somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা আমূল সংস্কারের দাবীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলাচিঠি

০১ লা জুন, ২০১৭ দুপুর ১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

⊰১.পূর্বকথা⊱

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমুতুল্লাহ। যথাবিহীত সম্মানপূর্বক, আপনার কাছে প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবীতে এ চিঠিটি লিখছি। ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের দাবী সম্বলিত এই চিঠিটি আপনার কাছে লিখছি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বলে নয় বরং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলে। আজ আপনি প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে আপনার কাছে এ চিঠিটি লিখছি। এ সময় আপনি ছা্ড়া অন্য কোন দল থেকে অন্য কেউ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও এই চিঠিটি আমি তাঁর কাছে পেশ করতাম। কারণ এই চিঠিতে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যে সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে, তা যে কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারী প্রধানমন্ত্রীই বাস্তবায়ন করুন না কেন, তার সুফল দল ও মত নির্বিশেষে দেশের জনগণ সমানভাবে পাবে।

আমার চিঠির শুরুতে আপনাকে জানাতে চাই যে, আমি দুই যুগ আগে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে জাপানী ভাষা শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছি। ঠিক তখন থেকেই আমি দেশের ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করি। সে সময় এমন একটি অবস্থা ছিল যে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন দূতাবাস পরিচালিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছাড়া কোথাও কোন বিদেশী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারেও বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। সে সময়ের তুলনায় বিদেশী ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বিদেশী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বলতে যা বুঝায় তা এখনও গড়ে উঠেনি। কারণ বিদেশী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে হলে চাই একটি ভাষা শিক্ষানীতি। কিন্তু ভাষা শিক্ষানীতি থাকবে কী করে? বাংলাদেশেরতো কোন ভাষানীতিই নাই। আর ভাষানীতি নেই, কারণ ভাষানীতি প্রণয়নের জন্য যে ভাষাগত আদর্শ থাকা দরকার তার উপলব্ধি কারো মধ্যে নেই।

বর্তমানে যে বিদেশী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তার সবটুকু জুড়েই রয়েছে ইংরেজী ভাষা। এ ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজী ভাষা শিক্ষার প্রতি যেরূপ গুরুত্ব রয়েছে, মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষার প্রতি তেমন গুরত্ব নেই। আর এই ভাষা শিক্ষব্যবস্থায় বিদেশীভাষা শিক্ষা একেবারেই উপক্ষিত। ভাষানীতিহীন এই ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে দেশের নীতি নির্ধারকদের ভাষাগত আদর্শের প্রতি অনীহা ও ভাষানীতি সম্বন্ধে উপলব্ধির দীনতা থেকে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসে ভাষা অধিকার আন্দোলনে বাঙ্গালী জাতির আত্মত্যাগ, স্বাধীনতা অর্জনের পথে ভাষা অধিকার আন্দোলনের গুরুত্ব ও বাংলাভাষার মাহত্ব্য নিয়ে সবাইকে যতো উচ্চসিত মনে হয়, সে পরিমাণে কাউকে ভাষাগত আদর্শ ও ভাষানীতি নিয়ে চর্চা করতে দেখা যায় না। অথচ ভাষা আন্দোলনের মাসে বাংলাভাষা ও ইদানীং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা নিয়ে যত আয়োজন চলছে, তার সবকিছুই হল একটি ভাষানীতির প্রতি প্রতিক্রিয়ার ফসল। ১৯৪৭ সালে আগষ্ট মাসে ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে যে দু’টি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়, তার প্রত্যেকটিরই রাষ্ট্র হিসাবে স্থিতি লাভের জন্য ভাষানীতি প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল। শুধু ব্রিটিশ ভারত নয়, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত এশিয়া ও আফ্রিকার সমস্ত দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তাদের একটি করে ভাষানীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কেননা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত এশিয়া ও আফ্রিকার এ সমস্ত দেশে বহু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, যাদেরকে নিয়ে একটি ঐক্য জাতি গঠনে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধনকারী একটি এজমালী ভাষার প্রয়োজন ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পরও এই ঐক্য প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকগণ উর্দুকে এজমালী ভাষা ধরে একটি ভাষানীতি প্রণয়নের প্রয়াস পায়। যার প্রতিক্রয়া হিসাবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা অধিকার আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। যেহেতু সমগ্র বৃটিশ ভারতের সমস্ত মুসলমানদের দাবীর প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল, সেহেতু তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসক শ্রেণী সর্বভারতীয় মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বাংলাভাষা অধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে দমন পীড়ন শুরু হলে এই আন্দোলন আরও তুঙ্গে উঠে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার এই আন্দোনকে লাঠি-গুলির মাধ্যমে দমন করতে গেলে ঘটে যায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা। একক পাকিস্তান ধারণার ভিত্তিতে ভাষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে গেলে ভাষা অধিকার আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভাষার অধিকার লাভ করে। কিন্তু সেই অনাঙ্খিত ভাষানীতিটি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পর, স্বাধীন বাংলাদেশে কোন ভাষানীতি প্রণয়ন করা হয়নি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর নিজেদের জন্য যে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোন উপলব্ধি জন্মেনি। যে কারণে যে সমস্ত ভাষা যে প্রয়োজনে যেভাবে গুরুত্বের সাথে পঠন-পাঠন ও ব্যবহার করা প্রয়োজন, সেইভাবে সেই সমস্ত ভাষার পঠন-পাঠন ও ব্যবহার হচ্ছে না। আর সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় এই যে দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাংলাভাষা অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছে। বাংলাভাষা চর্চা ও উন্নয়নে যে সমস্ত নীতি নির্ধারকেরা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁরা তাঁদের নিজেদের জীবনযাপনের সর্বপর্যায়ে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না। ফলে সর্বস্তরে ইংরেজী ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হতে চলেছে। বাংলাভাষা একটি দরিদ্র ভাষায় পরিণত হতে চলেছে। বাংলা ভাষাকে এই যে উপেক্ষা এবং ইংরেজী ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার এই যে উদ্যোগ তা অভিজাত শ্রেণীর কারসাজিতে অত্যন্ত চালাকির সাথে সরকারী অর্থব্যয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে-আমি দেশে প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত করে একটি সম্ভাব্য ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরেছি, যেন আপনি এটির অনুসরণে প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে একটি গ্রহণযোগ্য ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারেন।

এই প্রেক্ষাপটে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্র ক্ষমতাধীনে শিক্ষাব্যবস্থাসহ যে কোনো ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করা হয়। এই পাঁচটি ধাপ হলো-ক)মতাদর্শগত ভিত্তি রচনা, খ)নীতি প্রণয়ন, গ)নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন, ঘ)পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা সৃজন ও ঙ)সর্বশেষে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অভীষ্ট ব্যবস্থাটির প্রবর্তন। কাজেই একটি সুষ্ঠু ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে ৫টি ধাপের প্রতিটি ধাপ পর্যায়ক্রমে অনুসরণ করতে হয়। কাজেই রাষ্ট্রের পরিচালনাধীন কোন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রাথমিক ধাপ হলো-সেই ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি মতাদর্শগত ভিত্তি রচনা করা। কোন আদর্শগত ভিত্তি ছাড়া অন্য কোন দেশের দেখাদেখি কোন ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তা সে দেশের জন্য আখেরে কুফল বয়ে আনে। আবার কোন আদর্শের অস্তিত্ব থাকলেও সে সম্পর্কে আবছা ধারণা থাকলে, সেটিকে নীতিতে রূপান্তর করা সম্ভব হয় না। আবার আদর্শিক ভিত্তির অভাব অথবা আদর্শ সম্পর্কে আবছা ধারণা এ দু’টির মধ্যে যে কারণেই হউক না কেন সুষ্ঠু নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হলে, তা অনুসরণে পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে এবং সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হয় না। আবার মতাদর্শগত ভিত্তি থেকে শুরু করে অভীষ্ট ব্যবস্থাটি প্রবর্তন পর্যন্ত সবগুলো ধাপের পারস্পরিক সম্পর্ক না বুঝে একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাইলে তা সুষ্ঠু ব্যবস্থা হিসাবে দাঁড়াতে পারে না। বাংলাদেশে যে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তা বৃটিশ আমলে প্রবর্তিত ব্যবস্থার কেবলই অনুকরণ ও প্রসারণ মাত্র। এই ব্যবস্থাটি পূর্বে এক সময় প্রচলিত হয়েছিল বলে, তা পাকিস্তান আমলে ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ আমলে আরও বিস্তৃত করে পরিচালনা করা হচ্ছে। এই ব্যবস্থাটির জন্য যে কোন আদর্শ বা নীতি প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে বা সরকারের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে কোন উপলব্ধি বা উদ্বেগ নেই।

তার মানে দেশে ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, অথচ তার কোন আদর্শগত ও নীতিগত ভিত্তি নেই। কেন দেশে আদর্শগত ও নীতিগত ভিত্তি ছাড়া ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হলো, আমি তার উত্তর খুঁজতে শুরু করি। এ প্রেক্ষাপটে একসময় আমি নিজেই বাংলাদেশের ভাষানীতি নিয়ে গবেষণার কাজে হাত দেই। গত ১০ বছর যাবত এ নিয়ে গবেষণা করে চলেছি। ভাষা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ গবেষণা কাজটি করছি নিম্নে উল্লেখিত পাঁচ শ্রেণীর ভাষাকে কেন্দ্র করে:-
১) জাতীয় ভাষা অর্থাৎ বাংলা,
২) দেশে দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হিসাবে বহুল প্রচলিত বিদেশী ভাষা অর্থাৎ ইংরেজী,
৩) পূর্বকাল থেকে দেশে প্রচলিত বিদেশী ভাষা, যেমন-আরবী, ফার্সী ও উর্দু,
৪) আধুনিককালে বিশ্বায়নের ফলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বিদেশী ভাষা, যেমন-চীনা, জাপানী, জার্মান, স্পেনীয়, রুশ ইত্যাদি, এবং
৫) দেশাভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহ, যেমন-গারো, সাঁওতাল, ত্রিপুরা ও মারমা ইত্যাদি

