somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লকডাউন ( শেষ পর্ব )

০৭ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুদিন ধরে বিল্ডিং লকডাউন হয়ে আছে । এই লকডাউনের জন্য বিল্ডিংয়ের কোন পরিবারই প্রস্তুত ছিল না । ফ্রিজে তরিতরকারি, মাছ-মাংস যা আছে তাতে সবারই কমবেশী চার,পাঁচ দিন চলবে । কিন্তু ফুরিয়েছে অন্য আইটেমে । এক ভাড়াটিয়ার চা পাতা, চিনি ফুরিয়ে গেছে, বাড়িওয়ালা আন্টির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে চলছে। আরেক ভাড়াটিয়ার গুঁড়া সাবান আর টুথ পেষ্ট শেষ, খালি ব্রাস দিয়ে দাঁত মেজে মাড়ির রক্ত বের করে একাকার । পাঁচ তালার এক ভাড়াটিয়া আবার বেশী সেয়ানা ৷ সরকার ছুটি ঘোষণার সাথে সাথেই উনি মাসখানেক চলার মত খাবার-সদাই কিনে ফ্রিজ আর স্টোররুম ভরে ফেলেছেন। তারপরেও তিনি আজ অনলাইনে পাউরুটি, চিপস, কোক আর লুডুর বোর্ড ওডার দিয়েছেন। ডেলিভারি ম্যান মাল নিয়ে আসার সময় দূর্ভাগ্যবশত প্রজেক্টের যুব সমাজের সামনে পড়ে যায়, যুব সমাজের এক সদস্য দুই চটকানা দিয়ে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
: যা ভাগ, মানুষে ভাত খাওয়ার চাউল পায় না, আর হে আসছে চিপস কোক বেচতে ? আবার লুডুও !
দশ মিনিটের মাঝে কর্তৃপক্ষ ফোনে পাঁচতালার ভাড়াটিয়াকে জানায়, তাদের ডেলিভারি ম্যানেকে মারধর করা হয়েছে, তারা আর এই এলাকায় মাল ডেলিভারি করতে পারবে না, সরি।
এদিকে গতরাত থেকে ভাড়াটিয়া খালার খয়ার নাই। উনি বেজায় ত্যক্তবিরক্ত হয়ে আছেন ।
: কুসুম, অই কুসুম....
: জ্বী খালা ।
: অই খালার বাচ্চা, তোরে কুন সময় থিকা কইতাছি আমার খয়ার শেষ, খয়ার শেষ, আনাস না ক্যান ?
: কে আনব ? গেইটে যে বাঁশ বান্ধা জানেন না ?
: সফুরে ফোন দিয়া ক, সাজ্জাদরে দিয়া পঞ্চাশ টাকার খয়ার কিননা পাঠাইতো ।
: হু ! সাজ্জাদ ভাই আইব ? পাঁচতলার ভাড়াইট্টা মোবাইলে সদাইয়ে অডার দিছিল। প্রজেক্টের পোলাপাইন মাইরা সদাইওয়ালা বেডারে কানপট্টি ফাটাইয়া দিছে।
: দূরু ছাতা ! খালার বিরক্ত আসমান ছোঁয়। খয়ার ছাড়া পান খাওন যায় ? মনে হয় ছইয়ের পাতা চুন লাগাইয়া খাইতাছি !
: আপনে ছইয়ের পাতাও খাইছেন ?
: চুপ থাক, হারামজাদী ।
: আমারে বকেন কেরে, আমার কী দোষ ? আকামডা তো করছে অই সাততালার বেডায় । তার জন্যেইতো আজ আমরার এই দশা !
: বাড়িওয়ালা অহনও সাততলার তাগোরে বার করে না ক্যান ? সবডিরে টুন্ডা ঝাড়ু দিয়া বাইড়াইয়া খেদানো দরকার । অই দরজা খোল, আমি বাড়িওয়ালারে গিয়া জিগাই, কুন বিবেচনায় এহনো তাগো বিল্ডিংয়ে রাখছে ? কুন বিবেচনায় ? খোল, দরজা খোল ।
: সত্যি সত্যিই যাইবেন ?
