তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বিজ্ঞান ক্লাশ। মাথায় চুল কম কাটো রকম একজন মানুষ হাতে একটা স্বচ্ছ কনিক্যাল ফ্লাক্স নিয়ে ক্লাশে ঢুকলেন। ইনিই পরে ক্লাশ নাইনে আমাদের পদার্থ, রসায়ন, গনিত, উচ্চতর গনিত, বায়োলজি ও কৃষিশিক্ষা এর টিচার ছিলেন। মুখে স্পষ্ট বিরক্তির চাপ। যাকে এত কিছু পড়াতে হয় তার মুখে সব সময় বিরক্তির চাপ থাকাটাই স্বাভাবিক!
মনে হয় কনিক্যাল ফ্লাক্সটি খুজে পেতে কয়েক মন কাঠ-খড় পুড়াতে হয়েছে। শুধু যে কাঠ-খড় তাও নয় ইট পাঠকেলও কম সরাতে হয় নি। মানে এক যুগের ব্যবহৃত না হওয়া কনিক্যাল ফ্লাক্স তো আর এমনি এমনি ব্যবহারের উপযুক্ত হয় না। যাই হোক অনুমানের উপর এত গুলো কথা বলা ঠিক নয়। তাও আবার অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ক্লাশ। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এত বড় একটা বিষয় ঘটতে যাচ্ছে আর কারো কোন ভাবান্তর নেই। সবার ভাব দেখে মনে হচ্ছে স্যার প্রতিদিন এমন চার-পাচটা কনিক্যাল ফ্যাক্স নিয়ে ক্লাশে ঢুকেন।
এতক্ষনে ফাক্সটির দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালাম। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ফাক্সটি খালি নয়। তরল জাতীয় পদার্থ। স্বচ্ছ বলে বুঝা যাচ্ছিল না। স্যার ফাক্সটি হাতে নিয়ে আমাদের সামনে দাড়ালেন। সবাই কে অবাক করে দিয়ে বললেন এটা এসিড…! সালফিউরিক এসিড...!
আমরা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে সবাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিকে দেখছে। অনেকে আবার পাত্তাই দিলো না। তারা দুষ্টুমিতে ব্যাস্ত। তাদের কাছে এসিডের থেকে দুষ্টিমিটা বেশি প্রাধান্য পায়। আর আমরা যারা সামনে বসে দুষ্টুমি করতে পারছিলাম না তারা দেখতে থাকলাম। মনে মনে বলতে থাকলাম “এই তাইলে ঘটনা, ফ্লাক্সের ভিত্রে পানি ঢুকাইলে এসিড হয়া যায়!”
তারপর স্যার এর বর্ননা দিতে থাকলেন। আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আসলে এটা পানি না। পানি থেকে বেশি কিছু। যার একটা গন্ধ আছে, যারা মুখে নিলে টক লাগে।
স্যার এসিডের সাথে বেশি করে পানি মিশিয়ে আমাদের হাতে দিলেন। আমরা মুখে নিয়ে চেকে দেখলাম। সত্যিই টক। তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল ক্লাশ নাইনে উঠে সাইন্স নিবো। অত্যন্ত বিনে পয়সায় টক, মিষ্টি ঝাল কিছুতো খাওয়া যাবে। তাই ক্লাশ এইটে চার সাব্জেক্টে ফেল করে, বিশেষ কেসে পাশ হয়ে স্বাদের সাইন্স নিলুম।
কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম আমাদের স্কুলের সাইন্স এসিডের টক পর্যন্তই শেষ। আমার আর ঝাল-মিষ্টি খাওয়া হলো না। সালফিউরিক এসিডের স্বাদ শেষ হতে হতেই এসে পড়লো S.S.C পরীক্ষা। তারপর পাস। ভালো রেজাল্ট করলো অনেকে। কেউ কেউ আবার বোর্ড স্ট্যান্ড। জেলা পর্যায়ে ফার্স্ট। কিন্তু সবাই দৌড়ই ছিল সালফিউরিক এসিডের টক স্বাদ পর্যন্ত!!
আমরা কি এখনো পেরে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান এর ঝাল-মিষ্টির স্বাদ দিতে?? আমরা শুধু তাদের রেজাল্টই চেয়েছি।
এদেশের ১৫ লক্ষ্য S.S.C পরীক্ষার্থীর বাবা-মাই এই একটা দিনের অপেক্ষা করেন যেদিন তাদের ছেলে মেয়ের রেজাল্ট দিবে। কিন্তু আমাদের ভেবে দেখা উচিত এই রেজাল্ট কি আদৌ তাদের শেখাটাকে তুলে ধরে?? রেজাল্ট খারাপ হলে একটা ছাত্র/ছাত্রী এর কতটুকু মন খারাপ হয় তা আমি জানি। তার উপর আবার পারিবারিক চাপ। সব মিলিয়ে ঐ ছাত্র/ছাত্রীটির ভবিষত ভাবনাটাকে আমরা রোদ করে দিই।
আমরা যেনো তাদের প্রতিভাবে রেজাল্ট দিয়ে বিচার না করি...।