বর্তমানে ইংরেজী ভাষানীতি সম্পর্কে গবেষণার কাজটি অনেকটা এগিয়েছে। ইংরেজী ভাষানীতি নিয়ে গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে রচিত তিনটি প্রবন্ধ ইতোমধ্যে তিনটি একাডেমিক সম্মেলনে উপস্থাপন করেছি এবং একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ একটি একাডেমিক জার্নালে প্রকাশ করেছি। একাডেমিক সম্মেলনে উপস্থাপিত তিনটি প্রবন্ধের নাম হলো যথাক্রমে: ১) Issues as to Foreign Language Policy in Bangladesh, ২) Language Competency as an Indicator of Human Resource in the Context of Bangladesh ও ৩) Socioeconomic Consequences of the English Language Education Practices in Bangladesh । এর মধ্যে প্রথম প্রবন্ধটি ২-৪ জানুয়ারী ২০১৫ তারিখে Bangladesh English Language Teachers Association কর্তৃক ঢাকায় আয়োজিত 7th BELTA International Conference-এ উপস্থাপন করেছি। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ১৮-১৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে Bangladesh Psychological Association কর্তৃক ঢাকায় আয়োজিত International Psychological Conference 2016–এর সম্মেলনে উপস্থাপন করেছি। আর তৃতীয় প্রবন্ধটি ২৬ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ কর্তৃক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত International Conference on Natural Resource Management-এর সম্মেলনে উপস্থাপন করেছি। এবং একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধটির শিরোনাম হল-Reconsidering the Prevalent English Language Education System in Bangladesh যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত Journal of the International Mother language Institute-এর ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধটি চিঠির শেষ প্রান্তে সংযুক্ত করলাম যেন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা বিভাগের গবেষকগণ সংস্কারের পক্ষে আমার দাবীর যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে নিতে পারেন।

দীর্ঘ ১০ বছর ধরে পরিচালিত এ সমস্ত গবেষণা থেকে আমার এমন উপলব্ধি জন্মেছে যে-আমাদের দেশে যে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, তা একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা। প্রচলিত এই ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার চালু থাকার ফলে বাংলাদেশে বিদ্যালয়গামী সমস্ত জনগোষ্ঠীর ইংরেজী শিক্ষায় যে বাধ্যবাধকতা আরোপিত হয়েছে তার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। তাছাড়া প্রচলিত এই ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজী সাক্ষরতা ও সাংজ্ঞাপনিক ইংরেজী শিক্ষা অর্জন উপযোগী হলেও, একাডেমিক কাজে বৃহত্তর প্রয়োজনে যে ধরণের ইংরেজী শিক্ষা প্রয়োজন, সে ধরণের ইংরেজী দক্ষতা অর্জনের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। অর্থ্যাৎ বর্তমানে প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চশিক্ষা অর্জনে ও দাপ্তরিক কাজে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়ক নয়। কারণ প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি রয়েছে। সেজন্য প্রচলিত ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাটি সংস্কারের প্রয়োজন। বাংলাদেশে প্রচলিত ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাটি সম্পর্কে আমার এ উপলব্ধি থেকে আমি নিম্নে বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে কতকগুলি যুক্তি তুলে ধরেছি এবং প্রস্তাবিত ভাষানীতির আলোকে একটি ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরছি।

⊰২. যে সব যুক্তিতে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া প্রয়োজন⊱

হে দেশমাতৃকার কর্ণধার,
বর্তমানে বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকার ফলে বিদ্যালয়গামী সমস্ত জনগোষ্ঠীকে বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আমি আমার গবেষণায় লক্ষ্য করেছি যে, বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা প্রচলনের কোন যৌক্তিকতা নেই। বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা যে অযৌক্তিক সে বিষয়টিকে নিচে ১) ভাষাগত আদর্শ, ২) ভাষানীতি ও ৩) ভাষা পরিকল্পনা-এর নিরিখে পর্যলোচনা করে দেখালাম।

১) ভাষাগত আদর্শের নিরিখে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপের অযৌক্তিকতা
একটি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজন একটি ভাষা পরিকল্পনা যা একটি ভাষানীতির উপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। আর ভাষানীতি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে কতকগুলি ভাষাগত আদর্শকে ভিত্তি করে। যে ভাষানীতির কোন আদর্শিক ভিত্তি থাকে না, সে ভাষানীতির আলোকে কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতে কোন ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করলে, সে ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা জাতির জন্য কোন সুফল বয়ে আনে না। সেজন্য এখানে বিভিন্ন ভাষাগত আদর্শের আলোকে বাংলেদেশের ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করা হল, যেন বর্তমানে প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার অযৌক্তিকতা পরিস্ফূট হয়। এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ্য যে-ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে মোট ৪টি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ রয়েছে। এগুলো হলো- আত্তীকরণ, ভাষিক বহুত্ববাদ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন। যে কোন রাষ্ট্রের ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যে ভাষানীতি প্রয়োজন তা এ ৪টি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শের কোন না কোনটির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের একটি ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। এটি বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত। কাজেই বর্তমানে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাটি কেবলই বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারিত রূপ। এটি কোন ভাষানীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কাজেই ভাষাগত আদর্শের পর্যায়ে এটি কোন সময়ই আলাচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। ভাষাগত আদর্শবিহীন এই বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতাকে বুঝতে হলে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা অন্য যেসব দেশে চালু রয়েছে সেইসব দেশের ইংরেজী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তির আলোকে বিবেচনা করতে হবে। একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে-বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার সাথে মিল রয়েছে বৃটিশ শাসিত সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার। এশিয়া ও আফ্রিকার এ সমস্ত দেশের মধ্যে রয়েছে-পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও উগাণ্ডা ইত্যাদি যেগুলোতে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ সমস্ত রাষ্ট্রের ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একক কোন সংজ্ঞাপনের ভাষা না থাকায় চরম ভাষাগত বিশৃঙ্খলা বিরাজিত রয়েছে, যার ফলে এ সমস্ত দেশে রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার পথে। কাজেই এ সমস্ত সাবেক বৃটিশ উপনিবেশ বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষার স্বার্থে ব্যক্তিগত, দাপ্তরিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে ইংরেজী প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। শিক্ষাব্যবস্থায়ও বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষা চালু করে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে দেশাভ্যন্তরীণ উপজাতীয় ভাষার পরিবর্তে ইংরেজীকে প্রাধান্য দেয়। ফলে এসমস্ত দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইংরেজী চালু হয়েছে এবং ভাষাগত বিভিন্নতার কারণে যে বিভেদ রয়েছে তা সাময়িকভাবে তিরোহিত হয়েছে। কিন্তু এ সমস্ত দেশ কার্যত: ইংরেজী ভাষাগত উপনিবেশের নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বহুভাষাভাষী জনগোষ্ঠীসম্পন্ন এ সমস্ত সাবেক বৃটিশ ঔপনিবেশিক দেশসমূহে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন করা হয়েছে একটি ভাষানীতির উপর যার সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শিক ভিত্তি হলো-আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন। আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন এমন একটি ইংরেজী ভাষানীতিকে সমর্থন করে যা ইংরেজী ভাষাকে সর্বস্তরে চালুর ব্যাপারে যৌক্তিক ভিত্তি তৈরী করে। আত্তীকরণ হল এমন একটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ যা বহু ভাষাভাষী একটি জনগোষ্ঠীর দেশে সবাইকে ইংরেজী ভাষাকে গ্রহণে বাধ্যতা আরোপ করে, যেন দেশের প্রতিটি মানুষ একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হয়। আর দেশীয়করণ হল এমন একটি ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ, যা ইংরেজী ভাষাকে দেশীয় ভাষা হিসাবে আপন করে নেওয়ার নীতিকে সমর্থন করে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকায়ন এমন একটি ইংরেজী ভাষানীতিকে সমর্থন করে, যা ইংরেজী ভাষাকে দাপ্তরিক কাজে চালুর নীতিকে সমর্থন করে। এভাবে আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন-এ ৩টি সমাজ- ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ মিলে পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও উগাণ্ডা প্রভৃতি দেশে সেদেশের নিজস্ব ভাষার পরিবর্তে ইংরেজী ভাষাকে আপন করে গ্রহণের ভাষানীতির ভিত্তি তৈরী করে। কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও ভারত ও সিঙ্গাপুরে যে ইংরজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে, তা মূলত: প্রচ্ছন্নভাবে আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন-এ ৩টি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শপুষ্ট ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা।

