somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আলো

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আলো এক ধরনের বিকীর্ণ শক্তি। এর কণা ও তরঙ্গ উভয় ধর্ম রয়েছে। অালো তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ অাকারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। অালোর গতিবেগ মাধ্যমের উপর নির্ভর করে। শূন্য মাধ্যমে এর গতিবেগ সর্বোচ্চ। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত অাইনস্টাইনের অাপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব থেকে জানা যায়, "শূন্য মাধ্যমে অালোর গতিবেগ সমস্ত পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে একই এবং তা অালোর উৎসের ও পর্যবেক্ষকের গতির সাথে নিরপেক্ষ"। অর্থাৎ একগুচ্ছ অালোকরশ্মি যেখান থেকেই উৎপন্ন হোক না কেন এবং এটিকে মহাবিশ্বের যেকোন স্থান থেকে যে পরিস্থিতিতেই পর্যবেক্ষণ করা হোক না কেন, সেই পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষকের গতি যতই থাকুক, সকল ক্ষেত্রেই অালোর গতিবেগ অভিন্ন থাকবে।

প্লেটো প্রথম অালোর নির্গমন তত্ত্ব গ্রন্থনা করেন। তার মতে চোখ থেকে নির্গত অালো দ্বারা দর্শন উপলব্ধি হয়। তিনি টিমিউস এর অায়নায় বিম্বের উল্টো সমতা সম্পর্কেও মন্তব্য করেন। এর প্রায় শত বছর পর ইউক্লিড "অপটিকস" নামে একটি গ্রন্থ লিখেন। এ বইটিতে তিনি দৃষ্টির সাথে জ্যামিতির সম্পর্ক স্থাপন করেন অার সৃষ্টি হয় জ্যামিতিক অালোকবিজ্ঞান। অালোকবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা লাভের পর সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি ছিল কিভাবে অালোক শক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। এই সংক্রান্ত দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত ছিল, একটি কণাতত্ত্ব, অপরটি তরঙ্গতত্ত্ব। নিউটন অালোর কণাতত্ত্বের প্রবর্তন করেন। কণাতত্ত্ব অনুসারে কোন দীপ্ত বস্তু হতে অসংখ্য ক্ষুদ্র কণা নির্গত হয়। এই কণাগুলোর কোন ভর নেই এবং এগুলো অালোকরশ্মির সমান গতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নিউটনের সমসাময়িক ডাচ বিজ্ঞানী হাইগেনস প্রথম অালোর তরঙ্গতত্ত্ব প্রদান করেন। তার মতে অালোকশক্তি তরঙ্গ অাকারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানী ইয়ং, ফ্রেনেলসহ অারো কয়েকজন বিজ্ঞানী পরীক্ষণের মাধ্যমে হাইগেনস এর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তরঙ্গতত্ত্ব প্রতিষ্ঠালাভ করলেও অালোর অনেক ধর্মই তরঙ্গ তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার সমাধান ঘটে বিংশ শতাব্দীতে এসে যখন অালোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব অাত্মপ্রকাশ করে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে অালো বা যেকোন বিকিরণই অসংখ্য কোয়ান্টার সমষ্টি। এই কোয়ান্টাগুলোকেই ফোটন বলা হয়। এই ফোটন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হতে পারে। পরমানুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রন একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিউক্লিয়াসের চারপাশে পরিভ্রমণ করে। ইলেকট্রনের এই কক্ষপথকে শক্তিস্তর বলে। ইলেকট্রন কিছু শক্তি শোষণ করে অপেক্ষাকৃত উচ্চ শক্তিস্তরে ভ্রমণ করতে পারে। এই ইলেকট্রন যখন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে অাবার এর স্বাভাবিক কক্ষপথে ফিরে অাসে, তখন এই শোষিত শক্তি ফোটন হিসেবে নির্গত হয়। দৈনন্দিন জীবনে যেই লাইটগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলো এই পদ্ধতিতেই ফোটন উৎপন্ন করে। কিন্তু মহাশূন্যে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে যেই অালোকরশ্মি নির্গত হয়, তার ফোটনগুলো নক্ষত্রের অভ্যন্তরেই জটিল ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১০ সেকেন্ড পর থেকে পরবর্তী ৩৮০০০০ বছর পর্যন্ত সময়কালকে ফোটন যুগ বলা হয়। এই সময়ে অাদি মহাবিশ্ব অত্যন্ত উত্তপ্ত, ঘন প্লাজমা অবস্থায় ছিল। মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের সাথে সাথে তাপমাত্রা কমতে থাকে। প্রায় ৩৮০০০০ বছর পর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এমন একটি সহনীয় পর্যায়ে পৌছায় যখন পরমানুর নিউক্লিয়াস ইলেকট্রনের সাথে যুক্ত হয়ে পরমানু গঠন করতে শুরু করে। অার এই সময়ই বহুল অালোচিত Cosmic Microwave Background Radiation তৈরী হয়েছিল।



