somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আসামের ভাষা-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার দুরাবস্থা

১৪ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আসামের ভাষা-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার দুরাবস্থাআসাম রাজ্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত বরাবর অবস্থিত ভারতীয় গণরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজ্য। এই রাজ্য বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল বরাবর বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝখানে গারো ও খাসিয়া জাতি অধ্যুষিত মেঘালয় রাজ্য প্রবিষ্ট রয়েছে।

আসামের সমাজ বহু শতাব্দি ধরে সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দু ধর্মের প্রভাবাধীনে আর্যায়িত হয়ে এসেছে। তবে বাংলাদেশ সংলগ্ন কয়েকটি অঞ্চল, যেমন-বরাক উপত্যকা (করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও কাছাড় জেলা নিয়ে গঠিত বিস্তৃত অঞ্চল) ও বৃহত্তর গোয়ালপাড়া অঞ্চল (বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও ধুবরি জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চল) পূর্বকাল থেকে মুসলামান শাসনাধীনে নিপতিত হওয়ায় ইসলামায়িত হয়েছে। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ব্রিটিশ-বার্মা যুদ্ধে বার্মা পরাজিত হলে, ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আর্যায়িত আসামের বিস্তৃত অঞ্চল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন থেকে আসামের বরাক উপত্যকা এবং বৃহত্তর গোয়ালপাড়া অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষীদের অভিবাসন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে সমস্ত আসাম জুড়ে বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যা বিস্তৃত হতে থাকে। অভিবাসিত এসব বাংলা ভাষাভাষীদের অধিকাংশ ছিলো মুসলমান আর কিছু সংখ্যক ছিলো হিন্দু।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারায় বাঙ্গলাবর্ত (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড) থেকে বাংলা ভাষাভাষীদের অভিবাসনের ফলে আসামের ভাষিক জনমিতিতে পরিবর্তন সূচিত হয়। আর শুরু হয় ভাষিক রাজনীতির নতুন অধ্যায়। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে আসাম অধিকারের পর ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া কোম্পানী একে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অন্তর্ভুক্ত করে এবং ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষাকে আসাম প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসাবে চালু করে। সে সময় অসমীয়া ভাষাকে বাংলা ভাষার একটি উপভাষা হিসাবে ধরা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আসামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালতের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার প্রচলন করে। তবে আসামবাসীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সরকার ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে অসমীয়া ভাষাকে পুনরায় এই রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়। সে হিসেবে প্রায় ৩৮ বছর বাংলা ভাষা ছিলো আসামের সরকারী ভাষা। এর প্রতিক্রিয়ায় অসমীয়ারা বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করা শুরু করে। সেই উপেক্ষা এখনও চলছে। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান হওয়ার সময় সিলেট জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হলেও, বরাক উপত্যকা ও গোয়ালপাড়া অঞ্চল ভারতের আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। কাজেই আসামে বাংলা ভাষা ক) বরাক উপত্যকা, খ) বৃহত্তর গোয়াল পাড়া ও গ) অন্যান্য জেলা― এই তিনটি অঞ্চলে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়।

স্বাধীনতাত্তোর আসামে ক্ষমতায় অধ্যুষিত রাজনৈতিক শক্তি অসমীয়া ভাষিক আধিপত্যবাদের প্রতিভূ। এই রাজনৈতিক শক্তি গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় একচেটিয়াভাবে অসমীয়া ভাষাকে বাস্তবায়ন করে চলেছে। অর্থ্যাৎ বাংলাসহ অন্যান্য তিব্বতীয়-বর্মী ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত ভাষাগুলোর উপর অসমীয়া ভাষার আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বাংলা ভাষা ও তার উপভাষাগুলো অসমীয়া ভাষার আধিপত্যের ঝুঁকিতে নিপতিত রয়েছে। কারণ অসমীয়া রাজনৈতিক শক্তি বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতি কঠোর। এই কঠোরতা সৃষ্টিতে যেসব রাজনৈতিক উপাদান কাজ করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১) ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ উপনিবেশত্তোর ভারতে আসামের রাজনীতিতে বাংলা ভাষাভাষীদের আধিপত্য,
২)অসমীয়া ভাষাকে বাংলা ভাষার উপভাষা হিসাবে আখ্যা দিয়ে, একে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা হিসাবে স্বীকৃতিদান বিলম্বিতকরণ,
৩) বাংলা ভাষার প্রভাবে উদ্ভূত ভাষা-সাংস্কৃতিক সঙ্কট,
৪) বৃহৎবঙ্গ বা বৃহত্তর বাংলাদেশ তত্ত্ব,
৫) বাংলাদেশি বহিরাগত তত্ত্ব

