আমার টিনশেডের অন্ধকার ঘুটঘুটে ঘরের জানালায় কে যেন এসে টোকা দিয়ে বলল,সুমন সুমন ঘরে আছিস?
-কে বিডিআর দাদু?
-হ্যা রে।বাইরে আসবি?ভালো বিস্কুট পেয়েছি।নিয়ে যা কয়েক প্যাকেট
-আসছি দাদু
আমি আন্ধকারেই তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে যাচ্ছিলাম।কিন্তু কে যেন আমার হাতটা টেনে তার কোলে আমাকে টেনে শক্ত করে চেপে ধরলো।বুঝলাম কোলটা আপুর।আমার বুঝতে বাকি রইলো না।আপুর কোলেই মুখ গুজে হু হু করে কেদে উঠলাম।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো আপু।কিন্তু আমার চোখ যে সে শান্তনা মানতে চাইছে না।
তখন আমি অনেক ছোট।সীমান্তবর্তী এলাকায় আমার হেসে খেলে বেড়ে ওঠা।পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের সাথে রোজ বিকেলে গরুর পাল নিয়ে চরাতে যেতাম।কাটাতারের এপারে বিশাল বিলের মাঝে ছেড়ে দিতাম গরু গুলোকে।তারপর মেতে উঠতাম খেলাধুলায়।পদ্মফুল তোলা,ফাঁদ পেতে পানকৌড়ী,পাতিহাস ধরাটা ছিল নেশার মত।সেগুলো আবার বিডিয়ার ক্যাম্পে বিক্রি করে দিতাম,বিনিময়ে পেতাম টাকা অথবা খাবার দাবার।
একবার আমার ফাঁদে আটকা পড়লো একটা বড় পাতিহাঁস।সেটা ধরেই ছুট দিলাম ক্যাম্পে।সেখানে গিয়ে কিনে নেওয়ার কথা বলতেই জানালো কিনবে না।খাবার নাকি এমনিতেই অনেক জমে আছে।আমি মন খারাপ করে ফিরে আসছিলাম।হঠাত পেছন থেকে একজন ডাক দিল,এই পিচ্চি।আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি মোটা করে এক বয়স্ক দাড়িওয়ালা লোক দাঁড়িয়ে আছে,লম্বা চওড়ায় বিশাল দেহী।আমি হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে।ইনাকে আগে এই ক্যাম্পে দেখি নি।নিশ্চয়ই নতুন এসেছে এখানে।
আমার হা হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে বলল,কি দেখিস?
-আপনি এত লম্বা কেমনে হইলেন?
লোকটা হাসলো,তবে সে বিষয়ে কিছু বলল না।আমার হাতের পাতিহাঁসটার দিকে হাত ইশারা করে বলল,এটার নাম কি?
-পাতিহাঁস।কেন আপনি জানেন না?
-নাম শুনেছিলাম।তবে দেখি নি কোনদিন
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম এই লোকটার দিকে।কত লম্বা লোক রে,তবুও নাকি পাতিহাঁস দেখে নি।আর আমি কত ছোট,তবুও রোজ দিনে কম করে হলেও একটা ধরি।
-বিক্রি করবি?
-হুম একদাম দেড়শ টাকা
ভেবেছিলাম নেবে না,কিন্তু নিল।আমি টাকা নিয়ে চলে আসছিলাম।পেছন থেকে বলল,তোর নাম কিরে?সুমন,তয় সবাই সুমইন্না বলে কয়।বলেই আর দাঁড়ালাম না।দৌড়াতে দৌড়াতে সোজা বাসায় এসে টাকাটা মায়ের আচলে বেধে আবার গরুর পাল দেখতে ছুট দিলাম।
সুমইন্না সুমইন্না তোকে বিডিআর ডাকে।রাসেলের কথা শুনে একটু দূরে রাস্তার উপরে তাকালাম।দেখলাম সেদিনের ক্যাম্পের লোকটা আমাকে ডাকছে।আমি দৌড়ে গেলাম লোকটার কাছে।আমাকে দেখে হেসে বলল,সুমন এখানে কি করিস রে?
-গরুর চরাই আর খেলি
-রোজ আসিস এখানে?
-হ্যা।কিছু কইবেন?
-কেন তোর তাড়া আছে?
আমি উত্তর না দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন।কেন জানি উনার হাসিটা আমার খুব ভালো লাগলো।লাল দাড়ির সাথে সেই হাসিটায় যেন জাদু আছে,আমাকে টানলো খুব।আমি মাথা নেড়ে বললাম না নেই।তারপর তিনি আমার হাত ধরে হাটতে লাগলেন আর সীমান্তের কাঁটাতারের দিকে হাত ইশারা করে এটা ওটা বলতে লাগলেন।আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম মানুষ এত ভালো হয় কি করে!