আমরা উপরের আলোচনায় লক্ষ্য করেছি যে, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের জন্য যে ভাষাগত ঐক্য প্রয়োজন তার আদর্শিক ভিত্তি হল আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন নামক ৩টি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ। পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, উগাণ্ডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর প্রভৃতি সাবেক বৃটিশ ঔপনিবেশিক দেশ ঐক্যবদ্ধ জাতি নির্মাণের উদ্দশ্যে আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন নামক ৩টি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শের সমর্থনে প্রণীত ভাষানীতির ভিত্তিতে ইংরেজী ভাষাকে সর্বস্তরে চালুর প্রচেষ্টা হিসাবে বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষা চালু করে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার শতশত বছর পূর্বে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রক্রিয়ার অনুসরণে একটি একক ভাষা ভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে সুগঠিত হয়েছে। এই ভাষাগত ঐক্য সাধিত হয়েছে যখন বাংলা অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাভাষী অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী সংস্কৃতের অপভ্রংশকে নিজেদের ভাষা বলে গ্রহণ করে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে আত্তীকৃত হয় এবং সংস্কৃতের অপভ্রংশের দেশীয়করণ ঘটে। এ ভাষাটি ততোদিনে নাম ধারণ করে বাংলা। এ ভাষাটির আন্তর্জাতিকয়ান ঘটে যখন বাংলার নবজাগরণের যুগে পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় এটির কাঠামো ও অবয়ব সংস্কৃতের উপাদান দ্বারা আরও পরিপুষ্ট হয়। কাজেই যেখানে পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, উগাণ্ডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ ঔপনিবেশক শক্তি থেকে মুক্তিলাভের পর ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের জন্য ইংরেজীকে ধার করেছে, সেখানে বাংলাদেশ বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্বকাল থেকেই একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় রয়েছে। যেকারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী ইংরেজী ভাষার অভাবে জাতীয় অনৈক্যের আশঙ্কায় নাই। একই কারণে আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন নামক ৩টি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ বাংলাদেশে ইংরেজী ভাষাকে সর্বস্তরে চালুর ভাষানীতিকে সমর্থন করে না। এই একই কারণে বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর কোন যৌক্তিকতা উপস্থাপন করে না।

২) ভাষানীতির নিরিখে ইংরেজীভাষা শিক্ষা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপের অযৌক্তিকতা
ভাষানীতির নিরিখে বর্তমানে প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ বর্ণনা করতে গেলে প্রথমেই একটি বিষয় অবতারণা করা প্রয়োজন যে-বাংলাদেশে যারা ভাষাশিক্ষা নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা করেন তাঁদের প্রায় সবাই ভাষানীতি ও ভাষাপরিকল্পনার মধ্যে পার্থক্য করেন না বা একটির সাথে অন্যটি গুলিয়ে ফেলেন। সেজন্য শুরুতে স্পষ্ট করছি-ভাষানীতি বলতে কী বুঝায়। আসলে ভাষানীতি হলো কতকগুলো কার্যপ্রণালী যার সাহায্যে কোন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে তিনটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই তিনটি বিষয় হলো-১) জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে (বা ভাষাসমূহকে) অন্যান্য অপেক্ষাকৃত অগুরুত্বপূর্ণ দেশীয়, উপজাতীয় ও বিদেশী ভাষার চেয়ে অধিক মর্যাদা আরোপ ও কার্যকারিতা প্রদান, ২) সেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ করে পরিপুষ্টি সাধন এবং ৩) সেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রশাসনের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচলন। কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের কোন ভাষানীতি নেই। ভাষানীতি যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য একটি প্রয়োজনীয় নীতি সে সম্পর্কে দেশের বুদ্ধিজীবি ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোন ধারণা নেই। অথচ জাতীয় উন্নয়নে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় নীতির চেয়ে ভাষানীতি কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতি, যেমন-অর্থনীতি, শিল্পনীতি ও শিক্ষানীতি ইত্যাদি বাস্তবায়নের কারণে যেমন যথাক্রমে দেশের অর্থনীতি, শিল্প-কারখানা ও শিক্ষার উন্নয়ন ঘটে, তেমনিভাবে ভাষানীতি বাস্তবায়নের ফলে সে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংশ্রয়ে শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটে। কাজেই কোন একটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থা নীতি দ্বারা পরিচালিত হলে যেমন সে সংশ্রয়ের উন্নয়ন ঘটে, তেমনি যদি রাষ্ট্রে কোন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে অথচ তার পরিচালনার জন্য যদি কোন নীতি না থাকে তবে সে ব্যবস্থাটি আখেরে সুফল বয়ে আনে না। ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা তেমন একটি ব্যবস্থা যা কোন নীতি দ্বারা পরিচালিত নয়। ফলে বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ভাষাগত কর্মকৌশল প্রণয়ন করে চলছে। যেমন-বিচরালয়, ব্যংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মত ভাষাগত কর্মকৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যথেচ্ছ ইংরেজী ব্যবহারের ফলে বাংলার বদলে ইংরেজী সর্বস্তরে চালু হতে চলেছে। যত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান তত বেশী বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকার কথা থাকলেও, বাস্তবে সে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে ইংরেজী ভাষার ব্যবহার হচ্ছে বেশী। এ অবস্থা কয়েক দশক ধরে চলতে থাকলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন সংশ্রয়ে শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। ফলে একসময় হয়তো ভারত ও পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশেও ইংরেজী ভাষাগত কারণে সমাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি হবে।

কাজেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার কারণে উদ্ভূত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংশ্রয়ে সম্ভাব্য যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, তা থেকে নিষ্কৃতির জন্য একটি ভাষানীতি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের সে ধরণের কোন ভাষানীতি নাই। এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ভাষানীতি প্রণয়ন একটি জ্ঞানীয় কার্যক্রম। তা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন ভাষাগত আদর্শ। অর্থ্যাৎ আদর্শ ছাড়া শুধুমাত্র যুক্তিতর্ক দিয়ে একটি ইংরেজী ভাষানীতি প্রণয়ন সম্ভব নয়। পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে দেখানো হয়েছে চারটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ (যথা-আত্তীকরণ, ভাষিক বহুত্ববাদ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন)ভাষানীতি প্রণয়নের ভিত হিসাবে কাজ করে। সেখানে দেখানো হয়েছে যে-আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন-এ তিনটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ বহু ভাষাভাষী বিভিন্ন দেশে (যেমন-পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, উগাণ্ডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর) ইংরেজী ভাষানীতি সৃজনের ভিত্তি তৈরীতে সহয়তা করে। কিন্তু এগুলো বাংলাদেশের ইংরেজী ভাষানীতি সৃজনের ভিত্তি তৈরী করে না; বরং এগুলি বাংলা ভাষা সহায়ক ভাষানীতি সৃজনের ভিত্তি তৈরী করে। সেজন্য বাংলাদেশে ইংরেজী ভাষানীতি সৃজনের জন্য অন্য কোন ভাষাগত আদর্শের অনুসন্ধান প্রয়োজন। আর সে ভাষাগত আদর্শ হল-বিশ্বায়ন।

বিশ্বায়ন হল-বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত একটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া যার উপযোগিতায় অংশগ্রহণকৃত বিশ্বের দেশ বা অঞ্চলসমূহ তাদের নিজ নিজ জ্ঞান, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, দ্রব্য, পণ্য ও পুঁজি ইত্যাদি বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর লাভবান হতে পারে এবং সার্বিকভাবে বিশ্বজগৎ লাভবান হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়ন কেবলই বুলিসর্বস্ব আদর্শে পরিণত হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারী অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ বা অঞ্চলসমূহ লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ একচেটিয়াভাবে এ প্রক্রিয়া থেকে লাভবান হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যেম অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ অনবরত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বীকার হচ্ছে। যে কারণে বিশ্বায়ন বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ-বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-এর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। সেজন্য বিশ্বায়ন আদর্শের ভিত্তিতে একটি ইংরেজী ভাষানীতি এমনভাবে সৃষ্টি করা

প্রয়োজন যেন এগুলো বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এর সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।
কাজেই বিশ্বায়নের অনাঙ্খিত কুফল থেকে রক্ষা পেতে হলে এবং এ থেকে সুফল লাভ করতে হলে-বিশ্বায়নের মূলবাণীকে আমলে নিয়ে তার আলোকে রাষ্ট্রীয় ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এভাবে বিশ্বায়নের আলোকে প্রণীত একটি ভাষানীতির আলোকে একটি বিদেশী ভাষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে-দেশের ভাষা পরিস্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগপোযোগী করা সম্ভব হবে। তবে এ বিষয়ে এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিশ্বায়ন একক ইংরেজী ভাষানীতিকে সমর্থন করে না। এটি বরং একটি বিদেশবিদ্যা চর্চা সহায়ক ভাষানীতিকে সমর্থন করে। এ হিসাবে বিশ্বায়ন আদর্শ বিদেশবিদ্যা বিষয়ক অধ্যয়ন এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিদেশী ভাষা শিক্ষানীতিকে সমর্থন করে। কাজেই বিশ্বায়নকে আদর্শ হিসাবে নিয়ে ভাষানীতি প্রণয়ন করতে হলে বাংলাদেশের সাথে যে সমস্ত দেশ বা অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে যোগাযোগ রয়েছে বা যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে সে সমস্ত দেশ ও অঞ্চল বিষয়ক বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ভাষাশিক্ষা সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে। সে হিসাবে বিশ্বায়ন ইংরেজী ভাষাভাষী দেশ ও সাবেক ইংরেজ ঔপনিবেশিক দেশ বিষয়ক আঞ্চলিক অধ্যয়ন (অর্থ্যাৎ ইংরেজী আঞ্চলিক অধ্যয়ন) ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে। কাজেই বিশ্বায়ন ইংরেজী ভাষাভাষী দেশ ও সাবেক ইংরেজ ঔপনিবেশিক দেশ বিষয়ক আঞ্চলিক অধ্যয়নের ব্যবস্থাবিহীন বর্তমান ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। এ আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক কোন আদর্শ বর্তমান বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। যদিওবা বিশ্বায়ন আদর্শটি একটি ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে, এটি একটি ঐচ্ছিক বিদেশী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে। সে অর্থে এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন একক বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না।

