somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিঠি

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিভূতিভূষণ শ্রদ্ধাভাজনেষু,

যেখানে আপনি এখন আছেন তাতে করে কেমন আছেন , শরীর কেমন আছে এসব জিজ্ঞেস করা অর্থহীন। আপনি যেমন কালজয়ী লেখা লিখে কালের সীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছেন সেভাবে নিজের নশ্বর দেহকে তো আর কালোতীর্ণ করতে পারেন নি। তাছাড়া চিঠি লেখার অভ্যাস আমার নেই। এটিকেটে ভুল থাকবে আগেই স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু আপনি যে সশরীরে নেই সেই কারণেই আরো বেশী করে অনভ্যাসী কলম ধরার অ্যাডভান্টেজ আছে ।সেজন্যই ধরা।

নটা পাঁচটার চাকরি করার আবেগ ছিল ঠিক ততদিনই যতদিন চাকরিটা জোটেনি। এখন জোটার সাথে সাথেই ক্যাম্পাস, হুদাহুদি ঘোরাঘুরি, আড্ডা সব গেছে। টঙের রং চায়ের মজা এখন নেই, যখন নির্দিষ্ট লোককে বললেই টেবিলে এসে দিয়ে যায় তখন খাঁচা থেকে বের হবার কোন অজুহাত দেখানো যায় না। টাকা অনেক কিছু কিনতে পারে। মেয়েলি চাহিদার ছোটখাট জিনিসপাতি- একটা নতুন স্টাইলিশ থ্রিপিস, লেটেস্ট ডিজাইনের শখের গয়না,আরও অনেক বড় উপরতলায় উঠতে পারলে ফ্ল্যাট , গাড়ি ইত্যাদি। কিন্তু যে ফ্ল্যাটটা কেনা হবে তার বারান্দায় বসে আয়েশ করে সূর্যাস্ত দেখাটা কিনতে পারে না। টাকা যতই বাড়ে সকালের প্রথম কিরণটা মুঠোবন্দি করা ততই দূর্মুল্য হয়ে যায়। তাই বই নামক বন্ধুর সাথেই আমি ঘুরতে শুরু করি। অভ্যাসটা আগেও ছিল, এখন নিরুপায় অবস্থায় আরো প্রবলতর হয়েছে। আর অভ্যাসটা ব্যাকটেডেট মানুষের, তাই আপনার মত সেকেলে একজন লোকের কাছেই লিখছি।তাও আপনার অারণ্যক পড়ার পড়েই লিখতে ইচ্ছা করছে। যদিও আপনার সাথে পরিচয় আমার মেলা দিনের। সেই ছোটবেলার পথের পাঁচালির দিনগুলো থেকে।তবুও আরণ্যক পড়ার পরই এতদিনে যেন মনে হলো, আপনার সাথে আমার অবস্থার ও মনের খুব মিল। সবসময়ই আমার মনে হয়েছে বাঁধানো সুখী গৃহস্তের পথ আপনাকে বিশেষ সুখ দিতে পারেনি।আসলে সংসারে মাত্র একটা রাস্তা ছাড়া প্রতিষ্ঠা নামক শব্দের অর্থ এত সংকীর্ণ হওয়া উচিত ছিল না। পথের পাঁচালীর অপুর মধ্যেকার ভ্রাম্যমাণ অ্যাডভেঞ্চারী মনটা , পরিণত বয়সের অপরাজিতর অপুর মাঝেও হারিয়ে যায় নি। সেও অনাস্বাদিত বিকেলগুলোর অপমৃত্যুতে বিচলিত হয়। দুপুরে কুৎসিত সাদাকালো কাগজের মধ্যে থাকতে থাকতে আমারও টিউট টিউট করে ডাকতে থাকা অচিন পাখির ডাকে মন উচাটন করে। ইচ্ছে হলে জানালায় ঝুঁকে দেখতে পর্যন্ত পারি । এখনও পর্যন্ত ।নিচু দরের স্টাফ তাই খুব চাপ এখনও নেই আপাতত। কিন্তু আশেপাশে থেকে খালি ফিসফিস শুনি, কি করছো বোকা মেয়ে? এত অল্পেই তুষ্ট থাকলে কি হয়? অ্যাপ্লাই করো, একটার পরে একটা ঘাড় গুঁজে গুঁজে ,জানি তুমি খুব মেধাবিনী না, তবু কোথাও হয়ত লেগে যাবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিও না । অল্প কয়েকটা টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটা বোকামি। নতুন একটা ধর, তারপরে ওখানে থেকে ভালো সুযোগ পেলে নাহয় আরেকটা। এভাবেই মরীচিকার পেছনে চলে যাবে একসময় জীবন । তাতে কি? গতিই তো জীবন। কিন্তু মনে মনে আমি যে আসলে চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর- এই সত্যটা জানতে পারলে গেছো মেয়ের কলঙ্কে চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে যাবে- জানি ,তাই চুপ করে থাকি।এইখানেই আরণ্যকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আপনাকে আমি ঠিক চিনেছি। জানি ভবঘুরে একটা মন আপনারও ছিল। তবে পার্থক্য আপনি সেটা পেয়েছেন । আমি শুধু পাই বইয়ের পাতায়।তবু ভক্ত পাঠিকা হয়ে বইয়ের পাতায় পাওয়া দুধের সাধ ঘোলে মেটানো , তবু হাত খালি তো আর থাকেনা।