: নিশ্চয় যামু । যামু না ক্যান, আমি কি কাউরে ডরাই ? খালা শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়ান।
: একটু দাঁড়ান, টিভিতে কি কয় শুইন্না লই, অই যে আজকেও করোনায় দশজন মরছে।
সাথে সাথে খালা বসে পড়েন।
: দরজার ছিটকানি কোনটা লাগানো ?
: নিচেরডা ।
: উপরেরটাও লাগা ! ভেটকাবি না ....। খালা বিড়বিড় করে বকতে থাকে, জগত সংসারের সবাইকে বকতে থাকে ।
ডেলিভারি ম্যানকে মারধরের খবরটা বাড়িওয়ালা নীরবে শুনেন। উনি বুঝতে পারছেন এটা অতি উৎসাহীদের কাজ । আসলে এ ধরেনের অতি উৎসাহী লোকজনের কারণে সমাজের যে কোন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে ও জটিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে যা ট্যাকল করা কঠিন হয়ে পড়ে। উনার দীর্ঘ পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন । তারপরেও উনার মন মানছে না - একজন করোনা রুগীর কারণে একটা বিল্ডিংয়ের সবাই এলাকাবাসীর শত্রু হয়ে যাবে কেন ? আসলে মানুষের মাঝে এখন মানবতাবোধ বিন্দু মাত্র নেই ! স্বার্থপরতা আর লোভ সবই ধংস করে ফেলছে।
উনি ঠিক করেন বিল্ডিংয়ের কার কী লাগবে সব লিষ্ট করে কাল হাউজিং সোসাইটির সহায়তায় বাজার করিয়ে আনবেন । তারপর উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে বাহির পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করেন । এখনও দু’জন আছে । বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। বাড়িওয়ালা এ ক’দিনে একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, দিনে দু‘বার বাসার সামনে লোকজনের উপস্থিতি বেড়ে যায়। এক, সকালে বাজারের সময় । আর এক, আছর ওয়াক্তের পর পর । যোহরের পরও হয়, তবে আছরের মত না । আছরের ওয়াক্তের পর মানুষজন বেশী জমে। তিনি বিষয়টা ভেবেছেন, বাজারের সময় না হয় ঠিক আছে । কিন্তু যোহর বা আছরের পর কেন মানুষের উপস্থিতি বাড়বে ?
সবাইতো বাসায় নামাজ পড়ে । তাহলে ?
তবে কি নামাজ পড়ে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় - তাদের করোনা হবে না ? কি জানি, হবে হয়তো !
এদিকে জটলার নানান জনের বলা নানান ধরনের কথাগুলো কিভাবে যেন ডালপালা ছড়াতে থাকে। ডালপালা যত ছড়ায় বাড়িওয়ালার মোবাইলে ইনকামিং কললিস্ট ততই দীর্ঘ হতে থাকে !
আত্মীয়স্বজন ফোন করে জানতে চায়,
: চাচা, আপনার না কি করোনা হয়েছে ? কিভাবে হলো ?
: চাচির শরীরটাও কি গরম গরম ?
: খালু, আপনারে তারা বাসায় রাখছে কেন ? করোনা রুগী বাসায় রাখাতো রিক্স, যেকোন সময় যা কিছু হয়ে যেতে পারে !
বাড়িওয়ালা এখন আর আত্মীয়স্বজনদের ফোন ধরেন না । ভুলে যদি ধরে ফেলেন, ধমকে লাইন কেটে দেন ।
এদিকে ছেলের বন্ধুবান্ধবদের কথাবার্তা হয় আঁকাবাঁকা মার্গে,
: অই, তোরা বাপ-পুতের দুই জনেরই বলে করোনা হইছে ? ভালা, তো পত্থম কার হইছে ? মানে, আমি জানতে চাইতাছি, করোনাডা ঘরে ঢুকাইল কে ?