৩) ভাষা পরিকল্পনার নিরিখে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপের অযৌক্তিকতা
বাংলাদেশে প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা পরিকল্পিত নয়। অপরিকল্পিত এই ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে একটি ভাষানীতির অভাবে। আমরা পূববর্তী আলোচনায় দেখতে পেয়েছি যে আত্তীকরণ বা দেশীয়করণ নয় বরং বিশ্বায়ন নামক আদর্শটি বাংলাদেশে ইংরেজী ভাষানীতি প্রণয়নের ভিত্তি প্রদান করে। কিন্তু এ ভাষানীতিটি বাস্তবায়ন করতে হলে একটি ভাষা পরিকল্পনা প্রয়োজন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে একটি ভাষানীতি বাস্তবায়নের জন্য ৬টি বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো-১) শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা ও ২)অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কাজেই এ পর্যায়ে শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নিরিখে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপের যৌক্তিকতা রয়েছে কি-না তা পর্যলোচনা করা হবে।

১)শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা: কোন বিষয়ে শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা হলো-সে বিষয়-এ শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে (যেমন-প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ ইত্যাদি) পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও মূল্যায়ন কৌশল ইত্যাদি নির্ধারণের একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিশেষ। কাজেই ইংরেজী ভাষার শিক্ষাক্রম পরিকল্পনার জন্য প্রথমেই জানা প্রয়োজন যে ইংরেজী ভাষা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী। বাংলাদেশে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাকে বুনিয়াদী শিক্ষার অংশ হিসাবে নিয়ে শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। সেজন্য বর্তমানে ইংরেজী বিষয়কে মাতৃভাষা বাংলা, অংক, সাধারণ বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদির মতো বুনিয়াদি শিক্ষার বিষয়ের সাথে সমান পর্যায়ের বিষয় ধরে দেশের সব শিক্ষার্থীর জন্য ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজী ভাষা শিক্ষা বুনিয়াদী শিক্ষার অংশ নয়। সেজন্য এই শিক্ষার জন্য প্রয়োজন বুনিয়াদি শিক্ষার চেয়ে ভিন্নতর শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা। আমরা জানি যে বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এ সব ক্ষেত্রের মধ্যে কতকগুলি ক্ষেত্র (যেমন- বিভিন্ন বেসরাকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বিচরালয় ইত্যাদি) কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
গবেষাণায় দেখা গেছে যে-বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র তাদের ইংরেজী জানা প্রয়োজন ক)যারা ইংরেজী ভাষাভাষী দেশের কর্মক্ষেত্রে চাকুরীতে নিয়োজিত, খ)যারা দেশে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী অফিসের ইংরেজী মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রয়োজনে দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত, গ)যারা উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা-গবেষণা কর্ম পরিচালনার কাজে নিয়োজিত, ঘ)যারা শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ইংরেজী পাঠদানে নিয়োজিত এবং ঙ)যারা ইংরেজী মাধ্যমে বিভিন্ন একাডেমিক বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত। সেজন্য এই ছয় ধরণের কর্মে ভবিষ্যতে নিয়োজিত হতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরই শুধু ইংরেজী ভাষা শিক্ষা গ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের অধিবাসীদের সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে যে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় তা তাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে না। তাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যাদের জীবৎকালে কখনও ইংরেজী ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। আবার ইংরেজী প্রয়োজন হয় এমন যে সমস্ত কর্মক্ষেত্র রয়েছে সেখানে কাজকর্ম পরিচালনা করতে ইংরেজীতে যে উচ্চতর দক্ষতার প্রয়োজন তা অনেকের নাই অথবা অনেকের পক্ষে সে দক্ষতা অর্জন করা সম্ভবও নয়। কেননা কোন ভাষায় দক্ষতা অর্জন বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি ও জন্মগত প্রবণতার সাথে সম্পর্কিত। সে কারণে প্রত্যেক সমাজের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে ইংরেজীই হউক, বাংলাই হোক বা অন্য যে কোন ভাষায়ই হোক তাদের পক্ষে সে ভাষায় উচ্চতর দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটিশ যুক্তরাজ্য বা কানাডা ইত্যাদি দেশের অধিবাসীদের মাতৃভাষা ইংরেজী হওয়া সত্ত্বেও, তাদের মধ্যে দৈনন্দিন কাজের উপযোগী ইংরেজীতে অনর্গলতা জন্মালেও, একাডমিক বা দাপ্তরিক কাজের জন্য ইংরেজীতে যে দক্ষতার প্রয়োজন, সে পরিমাণ দক্ষতা সে দেশের অধিকাংশ লোকের মধ্যে জন্মায় না। একই কারণে বাংলাদেশের অধিবাসীদের সবাইকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা গ্রহণে বাধ্যতা আরোপ করা হলেও, অধিকাংশ অধিবাসীর ক্ষেত্রে একাডমিক বা দাপ্তরিক কাজের উপযোগী দক্ষতা ইংরেজীতে জন্মায় না। সেজন্য বাংলাদেশের এমন একটি ইংরেজী ভাষা শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা প্রয়োজন, যেখানে বিদ্যালয়ে সবাইকে ইংরেজী ভাষা শিখার সুযোগ দেয়া হবে, কিন্তু শুধুমাত্র তারাই ইংরেজী ভাষা শেখার সুযোগ পাবে যাদের উচ্চতর ইংরেজী দক্ষতা অর্জনের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতা, যেমন-বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি ও জন্মগত প্রবণতা ইত্যাদি রয়েছে। সে হিসাবে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাক্রমটি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যেন-সকল বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীই ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ পায়, কিন্তু ইংরেজী শিক্ষা অর্জনের প্রবণতা নাই এমন শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বাদ পড়ে। এ আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভাষা শিক্ষাক্রম পরিকল্পনার নিরিখে বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা যৌক্তিক নয়।

২)অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: বর্তমানে ইংরেজী শিক্ষা বাধ্যতামূলক বলে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে এই শিক্ষা চালু রাখা হয়েছে। এই বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা চালু রাখতে যতো অর্থই প্রয়োজন হউক না কেন তা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু উপরের অনুচ্ছেদের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে-বাংলাদেশে ৬টি ক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষার উপযোগিতা রয়েছে। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশের জনগণ সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করতে হলেও, কেবল যারা এই ৬টি ক্ষেত্রে নিয়োজিত থেকে কর্মরত আছেন তারাই শুধু ইংরেজী শিক্ষাব্যয়ের বিপরীতে সুফলতা ফেরৎ আনতে সক্ষম হন। জাতীয় অর্থনীতিতে ইংরেজী ভাষা শিক্ষার অর্থনৈতিক সুফলতা যোগ করতে পারেন। আর অন্য যারা ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেন তাদের ইংরেজী কোন কাজে লাগে না বলে-তাদের পিছনে ব্যয়িত ইংরেজী শিক্ষাব্যয়ের বিপরীতে কোন আর্থিক সুফলতা আসে না। যারা ইংরেজী কোন উৎপাদনশীল কর্মে প্রয়োগ করতে পারে না, তাদের সংখ্যা অসংখ্য। কাজেই এতোসব আয়োজনে লব্ধ ইংরেজী শিক্ষার অধিকাংশই যা কোন অর্থনৈতিক সুফল আনে না। কাজেই ইংরেজী শিক্ষায় অর্থব্যয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপব্যয়ের সামিল। এভাবে ইংরেজী শিক্ষায় ব্যয়িত অর্থের বিপরিতে প্রাপ্ত লাভালাভের কথা চিন্তা করলে, এই শিক্ষা চালু করা উচিত এর চাহিদা অনুসারে। অর্থ্যাৎ ইংরেজী শিক্ষার উপযোগিতা অনুসারে ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা উচিত। সেজন্য ইংরেজী শিক্ষায় প্রযোজিত ব্যয় নির্ধারণের জন্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ্য যে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ চার ধরণের: ক)ব্যয় বিশ্লেষণ, খ)রাজস্ব প্রভাব বিশ্লেষণ, গ) ব্যয়সাশ্রয়তা বিশ্লেষণ ও ঘ) ব্যয়-সুফলতা বিশ্লেষণ। এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণগুলি যা পরিমাপ করে থাকে তা হলো যথাক্রমে-ক) ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত ব্যয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব, খ) প্রস্তাবিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষানীতির ফলে রাজস্ব, ব্যয় ও সঞ্চয়-এ এর প্রভাব, গ) বাজেটে প্রস্তাবিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষানীতির প্রভাব, এবং ঘ) প্রস্তাবিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রকৃত আর্থিক সুফলতার চে্য়ে ব্যয়ের আধিক্য। কিন্তু বর্তমানে প্রথম তিন প্রকার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা ব্যয়ের কথা পর্যালোচনা করা হলেও, ৪র্থ প্রকার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অর্থ্যাৎ ইংরেজী শিক্ষায় ব্যয়িত অর্থ থেকে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক সুফলতা পাওয়া যাচ্ছে সে বিষয়টিকে বরাবরই উপেক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যয়ের আধিক্য অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর-এ বিষয়টি বিবেচনা নেয়া হলে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য হবে না।
কাজেই উপরে ২টি পর্যায়ক্রমিক অনুচ্ছেদের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পেলাম যে-শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নিরিখে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা সমর্থনযোগ্য নয়।