অালোর গতিবেগঃ
অালোর গতিবেগ ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ m/s বা সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। সপ্তদশ শতাব্দীর অাগে মনে করা হতো অালোর গতি অসীম। ১৬৬৭ সালে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও প্রথম অালোর গতিকে সসীম বলে দাবী করেন। কিন্তু তিনি অালোর গতিবেগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। ১৬৭৫ সালে বিজ্ঞানী Olaus Roemer সর্বপ্রথম বৃহঃস্পতির একটি উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের সময় অালোর গতিবেগ নির্ণয় করেন। তার পর্যবেক্ষণ থেকে অালোর গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ২,১৪,০০০ Km/s নির্ণীত হয়। এরপর ১৭২৪ সালে James Bradley নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অালোর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩,০১,০০০ Km নির্ণয় করেন। এগুলো ছিল অালোর গতিবেগ নির্ণয়ের নভোপদ্ধতি। ১৮৪৯ সালে ভূপদ্ধতি ব্যবহার করে অালোর গতিবেগ সর্বপ্রথম পরিমাপ করেন Armand Fizeau। তিনি দাঁতযুক্ত একটি ঘূর্ণায়মান চাকার মধ্যদিয়ে অালোকরশ্মি প্রেরণ করেন যা ৮ কিলোমিটার দূরত্বে স্থাপিত একটি অায়নায় প্রতিফলিত হয়ে ফিরে অাসে। এই পদ্ধতিতে তিনি অালোর গতিবেগ ৩,১৫,০০০ Km/s নির্ণয় করেন। পরবর্তীতে Leon Faucault তার এই পদ্ধতিকে উন্নত করে এবং অালোর গতিবেগ ২,৯৮,০০০ Km/s পান। ম্যাক্সওয়েল এর তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্ব অাবিষ্কারের পর পরোক্ষ পদ্ধতিতে অালোর গতিবেগ নির্ণয়ের পথ উন্মোচিত হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ১৮৫৭ সালে Weber ও Kohlrausch এবং ১৯০৭ সালে Rosa ও Dorsey অালোর গতিবেগ ২,৯৯,৭৮৮ Km/s পান। ১৯৫৮ সালে Froome মাইক্রোওয়েভ ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহার করে অালোর গতিবেগ ২,৯৯,৭৯২.৫ নির্ণয় করেন। ১৯৭০ সালের পর লেজারের সাহায্যে অারো নির্ভুলভাবে অালোর গতিবেগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় যা ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ Km/s।


অালোকরশ্মি যেই উৎস থেকেই উৎপন্ন হোক না কেন শূন্য মাধ্যমে এর গতিবেগ সর্বদা ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ Km/s ই থাকবে। প্রাচীনকালে অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম অালোকরশ্মি চলাচলের মাধ্যম হিসেবে "ইথার" কে গণ্য করতেন। তার মতে এই ইথারের অস্তিত্ব ছিল সর্বত্রই। দীর্ঘদিন অ্যারিস্টটলের এই কাল্পনিক ইথারকেই অালোকরশ্মি চলাচলের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হতো। এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী হাইগেনসও ইথারের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। পরবর্তীতে ১৮৮৭ সালে Michelson ও Edward Morley'র পরীক্ষণ থেকে জানা যায় ইথারের কোন অস্তিত্ব নেই। Michelson ও Edward Morley চিন্তা করলেন যদি ইথারের অস্তিত্ব থেকেই থাকে, তবে অালোর গতিবেগ ইথার প্রবাহের দিকে একরকম হবে এবং ইথার প্রবাহের বিপরীত দিকে অারেকরকম হবে। তাই তারা বছরের বিভিন্ন সময় সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের প্রেক্ষিতে অালোর গতিবেগ নির্ণয় করলেন এবং দেখলেন যে প্রতি ক্ষেত্রেই অালোর গতিবেগ একই। তাদের এই পরীক্ষণের মাধ্যমে ইথারের অস্তিত্বের অবসান ঘটে।

