somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিকনিক

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সামিয়া আপু বেশ হাসিখুশি। আমার চেয়ে বয়সে বড় কিন্তু আসলে তো তরুণীই। কিন্তু বিশেষ করে ত্রিশোর্ধ বয়সে যাওয়া মেয়েকে অনায়াসে মানুষ বুড়ি বলে ফেলে । উনার খুব হাসিখুশি ভাব দেখে মনে হয়না এতে বা কোনকিছুতে উনার কোন দুঃখ আছে। আছে- তা জানতে পারলাম যখন পারিবারিক পিঠা উৎসবে সাভার যাচ্ছেন বললেন। খুব উজ্জ্বল মুখে প্রায় লাফাতে লাফাতে এসে বললেন, বৃহস্পতিবার দিনটা শেষ হয় না কেন? ওনাদের প্রতিবারই পিঠা উৎসব হয়। যাননা। কেন, এত ভালো লাগে তাও কেন যান না? ফুলো খরগোশের মত আদুরে মুখটা আরো ফুলিয়ে বললেন, 'সবাই খালি বিয়ে বিয়ে করে।' তা শুক্রবারে আমারও পিকনিকের প্রোগ্রাম ছিল, এবং বয়সে ছোট হলেও এব্যাপারে জনসমাবেশে আমারও আজাইরা প্রচুর কথা শুনতে হয়। চেনে নাই জানা নাই, নাম কি' র পরের প্রশ্নই এই নিয়ে।সমাজ মানতে চায় না- মেয়েরা বলবে, কাউকে ভালো লাগলে এবং যখন ভালো বুঝবো বিয়ে করবো, না হলে করব না।বিশেষ করে বিবাহিতাদের বিদ্বেষ আরো এক কাঠি বাড়া। দিব্যি সুখে আছি। তাদের ল্যাজ কাটা গেছে, স্বাধীন মানুষগুলোর ল্যাজটা কাটলে তবে তাদের শান্তি! তাই ভাবছিলাম যাব কিনা, তবে শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম,লোকের কথায় ভয় পেয়ে না যাওয়া কাপুরুষের কাজ থুরি কা-নারীর কাজ হবে। ঘুরতে শখ অথচ সুযোগের অভাব এই কারণে এমনিতেও অনেকদিন কোথাও যাচ্ছি না। যাওয়া যাক।

তো সকাল বেলা থেকেই মনে হওয়া শুরু করলো সিদ্ধান্ত ভুল। মনের মধ্যে কু ডাকতে শুরু করলো যখন সাতটায় উঠে ঠান্ডাপানি দিয়ে গোসল করতে হল। হিটার আছে তবে মা ও বোন যথাক্রমে এক এক ঘন্টা করে নিয়ে সব গরম পানি শেষ করে ফেলেছে। গায়ে পানি ঢালতে শক খেলাম। ঠান্ডা পানিও যে শক দিতে পারে কে জানতো! তারপরে সেজেগুজে রাওনা হয়ে গেলাম। যাবো গাজীপুর।গাজীপুর অনেকবার যাওয়া হয়েছে তাই অনিচ্ছার এটাও একটা কারণ ছিল। আল্লার দুনিয়ায় এত সুন্দর সব জায়গা থাকতে বাংলাদেশের সব পিকনিক স্পট মনে হয় গাজীপুরেই। বনভোজনে সব মিলে এক বাসে যাবার নিয়ম তবে এবার ব্যবস্থা অন্যরকম হয়েছে। অনেকগুলো ছোট ছোট মাইক্রোবাস , ব্যাক্তিগত গাড়িও নিয়েছে কেউ কেউ । সব মিলে রাস্তায় যাবার সময় অনেকখানি দখল করে যেন ভিআইপি গাড়িবহর।মানুষজন চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে, এর মজাই আলাদা। বাঁকটা ঘুরতেই সবাই হইহই করে উঠলাম,'ড্রাইভার সাহেব গান ছাড়েন।'ড্রাইভার সাহেবের কাছে আছে শুধু কোরআন তেলাওয়াতের ক্যাসেট আর পুরানো আর কি কি যেন গানের ক্যাসেট। ক্যাসেটের যুগ শেষ তবু পুরানো গাড়িতে পাওয়া যায়।কোরআন তেলাওয়াত খুব ভালো জিনিস তবে পিকনিকে এসে সবাই আর অত ভালো মানুষ থাকি না। অতএব জনগণের রায়ে কয়েকটা গানের ক্যাসেট চালিয়ে দেয়া হলো।ছাড়তে উনি একটু বিব্রত বোঝা গেল ,কারণটা ছাড়ার পরে আমরাও বুঝলাম। চটুল হিন্দি গান । কথাগুলো যেমন স্থূল তেমন ক্ষ্যাত সুর। এই সুরে এখন আর কোথাও গান বাজে না।তারপরেও পিকনিকে গেলে গান না ছাড়লে জমে না বলে একটা অলিখিত বিধান থাকায় বন্ধও করা হলো না।

