somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিজড়া বনাম মানুষ~

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একটা এসাইমন্টের কাজে তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষের সাথে কথা হয়েছিল। যাদের আমরা 'হিজড়া' হিসেবে জানি তাদের জীবনের চরম তিক্ত কিছু গল্প শোনা হয়েছিল। ঢাকার মগবাজারে একটা গলিতে তাদের বাস। ওই গলির পুরোটাতেই শুধু তারাই থাকে। আগে থেকেই যোগাযোগ করে একদিন সকালে গিয়েছিলাম সেখানে। সাথে আমার একজন বড় আপু ছিল। আমরা যাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের একটা রুমে নিয়ে বসতে দিলো~

আমাদের বসতে দিয়ে ওরা কোথায় যেন চলে গেল। খুব বেশি ভয় না হলেও, একটু একটু ভয় হচ্ছিল। আমি রুমটা একনজরে দেখে নিলাম। একটু অগোছালো রুম। একটা খাট আছে। আর একটা আলমারি আছে। খাটের উপরই আমাদের বসতে দিলো~

৫ মিনিট পর একজন ১ লিটারের একটা পেপসি আর এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে রুমে ঢুকে বললো, "আসলে সবাই আমাদের ঘৃণা করে তো!! কেউই আমাদের এইখানে আসে না। আরো আগে একজন সাংবাদিক এসেছিল। তবে আপনাদের মত মানুষরা আসলে সত্যি আমরা অনেক খুশি হই। বলুন আপনাদের কিভাবে সাহায্য করব?"

আমরা বললাম, "আসলে আমরা আপনাদর সম্পর্কে জানতে এসেছি।" উনি বললেন "ওকে জানবেন, তার আগে এই পেপসি আর একটু বিস্কুট খেয়ে নিন। আপনারা খেলে আমি অনেক খুশি হব।"

খাওয়ার পরই শুরু হলো প্রশ্ন...

-আপনার নাম কি?
--রিংকু... রিংকু হিজড়াও বলতে পারেন।

-আচ্ছা আমরা যতটুকু জানি, হিজড়াদের সাথে যোগ দেওয়ার পূর্বে আপনাদের অন্য একটা নাম থাকে। তখন আপনার নাম কি ছিল?
--তখন আমার নাম ছিল 'রাজু'। আমরা ৩ ভাই, ২ বোন ছিলাম। আমার বাবা বিদ্যুৎ অফিসের একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।

-আপনার বর্তমান বয়স কত? কত বছর বয়সে আপনি হিজড়াদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন? কেন যোগ দিয়েছিলেন?
--আমার বর্তমান বয়স ৩২ বছর। আমি ১৩ বছর বয়সে হিজড়াদের সাথে যোগ দেই। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ছোট বেলা থেকেই আমি একটু মেয়েলি স্বভাবের ছিলাম। তখন আমার এই স্বভাবের কারনে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আমার বাবা-মা ও আমাকে সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখত। তারা কোন বিয়েবাড়ি বা কোন অনুষ্টানে গেলে আমাকে নিত না। লোক লজ্জার ভয়ে তারা আমাকে তাদের ছেলে হিসেবেও দাবি করত না। সমাজ যখন আমাকে দাম দিলো না, আমাকে তুচ্ছ করে দেখতে থাকলো, তখন এই হিজড়ারাই আমাকে বুকে টেনে নিল। তাই আমি হিজড়াদের সাথে যোগ দিয়েছি।

-হিজড়াদের সাথে যোগ দেওয়ার পর, আপনার ফ্যামেলির সাথে আর যোগাযোগ হত? এরপর তাদের সাথে দেখা হয়েছে কখনও? আপনি হিজড়াদের সাথে যোগ দেওয়ার পর আপনার ফ্যামিলির কেউ আপনার সাথে রাগ করে নি?
--রাগ করবে মানে? উল্টা সবাই আরো খুশি হয়েছিল। আমি ছিলাম তাদের কাছে একটা বোঝার মত। আমার জন্য তাদেরকে সমাজের মানুষের কাছে হেয় হতে হত। তাই আমি যখন এখানে চলে আসি, তারা সবাই মোটামুটি খুশিই হয়েছিল। আর বাবা-মা যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিন মাঝে মধ্যে কথা হত। আর এইখানে চলে আসার পর দুইবার বাসায় গিয়েছিলাম।