প্রতিফলনঃ
অালোকরশ্মি স্বচ্ছ কোন মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় যদি অন্য কোন মাধ্যমে বাধা পায়, তখন দুই মাধ্যমের বিভেদতল থেকে কিছু পরিমাণ অালো প্রথম মাধ্যমে ফিরে অাসে। এই ঘটনাকে অালোর প্রতিফলন বলে। দৈনন্দিন জীবন অালোর প্রতিফলনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। অামরা যখন অায়নার সামনে দাঁড়াই, তখন অায়নায় অামরা নিজেদের যেই প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, তা অালোর প্রতিফলনের জন্যই সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, অামাদের চোখের মেকানিজমও কিন্তু অালোর প্রতিফলন নির্ভর। কোন বস্তু থেকে অালোকরশ্মি যখন অামাদের চোখের রেটিনা অংশে প্রতিফলিত হয়, তখন রেটিনায় সেই বস্তুর একটি প্রতিবিম্ব গঠিত হয়, যার ফলে অামরা বস্তুটি দেখতে পাই। প্রতিফলক পৃষ্ঠ মসৃণ হলে অালোর প্রতিফলন প্রধানত তিনটি সূত্র মেনে চলে-
১) অাপতিত রশ্মি, অাপতন বিন্দুতে প্রতিফলকের উপর অভিলম্ব এবং প্রতিফলিত রশ্মি একই সমতলে থাকে
২) অাপাতন কোণ এবং প্রতিফলন কোণ সর্বদা সমান হয়
৩)অাপতিত রশ্মি ও প্রতিফলিত রশ্মি সর্বদা অভিলম্বের বিপরীত পার্শ্বে অবস্থান করে



প্রতিসরণঃ
অালোকরশ্মি এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রবেশ করলে মাধ্যম দুটির বিভেদতলে এর দিক পরিবর্তন ঘটে। এই ঘটনাকে অালোর প্রতিসরণ বলে। মূলত মাধ্যমগুলোর ঘনত্বের পার্থক্যের জন্যই অালোর প্রতিসরণ ঘটে থাকে। বিভেদতলের যেই বিন্দুতে অালোকরশ্মি অাপতিত হয় তাকে অাপতন বিন্দু বলে এবং এই বিন্দুতে অঙ্কিত লম্বকে অভিলম্ব বলে। অালোকরশ্মি যখন হালকা ঘনত্বের মাধ্যম থেকে ঘন মাধ্যমে প্রবেশ করে, তখন এই অালোকরশ্মি অভিলম্বের দিকে বেঁকে যায়। অাবার যখন অালোকরশ্মি অধিক ঘনত্বের মাধ্যম থেকে হালকা ঘনত্বের মাধ্যমে অাপতিত হয়, তখন তা অভিলম্ব থেকে দূরে সরে যায়। ১৬২০ সালে নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানী Willebrond Snellius অালোর প্রতিসরণকে একটি গাণিতিক রূপ দান করেন যা স্নেলের সূত্র নামে পরিচিত। তিনি গাণিতিকভাবে দেখান যে একজোড়া নির্দিষ্ট মাধ্যম এবং একটি নির্দিষ্ট বর্ণের অালোকরশ্মির জন্য অাপতন কোণের সাইন এবং প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাত সর্বদা ধ্রুবক থাকে। এই ধ্রুবককে গ্রীক বর্ণমালা μ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।


