somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নষ্ট কষ্ট যখন....

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজকাল সংবাদপত্রে উল্লেখযোগ্য খবর খুব কমই দেখা যায়। যা থাকে তা গতানুগতিক। তার পরও একটা বাড়তি নেশা পত্রিকা পড়াটা। সকালে নাস্তার পর এক কাপ চা হাতে পত্রিকা পড়ার মজাই আলাদা। প্রতি চুমুকের সাথে পঠিত প্রতি সংবাদের সংমিশ্রনে একটি ভিন্ন মাত্রার স্বাদ অনুভূত হয়।
জোড়া খুনের একটি সংবাদে আমার দৃষ্টি থেমে যায়। যদিও এ ধরনের সংবাদ প্রতিদিনের পাঠকের নিয়মিত খোরাকে পরিনত হয়েছে। বরং এ ধরনের সংবাদ না থাকাটা অস্বাভাবিক।
লিড নিউজ। জোড়া খুনের আসামীর থানায় আত্মসমর্পন দুইকলাম বরাবর খুনীর ছবি। ছবিটা চোখে পড়তেই কৌতুহলী হয়ে ওঠে মনটা। নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকি। চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। এ কারনে আমার অস্থিরতাটাও বাড়ছিল ক্রমান্বয়ে।
স্মৃতির পাতায় সতর্কতার সাথে খুঁজতে লাগলাম। নাহ্ কিছুতেই মনে আসছে না। তবে হলফ করে বলতে পারি, এই খুনিটাকে আমি ভালভাবে চিনি। একে দেখেছি আমি। প্রায় আধাঘন্টা চেষ্টার পর মনে পড়লো। একেবারে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো সেদিনে সেই চিত্র।

ভারত থেকে ফিরছিলাম। বেনাপোল বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ছাড়ার সাথে সাথে এক আর্তচিৎকারে সচকিত হলাম। বাসের প্রায় সব যাত্রীর দৃষ্টি এসে পড়লো ঐ যুবকটির উপর। তার কান্নাজড়িত বিলাপ, “আমি যাব না, আমাকে নিতে পারবেন না। আপনারা কি করছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ও দারোগা, আপনি তো বললেন আমার কিছু হবে না। আমার মন ভাল বলছে না। আমার সামনে ফেনসিডিলের বোতল রেখে ছবি তুলেছেন। লোকে বলছে আমি ফেনসিডিল ব্যবসা করি। বিশ্বাস করেন, আমি এসবের কিছুই জানি না। ও আল্লা, আমার কি হবে।”
পাশ থেকে কে যেন, হয়ত ওর পরিচিত কেউ হবে, বললো, “এই চুপ কর। তোর কিছু হবে না। আমি তোকে নিয়ে আসবো।”
আপন মনে হাসলাম। সব অপরাধীই ধরা পড়ার পর নিজেকে নির্দোষ দাবী করে। তাছাড়া বর্ডার এলাকার বেশির ভাগ লোকই তো এসব ব্যবসার সাথে জড়িত। তবে ওর চোখে প্রবাহিত অবিরাম অশ্র“ ধারা নিরপরাধের স্বাক্ষী বলে মনে হয়েছিল।
বাস চলতে শুরু করেছে। তখনও ছেলেটির চিৎকার কানে ভাসছিল। আমি আবার দূর্বল চিত্তের মানুষ। কারো দুঃখ কষ্ট এবং কান্নাকাটি একদম সহ্য করতে পারি না। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। সে কারনেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিলাম।
রাস্তার পাশে সুবিস্ত্রির্ণ ধানের সবুজ পাতায় নিজের চোখ রাখি। লিকলিকে সবুজ ধানের শীষের দোলা মনের মাঝে সুখময় শীতলতার ছোঁয়া লাগে কিন্তু তারপরেও প্রতি মুহুর্তে ঐ যুবকের অশ্র“ সিক্ত মুখটা মনের মাঝে বারবার ভেসে উঠতে থাকে। মাঝে মধ্যে যুবকটির কান্না এবং সেই সাথে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা অব্যহত রাখে। বাস ভর্তি লোক কেউ তার কথা কানে তুলছে না। বরং তারা সবাই যেন ভিন্ন স্বাদের কৌতুক অনুভব করছে। কেউ আবার টিপ্পনি কাটতেও দ্বিধাবোধ করছে না। ডালের ব্যবসা করবা না। এবার বোঝো ঠেলাটা। ক’দিন জেলের ভাত খেলেই.........।
হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখি এরই মধ্যে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। তারপরও চিনতে মোটেও কষ্ট হয়নি। ছবির ঐ যুবককে। কিন্তু একটা বিষয় আমাকে বিব্রত করে তুলছিল। সামান্য মাদক কেসে কত ভয় আশঙ্খা তার মাঝে ভয় করেছিল; সেই ছেলে জোড়া খুনের মত ঘটনা ঘটিয়ে নিজেকে আত্মসমর্পন করেছে। হিসাব মেলাতে পারছিল না। এক ধরনের রহস্যের গন্ধ পেতে শুরু করলাম।
আজই তো ওকে কোর্টে চালান করবে। ওর সাথে দেখা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম।
সাংবাদিক বন্ধুর সহায়তায় কোর্ট ইন্সপেক্টরের অনুমতি নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় একান্তে তার সাথে কথা বলার অনুমতি পেলাম।
প্রায় বিশ মিনিট পর দুই পুলিশ হাতকড়া সহ ওকে আমার সামনে নিয়ে এলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবলেশহীন ওর মুখ দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। অবাক হই ওর ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ানো দেখে। একমাত্র পেশাদার খুনী ছাড়া এমন স্বাভাবিক থাকা কখনোই সম্ভব নয়।
কত ব্যবধান। পাঁচ বছর আগে ফেনসিডিল সহ গ্রেপ্তার হওয়া যুবকের সাথে আজকের এই যুবকের মাঝে। পার্থক্য শুধু গত হয়ে যাওয়া পাঁচটি বছর।
দ্বিধাগ্রস্থ আমি। ভুল হলো নাকি? সংশয় মন প্রশ্ন তোলে, একি সেই ছেলে নাকি অন্য কেউ?
নিশ্চিত হতে জানতে চাইলাম, তুমি কি সেই ছেলে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ফেনসিডিল সহ ধরা পড়েছিলে? মুহুর্তে কঠিন হয়ে গেল ওর মুখের মাংসপেশী। সেই সাথে সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে উঠলো। চোখের মনিতে যেন অগ্নিশিখা বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে। যেন তার জ্বলন্ত চোখের তেজস্ক্রিয়ায় আমাকে ভষ্ম করে দিবে।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র। তারপর দপ্ করে যেন নিভে গেল ওর ভেতর জ্বলে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখা। শীতল চোখে চেয়ে থাকে আমার দিকে। কিছু সময় কি যেন ভাবলো। এরপর সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।
আজকের রশিদ আর সেদিনের রশিদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? - “সেদিন ছিলাম আমি নিরপরাধ। আজ অপরাধী।”
খুন করলে কেন? নিরুত্তর। নির্বিকার দৃষ্টি শুধু আমার মুখের উপর থেমে থাকে। আত্মনির্ভরশীলতার প্রতিচ্ছবি ওর মুখে বিদ্যমান। ওর ঠোঁটের কোনে পরিতৃপ্তির অস্পষ্ট রেখা দেখতে পেলাম। কৌতুহল চেপে রাখতে পারছিলাম না। মূল রহস্য জানার উদগ্র বাসনার সুড়সুড়ি আমাকে উত্যক্ত করছিল।
ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, “মানুষ যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, তার মাঝে অপরাধ বোধের একটি অস্পষ্ট ছায়া তার উপর থাকে। ভয়ভীতি ক্রমান্বয়ে তার মনের ভিতর বাসা বাধতে থাকে। অথচ তুমি পেশাদার খুনি না হয়েও এতবড় একটা অপরাধ করার পরও তোমার মাঝে কোন অনুশোচনা, অনুকম্পা কিছুই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং আত্মতৃপ্তির স্পষ্ট রেখা দেখতে পাচ্ছি। এর কারণ কি?”