⊰৩.দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইংরেজী শিক্ষার নেতিবাচক প্রভাব⊱

হে মহান সত্যাদর্শী,
উপরের পর্যালোচনা থেকে আপনি লক্ষ্য করেছেন যে- প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে একটি বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছে। এই শিক্ষায় প্রাথমিক শিক্ষার স্তরগুলিতে ইংরেজী শিক্ষার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে এবং শিক্ষার পরস্পর উপরের স্তরগুলিতে প্রয়োজনীয় ইংরেজী দক্ষতার বিষয়টিকে খুব কৌশলে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের শিক্ষক হিসাবে চাকুরীতে যোগদানে প্রয়োজনীয় ইংরেজী দক্ষতার বিষয়টিকে কৌশলে ছাড় দেওয়া হয়েছে। অর্থ্যাৎ ইংরেজী বিষয়ে শিক্ষক ও ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয়ের শিক্ষকদের শিক্ষাদানে প্রয়োজনীয় ইংরেজী দক্ষতা রয়েছে কি-না সে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা যে একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা সে সম্পর্কে গবেষকগণ ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন। এই ত্রুটিপূর্ণ ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তোরত্তর ক্ষতি সাধন করছে। এই ক্ষতিগুলি নিম্নরূপ:

১) বিভিন্ন ধারণা প্রকাশে বাংলাভাষার দৈনতার সৃজন: বাংলাভাষায় ঋণ ও অনুবাদের মাধ্যমে ইংরেজী ভাষা থেকে বহু ভাষাসংশ্লিষ্ট উপাদান বাংলা ভাষায় প্রবেশ করছে। অনেক বাংলা শব্দ বা উপাদান কৃতঋণ ইংরেজী শব্দ বা উপাদান দ্বারা প্রতিস্থাপতি হচ্ছে। এভাবে ইংরেজী থেকে অনবরত শব্দ ও ভাষা উপাদান ধার করার ফলে বাংলা ভাষা বিদ্যার বিভিন্ন ধারার জ্ঞান ধারণ ও প্রকাশের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ফলশ্রুতিতে বাংলা বাংলাভাষা উত্তোরত্তর জ্ঞান ধারণের অনুপযোগী ভাষায় পরিণত হতে চলেছে। এই যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাকে ইংরজী ভাষা কর্তৃক বাংলা ভাষাকে দখল হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এবং ইংরেজী কর্তৃক এই দখল প্রক্রিয়া ভয়াবহরূপে এক জ্ঞানের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় ছড়িয়ে পড়ছে।

২) দেশের ভাষাগত ভূদৃশ্যের পরিবর্তন: বাংলাদেশে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার কুফল দেশের ভাষাগত ভূদৃশ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। চাক্ষুষ ভূদৃশ্যগত চিত্র সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন পণ্যের মোড়কেও এই ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার কুফল দৃশ্যমান হচ্ছে। দেশে এমন কতকগুলি শহর রয়েছে যেখানে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড খুব কমই দৃশ্যমান হয়। দেশে বাংলাদেশীদের মালিকানায় এমনও প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলি আদৌ কোন দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন কি-না তা সন্দেহের উদ্রেক করে। এই ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার কুফল চাক্ষুষ ভূদৃশ্যের মতোই শ্রাবণিক ভূদৃশ্যেও অনুরূপভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ ধরণের শ্রাবণিক বিশৃঙ্খলা দেশের সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলার সাথে ইংরজীর মিশ্রণ অথবা বাংলার স্থলে ইংরেজীর ব্যবহার খু্বই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তব জীবন থেকে শুরু করে রেডিও-টিভিতেও ইংরেজীর প্রভাবে সৃষ্ট এই শ্রাবণিক বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশে এমনও প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন রয়েছে যেখানে অহেতুক ইংরেজীর ব্যবহার চলে। এভাবে ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘিরে ফেলছে।

৩) ইংরেজী নির্ভর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সৃজন: বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিফলিত হচ্ছে। এবং দেশের বাংলা মাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলি ক্রমান্বয়ে ইংরেজী নির্ভর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলি এমনভাবে ইংরেজী মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে যে সেগুলির চাক্ষুষ ও শ্রাবণিক অবয়ব দেখলে বিদেশি কোন শহরে অবস্থান করছি বলে ভ্রম হতে পারে।

৪) ইংরেজী উপসংস্কৃতির সৃজন: বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের চিন্তাচেতনাকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে যে, ইংরেজী শিক্ষিতজনেরা ইংরেজ শাসিত বিশ্ব থেকে ইংরেজী সংস্কৃতি ধার করে বাঙ্গালী সংস্কৃতির ভিতরে ইংরেজী সংস্কৃতি সৃজন ও সমৃদ্ধকরণে তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা যে সংস্কৃতির সৃজনে ব্যপৃত তা দেশজ বাঙ্গালী সংস্কৃতির চেয়ে ভিন্নতর। দেশাভ্যন্তরে এই বিজাতীয় ইংরেজী উপসংস্কৃতি সৃষ্টি প্রক্রিয়া অহর্নিশ চলছে ইংরেজী মাধ্যম বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষিতজনদের দ্বারা। উপসংস্কৃতির এই সৃজন প্রক্রিয়া থেকে এটা এখন স্পষ্ট যে, দেশে একটি বিজাতীয় উপসংসস্কৃতির সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের দেশীয় লোকদের দ্বারা জাতীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে।

৫) ইংরেজী ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদের প্রতি বাংলাদেশের তাবেদারী: প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে ইংরেজী ভাষাগত সামাজ্যবাদের প্রতি নতজানু হওয়ার ক্ষেত্র তৈরী করছে। যদিও ইংরেজী একসময় ইংল্যাণ্ডের ভাষা ছিলো, বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যাণ্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশের ভাষায় পরিণত হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে ইউরোপীয়রা গত কয়েক শতাব্দী ধরে এ সমস্ত দেশ দখল করে নিয়ে ইংরেজী ভাষা চালু করে। ইংরেজী ভাষাভাষী এ সমস্ত দেশ ঔপনিবেশিক বিস্তৃতির যুগ থেকে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছে। এ সমস্ত শক্তিধর ইংরেজী ভাষাভাষীদের দেশ নানা কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চলেছে। এ সমস্ত কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: ক) এ সমস্ত দেশের রয়েছে অবাক করা বৃহৎ অর্থনীতি, খ) এ সমস্ত দেশ বিশ্বের তাবৎ জ্ঞান তাদের ভাষা ইংরেজীতে সঞ্চিত করেছে, গ) এ সমস্ত দেশ বিশ্বের অর্থনীতির নিয়ন্তা হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে, ঘ) তাদের রয়েছে অন্তর্জালের মাধ্যেম পরস্পর সংজ্ঞাপনের জন্য এজমালী ইংরেজী ভাষা, ঙ) এ সমস্ত দেশের সবগুলি মিলে উচ্চশিক্ষা অর্জনের বিকল্প গন্তব্যস্থান হিসাবে অভির্ভূত হয়েছে। এই সমস্ত কারণে ইংরেজী ভাষাভাষী দেশগুলি এমন একটি অবস্থানে পৌঁচেছে যে বাংলাদেশের অধিবাসীরা বিশ্বায়নের সুফল পেতে গিয়ে কার্যত এ সমস্ত দেশের তাবেদার হয়ে পড়েছে যা ইংরেজী ভাষাভাষীদের দেশ কর্তৃক বাংলাদেশের উপর প্রভূত্ব বিস্তারে সহায়ক হচ্ছে।

৬) সামাজিক বৈষম্য সৃজন: ইংরেজী শিক্ষা ক্ষমতা, মর্যাদা ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্য্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি সামাজিক গতিশীলতার এক নিয়ামক হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে, যার ফলে মানুষ এটিকে নিম্ন সামাজিক স্তর থেকে উপরের স্তরে উলম্ফনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এটি অর্জনের পথে বাধা হিসাবে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে এই অপরিকল্পিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের সমাজকে এমনভাবে রূপান্তর করছে যে এটিকে ইংরেজীসৃষ্ট বৈষম্যপূর্ণ সমাজ বলে বৈশিষ্টায়িত করা যেতে পারে।

⊰৪.ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় যা কিছু সংস্কার করা প্রয়োজন⊱

হে মহান সংস্কারক,
উপর্যুপরি আলোচনা থেকে আপনি লক্ষ্য করেছেন যে, আদর্শ, নীতি ও পরিকল্পনা ইত্যাদির নিরিখে ইংরেজী শিক্ষায় বাধ্যবাধকতা আরোপের কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। যে কারণে প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য নানা ক্ষতি বয়ে আনছে। যারা ইংরেজী ভাষা শিক্ষাদানের কাজে জড়িত রয়েছেন তাঁরাও স্বীকার করেন যে-বর্তমান ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু তাঁরা বাধ্যতামূলক এই ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষে কথা বলেন। তাঁরা এ সমস্ত ত্রুটি শিক্ষা পরিকল্পনা পর্যায়ে, যেমন-পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ও শিক্ষাদান পদ্ধতির সংস্কারের মাধ্যমে সারানোর পক্ষে ওকালতি করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা আদর্শ ও নীতি পর্যায়ে এ ত্রুটিগুলো নিয়ে ভাবেন না। যে কারণে তাঁরা ভাষাগত আদর্শ ও ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করেন না। অথচ ভাষাগত আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত ভাষানীতির আলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে-পুরা ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাটিই ত্রুটিপূর্ণ। আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় লক্ষ্য করেছি যে বিশ্বায়ন আদর্শ হিসাবে বাংলাদেশে একটি ইংরেজী ভাষানীতির ভিত্তি প্রদান করে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়ন আদর্শপুষ্ট ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু নাই। বিশ্বায়ন আদর্শপুষ্ট ইংরেজী ভাষা শিক্ষানীতির ভিত্তিতে একটি ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হলে, সেই ভাষা শিক্ষানীতিটি এমনভাবে পরিকল্পনায় পরিণত করতে হবে যেন দেশে ইংরেজী আঞ্চলিক অধ্যয়নের পথ প্রশস্ত হয় এবং ইংরেজী শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন সহায়ক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। আমার গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, বিশ্বায়নের ভিত্তিতে প্রণীত ভাষানীতিকে বাস্তবায়ন করতে হলে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন হবে। ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় এই সংস্কারের ফলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষালয়, শিক্ষালয়ে ইংরেজী শিক্ষার স্তরবিন্যাস, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা প্রশাসন ইত্যাদি সবকিছুতই ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হবে। এর ফলশ্রুতিতে দেশে একটি যুগপোযোগী টেকসই ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম হবে। কাজেই ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা এখন সময়ের দাবী। সেজন্য নিচের কয়েকটি ধারায় ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি:

১) কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট বর্তমান ইংরেজী ভাষাপরিস্থিতির সংষ্কারের অনুরোধ
একটি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা তার ভাষা পরিস্থতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা যেমন একটি দেশের ভাষাপরিস্থিতিকে গড়ে তুলে, তেমনিভাবে একটি দেশের ভাষা পরিস্থিতি সে দেশের ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা স্থাপনে নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে ইংরেজী ভাষা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। ভাষানীতির আলোকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের ইংরেজী ভাষা পরিস্থিতি যে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সহজেই ধরা পড়বে। পূর্বালোচনা থেকে আমরা অবগত হয়েছি যে, ভাষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্য হল-একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে অন্যান্য অপেক্ষাকৃত অগুরুত্বপূর্ণ ভাষার চেয়ে অধিক মর্যাদা আরোপ ও তাকে কার্যকারিতা প্রদান করা। কাজেই বাংলাদেশে সত্যিকারভাবে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা হলে এবং তা মানা হলে-যেসব ক্ষেত্রে বাংলাভাষাকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে, সেসব ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপিত হবে। ব্যাংক, বীমা, বেসরকারী অফিস, আদালত ও সামরিক বাহিনী ইত্যাদির আন্তর্জাতিক ডেস্ক ব্যতীত সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপিত হবে। তাছাড়া দেশের সরকারী- বেসরকারী অফিস, দৃশ্যমান কোন স্থান এবং পণ্যের মোড়ক ও বিজ্ঞাপনে ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপিত হবে। দেশের সরকারী, আধা-সরকারী ও বেসরকারী বাণিজ্যক, বিপণী, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দলিল ও তথ্য বাংলায় সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক হবে। এভাবে একটি ভাষানীতির অনুসরণে সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহার নিশ্চিত হলে দেশে বাংলাভাষা দ্যোতক ভাষাপরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় ইংরেজী ভাষার ব্যবহার তিরোহিত হবে। দেশের সরকারী, আধা-সরকারী ও বেসরকারী বাণিজ্যক, বিপণী, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজীতে লিখিত সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড ইত্যাদি অপসারিত হবে এবং পণ্যের মোড়কের গায়ে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা বর্ণনা যুক্ত হবে। ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং ইংরেজী ভাষা প্রান্তিক ভাষায় পরিণত হবে। যার ফলে দেশে ইংরেজি ভাষাপরিস্থিতি পরিবর্তিত হবে। পরিবর্তিত ইংরেজী ভাষা পরিস্থিতির আলোকে ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হলে, ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা যুগপোযোগী হয়ে উঠবে। সেজন্য আপনাকে সবার আগে ইংরেজী ভাষা পরিস্থিতি সংস্কারের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

২) বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের অনুরোধ
বর্তমানে প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা ৪টি যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সে গুলো হলো- ক)ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা হল বৃটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, খ)ইংরেজী হল একটি আন্তর্জাতিক ভাষা, গ)ইংরেজী হল আন্তর্জাতিক জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশের একটি মাধ্যম এবং ঘ)ইংরেজী হল আন্তর্জাতিক চাকুরী বাজারে প্রবেশের একটি মাধ্যম। এই ৪টি যুক্তি বাংলাদেশে ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে, কিন্তু এই গুলি বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না।
বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার ভিত সৃজনে যে সমস্ত সমাজ-ভাষা তাত্ত্বিক আদর্শ রয়েছে সেগুলো হলো-আত্তীকরণ ও দেশীয়করণ। এই সমাজ-ভাষা তাত্ত্বিক আদর্শগুলো সে সমস্ত সাবেক বৃটিশ ঔপনিবেশিক দেশে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ভিত তৈরী করে, যে সমস্তু দেশের দেশাভ্যন্তরে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর সংজ্ঞাপনের জন্য এজমালী কোন ভাষা নাই। এ সমস্ত দেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর পরস্পরের মধ্যে সংজ্ঞাপনের জন্য এজমালী কোন ভাষা না থাকার জাতীয় অনৈক্যের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এই সমস্ত দেশ রাষ্ট্রাভ্যন্তরে সব ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে একটি বৃহত্তর সমাজব্যবস্থায় আত্তীকরণের উদ্দেশ্যে উত্তরাধিকার হিসাবে প্রাপ্ত বৃটিশ ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজীকে দেশীয়করণের উদ্যোগ নেয়। এ ধরণের ভাষাগত আদর্শের ভিত্তিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার নীতি গ্রহণের ফলে পাপুয়া নিউ গিনি, কেনিয়া ও নাইজেরিয়া ইত্যাদির মত দেশের কর্তৃপক্ষ তাদের দেশের সমস্ত জনগোষ্ঠীকে ইংরেজী শিক্ষা প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ ভাগ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হল বাংলা, আর অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই দ্বিতীয় ভাষা বংলা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ভাষাগত কারণে জাতিগত অনৈক্যের সম্ভাবনা নাই। সেজন্য বাংলাদেশে সবার জন্য বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজন নাই। আমি গবেষণায় দেখতে পেয়েছি যে, বিশ্বায়ন আদর্শটি বাংলাদেশে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা প্রচলনকে সমর্থন করে। কিন্তু এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক ইংরজী শিক্ষাকে সমর্থন করে না। এটি বরং যাদের আসলেই ইংরেজী ব্যবহার প্রয়োজন শুধু তাদের জন্যই ইংরেজীভাষা শিক্ষা গ্রহণকে সমর্থন জানায়। কাজেই প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী ভাষাশিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করা প্রয়োজন। সেজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজী ভাষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে ধরে একটি নতুন যুগপোযোগী ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। সেজন্য আপনাকে প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করে নতুন একটি ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

৩) ইংরেজী ভাষা শিক্ষাক্রম সংস্কারের অনুরোধ
বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষা বাতিল করা হলে ইংরেজী ভাষা শিক্ষার শিক্ষাক্রমেও সংস্কার প্রয়োজন হবে। এই শিক্ষাক্রমের থেকে ভিন্নতর একটি শিক্ষাক্রম চালুর প্রয়োজন হবে। এই শিক্ষাক্রম পর্যাক্রমে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনের উপযোগী হবে এবং এটি একই সাথে নবম শ্রেণী থেকে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয় অধ্যয়নের সুযোগ সৃষ্টি করবে। নবম শ্রেণী থেকে সেসব শিক্ষার্থীরা ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয় পড়ার সুযোগ পাবে, অষ্টম শ্রেণীতে যাদের অন্তত: নিম্নমাধ্যমিক স্তরের ইংরেজী দক্ষতা থাকবে। এই শিক্ষাক্রমে উচ্চশিক্ষাস্তরে ইংরেজী মাধ্যমে আঞ্চলিক বিদ্যা অর্থ্যাৎ ইংরেজীবিদ্যা অধ্যয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তার ফলে শিক্ষাক্রমে বিভিন্ন ইংরেজী ভাষাভাষী দেশ, যেমন-কেনিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, আমেরিকা ও নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশের ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি পাঠ ইত্যাদি শিক্ষাক্রমে অর্ন্তভূক্ত হবে।

৪) পাঠ্যক্রমের সংস্কারের অনুরোধ
ইংরেজী শিক্ষাক্রম সংস্কারের সাথে সাথে ইংরেজী পাঠ্যক্রমেও পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। এই পরিবর্তনের ফলে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ইংরেজী ১মপত্র নামক বিষয়টি বাতিল হবে। তার স্থলে তৃতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধাপে ইংরেজী স্বাক্ষরতা বিষয়ক কোর্স প্রবর্তনের প্রয়োজন হবে। এবং নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ধাপে মানবিক, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় ইত্যাদি বিভিন্ন একাডেমিক বিষয় ইংরেজীতে পড়ানোর ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন হবে। কেননা ইংরেজী ১ম পত্র বিষয়টি ইংরেজী শিক্ষার যে লক্ষ্য নিয়ে প্রবর্তিত, প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম চালুর ফলে আরও কার্যকরভাবে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজী রিমেডিয়েল কোর্স (ইংরজী ১ম বা ২য় পত্র নামে বিষয় বা কথপোকথন যে কোর্স) প্রদানের কোন যৌক্তিকতা থাকবে না। কেননা উচ্চশিক্ষার স্তরে একাডেমিক ইংরেজীতে যে দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তা দু’একটি ইংরেজী রিমেডিয়েল কোর্সে অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে অর্জন সম্ভব নয়। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম অনুসরণে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের ভাষিক মাধ্যম ও পাঠ্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হবে। এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজী অবিমিশ্র মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা অপাংক্তেয় হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজী বিষয়টিতে বিভিন্নতা আসবে। কেননা শুধুমাত্র ‘ইংরজী’ বিষয় দ্বারা ইংরেজীর কী বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর প্রাপ্ত তা বোধগম্য নয়। সেজন্য ইংরেজী শিক্ষাবিদ্যা, ইংরেজী সাহিত্য, ইংরেজী ভাষাতত্ত্ব এবং ইংরেজী আঞ্চলিকবিদ্যা (যুক্তরাষ্ট্র), ইংরেজী আঞ্চলিকবিদ্যা (নাইজেরিয়া) ও ইংরেজী আঞ্চলিকবিদ্যা (অষ্ট্রেলিয়া) ইত্যাদি চালু করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