অাপতিত রশ্মি ও অভিলম্বের মাঝে যেই কোণ উৎপন্ন হয় তাকে অাপতন কোণ বলে, যাকে স্নেল Sin i দিয়ে প্রকাশ করেছেন। এখানে i অর্থ incident ray বা অাপতিত রশ্মি। প্রতিসরিত রশ্মি ও অভিলম্বের মাঝে উৎপন্ন কোণকে প্রতিসরণ কোণ বলে যাকে r দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এখানে r অর্থ refracted ray বা প্রতিসরিত রশ্মি। তাহলে স্নেলের সূত্রানুসারে, Sin i/ Sin r= μ। এই সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে অাপতন কোণ ও প্রতিসরণ কোণ পরস্পর সমানুপাতিক। অর্থাৎ অাপতন কোণের মান যত বাড়বে প্রতিসরণ কোণের মানও তার সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। অাপতন কোণের যেই মানের জন্য প্রতিসরণ কোণের মান ৯০° হয় তাকে সংকট কোণ বলে। অালোকরশ্মি ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমে প্রবেশের সময় দুই মাধ্যমের বিভেদতলে অভিলম্বের সাথে যদি সংকট কোণের চেয়ে বেশি কোণে অাপতিত হয়, তখন অালোকরশ্মি প্রতিসরিত না হলে সম্পূর্ণ অালো প্রথম মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এই ঘটনাকে অালোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন বলে।

অালোর বিচ্ছুরণঃ
দৃশ্যমান অালোকরশ্মির বর্ণ সাদা। কিন্তু এই সাদা বর্ণের অালো সাতটি ভিন্ন বর্ণের অালোর সমষ্টি। দৃশ্যমান অালোকরশ্মি যখন একটি প্রিজমের ভেতর দিয়ে গমন করে তখন এটি সাতটি ভিন্ন বর্ণে বিভাজিত হয়। এই ঘটনাকে অালোর বিচ্ছুরণ বলে। সর্বপ্রথম অাইজ্যাক নিউটন অালোর এই ধর্ম অাবিষ্কার করেন। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের অালোকরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন হওয়ায় প্রিজমের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় এরা বিভিন্ন কোণে বেঁকে যায়। যার ফলে অালোর বিচ্ছুরণ ঘটে। প্রিজম হলো তিনটি অায়তাকার এবং দুটি ত্রিভুজাকার তল দ্বারা সীমাবদ্ধ একটি সমসত্ব ও স্বচ্ছ প্রতিসারক মাধ্যম। অামাদের চোখ ৩৮০ থেকে ৭৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অালো দেখতে পায়। এর মধ্যে যেই সাতটি বর্ণের অালোকরশ্মি রয়েছে তাদের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যথাক্রমে-
বেগুনীঃ ৩৮০-৪৫০ nm
নীলঃ ৪৫০-৪৮৫ nm
অাসমানিঃ ৪৮৫-৫০০
সবুজঃ ৫০০-৫৬৫ nm
হলুদঃ ৫৬৫-৫৯০ nm
কমলাঃ ৫৯০-৬২৫ nm
লালঃ ৬২৫-৭৫০ nm