: স্কুল থেকে তোর এই ঘাড়-ত্যারা স্বভাব, কত বলি সাবধানে থাক, সাবধানে থাক । কিন্তু তই ? তুইতো তুই-ই ।
: শোন, বেহুব গাছে ধরে না, বেহুব মানুষের বাড়িতেই জন্মায় ।
: একদম ফালতু কথা বলবি না, আমাদের কারো করোনা হয় নি। হয়েছে আমাদের এক ভাড়াটিয়ার । বাড়িওয়ালার ছেলে রেগে যায় ।
: বুঝছি মামা, বুঝছি, আর বলতে হবে না। শোন মামা, কোন টেনশন নিও না, সব ঠিক হয়ে যাবে । তুমি খালি নুনজলের উপর থাকো মামা, নুনজলের উপর - প্রথমে নুনজলে গলগলা করবা, তারপর নুনজলে একাটা গোছল নিবা, এরপর নুনজলের পান্তা খাবা, আর সব শেষে নুনজলের চা । ব্যস !
প্রতিবেশীরা কেউ কাছে ঘেষে না, ফোনে ফোনে বাড়িওয়ালাকে সাবধান বাণী শোনান,
: ভাই সাহেব, কেমন আছেন ? সাবধানে থাকবেন। এলাকার ছেলেপেলে তো আপনার পুরা পরিবারকে হাসপাতালে পাঠাতে চাচ্ছে !
: শুধু আমার পরিবার পাঠালেতো চলবে না, সাথে আমার বিল্ডিংয়ের সবকটা পরিবারকেই পাঠাতে হবে ।
বাড়িওয়ালা চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন । বাড়িওয়ালার চাবানো কথা শুনে প্রতিবেশীরা লাইন কেটে দেয় ।
বিল্ডিং বানাতে গিয়ে দু’এক দোকানে বাকি পড়েছে, সে সব দোকানদারদের উৎকণ্ঠাই সব থেকে বেশী,
: স্যার, আপনের করোনা হইছে আর আমারে জানাইলেন না ! আমি আপনারে এত আপন জানি, আর আপনে.....
: আরে না, আমার কিছু হয় নি।
: তাহলে মানুষজন যে বলতেছে ?
: ভুল বলতেছে ।
: বাঁচালেন, আমিতো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম ।
: চিন্তার কিছু নেই, আমার কিছু হয় নি, আর হলেও আপনার পেমেন্ট ক্লিয়ার করে যাব ।
: ছিঃ ছিঃ স্যার, আমি এত ছোট লোক না, আমি শুধু আপনার খোঁজ খবর নিতে ফোন করছি। তো আপনে ভাল আছেন, না ?
: হ্যাঁ, ভাল আছি ।
: ভাল, ভাল। তো স্যার সোমবার আমার ছেলেটাকে পাঠাই ? না মানে, বুঝতেই পারছেন ব্যবসা বাণিজ্যের যে অব ....
বাড়িওয়ালা আর ধৈর্য রাখতে পারেন না, লাইন কেটে দেন। কেটে ভাবেন, চৌদ্দ দিন আশকোনা হজ ক্যাম্পের কোয়ারেন্টাইনে যদি থেকে আসা যেত !
দিনের শেষে ফোনটা আসে হাউজিং সোসাইটির কোষাধ্যক্ষর কাছ থেকে -
: ভাই, আপনি বাড়ির প্লান পাশ করান নাই ?
: করিয়েছি, কেন ?
: শুনলাম রাজউক না কি আপনার বাড়ি ভাঙবে ?
: কি বলছেন ?
: হ্যাঁ, লোকজনতো তাই বলাবলি করছে, তাই বললাম।
: আমিতো বুঝতে পারছি না, তারা এসব কথা কোথায় পায় !