সন্ধানী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো। এরপর আগের মতই স্বাভাবিক উত্তর “কারন জেনে আপনার কি লাভ? তাছাড়া আমার অপরাধ আমি নিজেই স্বীকার করে নিয়েছি। আদালতেও স্বীকার করবো। কারন, আমার পরিনতির কথা আমি জানি। এ নিয়ে কোন শোক তাপ নেই।”
তা হয়তো ঠিক। আসলেই তোমার সব কিছু শুনে আমার কোন লাভ হয়তো হবে না। তবে একজন মানুষ হিসাবে প্রকৃত সত্য জানার পর সমবেদনা আর সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে দায়মুক্ত হতে পারি।”
কথাটায় কাজ হলো। কোর্টের বারান্দায় লোহার শিকের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। ওর উজ্জ্বল মুখটা অস্পষ্ট ছায়ায় ঢেকে গেল। এরপর আমি এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হলাম।
দুই
গ্রামের নাম সাদীপুর। বেনাপোল চেকপোষ্টের উত্তর দিকে। বর্ডার সংলগ্ন এই গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই চোরাকারবারীর সাথে সংশ্লিষ্ট। বিশেষ করে যারা নিম্নবিত্ত। রশিদ ঐ গ্রামের আতর আলীর একমাত্র সন্তান। তিন বছর বয়সে রশিদ পিতৃহারা হয়। আতর আলী বি,এস,এফ এর গুলিতে মারা যায়। আতর আলী ধুর পাচার করতো। অবৈধ পথে যারা ভারতে যাওয়া আসা করে তাদেরকে ধুর বলে থাকে। শুধু আতর আলীই নয়। জয়নাল, বেলায়েত, শম্ভু, কানকাটা গফ্ফার এরা সবাই ধুর পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্য। এই সিন্ডিকেটের প্রধান রশিদের চাচা মোনাজাত আলী। এর আবার একটু ধারভার আছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে উঠা বসা। সবার সাথেই খাই খাতির আছে।
আতর মারা যাওয়ার পর রশিদের মা প্রতীজ্ঞা করেছিল। না খেয়ে মরলেও ওর ছেলেকে ঐ সব অবৈধ কাজে ভেড়াবে না। জমি যা আছে তা দিয়েই ওদের ভবিষ্যৎ সুখে শান্তিতে কেটে যাবে। রশিদের মাকে বিয়ে করার জন্য ওর চাচা বহু ভাবে রাজী করানোর চেষ্টা করে, বিফল হয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দেয়।
রশিদ বড় হয়ে সংসারের হাল ধরে। কঠোর পরিশ্রম তাকে ক্রমান্বয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এমনি এক সুখময় মুহুর্তে ওর জীবনে দূর্যোগের মেঘ জমে উঠল। ওর মা মরন ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলো। দিন দিন শুকিয়ে যেতে থাকে। সে বুঝতে পারে তার দিন ফুরিয়ে আসছে। সে কারনে ছেলেকে বিয়ে করার জন্য পিড়াপিড়ি করতে থাকে। মৃত্যুর আগে অন্তত ছেলে বৌর মুখ দেখে যেতে চায়। মায়ের অনুরোধে পাশের গ্রাম দৌলতপুরের কোবাদ আলীর মেয়ে সাবিনাকে বিয়ে করে ঘরে আনলো। বৌমাকে পেয়ে রশিদের মায়ের জীবনি শক্তি দ্বিগুন হয়ে গেল। তবে বেশি দিন টিকলো না। এক মাসের মাথায় চিরদিনের জন্য চোখ বুঝলো।
রশিদ অনেকটা অসহায় হয়ে পড়লো। সে তার মাকে ভীষণ ভালবাসতো। তবে স্ত্রী সাবিনার ভালবাসা আর উৎসাহে সেই ক্ষতটা দ্রুত মিশে যেতে থাকে। বছর ঘুরতেই ওদের কোল জুড়ে এল সন্তান। নাম রাখলো সোহাগ। ওর মা বলেছিল, মেয়ে হলে সোহাগী আর ছেলে হলে সোহাগ নাম রাখিস। মায়ের কথা মত ছেলের নাম রাখলো।
হাসি আর আনন্দের মাঝে ওদের সুখের জীবন এগিয়ে যেতে থাকে।
তিন