আশ্চর্য কি জানেন, আমার কিন্তু অরণ্য ভালো লাগে না। ভালো লাগে সবুজ বিস্তৃত প্রান্তর। কিংবা উচ্ছ্বল জলরাশি। কেমন করেই বা লাগবে বলুন? আমরা নারীরা জন্ম থেকেই আবদ্ধ থাকি ইটকাঠের ভরা দেয়ালের জঞ্জালে , যেভাবে গাছেরা জঙ্গলে মোটা মোটা গুড়ির দেয়াল তুলে বেড়া দিয়ে দেয়। মাটিও তাই অসূর্যস্পর্শা হয়ে ওঠে। যেমন মাটির তৈরী মানবী আমরা আমাদের ঘরে। - তাই , আর কত বিজন বনানী ভালোলাগে? তবুও আপনার জঙ্গলের বর্ননা পড়ে বেশ লাগলো।বেশ হারিয়েই গেলাম ওতে।তবু সে এমন হারানো যাতে পথ খুঁজে পাবো কিনা,সে ভয়ও নেই।পথ খুঁজে পাবার ইচ্ছাও এমনকি নেই। জোৎস্না নিয়ে ফ্যাসিনেশন না থাকলেও হুমায়ুন পড়ে যেমন জ্যোৎস্না ভালোবেসেছি বইয়ের পাতায় লেখকের চোখ দিয়ে দেখতে, অারণ্যক পড়েও সুন্দর বর্ননায় জঙ্গলা পথে আটকে গেছি। বেশ লাগে ভাবতে ঘোড়ায় চড়ে একাকী বনপথে চলেছি, লবটুলিয়ার মাঠ ও বন , নাঢ়া বইহার পেরিয়ে স্বরস্বতী কুন্ডীর চমৎকার অরণ্য ঘেরা টলটলে হৃদ,কারো নদী , শৈলমালা , কত কিছু পেরিয়ে- বুকে ঢপ ঢিপ করছে ভয় , হয়ত বুনো মহিষ এসে চড়াও হবে যেকোন মুহূর্তে। হয়ত বাঘও আছে এখানে। ভালুকের আক্রমণও বিচিত্র কিছু না।আবার প্রকৃতির নিজের হাতের রচনা সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়েছি। আপনি পরীদের শুধু গল্প শুনেছেন,আমি কিন্তু কল্পনার চোখে দেখতেও পেয়েছি, আবছা আলোয় তাদের ম্লান স্বচ্ছ পাখা গুটিয়ে সেরকমই কুয়াশা আর জ্যোৎস্না রঙের গড়া তাদের মসলিন ওড়না আর জামা। স্পষ্ট পেয়েছি নাম- না -জানা বন্যফুলের গন্ধ।