-আচ্ছা আমরা দেখে থাকি, হিজড়ারা এখন তাদের পেশা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেঁচে নিয়েছে। এবং অভিযোগ আছে যে, তারা প্রায় সময়ই জোর করে টাকা আদায় করে। এটা কি ঠিক? এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
--হুম আমরা ভিক্ষাবৃত্তি করেই বেঁচে থাকি। এছাড়া আমাদের যে আর কোন পথ নাই! আচ্ছা ধরুন, আমি একটা দোকান দিলাম। আপনারা ভদ্র সমাজের কজন আমার থেকে পন্য ক্রয় করবেন? নাকি নাক ছিটিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন? আচ্ছা ধরুন আমি আপনার একটা অফিসে চাকুরি করতে গেলাম। আপনি কি আমাকে চাকুরি দিবেন? নাকি তখনও মুখ ব্যাকিয়ে বলবেন, এই লোক আমার অফিসে থাকলে কেউ আমার অফিসে আসবে না। একে চাকুরি দেওয়া যাবে না। তাহলে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আমরা কি করে খাব বলুন? এইতো গেল আয়ের হিসাব... আচ্ছা এইবার ধরুন আপনি ৬ তলা একটা বাড়ির মালিক। প্রত্যেক তলায় ২ টি করে ফ্ল্যাট আছে। আপনি একটি ফ্ল্যাট বিক্রয় করবেন। আপনি প্রতিটি ফ্ল্যাটের যা দাম চেয়েছেন, আমি যদি তার চাইতে ৫ লক্ষ টাকা বেশিও দিতে চাই তবুও আপনি আমার কাছে ফ্ল্যাট বিক্রয় করবেন না। কেন জানেন? তখন আপনি ভাববেন, একটা হিজড়া আমার বাসায় থাকলে আমার মান সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। এইবার বলুন আমরা কোথায় যাব? জোর করে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া এই সমাজে আমাদের জন্য অন্য কোন পেশা নাই।

-আচ্ছা সরকার তো বলেছিল, আপনাদের ট্রাফিকে চাকুরি দিবে, সেটা হলেই তো আপনাদের আর ভিক্ষাবৃত্তি করা লাগবে না। নাকি?
--সরকার আমাদের ট্রাফিকে চাকুরি দিবে, এটা আপনিও জানেন আমরাও জানি। কিন্তু এটার পেছনেও আরো কিছু কথা লুকিয়ে আছে, সেটা আমরা কয়জন জানি? যেসব হিজড়ারা SSC পাশ করেছে, সরকার শুধু তাদেরই চাকুরি দিবে। আমাদের দেশে SSC পাশ করতে নূন্যতম বয়স লাগে ১৬/১৭ বছর। কিন্তু বেশিরভাগ হিজড়াই হিজড়া দলে প্রথম যোগ দেয় তাদের নূন্যতম জ্ঞান হওয়ার পর। মানে ক্লাস ৭/৮ এর দিকে। হিজড়াদের সাথে যোগ দেওয়ার পর কারোই আর পড়াশোনা করা হয়ে উঠে না। সারা বাংলাদেশে হিজড়া আছে ১ লাখের অধিক। কিন্তু SSC পাশ হিজড়া আছে সর্বোচ্চ ১০০ জন। সরকার হিজড়াদের চাকুরি দিবে বলেই অনেক সুনাম অর্জন করে নিচ্ছে। কিন্তু কজন কে চাকুরি দিবে, সেটা আমরা ভালো জানি...

-আচ্ছা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি, আপনার আমাদের মত মানুষদের উপর ভালোই ক্ষোভ আছে। কেন এ ক্ষোভ? আর আপনি কি আমাদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু বলতে চান?
--ক্ষোভ একটু একটু আছে। কারন সুশীল মানুষদের কারনেই আমাকে আজ পরিবার ছেড়ে দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে। আর বলার মত একটা কথাই আছে, আমাদের ঘৃনা করবেন না প্লিজ। আমরাও মানুষ... আমাদের একটু সম্মান করুন প্লিজ। আর আমাদের দেখে যখন আপনারা ছোটাছুটি করেন, তখন আমাদের অনেক কষ্ট লাগে। আমরা কোন প্রানী না, আমরাও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ।
.
.
.
একজন ৮ম শ্রেনী পাশ মানুষ সত্যিই আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আসলেই কি ওরা ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে আছে? নাকি আমরা ওদের ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য করছি?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:২৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরোনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×