ব্যতিচারঃ
ব্যতিচার বলতে সাধারনত দুটি তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে সৃষ্ট নতুন তরঙ্গের বিস্তারের পর্যায়ক্রমিক হ্রাস-বৃদ্ধির ঘটনাকে বোঝানো হয়। বিভিন্ন বর্ণের অালোকরশ্মির ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য রয়েছে এবং তা একটি নির্দিষ্ট দ্রুতিতে সামনে অগ্রসর হয়। একটি নির্দিষ্ট বর্ণের অালোকরশ্মির ক্ষেত্রে তার দ্রুতিকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করলে সেই অালোকরশ্মির তরঙ্গের কম্পাঙ্ক পাওয়া যায়। তরঙ্গ সঞ্চালনকারী একটি কণা তার সাম্যাবস্থান থেকে যেকোন দিকে সর্বাধিক যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে বিস্তার বলে। অাবার তরঙ্গ সঞ্চালনকারী কোন কণার যেকোন মুহূর্তের গতির সম্যক অবস্থানকে দশা বলা হয়। এখানে গতির সম্যক অবস্থার অর্থ একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত্বে কণাটির সরণ, বেগ, ত্বরণ ইত্যাদি। অালোর ব্যতিচার বোঝার জন্য এই বিষয়গুলো জানা অাবশ্যক। এখন দুটি সুসংগত উৎস হতে নিঃসৃত সমান কম্পাঙ্ক ও বিস্তারের দুটি অালোক তরঙ্গ কোন মাধ্যমের একটি বিন্দুর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে গমন করলে তরঙ্গ দুটির উপরিপাতনের ফলে বিন্দুটি কখনো কখনো খুব উজ্জ্বল হয়, অাবার কখনো কখনো অন্ধকার দেখায়। অালোক রশ্মির এই ঘটনাকে ব্যতিচার বলে। তরঙ্গ দুটি যখন কোন বিন্দুতে একই দশায় মিলিত হয় তখন যেই উজ্জ্বল অালো দেখা যায় তাকে গঠনমূলক ব্যতিচার বলে। পক্ষান্তরে তরঙ্গ দুটি যখন কোন বিন্দুতে বিপরীত দশায় মিলিত হয় তখন যেই অন্ধকার তৈরী হয় তাকে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলে। ১৮০৭ সালে Thomas Young একটি পরীক্ষণের মাধ্যমে অালোর ব্যতিচারকে ব্যাখ্যা করেন। ব্যতিচার অালোর তরঙ্গ ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য, সেজন্য তৎকালীন অনেক বিজ্ঞানীই Thomas Young এর পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে ফরাসি পদার্থবিদ Augustin Fresnel এবং Francois Arogo'র মাধ্যমে ইউরোপে Thomas Young এর পরীক্ষণটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।



অপবর্তনঃ
অালোকরশ্মি যখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষা ছোট কোন ছিদ্রের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন কিছুটা বেঁকে যায় এবং জ্যামিতিক ছায়া উৎপন্ন করে। অালোকরশ্মির এই ধর্ম অপবর্তন নামে পরিচিত। এই বেঁকে যাওয়ার পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অালোর জন্য বিভিন্ন রকম। সাদা অালোকে এই ধরনের ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে অপবর্তিত করা হলে এর মধ্যে উপস্থিত সাতটি বর্ণের অালো ভিন্ন ভিন্ন কোণে বেঁকে যায়। এর ফলে বর্ণালী সৃষ্টি হয়। Francesco Grimaldi সর্বপ্রথম অালোকরশ্মির এই ধর্ম প্রত্যক্ষ করেন এবং অপবর্তন শব্দটির প্রচলন করেন। তিনি একটি পরীক্ষণে দুটি ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে অালোকরশ্মি পাঠান যা ছিদ্র দুটির অপরপ্রান্তে অবস্থিত একটি পৃষ্ঠতলে পতিত হয়। তিনি লক্ষ্য করলেন যে অালোকরশ্মি সরলপথে ছিদ্র দুটি দিয়ে গমন করলে পৃষ্ঠতলে পতিত অালোকরশ্মি যতটুকু প্রশস্ত হওয়ার কথা প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে কিছুটা অধিক প্রশস্ত। এটি কেবলমাত্র তখনই সম্ভব যদি অালোকরশ্মি সরু ছিদ্রের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় গতিপথে কিছুটা বেঁকে যায়। এই ঘটনা থেকেই তিনি অালোকরশ্মির অপবর্তন অাবিষ্কার করেন যা অালোর তরঙ্গ ধর্মের একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ।