তারপর থেকেই রোজ বিকেলে তাঁর সাথে আমার হাটাহাটি,আড্ডা চলত।উনার নাম আজগর আলী।কথায় কথায় জেনেছিলাম আমার বয়সী উনার এক নাতি আছে।তারপর থেকেই আমি তাকে দাদু বলে ডাকি,শুধু দাদু নয়,বিডিআর দাদু।আমার দেখাদেখি সবাই তাকে বিডিআর দাদু বলে ডাকা শুরু করলো।এমনকি পুরো এলাকায় উনাকে সবাই বিডিআর দাদু বলেই চিনে গেল।
বিডিআর দাদুর সাথে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যেত।তারপর গরুর পাল নিয়ে বাসায় ফিরতাম।কোন কোন রাতে দাদু আমার ঘরের জানালায় এসে ফিসফিস করে বলত,সুমন সুমন আছিস?আমি ধড়ফড় করে উঠে দাদুর কাছে দৌড়ে যেতাম।তারপর আমার হাতে এক একদিন এক জিনিস,খাবার তুলে দিত।বেশির ভাগ থাকতো বিস্কুট,চানাচুর।নেওয়ার সময় আমি অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করতাম,দাদু তুমি এগুলো পাও কোথায়?
-ব্লাকিদের ধরে
ব্লাকি কি জিনিস বুঝতাম না।তবে আমার খুব ব্লাকি হওয়ার শখ হত।ইশ এদের কাছে কত খাবার থাকে।আমিও যদি এদের মত হতে পারতাম!তাহলে কত্ত মজা হত।
আমাকে কোলে নিয়ে দাদু পেপার পড়তেন।আর আমি চুপ করে শুধু ছবিগুলো দেখতাম।একদিন এক কার্টুনের ছবি দেখে আমি হি হি করে হেসে উঠলাম।আমার হাসি দেখে দাদু বলল,হাসছিস কেন?বল দেখি এখানে কি লেখা আছে?আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,আমি তো পড়তে পারি না।দাদু বলল,কেন তুই স্কুলে যাস না?আমি মাথা নিচু করে রইলাম।
দুইদিন পর বিডিআর দাদু আমাকে নিয়ে গেলো কাছের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।আমাকে ভর্তি করিয়ে দিল,স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিল।সেই সাথে বিকেলে আমাদের আড্ডার সাথে সাথে দাদু আমাকে পড়াতে লাগলো।স্কুলে যেতে ভালো লাগত না,পড়া না পারলে স্যাররা শুধু মারতো।কিন্তু দাদু মারতো না।আদর করে কোলে নিয়ে ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দিত।আমিও শান্ত ছেলের মত সব পড়া করে দিতাম দাদুকে।
একবার আমাদের বাড়িতে ভাপা পিঠা তৈরি করা হল।আমি ক্যাম্পে গিয়ে বিডিআর দাদুকে ডাকতে গেলাম।কিন্তু দাদু আসতে চাইলো না।বলল তাদের নাকি অন্যের বাড়িতে গিয়ে এভাবে খাওয়ার নিয়ম নেই।আমি নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসলাম।বিকেলে স্কুল ব্যাগে লুকিয়ে দুইটা ভাপা পিঠা লুকিয়ে নিয়ে গেলাম দাদুর জন্য।দাদু তৃপ্তি নিয়ে খেলো সেগুলো।
ঈদ বলতে বুঝতাম দুধ চিনি দিয়ে মোটা সেমাই রান্না করে খাওয়া।কিন্তু সেবার আমার ঈদটা অন্যভাবে কাটলো।বিডিআর দাদু আমাকে একটা লাল শার্ট উপহার দিল।আমি খুশিতে দাদুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম অনেক্ষন।বাড়িতে ফিরে সবাইকে শার্টটা দেখালাম,কিন্তু পরলাম না।পরে যদি পুরনো হয়ে যায়!
এক সময় দাদুকে এক মুহূর্ত না দেখলে থাকতে পারতাম না।দাদুর জন্য মন আনচান করতো।দাদু যখন ছুটিতে বাড়ি যেত,আমি দাদুর হাত টেনে ধরতাম।বলতাম,বিডিআর দাদু তোমাকে যেতে হবে না।তুমি থেকে যাও।দাদু হেসে আমাকে কোলে নিয়ে বলত,পাগল কয়েকদিন পরই তো আসবো।আমি ফোলা ফোলা চোখে দাদুকে বিদায় জানাতাম।দাদুও কাদতো,দূরে গিয়ে হাত দিয়ে চোখ মুছা দেখে বুঝতাম।দাদু যখন ফিরতো তখন আমার জন্য খেলনা,কাপড় নিয়ে আসতো।সেসবের দিকে না তাকিয়ে আমি দৌড়ে গিয়ে দাদুর কোলে চড়ে বসতাম।
দাদুর কাছে শুনেছিলাম দাদুরা নাকি প্রায় রাতে ব্লাকিদের ধরতে যায়।আমাকে সেসব গল্প শোনাতো।আমি অবাক হয়ে শুনতাম সেসব ঘটনা।মাঝেমধ্যে আবদার জুড়ে দিতাম আমাকেও সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য।কিন্তু দাদু আমাকে নিত না।একদিন জানতে পারলাম রাতে নাকি দাদুরা ব্লাকিদের ধরতে বের হতে পারে।আমি এটা শুনে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন রাত হবে।যখন রাত হল আমি একা একা ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দাড়ালাম।দেখি দাদুরা বাইরে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে।আমাকে দেখে দাদু অবাক হয়ে বলল,সুমন তুই এখানে!