: বুঝতে পেরেছি, মানুষজন অযথাই রটাচ্ছে। ঠিক আছে, বাদ দেন। রাখি, সালামুলাইকুম, ভাল থাকবেন।
এসির মাধ্যেও বাড়িওয়ালা ঘামতে থাকেন। সোয়া কোটি টাকা লোন করে বাড়ি করেছেন। রড-সিমেন্টের দোকানে, রঙের দোকানে এখনও বাকি আছে । আর চারদিকে এ কি শুরু হলো । এতদিন ছিল করোনা, এখন যোগ হলো বাড়ি ভাঙা !
বাড়ি ভাঙার কথা শুনে বাড়িওয়ালার ছেলে এসে বলে,
: আব্বু, আমি নিশ্চিত কেউ গুটি করছে। অবশ্যই করছে ।
বাড়িওয়ালা অসহায় কণ্ঠে বলেন,
: আব্বুরে এই রাতবিরাতে আমার প্রেশারটা আর বাড়ায়ও না। এসিটা বাইশে দিয়ে, বাতি নিভিয়ে যাও ।
পরদিন সকাল নয়টায় বাড়িওয়ালার ঘুম ভাঙে সাততালার ভাড়াটিয়া ছেলের ফোনে ।
: আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
: তুমি ?
: জ্বী আঙ্কেল, আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি, গেট খুলেন।
: নিচে দাঁড়িয়ে আছো, মানে !
বাড়িওয়ালা সাথে উনার ছেলেও দ্রুত নিচে নেমে আসে ।
: তুমিতো সত্যি সত্যি চলে আসছো, বিষয় কী ?
: জি ভাইয়া, আমার করোনা হয় নি। ঠান্ডা কাশি হয়েছে, সামান্য ঠান্ডা কশি। তাই ছেড়ে দিয়েছে।
: তুমি দূরে দাঁড়াও, সরে দাঁড়াও । বাড়িওয়ালার সন্দেহ দূর হয় না।
: সমস্যা নাই আঙ্কেল, আমার করোনা হয়-ই নাই।
: তুমি রিপোর্ট নিয়ে এসেছো ?
: জ্বী ভাইয়া, এই যে... ।
ভাড়াটিয়া ছেলে ফাইল থেকে রিলিজ লেটার ও রিপোর্ট বের করে। বাড়িওয়ালা রিপোর্ট না দেখে জিজ্ঞেস করেন,
: তুমি যে আসছো, অই জটলার লোকগুলো দেখে নাই ?
: দেখেছে, কেন ?
: কেউ কিছু বলে নাই ?
: না, কেন ?
: তুমি এখন দূরে গিয়ে দাঁড়াও ৷ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে, কিচ্ছু বলবে না।
: ঠিক আছে বলব না, কিন্তু কেন ?
: কেন ? তারা যদি বুঝতে পারে তুমিই সেই করোনা রুগী, তাহলে তুমি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছো বলে হাত-পা বেঁধে তোমাকে আবার হাসপাতালে দিয়ে আসবে।
: না, কে-কে-কেন ? কী আ-আ-আশ্চর্য !
: কী আশ্চর্য ? বিন্ডিং লকডাউন দেখেও বুঝতে পারো না ?
ভাড়াটিয়া ছেলে এতক্ষণে গেটের দু’পাশে টানানো লাল পতাকা ও আড়াআড়ি বাঁধা বাঁশের দিকে তাকায় ।
: তা-তা-তাই তো ! এখন ?
: এখন তুমি আশেপাশে কোথাও যাও, আমি পুলিশকে খবর দিবো।
: পু-পু-পুলিশ কেন ?