তবে অালোকরশ্মি শুধু সরু ছিদ্র কিংবা তীক্ষ্ণ ধার ঘেষে যাওয়ার সময়ই গতিপথে বেঁকে যায় না। অালোকরশ্মির গতিপথে বেঁকে যাওয়ার অারেকটি ঘটনা অাপেক্ষিকতার সাধারন তত্ত্বে পাওয়া যায়। এটি অবশ্য অপবর্তন থেকে সম্পূর্ণ অালাদা একটি বিষয়। ১৯১৫ সালে অাইনস্টাইন অাপেক্ষিকতার সাধারন তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। তিনি এই তত্ত্বে পদার্থের কারনে স্থান-কালের গঠনের বিশৃঙ্খলা বিশদভাবে বর্ণনা করেন। মহাশূন্য প্রকৃতপক্ষে স্থান-কালের একটি চতুর্মাত্রিক কাঠামো এবং বৃহৎ ভরবিশিষ্ট মহাজাগতিক বস্তুসমূহ এই স্থান-কালের চতুর্মাত্রিক কাঠামোতে বক্রতা সৃষ্টি করে। বস্তুর ভর যত বেশি তা তত অধিক পরিমাণে বক্রতা সৃষ্টি করে। অালোকরশ্মি যখন এই বক্রতা দিয়ে গমন করে, তখন এর মহাকর্ষীয় দিক বিচ্যুতি ঘটে, অর্থাৎ গতিপথে বেঁকে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারনে অাইনস্টাইনের কাজগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মত মিত্র দেশগুলোতে পৌছানো একটি দুরহ কাজ ছিল। কিন্তু এই দুরহ কাজটিই সম্ভব হয়েছিল নেদারল্যান্ডের কিছু পদার্থবিদ, অস্ট্রিয়ান পল এরেনফেস্ট, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেঞ্জ ও লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলিয়াম ডি সিটার এর মাধ্যমে। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ অার্থার স্টানলি এডিংটন এর নেতৃত্বে একটি দল দাবী করেন যে তারা সূর্যের পাশ দিয়ে গমনকারী অালোকরশ্মির মহাকর্ষীয় দিক বিচ্যুতির প্রমাণ পেয়েছেন সূর্যগ্রহণের ছবি তোলার সময়। এই পর্যবেক্ষণ ব্রাজিলের সোব্রাল ও ক্যারিবিয় প্রিন্সিপ দ্বীপ থেকেও করা হয় এবং একই ফল পাওয়া যায়।

অালোক তড়িৎ ক্রিয়াঃ
একটি ধাতব পাতের উপর তড়িৎ চুম্বক বিকিরণ অাপতিত হলে তাতে ফোটনগুলো শোষিত হয় এবং ইলেকট্রন নির্গত হয় যা তড়িৎ প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধাতব পদার্থ থেকে নির্গত ইলেকট্রনকে বলা হয় ফটো ইলেকট্রন। এই প্রক্রিয়াকেই অালোক তড়িৎ ক্রিয়া বলা হয়। সোডিয়াম, পটাশিয়াম, সিজিয়াম প্রভৃতি ক্ষারধর্মী পদার্থে অালোক তড়িৎ ক্রিয়া অধিক পরিলক্ষিত হয়। ১৮৭৩ সালে W.Smith অালোক তড়িৎ ক্রিয়া অাবিষ্কার করেন। ১৯০৫ সালে অাইনস্টাইন একটি গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে দেখান যে ধাতব পাতে অাপতিত বিকিরণের কম্পাঙ্ক বৃদ্ধি পেলে নির্গত ফটো ইলেকট্রনের শক্তিও বৃদ্ধি পায়। ১৯১৫ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকান পরীক্ষা করে দেখেন যে অাপতিত বিকিরণের কম্পাঙ্ক বৃদ্ধির সাথে নির্গত ইলেকট্রনের শক্তি রৈখিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে অাইনস্টাইনের সমীকরণ সঠিক হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং ১৯২১ সালে অাইনস্টাইনকে ফটো তড়িৎ ক্রিয়ার জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।



অালো মহাবিশ্বের এক অপরিহার্য উপাদান। অন্ধকার এই মহাবিশ্বকে অালোকিত করে তা অামাদের চোখে দৃশ্যমান করেছে। দীর্ঘদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল অালো সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যগুলো একত্রে লিপিবদ্ধ করবো। লেখাটি দীর্ঘ হলেও প্রকৃতপক্ষে এখানে প্রতিটি টপিকস যতটা সম্ভব সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। অাশা করি এটি অনেকের কাজে লাগবে। ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্র ও ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Wikipedia, Wikimedia, Science abc, Science world, Light Physics, উচ্চমাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান-২য় পত্র(ড. অামির হোসেন ও মোহাম্মদ ইসহাক) Joostrekveld, britannica, math ucr, Physics world
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:৩৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×