পরিচিত নাম হাসান মাষ্টার। কলিগদের কাছে আবুল হাসান বি এস সি। শান্তিপুর গ্রামের মেটোপথ ধরে আছন্ন করা সবুজের ভেতর দিয়ে অল্প কিছুক্ষন হেটে গেলেই যে সাইনবোর্ডটি চোখে পড়ে কেউ যদি বেশ মনযোগী হয়ে খেয়াল করে তাহলে এই নামটিই খুজে পাবে। রাস্তাটা আগের থেকে বড় হওয়ায় সাইনবোর্ডটি রাস্তার মধ্যে চলে এসেছে বলে মনে হয়। সাইনবোর্ডটির বয়স নিশ্চিত সদ্য ডাক্তারী কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা যে কোন মানুষের থেকে বেশি হবে। শোনা যায় রাতের বেলা এক পাশে হেলে যাওয়া সাইনবোর্ডটিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভুত ভেবে অজ্ঞান হওয়া মানুষের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।
সাইনবোর্ডটির বাম পাশের রাস্তা দিয়ে অল্প কিছুদূর হেটে গেলে একচালা যে বাড়িটি চোখে পড়বে সেটাই আবুল হাসান বিএসসি এর বাড়ি। হেলে যাওয়া বাড়িটা যেমন একটা ঝড়োহাওয়ার অপেক্ষা করছে ঠিক তেমনী আবুল হাসান ও অপেক্ষায় আছেন অন্তিমের। একে একে তিন মেয়ের বিয়ে আর ছোট ছেলেটার চিকিৎসা হাসান মাষ্টারকে সারা জীবনের আয়ের দাড়প্রান্তে দাড় করিয়েছে। সকালে পৈতৃক জমিতে চাষাবাদ, সন্ধ্যে গ্রাম্য বাজারে হোমিওপ্যাথ ডিস্পেন্সারী আর মধ্যবর্তী সময়টা কাটে স্কুলে। ত্রিশ বছর আগে শুরু হওয়া রুটিনের সংশোধন হয়নি এক দিনের জন্যও।
আবুল হাসান নামের এই মানুষটি জগত আর জীবনের কাছে যতই তুচ্ছ হোক না কেনো শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের শেষ আশ্রয় বলা চলে। তিনিই এই স্কুলের একমাত্র বিজ্ঞানের শিক্ষক। ক্লাশ সিক্সের গনিত থেকে শুরু করে দশম শ্রেনীর জীববিজ্ঞান পর্যন্ত তাকেই পড়াতে হয়। এমনও সময় গেছে এক দিনে একটানা পদার্থ, রসায়ন, গনিত পড়াতে হয়েছে। নিউটনে মহাকর্ষ আর ডালটনের পরমানুবাদ তার পড়ানো কথা গুলোর মধ্যে তেমন একটা ভিন্নতা আনতে পারে না। অলিখিত রুটিনে অভ্যস্ত হওয়া মানুষটি যেমন শত শত শিক্ষার্থীকে f=ma এর প্রতিপাদন করা শিখিয়েছেন ঠিক তেমনি শিখিয়েছেন A=πr^2 ।
বিজ্ঞানের মাষ্টার হিসেবে এ অঞ্চলে তার সুনামও নিতান্ত কম নয়। দিনে দিনে যেমন করে সুনাম বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাড়িতে এসে বিনে পয়সায় কিংবা মাসের শেষে দুইটা লাউ দিয়ে টিউশনি পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। দ্বীনতা বেড়েছে তার সমানুপাতিক হারে। এতো গেল আবুল হাসান বিএসসির কথা। এবার যদি স্কুলের কথা বলি তাহলে কোন এককালের ছোট তিনটা ইটঘর(!) আর একটা পানি না উঠা টিউবওয়েল। অফিসের বাঁ পাশের ক্লাশ রুমটার মাঝ বরাবর বেড়া দিয়ে বিজ্ঞানের ব্যাবহারিক ল্যাব তৈরী করা হয়েছে। ল্যাবের জিনিস পত্র বলতে ধূলোয় ঘেরা চার-পাচটা কনিক্যাল ফ্ল্যাক্স সাথে নিষ্কাশিত প্রায় কয়েক প্রকার ক্যামিকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা বোতল। ভেঙে দ্বি-খন্ডিত হওয়া আট-দশটা ব্যুরেট-পিপেট আর মানব স্কেলেটালের ছিড়ে যাওয়া একটা বড় চিত্র থাকায় ছোট ল্যাবরেটরীটাকে পূর্ণ পূর্ণ মনে হচ্ছে। এই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ব্যাবহারিক বলতে যা বোঝায় তা হল ৫০ টাকা দামের চারটা ব্যাবহারিক খাতা আর কয়েকটা গ্রাফ পেপার। তবে আবুল হাসান স্যারের ঐকান্তিক ইচ্ছায় একটা কনিক্যাল ফ্ল্যাক্সে কিছু পরিমান সালফিউরিক এসিডের সাথে দ্বিগুন পরিমান পানি মিশিয়ে জিহবায় নেওয়া এই স্কুলের একটা ঐতিহাসিক পরীক্ষা। কোন ব্যাচই স্যারের এই এসিড আশির্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না!