৫) প্রচলিত বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থা সংষ্কারের অনুরোধ
পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা বাতিলের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করা হলে প্রচলিত বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থারও সংস্কার করতে হবে। কেননা বর্তমানে প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজী শিক্ষাকে বুনিয়াদী শিক্ষার অবিভাজ্য অংশ হিসাবে ধরে বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। যে কারণে বাংলা, সমাজ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার মত কোন বুনিয়াদী শিক্ষার সাথে একই বিদ্যায়তনিক সংশ্রয়ের অধীনে ইংরেজী শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইংরেজী ভাষা শিক্ষা বুনিয়াদী শিক্ষার অবিভাজ্য অংশ নয়। কেননা ইংরেজী শিক্ষা সামাজিকীকরণের নিয়ামক নয়। তাছাড়া শিক্ষালব্ধ ইংরেজী ভাষা অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে কোন কাজে লাগে না। দেশে ইংরেজীর সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবহার হয়ে থাকে উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষা ও গবেষণা কাজে এবং সরকারী-বেসরকারী দাপ্তরিক কাজে। এ সমস্ত কাজে ইংরেজীতে যে পরিমাণ দক্ষতা প্রয়োজন, বর্তমান বৈদ্যায়তনিক ব্যবস্থা সে পরিমাণ দক্ষতা অর্জনে সহায়ক নয়। সেজন্য ইংরেজী ভাষায় উচ্চতর দক্ষতা অর্জন সহায়ক বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। সেজন্য ইংরেজী শিক্ষার জন্য সাধারণ শিক্ষার চেয়ে ভিন্নতর একটি বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন।

এই বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থাটি সাধারণ স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত কাঠামোতে পরিচালিত হবে। কিন্তু এর শিক্ষা প্রশাসনিক কাঠামো সাধারণ শিক্ষা প্রশাসনিক কাঠামোর চেয়ে ভিন্নতর হবে। এ বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থায় তৃতীয় শ্রেণী থেকে শুরু করে তিনটি ধাপে ইংরেজীতে সাতস্তর বিশিষ্ট দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকবে। এই বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা তৃতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজী বিষয়ে ফেল করলেও উচ্চতর শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে পারবে। এখানে প্রস্তাবিত ইংরেজী ভাষার সাতটি স্তর হলো-মৌলিক স্তর, প্রাথমিক স্তর, নিম্নমাধ্যমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর, উচ্চমাধ্যমিক স্তর, উচচতর স্তর ও দক্ষ স্তর। আর তিনটি ধাপ হলো-প্রথম ধাপ, দ্বিতীয় ধাপ ও তৃতীয় ধাপ। প্রথম ধাপ তৃতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রণী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে; দ্বিতীয় ধাপ নবম শ্রণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, তৃতীয় ধাপ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাকালব্যাপী বিস্তৃত হবে। প্রথম ধাপে তৃতীয় শ্রেণী থেকে বিদ্যালয়গামী সমস্ত শিশুর জন্য শুধুমাত্র ইংরেজী ব্যাকরণ (বর্তমানে ২য় পত্র হিসাবে পরিচিত) ও ইংরেজী স্বাক্ষরতা কোর্স (বর্তমানে ১ম পত্র হিসাবে পরিচিত) চালু থাকবে যেন তারা ইংরজীতে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং দ্বিতীয় ধাপে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য যথেষ্ট তৈরী হয়। তবে কেউ ইংরেজী বিষয়টি না পড়তে চাইলে তাকে ইংরেজী পড়তে বাধ্যতা আরোপ করা যাবে না। যারা প্রথম ধাপে ইংরেজীতে নিম্নমাধ্যমিক স্তরের দক্ষতা অর্জন করবে, তারা দ্বিতীয় ধাপে মানবিক, বাণিজ্য বা বিজ্ঞান শাখার দু’টি একাডেমিক বিষয় (যেমন-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান) ইংরেজী মাধ্যমে পড়ার সুযোগ পাবে। আর যারা এ ধাপে ইংরেজীতে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না তারা ইংরেজী বিষয় ও ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষব পড়ার সুযোগ পাবে না। এ ধাপে ইংরেজী ব্যাকরণ (বর্তমানে ২য় পত্র হিসাবে পরিচিত) ও সাধারণ ইংরেজী কোর্স (বর্তমানে ১ম পত্র হিসাবে পরিচিত) পড়ার কোন ব্যবস্থা থাকবে না। কেননা অষ্টম শ্রণী পর্যন্ত ইংরেজী ব্যাকরণ পাঠের পর ইংরেজী ব্যাকরণের যে মৌলিক জ্ঞান অর্জন হয় তার সাহায্যে ইংরেজীতে একাডেমিক বিষয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর ইংরেজী ১ম পত্রের বিকল্প হতে পারে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয়। কারণ ইংরেজী ১ম পত্র নামে যে বিষয় বর্তমানে চালু রয়েছে তার মাধ্যমে যে ইংরেজী দক্ষতা লাভ করা যায়, একাডেমিক বিষয় ইংরেজীতে পড়াশুনা করলেও একই ইংরেজী দক্ষতা লাভ করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে ইংরেজীতে উচ্চতর স্তরের দক্ষতা অর্জনে সক্ষম শিক্ষার্থীরা তৃতীয় ধাপে ইংরেজী মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে। কিন্তু এই ধাপে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয় পাঠের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। তারাই এই তৃতীয় ধাপে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয় পাঠের সুযোগ পাবে, যারা নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশশ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজীতে উচ্চতর স্তরের দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। এই ধাপে ইংরেজী ব্যাকরণ বা সাধারণ ইংরেজী পাঠের কোন ব্যবস্থা থাকবে না। কিন্তু কলেজের ভৌত অবকাঠামোতে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ উম্মুক্ত রেখে ইংরেজী কথপোকথন কোর্স চালুর প্রয়োজন হবে। এই তিন ধাপ বিশিষ্ট ইংরেজী শিক্ষা সহায়ক বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের জন্য আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

৬) ইংরেজী শিক্ষক পদ সংজ্ঞায়নের অনুরোধ
এই সংস্কারের আওতায় ইংরেজী শিক্ষক ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। বর্তমানে ইংরেজী শিক্ষক ধারণাটি সীমিত অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষায় ইংরেজী ১ম পত্র ও ইংরেজী ২য় পত্র নামে যে দু্’টি বিষয় রয়েছে তা পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকগণ ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে পরিচিত। একইভাবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে ইংরেজী সাহিত্য ও ইংরেজি শিক্ষাবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকগণ ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত একাডেমিক বিষয় ইংরেজী মাধ্যমে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকগণ ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে গণ্য হন না। কিন্তু একাডেমিক বিষয় ইংরেজী মাধ্যমে পড়ানোর কাজে নিয়োজিত শিক্ষকগণের বরং ইংরেজীতে বেশী দক্ষতা প্রয়োজন। কাজেই এই ধরণের ইংরেজী মাধ্যমে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকের পদটিকে সংজ্ঞায়ন প্রয়োজন। কেননা তারা ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে স্বীকৃত না হওয়ায়, তাদের ইংরেজীতে দক্ষতার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইংরেজীতে তাদের অদক্ষতার কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যহত হচ্ছে। সেজন্য নীচে বর্ণিত উপায়ে ইংরেজী শিক্ষক পদ সৃজন ও সংজ্ঞায়নের প্রয়োজন।
ক) বাংলা মাধ্যমে একাডেমিক বিষয়ের শিক্ষক পদের বিপরীতে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয়ের শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ইংরেজীতে স্বীকৃত পরীক্ষায় দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকদেরকেই শুধু এই ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয়ের শিক্ষক পদে নিয়োজিত করা প্রয়োজন।
খ) ইংরেজী ১ম পত্র ও ইংরেজী ২য় পত্রের বিপরীতে ইংরেজী স্বাক্ষরতা শিক্ষক, ইংরেজী ব্যাকরণ শিক্ষক, সাধারণ ইংরেজী শিক্ষক, ইংরেজী কথপোকথন শিক্ষক ও ইংরেজী সাহিত্য শিক্ষক ইত্যাদি পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
গ) উচ্চশিক্ষা স্তরে ইংরেজী শিক্ষাবিদ্যা শিক্ষক, ইংরেজী সাহিত্য শিক্ষক, ইংরেজী ভাষাতত্ত্ব শিক্ষক ইত্যাদি ভিন্নভিন্ন পদ সৃজনের প্রয়োজন। তাছাড়া বিশ্বায়নকে দেশের ভাষানীতির ভিত্তি হিসাবে নিয়ে দেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে ইংরেজী আঞ্চলিকবিদ্যা চালু করা প্রয়োজন। দেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে ইংরেজী আঞ্চলিকবিদ্যা চালু করা হলে বিশ্বের বিভিন্ন ইংরেজী ভাষাভাষী দেশের আঞ্চলিকবিদ্যার পথ প্রশস্ত হবে। একই সাথে এই শিক্ষা পরিচালনার জন্য নতুন আঞ্চলিক বিদ্যা, যেমন- ইংরেজী আঞ্চলিক বিদ্যা (কেনিয়া), ইংরেজী আঞ্চলিক বিদ্যা (নিউজিল্যাণ্ড) ও ইংরেজী আঞ্চলিক বিদ্যা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ইত্যাদি শিক্ষক পদ সৃজনের প্রয়োজন হবে।
কাজেই উপর্যুক্ত ক)-গ)বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে আপনাকে ইংরেজী শিক্ষক ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করে নতুন নতুন ইংরেজী শিক্ষক পদ সৃজনের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