রশিদের বাড়ীর সামনে একেবারে সীমানার কাছাকাছি একটা বড় নিম গাছ। এই গাছটা রশিদের দাদা লাগিয়েছিল। নিম গাছের হাওয়া না কি শরীরের জন্য উপকারী। এটা ভেবেই গাছটা লাগিয়েছিল। বিশালাকৃতির গাছের নিচে ওরা প্রতিদিন বিকালে বসে গল্প করে সময় কাটায়। মাঝে মধ্যে ওর বন্ধুরা আসে আড্ডা দিতে। সেদিন আবার সাবিনার খাটুনিটা বেড়ে যায়। ভাজামুড়ি সেই সাথে রং চা ওদের আড্ডাটাকে পরিপূর্ণ করে তোলে। মাঝে মাঝে ওরা টিপ্পনী কাটে- “ভাবীর হাতের চায়ের স্বাদই আলাদা।”
সাবিনা ভীষণ লজ্জা পায়। “আসলে লজ্জা ভাবীকে এত বেশী সুন্দর করে যে, বোম্বের নায়িকাও হার মানবে।” জাফর আরো একটু বাড়িয়ে বলে। ওর ইয়ার্কির মাত্রাটা একটু বেশী। যেহেতু সাবিনা ওর আপন চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী। সেই সূত্রে বাড়ীতে আসা যাওয়ার মাত্রাটাও বেশী। একদিন রাতে জাফর এসে রশিদকে বলে, রশিদ, টিভি নাটকে তোর জন্য একটা পার্ট ঠিক করেছি।
রশিদ ওর কথার কোন আগামাথা খুঁজে পায় না। নাটক দেখেছে। এখনো দেখে। কিন্তু সে তো কোনদিন অভিনয় করেনি। অভিনয় সম্পর্কে তার কোন ধারনা নেই। সে সরাসরি প্রত্যাখান করে “নারে জাফর, এসব নিয়ে কোন দিন ভাবিনি। আর ভাবতেও চাইনা, যা করছি, তাতেই আমার সুখ।”
সাবিনাও ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে। জাফর একটা সিগারেট রশিদের দিকে এগিয়ে বলে, “নে ধর” পকেট থেকে দু’ হাজার টাকা বের করে বলে, “এই দ্যাখ, ওরা টাকাও দিয়ে গেছে। আর কি ভাবে কি করতে হবে তাও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে।”
এক সময় বিশ্বাস দৃড় হয়। উচ্চাশার প্রদীপ পিট পিট করে জ্বলে ওঠে মনের গোপন কক্ষে। অনুভূতির বাটনে ছোঁয়া লাগে। শিরা উপশিরায় সুখানুভূতির অস্তিত্ব মিশে যেতে থাকে। উচ্ছ্বাস আরো বেগবান হয়। কল্পনার আকাশে আনন্দের পাখিরা পাক খেতে থাকে। চোখে মুখে পুলকিত মনের রক্তিম আভা বিকশিত হয়। ভালো তো লাগারই কথা। শরীরে শিহরন জাগতেই পারে। যে কেউই এমন একটা লোভনীয় অনাকাঙ্খিত প্রত্যাশায় বিগলিত হতেই পারে। রশিদেরও তেমনটিই ঘটেছিল।
সেদিন রাতে সে সাবিনাকে ভীষন ভাবে আদর করে। শরীরে অস্বাভাবিক উত্তেজনা অনুভব করে। চোখের সামনে কত কিছু ভাসে। নিজেকে টিভির পর্দায় দেখার কথা ভাবে। একটা অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হয়। ঘুম আসতে চায় না। মস্তিস্কের কোষে কোষে অভিনেতা অভিনেত্রীর ছবি ঘুরপাক খায়। চঞ্চল চৌধুরী, তিশা, বিপাশা, চাঁদনী, আবুল হায়াত আরো কত মুখ। সবার নামও জানে না। নাটকে দেখেছে।
এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে চট করে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কে যেন ওর নাম ধরে ডাকছে। এত সকালে কে আবার ডাকাডাকি করছে। এদিক ওদিক তাকায়। চোখের পাতা ভারী হয়ে আছে। আসলে অনেক রাতে ঘুমানোর কারনে এখনো ওর ঘুমের রেশ কাটেনি। ভুল শুনছে বোধ হয়। আবার চোখ বোঁজে।
“রশিদ বাড়ি আছো না কি?” কে ডাকে এত সকালে। দ্রুততার সাথে দরজা খোলে। আসলে ভোর নয়। একেবারে সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু থমকে যায়। দ্যাখে তার উঠানে পাঁচ সাতজন পুলিশ, সাথে দারোগা। আরো দু’তিন জন সাদা পোশাকে। এক জনের গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। তাছাড়া জয়নাল, রাজ্জাক, মতিয়ার, বাচ্চু ওরাও আছে। ভয় পায়। কিছুই বুঝতে পারে না। তার বাসায় পুলিশ কেন। কি করেছে সে?