শখের বিজ্ঞান কিংবা পিতা-মাতার উচ্চ মানষিকতার কাছে পরাজিত হয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যখন আবিষ্কার করে সালফিউরিক এসিডের কটু স্বাদ আর তাদের অধ্যয়ন করা সূত্র-সমীকরণ এর স্বাদের মধ্যে কোন পার্থক্য তাকে না তখন আস্তে আস্তে নিজের মেধার প্রতি আস্তা হারিয়ে ফেলতে থাকে। সালফিউরিক এসিড মুখে নিয়ে কলেজে উঠা শিক্ষার্থী হারিয়ে যেতে থাকে বিজ্ঞান অনীহা শিক্ষার্থীর ভিড়ে। আমরা তাদের ইচ্ছা গুলো জাগিয়ে রাখতে পারি না। আমরা দেখতে থাকি কি করে দিনের অর্ধভাগেই একটা সূর্য তার উজ্জ্বলতা হারাতে থাকে। এইটা অবশ্যই আমাদের ব্যবস্থার ব্যার্থতা।
যদিও উপরের পুরোটা দৃশ্যপট কল্পিত কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি বাংলার ৮৬ হাজার গ্রামের ৫০ হাজার গ্রামের স্কুল ও তাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এই দৃশ্যপটের বাইরে নয়। আমাদের সমস্যাটা কোথায়? ছোট বেলায় কোন শিশুকে যদি প্রশ্ন করা হয়, সে বড় হয়ে কি হতে চায়? আমি প্রায় নিশ্চিত উত্তর গুলো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাহলে দেশে এতো ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার যায় কোথায়? যদিও বর্তমানে আমাদের দেশের শহর অঞ্চলে স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু তা মোট শিক্ষার্থীর কত শতাংশ। তাছাড়া আমাদের গ্রামের স্কুল গুলোর এই খবর কি আমরা নিয়ে থাকি? আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্যি গ্রামের স্কুল গুলো আদৌ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বাড়তেছে না বরং আর কমে যাচ্ছে দিন দিন। এর থেকে ভয়ংকর কথা আর কিই বা হতে পারে?
আবুল হাসান বিএসসি এর মত হাজারো শিক্ষক আছেন যাদেরকে জীবন স্রোতে ক্লান্ত বিজ্ঞানের শিক্ষক বললে ভুল হবে না। বর্তমানে আমাদের মন্ত্রনালয় কতৃক সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর মত উদ্যোগ মহতী উদ্যোগ গ্রহন করেছে। একে সাধুবাদ জানাই। এটা হয়তো আবুল হাসানদের জীবনকে টেনে নিতে কিছুটা উপকারী হবে। কিন্তু আমাদের আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রামের স্কুল গুলোর ক্ষেত্রে। যেখান থেকে একটা শিক্ষার্থীর ভিত্তি তৈরী হয়। যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী তার ভবিষতকে দেখতে চায়।
কয়েকটা কনিক্যাল ফ্যাক্স আর ভাঙা পিপেট-ব্যুরেট কখনোই একজন শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানে প্রতি উতসাহী করতে পারে না। আমি বলছি না সবাইকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞান মনষ্ক হওয়া জরুরী। শুধু যে জরুরী তা নয় বিষয়টা অনেকটা বাধ্যতামূলকও বটে। আমরা যে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার জন্য কাজ করছি না কিংবা টাকা ব্যয় করছি না তা কিন্তু নয় হয়তো আমাদের ব্যয় করার ব্যবস্থায় সমস্যা আছে। আমাদের সেটাকে খুজে বের করা উচিত। আমাদের শিক্ষার্থী গুলোকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে সাহায্য করা উচিত। এর থেকে দুঃখের আর কি হতে পারে যখন দেখি কারো ইচ্ছাটাকে আমাদের ব্যাবস্থার কাছে বলি হতে হয়।
বিশেষ করে বিজ্ঞানটাকে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। বিজ্ঞান যে f=ma এর মুখস্ত প্রতিপাদন নয় সেটা তাদেরকে বুঝাতে হবে। বিজ্ঞানের মজার বিষয়গুলোকে তুলে ধরতে হলে শিক্ষামন্ত্রনালয় থেকে যেমন বিজ্ঞান বিষয়ক উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে ঠিক তেমনি করতে হবে স্থানীয় পর্যায় থেকে। এ জন্য দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ সহ তাদের বেতন বাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিজ্ঞান বিভাগের ব্যাবহারিক এর জন্য আলাদা পারিশ্রমিক কিংবা আলাদা শিক্ষক নিয়োগ করা যেতে পারে। সামাজিক সংগটন গুলো এগিয়ে আসতে পারে। শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞানের মজার বিষয় গুলো তুলে ধরতে পারে। এতে একি সাথে বিজ্ঞানের প্রতি তাদের উতসাহ বাড়বে সেই সাথে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন আইডিয়ার জন্ম দিতে পারবে। আর আমাদের গ্রামের স্কুল গুলোতে ব্যাবহারিকের জন্য আরো বেশি করে ম্যাটারিয়াল প্রদান করা উচিত।
আমরা ইচ্ছে করলেই উপজেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে এমন একটা সংগঠনের জন্ম দিতে পারি যা মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করবে এবং বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থী সহ শিক্ষকদের আর বেশি আগ্রহি করে তুলবে।