এই রাজনৈতিক শক্তি বাংলা ভাষা বিকাশের পথকে রুদ্ধ করতে সর্বদা তৎপর রয়েছে। সেজন্য এই শক্তি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানান ভাষা-রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। নানা উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা ভাষার মর্যাদাকে উপেক্ষা করে, অসমীয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা। উল্লেখ্য যে আসাম সরকার ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর আসাম রাজ্য বিধানসভায় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একমাত্র অসমীয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের দাপ্তরিক দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এই উদ্যোগকে ঘিরে আসামের বাঙ্গালীদের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। বরাক উপত্যকার বাঙ্গালীগণ এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। সে সময় করিমগঞ্জ (উত্তর) আসনের বিধায়ক রনেন্দ্র মোহন দাস বিধান সভায় এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেন যে, এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা (অসমীয়া) দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। তবে ঐ বছর ২৪ অক্টোবর তারিখে এই আইন পাস হয়ে যায়। প্রতিবাদে বরাক উপত্যকায় ব্যাপক ভাষা অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। আন্দোলন সংঘটনের প্রক্রিয়ায় ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’। কিন্তু এ সময় বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও অন্যান্য অঞ্চলে বাংলা ভাষার পক্ষে অনুরূপ ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা যায় নি। একটানা চার মাস আন্দোলন চলার এক পর্যায়ে আসাম সরকার দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন থামাতে প্রয়াসী হয়। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ই মে তারিখে সর্বাত্মক হরতাল চলাকালে এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই হত্যাকাণ্ডে ১১ জন আন্দোলনকারীকে প্রাণ দিতে হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর আসাম সরকারের টনক নড়ে। ফলশ্রুতিতে আসামের রাজ্য সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। তবে সেই আন্দোলনের পর থেকে আসামসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ১৯ মে ‘বাংলা ভাষা শহীদ দিবস’ পালিত হয়।

এভাবে বরাক উপত্যকা অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আসামের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু বৃহত্তর গোয়ালপাড়া অঞ্চলে বাংলা ভাষার অধিকার প্রশ্নে কোনও আন্দোলন গড়ে উঠেনি। তার কারণ বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও তার সন্নিহিত জেলাগুলোর বাংলা ভাষাভাষীদের অধিকাংশই ধর্মে মুসলমান। আর এ সমস্ত মুসলমানদের প্রায়শই বহিরাগত হিসাবে চিহ্নিত করে, বাংলাদেশে বিতাড়ন করার ভয় দেখানো হয়ে থাকে। এভাবে গোয়ালপাইড়্যা বাংলা ভাষাভাষীগণ বহিরাগত ইস্যুতে কাবু হয়ে পড়ায়, তারা তাদের ভাষা অধিকার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। সে কারণে বৃহত্তর গোয়ালপাড়িয়্যাগণ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও, তারা তাদের দাপ্তরিক কাজকর্ম ও শিক্ষা গ্রহণের মতো বিষয়গুলো অসমীয়া ভাষায় পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও, তারা বাংলা ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সার্বিকভাবে অসমীয়া ভাষায় অপবর্তিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তারা বাংলা ভাষাকে হারিয়ে ধীরে ধীরে অসমীয়া ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীতে লীন হয়ে যাচ্ছে।



সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×