা নাটকিয় ভাবে বলে ফেললো- আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করবো। যান বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
বাজ পড়লেও বোধ হয় চমকাত না। অবিশ্বাসী চোখ আটকে যায় শাকিলের মুখের উপর। স্বপ্ন দেখছে না তো? ম্লান হেসে বলে- “এই দুঃসময়ে আপনিও রসিকতা করছেন স্যার।” - “না, এটা রসিকতা নয়। আর রসিকতার সময়ও এটা নয়। অনেক ভেবে চিন্তে আমার সিদ্ধান্ত আপনাকে জানিয়েছি। আর দেরি নয়। ভিতরে যান। ওরা কান্নাকাটি করছে। ওদেরকে শান্ত করুন।”

অনাবিল প্রশান্তির আলোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠে ঘটকের মুখ মণ্ডল। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের স্রোত ধারা নেমে আসে চোখের কোল বেয়ে। এরপর এক রকম দৌড়েই ছুটে যায় ঘরের দিকে। যাওয়ার সময় সবাইকে যেন এই শুভ সংবাদ এর ঘোষণা পাঠ করে জানিয়ে দেয়।
সবার দৃষ্টি এসে পড়ে শাকিলের উপর। শুরু হয় গুঞ্জন। নিজেকে অপ্রস্তুত মনে হয়। অস্বস্তি বোধ করে। কেমন যেন বোকা বোকা মনে হচ্ছে। কাজটা কি ঠিক করল? নিজেকেই প্রশ্ন করে। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়াটা বোধ হয় ঠিক হয়নি ওর। লোকে আবার ছ্যাবলা ভাববে না তো? বলবে না তো ব্যাটা হিরো বনার জন্য এ কাজ করেছে? ভাবে ভাবুক। এখন আর ওসব বাছ বিচারের সময় কোথায়? ঐ মুহূর্তে ঠিক বেঠিক সময় অসময় বিচারের মানষিকতা ছিল না, তার মাঝে একটা কথাই বার বার চক্রাকারে ঘুরছিল কেমন করে এই অসহায় মানুষটির অসহায়ত্বকে দুর করা যায়।

ঘটক যখন ওর ঘরের দ্বার প্রান্তে, ঐ মুহূর্তে ঘটলো দ্বিতীয় বিপর্যয়। একটি ছেলে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘটককে জড়িয়ে বলে- চাচা গো, সাথী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। লজ্জা আর অপমানের হাত থেকে চির দিনের মত আমাদের সবাইকে মুক্তি দিয়ে গেছে। ঘটকের তখনো ব্যাপারটা বোধগম্য হয়নি। সে ওর হাতটা ঝাঁকি দিয়ে বলে- কি সব পাগলের মত বকছিস! কি হয়েছে সাথীর। -“ও গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল যেন। মা গো বলে আর্ত চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল সে।”
সবাই ছুটে গেল ঘটকের কাছে। শাকিল কেবল বিমূর্ত ভ্রান্ত পথিকের ন্যায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। এড়িয়ে যাওয়ার মত দুঃসাহস তার হলো না। ওর বুক ভেদ করে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অর্থের দাম্ভিকতা আর সামাজিক বৈষম্য একটা সুন্দর জীবনকে কেড়ে নিল। হায় নিয়তি। এ কেমন ভাগ্যের প্লট নির্মাণ করলে, যে সুখের বাসর রচনার আগেই তা গুঁড়িয়ে গেল। ভাবতে কষ্ট হয় আবেগ আর অনুভূতির শিরাগুলি মাথা চাড়া দিয়ে ওকে অস্থির করে তোলে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। দূর্বোধ্য নিয়তির অন্তমিল খুঁজতে সে পথের দিকে পা বাড়ায়।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×