: পুলিশ এসে তোমার কাগজ-পত্র দেখবে, তারপর বিল্ডিংয়ের লকডাউন তুলবে। তখন তুমি ভিতরে ঢুকবে । সেই পর্যন্ত তুমি বাসার আশেপাশে আসবে না । কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, পাওনা নিতে এসেছিলে।
: জ্বী, আ-আ-আচ্ছা ।
ভাড়াটিয়া ছেলে দ্রুত চলে যায়। জটলার লোকজন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, সে নীরবে হনহনিয়ে চলে যায় । জটলার লোকজন ছেলে আর বিল্ডিংয়ের দিকে পালা করে তাকায়, বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। ছেলেকে সড়িয়ে দিয়ে বাড়িওয়ালা দুটা ফোন করেন। একটা থানায়, অন্যটা হাউজিং সোসাইটির সভাপতির কাছে ।
এর মাঝেই চারতলার ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলেটা দুইশ টাকায় কেনা পিপিই পরে নেমে আসে । সব শুনে সে মুখের মাক্স সরিয়ে বাড়িওয়ালার ছেলের কানে ফিস ফিস করে,
: বড় ভাই, একে কি এমনি এমনি ঢুকতে দিবেন ? না দেখেন, তার এই করোনা নাটকের জন্য তিনদিন ধরে বিল্ডিংয়ের প্রত্যেকটা মানুষ কি কষ্ট না পেলো ! সবার কথা বাদ দেন, আপনি একবার ভেবে দেখেন, গত তিনদিন আপনি কী মানসিক টর্চারের মাধ্যে দিয়ে গেছেন ? আর আংকেল - ফোনে ফোনে পাগল হওয়ার দশা ?
: আরে তাইতো ! এই হারামজাদার করোনা হয় নাই, কিন্তু তারপরেও তার জন্য এই বিল্ডিংয়ের প্রত্যেকটা মানুষ তিনদিন ধরে সাফার করেছে !
: বড় ভাই আমাদের বাসায় একটা ভাঙা ছাতির দান্ডা আছে, নিয়া আসি ?
বাড়িওয়ালা ছেলে কিছু বলার আগেই সে দৌড়ে দেয়। গত তিনদিনের যন্ত্রণার কথা যত ভাবছে ততই বাড়িওয়ালা ছেলের ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে কয়েক ধাপে উঠে আবার নামে। উঠে আবার নামে। কোন ভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না । চারতলার ছেলে ফিরে আসে ।
: বড় ভাই, বাসা সিফটের সময় অইটা কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না, তবে অন্য জিনিষ নিয়ে এসেছি - বেলুন । সে পিপিইর জ্যাকেট তুলে রুটি বানানোর বেলুন দেখায়।
হঠাৎ বাড়িওয়ালা তাদের দিকে তাকায় ।
: কী হয়েছে ?
: আব্বু তার যদি সত্যি সত্যি করোনা না হয়, তাহলে আজ কিন্তু তার কপালে দুঃখ আছে ।
: মানে ?
: দেখো আব্বু, তার করোনা হয়েছে কি হয় নি, এটা নিশ্চিত না হয়ে সে সারা দুনিয়া বলে বেড়িয়েছে, তার করোনা হয়েছে, করোনা হয়েছে। ফলে, বাসা লকডাউন। মানুষজন আমাদের নিয়ে গুটি করছে । বন্ধুরা ফেসবুকে ট্রল করছে ! সো, সো, হি মাস্ট বি পানিশড ।
: কি করতে চাচ্ছো ?
এবার চারতলার ছেলে উত্তর দেয় ।
: ডলা দিব, ডলা ।
: ডলা ?
: জ্বী, লিফটে ফেলে আমি আর বড় ভাই মিলে ডলা দিয়ে দিব। ভাড়াটিয়া ছেলে পিপিইর জ্যাকেট তুলে বেলুন দেখায়।
: আর ইউ মেড ?
: হাফ ! আর ক’দিন লকডাউন থাকলে ফুল হয়ে যাব, আঙ্কেল ।
: খবরদার ! আমি এসব এলাও করব না ।
: আঙ্কেল আপনি জানেন না, করোনা আসার পর থেকে সে লিফটে কাউকে সাথে নিত না । তিনদিন, তিনদিন সে আমাকে গেটে রেখে উঠে যায় । আমি রিকোয়েষ্ট করেছি তারপরেও নেয় নাই । সামাজিক দূরত্ব বজায়ে রাখার জন্য একা একা লিফটে চড়তো। আর তার জন্যই কাল রাত থেকে আমি চার বদলে আদা, তেচপাতা সিদ্ধ পানি খাচ্ছি ! তেচপাতা সিদ্ধ পানি ! একে একটা কিছু ...
