somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বজ্রপাত সমাচার

২৪ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে বাংলাদেশ একটি দূর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, জলোচ্ছাস, কালবৈশাখী ঝড় প্রভৃতির সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুকের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের ১০মে পর্যন্ত বজ্রপাতে সারাদেশে দুই হাজার একশ ছয় জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। মে মাসকে বজ্রপাতের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হিসেবে দেখানো হয়েছে গবেষণায়। জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম ব্যবহার করে দেখা গেছে রংপুর বিভাগের মধ্যে ঠাকুরগাঁও এবং লালমনিরহাটে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। এছাড়া রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণায় এবং ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জে বজ্রপাতের হার বেশি।

★বজ্রপাত কিভাবে হয়?

সাধারণত উষ্ণ এবং অার্দ্র অাবহাওয়ায় অধিকহারে বজ্রমেঘ সৃষ্টি হয়। ভূপৃষ্ঠের পানি যখন বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠে গিয়ে দ্রুত ঠান্ডা হয়, তখন বজ্রমেঘ তৈরী হয়। এই বজ্রমেঘ প্রকৃতপক্ষে বৃষ্টিকণা, ক্ষুদ্র তুষার স্ফটিক এবং গ্রাউপেলের সমষ্টি। গ্রাউপেল হলো দানাদার তুষার কণা যা অাকারে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ঘন। বজ্রমেঘের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র বৃষ্টিকণা এবং ক্ষুদ্র তুষার স্ফটিক দ্রুত গতিতে মেঘের উপরের দিকে উঠতে থাকে, অন্যদিকে গ্রাউপেল গুলো বড় ও ঘন হওয়ায় মেঘের নিচের দিকে নামতে থাকে, ফলে এদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষের ফলে তুষার কণার স্ফটিকগুলো ইলেকট্রন হারিয়ে পজিটিভ চার্জ লাভ করে এবং বজ্রমেঘের উপরের অংশে অবস্থান করে। অন্যদিকে গ্রাউপেল গুলো ইলেকট্রন গ্রহণ করে নেগেটিভ চার্জ প্রাপ্ত হয়ে মেঘের নিচের অংশে অবস্থান করে। ফলে বজ্রমেঘের অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়।



যখন এই বজ্রমেঘের সঞ্চিত চার্জ অত্যন্ত শক্তিশালী রূপ ধারণ করে, তখন বজ্রমেঘের নীচের অংশের নেগেটিভ চার্জ ভূপৃষ্ঠের পজিটিভ চার্জকে অাকর্ষণ করে। এই পর্যায়ে বজ্রমেঘের নেগেটিভ চার্জ গাছের শেকড়ের মত অাঁকাবাঁকা পথে ভূপৃষ্ঠের দিকে নেমে অাসতে থাকে। নেমে অাসতে থাকা চার্জের যেই অভিমুখটি প্রথম ভূপৃষ্ঠকে স্পর্শ করে সেই পথেই বজ্রপাত ঘটে।



★অামরা কিভাবে বজ্রপাতে অাক্রান্ত হই?