৭) দক্ষতা ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তনের অনুরোধ
বর্তমানে ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থায় কৃতি ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু রয়েছে। তাই এ পদ্ধতিতে কোর্স সমাপান্তে যে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, তার মাধ্যমে ইংরেজীতে শিক্ষার্থীর কৃতির মূল্যায়ন ঘটে, কিন্তু দক্ষতার মূল্যায়ন ঘটে না। অর্থ্যাৎ এ পদ্ধতিতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের মূল্যায়ন করা হয়, কিন্তু ইংরেজীতে দক্ষতার মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে এই ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের ইংরেজী ভাষায় পর্যায়ক্রমিক দক্ষতা মূল্যায়ন সহায়ক নয়। সেজন্য প্রতি বছর ধাপে ধাপে ইংরেজীতে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় কি-না তা এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে নিশ্চিত করা যায় না। তাই এক শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীর ইংরেজী দক্ষতা বৃদ্ধি পায় কি-না তা এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বুঝা যায় না। একই কারণে একটি বিদ্যালয়ে যেমন একই শ্রেণীতে বিভিন্ন দক্ষতার শিক্ষার্থীর অবস্থান থাকতে পারে, তদ্রুপ বিভিন্ন শ্রেণীতে একই দক্ষতার শিক্ষার্থীর অবস্থান থাকতে পারে। আবার একই পাঠ্যপুস্তকে ইংরেজী শিখলেও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গড় দক্ষতা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এই কৃতিভিত্তিক দুর্বল মূল্যায়ন পদ্ধতির জেরে ইংরেজীতে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েও অনেকেই ইংরেজীতে ঈস্পিত দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হন। আর এর কুফল হয় সুদূরপ্রসারী। কেননা ইংরেজীতে নিম্নমানের দক্ষতা নিয়ে যারা শিক্ষকতা পেশায় আসেন তারা তাদের দক্ষতার অভাবে শিক্ষার্থীদেরকে ইংরেজী শিক্ষাদানে ব্যর্থ হন। সেজন্য‌ ইংরেজীতে কৃতি ভিত্তিক এই দুর্বল মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তে দক্ষতা ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতিটি সাতস্তর বিশিষ্ট হবে। এই সাতটি স্তর হলো-মৌলিক স্তর, প্রাথমিক স্তর, নিম্নমাধ্যমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর, উচ্চমাধ্যমিক স্তর, উচ্চতর স্তর ও দক্ষ স্তর। ইংরেজীতে এই সাতটি দক্ষতা ভিত্তিক স্তর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কাজেই শিক্ষার্থীদের দক্ষতার মূল্যায়নে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন পরীক্ষা-টোফেল ও আই.ই.এল.টি.এস.-এর আদলে প্রস্তাবিত বিদেশী ভাষা শিক্ষাবোর্ডের (পরের অনুচ্ছেদে বিবৃত) নিয়ন্ত্রণাধীনে দক্ষতা ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা যে শ্রেণীতেই অধ্যয়ন করুক না কেন, এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে তারা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উলম্ফনের জন্য পরীক্ষার্থীকে সে স্তরের দক্ষতা ভিত্তিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। অর্থ্যাৎ শিক্ষার্থীরা বুনিয়াদী পরীক্ষায় পর্যায়ক্রমে উচ্চতর শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেও ইংরেজী দক্ষতা পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলেও তারা সেই ইংরেজী শিক্ষার স্তরে থেকে যাবে। এই প্রস্তাবিত দক্ষতা ভিত্তিক পরীক্ষা চালু হলে, অষ্টম শ্রেণী থেকে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয় অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে নিম্নমাধ্যমিক স্তরের ইংরেজী দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয় অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ইংরেজী দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন।

৮) ইংরেজী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কারের অনুরোধ
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা পরিস্থিতি পারস্পরিক সমন্বয় সাধিত হলে শিক্ষা কার্যক্রমটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু একজন শিক্ষক এই কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। কাজেই একজন ইংরেজী শিক্ষক বা ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক শিক্ষকের অদক্ষতা পুরা ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু বর্তমানে যারা ইংরেজী শিক্ষক বা ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত আছেন বা নিয়োজিত হতে আগ্রহী তাঁরা যে পরীক্ষা পদ্ধতিতে স্নাতক হয়েছেন তা ত্রুটিপূর্ণ। সেজন্য তাঁদের কোন নির্দিষ্ট শ্রেণীতে ইংরেজী বা ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক বিষয় পড়ানোর দক্ষতা রয়েছে কি-না তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিন্তু একজন ইংরেজী শিক্ষক বা ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক শিক্ষকের ইংরেজীতে দক্ষতা থাকা বাঞ্চনীয়। সেজন্য শিক্ষক নিয়োগে ইংরেজী ভাষায় ভাষাগত দক্ষতাকে আবশ্যিক শর্ত হিসাবে আরোপ করা প্রয়োজন। একই কারণে ইংরেজী শিক্ষক বা ইংরেজী মাধ্যমে একাডেমিক শিক্ষকের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন ইংরেজী ভাষা দক্ষতা পরীক্ষা বা তার সমমানের কোন দেশীয় ইংরেজী ভাষা দক্ষতা পরীক্ষায় নির্দিষ্ট দক্ষতা স্কোরকে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। যেহেতু দেশে বর্তমানে আন্তর্জাতিকমানের ইংরেজী দক্ষতা পরীক্ষা চালু নাই, তাই টোফেল ও আই.ই.এল.টি.এস পরীক্ষার স্কোরকে বিবেচনায় নিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। অর্থ্যাৎ শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে টোফেল বা আই.ই.এল.টি.এস ভিত্তিক মাপকাঠি প্রয়োগ বাধ্যতা আরোপ করা প্রয়োজন। সেজন্য আপনার কাছে একটি দক্ষতাভিত্তিক নিয়োগ পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

৯) পৃথক বিদেশী ভাষা শিক্ষাবোর্ড স্থাপনের অনুরোধ
বাধ্যতামূলক ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা বাতিলের ফলে যে নতুন বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে, তা পরিচালনার জন্য বর্তমান শিক্ষাবোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন যথেষ্ট নয়। সেজন্য বর্তমান সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের চেয়ে ভিন্নতর একটি বিদেশী ভাষা শিক্ষাবোর্ড স্থাপনের প্রয়োজন হবে। আমরা জানি যে, একটি ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা তখনই নিশ্চিত হয়, যখন এ ব্যবস্থার তিনটি বিষয়: শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-এর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটে। কিন্তু এই তিনটি বিষয়কে সমন্বয় করতে হলে প্রয়োজন একটি শিক্ষাপ্রশাসন। আর এই শিক্ষা প্রশাসনটি সুষ্ঠুভাবে পারিচালনার জন্য প্রয়োজন একটি বিদেশী ভাষা শিক্ষাবোর্ড, যার অধীনে ইংরেজীসহ সমস্ত বিদেশী ভাষা শিক্ষা বিষয়ক প্রশাসন ন্যস্ত করা যাবে। সেজন্য আপনার কাছে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিদেশী ভাষা শিক্ষাবোর্ড স্থাপনের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

⊰৫.শেষকথা⊱

শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী,
আমি চিঠির শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম যে, আমি গত দশ বছর ধরে ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার উপর যে গবেষণা পরিচালনা করে আসছি, তার আলোকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের দাবী সম্পর্কিত চিঠিটি আপনার বরাবর পেশ করেছি। এই প্রসঙ্গে আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, গত দশ বছর ধরে পরিচালিত গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল Reconsidering the Prevalent English Language Education System in Bangladesh-শীর্ষক অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করেছি।
আপনি নিশ্চয়ই চিঠির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য করেছেন যে, বর্তমান ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাটি ভাষাগত আদর্শ, ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনার নিরেখে গ্রহণযোগ্য নয়। এই অগ্রহণযোগ্য ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাটি চালু থাকার ফলে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এই ক্ষতি থেকে নিষ্কৃতির জন্য প্রয়োজন বর্তমান ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। এই সংস্কার কীভাবে সাধন করতে হবে সে কৌশল চিঠির শেষ অংশে বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আপনার কাছে আমার আকুল আবেদন এই যে, আপনি বর্তমানে প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করবেন এবং জাতিকে একটি যুগপোযোগী টেকসই ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিবেন।

আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করে এখানেই আমার প্রচলিত ইংরেজী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা আমূল সংস্কারের দাবীতে আপনার কাছে লেখা চিঠিটির ইতি টানছি।

বিনীত-



ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির
অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২১ সকাল ১১:৫০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×