দারোগার ডাকে ভাবনার ছেদ ধরে, “তুমি রশিদ?”
“হ্যা, ক্যান?”
দারোগা ওর কথার জবাব না দিয়ে পুলিশকে বলেন, “এ্যাই ঘরটা সার্চ করো।” নির্দেশ পেয়ে পুলিশ ঘরে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষনের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বোতল ফেনসিডিল নিয়ে বেরিয়ে এসে বললো, “স্যার, ইনফরমেশন রাইট স্যার।”
“তুমি ফেনসিডিলের ব্যবসা করো?”
এ কথা শুনে ওর শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। অজানা আতঙ্কে কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে প্রতিবাদ করে। “বিশ্বাস করেন স্যার। আমি এসবের কিছুই জানি না। বিশ্বাস না হয় ঐ যে, আমাদের পাশের বাড়ীর জয়নাল, রাজ্জাক ওদের জিজ্ঞেস করেন, ওদের কাছে শুনে দেখেন?”
“ঠিক আছে, থানায় চলো, যা বলার ওসি সাহেবকে বলো।”
ভারসাম্যহীন শরীরটা টলে উঠলো রশিদের। জাফরের ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠলো সামনে। এমন হীন ষড়যন্ত্র কেন করলো সে বুঝে উঠতে পারে না। কোর্টে হাজির করার পর রশিদকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হলো। পরদিন সাবিনা প্রতিবেশী মানুর সাথে জেলগেটে দেখা করে। ভীষণ কান্নাকাটি করলো। অপর প্রান্তে রশিদও কাঁদতে থাকে। মানু ওদের সান্তনা দিয়ে বলে, “ভাবী, এত চিন্তা করছেন কেন। আমরা আছি না। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি বড় উকিলের সাথে কথা বলেছি। সামনের তারিখে ওর জামিন হয়ে যাবে। মানু রশিদকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তবে বেশ কিছু টাকার দরকার। তোর জায়গাটা ভাবীর নামে পাওয়ার দিলে আমরা জমি বন্ধক রেখে টাকার ব্যবস্থা করতে পারবো।” ওদের কথা মত রশিদ ওর সম্পত্তি সাবিনাকে পাওয়ার অব এ্যাটর্নী দেয়। এরপর থেকেই সব কিছু যেন ওলটপালট হয়ে গেল। উকিল নিয়োগ পরের কথা। তার সাথে কেউ দেখা পর্যন্ত করতে আসে না। হতাশা আর শোক তাকে পাথর করে দিয়েছিল। আগে প্রায়ই শিশুর মত কাঁদতো। এখন কাঁদতে ভুলে গেছে। ভুলে গেছে এই জেলখানার চার দেয়ালের ওপাশে আলাদা কোন জগত আছে। এখন কয়েদীদের সাথে তার সময়টা ভালোই কেটে যায়। তার সাত বছরের সাজা হয়েছে। এ নিয়ে শোক তাপ নেই। ক্ষোভ কেবল তাদের উপর। যারা তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। ষড়যন্ত্র করে তাকে জেলে পাঠিয়ে তার সব কিছু হরন করেছে। তবে এমন প্রতারনার শিকার সে শুধু নিজে নয়। সাজা প্রাপ্ত এমন অনেক কয়েদীর সাথে তার আলাপ হয়েছে। যারা বিনা দোষে জেল খাটছে। সেদিন ওদের এলাকার বিনু চোর চুরির দায়ে জ্বেলে আসার পর রশিদকে দেখে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করে। এক পর্যায়ে বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রশিদের মুখের উপর। বিলু যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। বিষ্ময় প্রকাশ করে বলে, “রশিদ ভাই, তুমি কি কিছুই জানো না।”