আর গাঙ্গোতা প্রজাদের কথা আর কি বলবো। আপনার অতদিনের পড়শীরা আমারও বন্ধুমানুষ হয়ে গিয়েছে। ঐ যে যুগলপ্রসাদ নামের আধা পাগলাটে লোকটার সাথে আপনি বনে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বাগান তৈরী করেছেন , লুকিয়েই কারণ কেউ জানতে পারলে হয়ত শুধু স্বভাব উদাসী যুগলপ্রসাদকেই না, আপনাকেও- সম্মানিত ম্যানেজারবাবুকেও পাগল ঠাওড়াবে, সেই গুপ্ত কথা আমিও জেনে গিয়েছি। সাজিয়েছেন আপনারা , শোভা দর্শনে আমিও সঙ্গী হয়েছি। মহাজন ধাওতাল সাহুর অর্থের প্রাচুর্যে না, তার নির্লোভ বড় হৃদয়টাতে মুগ্ধ হয়েছি। পন্ডিত মটুকনাথের পন্ড অধ্যবস্যায়ে কষ্ট পেয়েছি, আবার তার ধৈর্য ধরে লেগে থাকায় শেষতক অর্জিত সাফল্যে খুশি। যেন কত আপনজনের সাফল্য এটা! নাটুয়া বালক ধাতুরিয়ার স্বপ্নে একাত্ন হয়ে গিয়েছি। ছোট ছোট আশা , তাও মানুষের পূর্ণ হয় না। কি যে কষ্ট , চোখের কোনে পানি চিক চিক -যখন ওর মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। হ্যাঁ পেলামই তো, অনবদ্য লেখনীর আরণ্যক পড়তে পড়তে আমি যে ঐসময়েরই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলাম।তাইতো দুঃসাহসী মঞ্চীর উধাও হয়ে যাবার কথা শুনে মনে অজানা আশঙ্কা হয়, কোথায় আছে কেমন আছে মেয়েটা? তাইতো ঢালতলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার , রাজা দোবরু পান্নার প্রতি শ্রদ্বা যখন জানিয়েছেন ,আমিও জানিয়েছি, মনে মনে। রাজার অবমাননায় আর তার প্রতি লোকের তাচ্ছিল্যে ক্ষুদ্ধও হয়েছি। মনটা কেমন মায়ার ভরে গিয়েছে। রাজকুমারী ভানুমতীর হৃদয়ে আপনার প্রতি অকলুষ ভালোবাসা টের পেয়েছিলেন কি? আমি তো পেয়েইছি , মনে হয় যেন আপনিও ঠিক পেয়েছিলেন। কেন তাকে অগ্রাহ্য করতে গেলেন? এত নিস্পাপ হৃদয়কে দলিত করা ভুল শুধু নয়, পাপ। কে জানে সে এখনও আপনার পথে চেয়ে আছে কিনা?

বন উজাড় হয়ে উঠেছে , সবুজ শোভা দলিত মথিত হয়েছে জীবনের প্রয়োজনে -জেনে আপনার মত আমিও কষ্ট পেয়েছি, যদিও বন ভালো লাগে না অতটা, আগেই বলেছি। থাকবার কথা দিনের পরে দিন চিন্তা করলেই নাগরিক অন্তকরণ সংকুচিত হয়ে ওঠে। তবুও কেন কষ্ট? এত কষ্ট!মনে হয় নারী বলেই।আশ্চর্য লাগছে না এই পরস্পরবিরোধিতা? মাত্রই না বললাম, নারী বলেই আবদ্ধ জঙ্গলে বিতৃষ্ণার কথা? আসলে অক্ষম নারীর গোপন কষ্ট পুরুষতান্ত্রিকতায় , তাই আর সব অক্ষম, দূর্বলের প্রতিই তার অকৃপণ মায়া চলে আসে। দেখুন , কতবার চিঠিটা লিখতে বসে ভেবেছি এই প্রসঙ্গ আনবো না।চিঠি হবে নৈব্যক্তিক। কারণ লেখকের (বা লেখিকারও) জাত বা লিঙ্গ থাকে। লেখার না। আরণ্যকের নেই।অরণ্যের আবার লিঙ্গপরিচয় কি? তাই এই চিঠিরও এমন কোন ভেদাভেদ থাকবেনা । কিন্তু অভিমান- যার অস্তিত্ব নিজের কাছেও লুকিয়ে যাই সেই অভিযোগ হয়ে থেকে থেকে ঠেলে বের হয়ে আসে বার বার। কি করব? দোষ শুধু নারী পুরুষের সমীকরণের না। তাহলে আবার এই অন্যায্য বৈষম্যের প্রশ্নের প্রতি বড় অবিচার করা হয়ে যাবে। দোষ বলুন প্রশ্ন বলুন বা উত্তর - আসলে সবল আর দূর্বলের ব্যবধানের। তাই ধনীর বনাম দরিদ্র , সক্ষমদেহের বনাম প্রতিবন্ধিতার, সুন্দরের সাথে কুৎসিতের ,সাদা ভার্সেস কালোর, সবলের মুখোমুখি দূর্বল। বনকে উজাড় হতেই হয় কারণ লড়াইটা আসলে জঙ্গলের বিরুদ্ধে ফসলের । তাই বন্যমহিষের রক্ষাকর্তা সদয় দেবতা টাঁড়বারো বনজ অধিবাসীদের উপকথার কাল্পনিক চরিত্র হয়েই থেকে যায়।বাস্তবে এদের দেখা মেলে না।



ইতি
আপনার একজন অনামা ভক্ত পাঠিকা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৩
৩৯টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×