: তুমি উপরে যাও, যাও । বাড়িওয়ালা ধমকে উঠেন ।
: কিন্তু আব্বু ...
: নো ....
এমন সময় হাউজিং সোসাইটির সভাপতি সাহেব ও সেক্রেটারী সাহেব চলে আসেন। পরপরই পুলিশ অফিসার কয়েকজন কনষ্টেবল নিয়ে আসেন । পুলিশ দেখে সাততালার ভাড়াটিয়া ছেলে কোথা থেকে যেন দৌঁড়ে আসে। গেটের সামেনে সবাই ফাঁক ফাঁক হয়ে দাঁড়ায়। দু’একজন উৎসুক লোকও ভিড় করে ।
প্রথমে পুলিশ অফিসার তার পেপারস দেখে সন্তুষ্ট হয়ে কনষ্টেবলদের ইশারা দেয়। কনষ্টেবলরা লালা পতাকা, বাঁশ খুলে ফেলে। অফিসারের কাছ থেকে পেপারস নিয়ে সভাপতি সাহেব ও সেক্রেটারী সাহেবও দেখেন। এই ফাঁকে চারতলার ছেলে আর বাড়িওয়ালার ছেলে লিফটের দু’পাশে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায় । বেলুন ডলার জন্য প্রস্তুত । এদিকে বাড়িওয়ালা থেকে চাবি নিয়ে কনষ্টেবলরা গেট পুরো খুলে ফেলে, তখন পুলিশ অফিসার সাততলার ছেলের দিকে ঘুরে বলেন,
: হ্যাঁ, আপনার করোনা হয় নি। নরমাল ঠান্ডা কাশি। সো, ওয়েল কামব্যাক, ওয়েল কামব্যাক । তারপরেই তিনি হাত তালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় । অফিসারের সাথে সাথে কনষ্টেবলরাও তালি দেয় । আস্তে আস্তে উপস্থিত সবাই হাত তালি দিতে থাকে। বাড়িওয়ালার ছেলে ও চারতালার ছেলে ছাড়া, তারা দুজন লিফটের পাশে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে, তারা বুঝতে পারছে না কী করবে ?
মুহূর্তে পরিবেশটা কেমন বদলে যায় ! এরকম অন্তরিক অভর্থনার জন্য সাততালার ছেলেও প্রস্তুত ছিল না। কতটা আতঙ্ক, আর কি পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে গত তিন দিন তিন রাত তার আইসোলেশন বেডে কেটেছে, তা শুধু সে জানে, আর জানে তার মাবুদ। প্রতিটা মুহূর্তে সে চোখের জলে প্রাথনা করেছে, প্রতিটা মুহূর্তে । হঠাৎই তার চোখে পানি জমতে থাকে। কৃতজ্ঞতায় আর ভাল লাগায় সে ঝাপসা চোখে সবার দিকে তাকায়। কিন্তু সবাইকে কেন এত অস্পষ্ট লাগছে ?
এমন সময় বাড়িওয়ালা এসে তার কাঁধে হাত রাখেন ।
: দূর বোকা কাঁদছো কেন ? তোমারতো করোনা হয়নি । যাও, বাসায় যাও. সবাই তোমার অপেক্ষায় আছে ।
বাড়িওয়ালার নরম ছোঁয়ায় বোকা ছেলেটার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে । তার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে নামে। সে এক ছুটে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে। সে ভুলে যায় তার পেপারসের কথা, সে ভুলে যায় এই নতুন বাসায় যে লিফট আছে, সে কথা। সে সিঁড়ি ভেঙেই সাততলায় উঠতে থাকে। এক একবার দু’তিনটা ধাপ টপকে উঠতে থাকে। উপরে যে তার প্রিয় মুখগুলো আছে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:২৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×