-দাদু আমিও তোমার সাথে যাব
-না তোকে নেওয়া যাবে না।তুই বাড়ি যা
-না আমি তোমার সাথে যাবই
-বাড়ি যা বললাম
-না তুমি আমাকে তোমার সাথে নাও
-বাড়ি যাবি না?
-না
দাদু আমাকে ঠাস করে একটা চড় মারলেন।তারপর আমার হাত ধরে আমাকে আমাদের বাড়িতে দিয়ে আসলেন।আসার সময় লক্ষ করলাম হাসি খুশি মানুষটা রেগে গিয়ে কেমন যেন ভয়ংকর হয়ে আছেন।আমি ভয়ে আর কিছু বলি নি।শুধু ঠোট ফুলিয়ে কাদছিলাম।
দাদুর উপর অভিমান করে দুইদিন দাদুর সামনে যাই নি।তিনদিনের দিন তিনি নিজেই আমাকে এসে নিয়ে গেলেন।তার রাইফেলটা নাড়তে দিলেন।অনেক মজার মজার গল্প শোনালেন।কিন্তু আমার অভিমান গলল না।পরে দাদু আমাকে বলল,দেখ রাতে আমাদের সাথে যাওয়া ভালো না।তাছাড়া ইচ্ছে করলেই আমি তোকে আমাদের সাথে নিতে পারবো না।
আমি ঠোট ফুলিয়ে বললাম,কেন নিলে কি হবে?সরকার আমাকে ফাঁসি দিবে।তুই কি তাই চাস?আমি সরল মনে সে কথা বিশ্বাস করে বললাম,না দাদু আমি তা চাই না।আর কোনদিন আমি তোমার সাথে রাতে যেতে চাইবো না।
সেদিন রাতেও ঘুমাচ্ছিলাম।হঠাত সুমন সুমন ডাকে লাফিয়ে উঠলাম।ভাবলাম বিডিআর দাদু এসেছে।আসারই কথা,আজকে রাতে তো দাদুদের ব্লাকিদের ধরতে যাওয়ার কথা।আমি বাইরে এসে দাদুকে খুঁজতে লাগলাম।কিন্তু পেলাম না।রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম,লোকজন ক্যাম্পের দিকে ছুটছে।আমিও ছুটলাম প্রাণপণ।ক্যাম্পের সামনে আসতেই দেখি অনেক মানুষের জটলা।আমি ভিড় ঠেলে ভিতরে যেতেই দেখি বিডিআর দাদু মাটিতে শুয়ে আছে।সারা শরীর রক্তাক্ত।বুকের মাঝখানটায় মনে হচ্ছে কেউ যেন কোন কিছু দিয়ে চিরে দিছে।আমি হাঁটুগেড়ে দাদুর হাত ধরলাম।শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম,বিডিআর দাদু উঠো উঠো।আমি এসেছি দেখো।বিশ্বাস করো,তোমার সাথে ব্লাকিদের ধরতে যেতে আসি নি।ঐ দাদু উঠো বললাম।
পাশ থেকে কে যেন বলল,তোর বিডিআর দাদু নেই রে,ব্লাকিদের হাতে মারা গেছে।আমি বিশ্বাস করলাম না।দাদুকে ঝাঁকুনি দিলাম।দাদু উঠলো না।আমি চিৎকার করে বিডিআর দাদু বিডিআর দাদু বলে ডাকতে থাকলাম।কে যেন আমাকে জাপটে ধরলো।আমি তখন দাদুর নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়ে প্রলাপ বকছি আর ভাবছি এই বুঝি দাদু উঠে বলবে,কাঁদছিস কেন রে সুমন?এই দেখ তোর দাদু তোর সামনে।স্কুলের পড়াটা রেডি করবি না?চল চল বিলের পাড়ে গিয়ে পড়তে বসি।দাদু উঠে নি।নিথর পড়ে থাকলো বিডিআর দাদুর দেহটা।পরের দিন দাদুকে সরকারী লোকেরা এসে নিয়ে যায়।
আমি আজও বিলের পাড়ে এসে বসে থাকি।কাটাতারের দিকে তাকিয়ে বিডিআর দাদুর সাথে গল্প করি।ভাবি এখনো দাদু আমাকে কোলে নিয়ে গল্প শোনায়।আদর করে দেয়।মাঝরাতে সুমন সুমন বলে ডেকে হাতে বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,এই নে এগুলো তোর জন্য।ব্লাকিদের কাছ থেকে এনেছি।
আমি এখন আর ব্লাকিদের মত হতে চাই না।কারন ওদের জন্যই আমার বিডিআর দাদু আর আমার কাছে আসে না

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