যখন বজ্রপাত সরাসরি কোন মানুষের শরীরে অাঘাত করে, তখন কিছু বিদ্যুত শরীরের বাইরের অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং কিছু বিদ্যুত শরীরের ভেতরের অংশ দিয়ে। শরীরের ভেতরে এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত সাধারণত স্নায়ুতন্ত্র এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করে। ফলে অাক্রান্ত ব্যক্তিটির কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। বজ্রপাতের ফলে উৎপন্ন উচ্চ তাপমাত্রায় শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যেতে পারে। এছাড়াও অাক্রান্ত ব্যক্তিটি রেসপিরেটরি অ্যারেস্ট, মাসল স্পাজম, সিজার প্রভৃতি সমস্যায় ভুগতে পারে। সরাসরি বজ্রপাতের অাঘাত ছাড়াও মানুষ অারো বিভিন্নভাবে বজ্রপাতে অাক্রান্ত হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির সময় অনেকেই গাছের নিচে অাশ্রয় নেয়। অামাদের শরীর গাছের চেয়েও ভাল বিদ্যুত পরিবাহী। ফলে বজ্রপাত যখন উঁচু কোন গাছে পতিত হয় এবং তার নিচে কোন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, বিদ্যুত তখন গাছ থেকে মানুষের শরীরের মধ্য দিয়েও প্রবাহিত হয়। এধরনের ঘটনাকে "সাইড ফ্ল্যাশ" বলে। অাবার কোন স্থানে বজ্রপাত ঘটলে বিদ্যুত সাথে সাথেই ভূপৃষ্ঠে বিলীন হয়ে যায় না, বরং যেই স্থানে বজ্রপাত ঘটেছে তার অাশেপাশের বেশ কিছু জায়গা জুড়ে ভূপৃষ্ঠ বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়া ভূপৃষ্ঠের মাঝে কোন মানুষ অবস্থান করলে তিনিও বজ্রপাতে অাক্রান্ত হয়ে পড়েন। কাজেই দেখা যাচ্ছে একজন মানুষের শরীরে সরাসরি বজ্রপাত না ঘটলেও তিনি অারো বিভিন্নভাবে বজ্রপাতে অাক্রান্ত হতে পারে।



★বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় কি?

বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের অাবহাওয়া অধিদপ্তর বেশ কিছু দিক-নির্দেশনা জারি করেছে-

১) ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোন অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু জায়গায় না থাকাই ভাল। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভাল হয় যদি কোন দালানের নীচে অাশ্রয় নিতে পারেন।

২) উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এসব জায়গায় যাবেন না বা কাছাকাছি থাকবেন না। ফাঁকা জায়গায় কোনও যাত্রী ছাউনি বা বড় গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে।

৩)বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতরে থাকুন।

৪)বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলোর সংস্পর্শে এসে অনেকে অাহত হন।

৫)বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও ধরবেন না। বজ্রপাতের অাভাষ পেলে অাগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করুন।

৬)বজ্রপাতের সময় রাস্তায় গাড়িতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করুন। যদি প্রচন্ড বজ্রপাত ও বৃষ্টির সম্মুখীন হন তবে গাড়ি কোনও গাড়িবারান্দা বা পাকা ছাউনির নীচে নিয়ে যান। এ সময় গাড়ির কাঁচে হাত দেয়া বিপজ্জনক হতে পারে।

৭)ঝড়-বৃষ্টির সময় রাস্তায় জল জমাটা অাশ্চর্য নয়। তবে বজ্রপাত অব্যাহত থাকলে সে সময় রাস্তায় বের না হওয়ায় মঙ্গল। একে তো বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে, উপরন্তু কাছাকাছি কোথাও বজ্রপাত হলে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়।

৮)বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি একান্ত বেরোতেই হয়, তবে পা ঢাকা জুতা পড়ে বের হন। রবারের গামবুট এক্ষেত্রে সব থেকে ভাল কাজ করবে।

৯)বজ্রপাতের সময় রাস্তায় চলাচলের সময় অাশেপাশে খেয়াল রাখুন। যেদিকে বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি সে দিক বর্জন করুন। কেউ অাহত হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।


বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। থাইল্যান্ড তাদের দেশে তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেকাংশে কমিয়ে এনেছে। তাই অামাদের দেশেও ১০ লাখ তালগাছ চারা লাগানো হয়েছে। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ির ছাদে বজ্র নিরাপত্তা টাওয়ার এবং হাওড় এলাকায় একতলা অাশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অাবহাওয়া দপ্তর বজ্রপাতের অাগাম সংকেত জানতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮টি "লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর" ক্রয় করেছে।

তথ্যসূত্র ও ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Wikipedia, National Weather Service, অাবহাওয়া অধিদপ্তর, প্রথম অালো, NOAA
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১০:২৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×