“কি জানবো। আমার জমি জালিয়াতি করে নিয়ে নিয়েছে। এইতো।”
“নারে ভাই, আরো বড় ঘটনা ঘটেছে।” তোমাকে জেলে পাঠানোর পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিলো। বিশেষ করে ভাবী আর জাফর দুজনে মিলে এসব পরিকল্পনা করেছিল। তোমাকে জেলে পাঠিয়ে তোমার সম্পত্তি বিক্রি করে ভাবীকে নিয়ে চলে গেছে। এখন শুনছি গদখালী থাকে ওরা।
রশিদের বুকের ভিতর পাথর হয়ে থাকা ক্ষোভ আর শোক বিস্ফোরিত হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। রশিদের চোখ দুটো ভাটার আগুনের মত জ্বল জ্বল করে জ্বলে উঠলো। মুখের পেশীগুলো তিরতির করে কাঁপতে থাকে। রক্তের গতি দ্রুতলয়ে উঠা নামা করে। মনে হয় এখনই উল্কার মত ছুটে গিয়ে ধ্বংস করে আসবে। চোখের সামনে কেবল বিধ্বংসী তাণ্ডবের চিত্র। এরই মাঝে একটা ফুটফুটে মুখ ভেসে ওঠে। মুহুর্তে শান্ত শীতল হয়ে যায়। থেমে যায় রক্তে জেগে ওঠা প্রলয়নাচন। চোখে মুখে ফুটে ওঠে অস্থির ব্যাকুলতা। “বিলুকে জড়িয়ে ধরে জানতে চায়, হ্যারে আমার ছেলেটা ভাল আছে তো?”
মানু চুপ করে থাকে। রশিদ ওকে বার বার তাগিদ দেয়, “কি রে। কিছু বলছিস না যে?”
“কি কবো রশিদ ভাই। মানুষ যে এমন নিষ্ঠুর, পাষান হতে পারে, তা কেবল শুনেছিলাম। এবার তা নিজের চোখে দেখলাম। একদিন সকালে ভাবীর কান্নাকাটি শুনে সবাই ছুটে গেল। ভাবী কাঁদতে কাঁদতে সবাইকে বললো, ছেলেটা হঠাৎ করে হাত পা খিঁচতে খিঁচতে এক সময় স্থির হয়ে গেল। কিন্তু আসল ঘটনা সবাই জানে যে, সাবিনা নিজেই ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে।”
পরের কথা গুলো রশিদের কানে গিয়েছিল কি না বিলু তা জানে না। ছেলের মৃত্যু সংবাদ শোনার পরই সে জ্ঞান হারিয়েছিল।
বছর মাস দিন গড়িয়ে একদিন সে মুক্তি পেল। জেল থেকে বের হওয়ার পর নিজেকে সে যেন এক ভিন্ন জগতে আবিস্কার করলো। চারিদিক কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কি যেন খোঁজার চেষ্টা করে। বুকের ভিতর কষ্টের মেঘ জমতে শুরু করে। অস্থিরতা শির শির করে ছড়িয়ে যেতে থাকে মেঘের মত। স্বস্তির বৃষ্টির জন্য ছটফট করে। জলজ প্রাণী যেমন ডাঙায় এসে জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, রশিদের ক্ষেত্রেও যেন তেমনি এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এই পরিবেশ তার জন্য মোটেও সুখকর নয়। কিন্তু পূর্বের স্থানে ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে সব কিছুর উর্দ্ধে দায় মুক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে মনের ভিতর। সে যখন গদখালী পৌঁছালো তখন রাত ৯টা। অনেকে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমের আয়োজনে। জাফরও কেবল ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছে। ঐ মুহুর্তে রশিদ ঘরে ঢুকে পড়ে। সাবিনা জাফর দুজনেই ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। বিশেষ করে সাবিনা তখন রীতিমত থর থর করে কাঁপছিল। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার মুখমন্ডল। জাফর রশিদকে সহজ করার চেষ্টা করে। রশিদ তাকে থামিয়ে বলে, “দেখ তোরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস। এর জন্য আমি কোন কিছুই মনে করিনি। কিন্তু আমার ছেলেকে তোরা মেরে ফেললি। এটা আমার পক্ষে সহ্য করা অনেক কঠিন। জেলখানার চার দেয়ালে প্রতিটি মুহুর্ত কঠিন যন্ত্রণা আমাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করেছে। সব সময় নিজের মৃত্যু কামনা করেছি। কারণ যে মানসিক যন্ত্রনা আমাকে তিলে তিলে নিঃশ্বেষ করছিল, এর চেয়ে মৃত্যু আমার কাছে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন ছিল। কিন্তু তোদের দূর্ভাগ্য এই দীর্ঘ দিনেও মৃত্যুনামক বস্তুটি আমাকে স্পর্শ করেনি। হয়তো আমাকে দায়মুক্ত করার জন্য সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
রশিদের ইস্পাত কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে জাফরের গলা শুকিয়ে যায়। সে রশিদকে শান্ত করার চেষ্টা করে। “তোকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে। আমরা তোর ছেলেকে........। কথা বলার কোন সুযোগ দেয়নি। এক হাতে চুলের মুঠি ধরে নিচে ফেলে গলায় ছোরা চালিয়ে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। গোঙানির শব্দ বের হয়। কিছুক্ষনের মধ্যে জাফরের দেহটা স্তব্ধ হয়ে যায়।
ভয়ার্ত সাবিনা রশিদের পা জড়িয়ে প্রাণ ভিক্ষা চায়। মিনতী জানায়- “ওগো। আমারে মাফ করে দাও।” রশিদ হিসহিসিয়ে ওঠে। “তোর মত ডাইনীকে মাফ করলে পৃথিবীর সমস্ত মা জাতিকে অপমান করা হবে। আরে তুই কেমন মা? যে সন্তান পেটে ধরে কষ্ট করে জন্ম দিলি, মোহের বসে সেই সন্তানকে মেরে ফেললি। কি করে মারলি নিজের কলিজার টুকরো কে। তোর হাত কি একটুও কাঁপলো না। আরে শুনেছি বাপের চেয়ে মায়ের টান বেশী থাকে সন্তানের প্রতি। নিজের খায়েশ মেটানোর যখন এতই শখ ছিল; তখন ছেলেটাকে নিয়েই তো তোদের আশাটা পূরণ করতে পারতিস। তাহলে তো আমি কিছুই বলতাম না। অন্তত ছেলের মুখ চেয়ে আমার সব জ্বালা ভুলে যেতাম। আর দ্যাখ, আল্লাহ বোধ হয় তোর নিয়তিকে এভাবেই লিখে রেখেছেন। যার জন্য এ পর্যন্ত তোদের আর কোন সন্তান হয়নি। আজ যদি তোর সন্তান থাকতো, তাহলে ওর দিকে চেয়ে তোকে মারতে পারতাম না। কিন্তু এখন তোকে শেষ না করা পর্যন্ত আমার ভেতরের আগুন কোন ভাবেই নিভবে না।” সাবিনাকেও একই ভাবে হত্যা করে রক্তাক্ত ছুরি সহ নিজেকে থানায় সোপর্দ করলো।
সব কিছু শোনার পর ওর প্রতি কোন কষ্ট আমার অনুভূতির শিরা স্পর্শ করেছিল কি না বলতে পারবো না। শুধু চলে আসার সময় ওকে এক নজর ভাল করে দেখলাম। ওর ঠোটের কোনে তীর্যক হাসির রেখা ফুটেছিল। সে কি আমাকে অবজ্ঞা বা তিরস্কার করেছিলো? জানিনা। তবে ক্ষোভের আকাশ হতে কষ্টের নক্ষত্র একে একে খসে পড়তে দেখেছি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×