শুনেছিলাম, এক ঘন্টা বেশী হলে দেড় ঘন্টা লাগবে। ওমা, গাড়িতেই তো দেড় ঘন্টার উপর জ্যামে আটকে শুনলাম মাত্র অর্ধেক পথ এসেছি। সকাল আটটায় রওনা করেছি ,তখন বেলা এগারোটা । গাড়িতে বসে বসে মান্দাতার আমলের যে গান ভুলে গিয়েছিলাম সেটা বার বার শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেল। এবং এক পর্যায়ে ওটার উচ্চস্বরে এমন অভ্যাস হয়ে গেল যে ঘুমপাড়ানি গানের এফেক্ট তৈরী করলো। আমি ঢুলছিলাম ।পাশে থেকে মৃদু নাকডাকার শব্দ শুনতে পেলাম। এক মহিলা , পরিচয় বলতে মানা -কেননা মেয়েদের জন্য নাকি নাকডাকা অশোভনীয়। পড়ার জন্য একখানা জমজমাট থ্রিলার এনেছিলাম, যদিও গাড়িতে আমি পড়তে পারিনা , তবু মনের সান্তনা যে সঙ্গে প্রিয় একটা সময় কাটানোর জিনিস আছে । সঙ্গী রেহাল সবসময়ক একটা ইয়ারফোন নিয়ে ঘোরে , এমনকি যেখানে ওটাতে শোনার কোন সুযোগ হবে না সেসব সব জমায়েতেও। জিজ্ঞেস করলে বলে, বুঝবেন না । এটা হলো মনের শান্তি। আমারও ঐ অবস্থা।যার কাছে যা ভালো লাগে। তবে ঐ যা বলছিলাম বই কোলে মেলে তবু না পড়তে পেরে নষ্ট হওয়া ছুটির দিনটার জন্য দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। দুস !বাসায় থাকলে পড়তে পারতাম, গান শুনতে পারতাম, মুভি দেখতে পারতাম, ঘুমাতে পারতাম আরও বহু কিছু করতে পারতাম আর এখানে নট নড়নচড়ন । অর্ধেক দিন স্রেফ বসে কেটে গেল।একসময় ধৈর্যসীমা ছাড়ালে ড্রাইভার সাহেব নেমে উল্টাপাশের বাস ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলেন , ঘটনা কি বস?
'বস ' উত্তর দিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচী আছে তাই অন্য রাস্তা বন্ধ । সব গাড়ি , রিকশা, বাস ,ট্রাক এই দিক দিয়ে যাচ্ছে তাই এমন জ্যাম। হায়রে ভিআইপি! মনে হয় আমাদের জন্য ওরা না , ওদের সেবার জন্য আমরা। অথচ মিছিমিছি নিজেদেরকেই ভাবছিলাম, ভাবি।

মনে আবার কু ডাকলো , কেন যে আসলাম? অনিন্দিতা আমাকে বুঝ দেবার চেষ্টা করে।' দেখিস, ওখানে অনেক মজা হবে। '
'হু, দিনের অর্ধেক শেষ, যাবার পরে দুই ঘন্টা পার হলে আবার ফেরার টাইম হয়ে যাবে। যত্তোসব!'

গিয়ে পৌঁছাতেই জুমার আজান দিয়েছে, সকালের খাবার জন্য শীতের পিঠায় গরম দুপুরে লাঞ্চ করলাম। সাথে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফি। কফিটায় আমার আগে চুমুক দিলো আনিকা। বললো, 'চিনি দেয়া হয় নি।' চিনি ছাড়া চা খাওয়া যায় , কফি খাওয়া যায় না। শঙ্কিত আমি চুমুক দিয়ে দেখলাম, ওর কথাই ঠিক।
'তোমাদের যেখানে খুশি চলে যাও আমি রয়ে যাবো গাছের ছায়াতলে ' ঘোষণা দিয়ে রগরগে বইটা খুলে বসলাম। কড়কড়ে রোদে বনবাদাড়ে ঘোরে কে ?কিন্তু অনিন্দিতা সত্যি একা একা পাড়া বেড়াতে গেল। আনিকা চেয়ারে হেলান দিয়ে গাড়ির অর্ধসমাপ্ত ঘুমটা পূরণ করার তালে লেগেছিল।মেয়েটা বেজায় ঘুমাতে পারে। 'গেমস হবে', কয়েকটা অচেনা মেয়ে এসে খুব ডাকতে লাগলো। খুব ভালোবাসায় পড়ে না। গেমসের জন্য লোক কম পড়েছে। এখন যারা আছে তিনজন - ফাস্ট , সেকেন্ড , থার্ড।আরো দুইতিনজন না হলে পুরস্কার হাতে নেয়াটা শোভন হবে না! অতএব উঠতে হলো। আয়োজক আঙ্কেলদের একজনও ডেকে গেছে এরপরেও বসে থাকা খারাপ দেখায়। বসে মন্দ লাগছিল না, হালকা হাওয়া বইছে। সবুজের নিচে খুব একটা আসা হয় না। প্রিয় কিছু মানুষের সান্নিধ্য - যারা এক পরিবারের - সেটাও সবসময় এক ছাদের নিচে পেয়েও পাওয়া হয় না, তবে যখন এখানে সব কাজ বা কাজের বাহানা ফেলে আসতে হয়েছে, দুই জন তিনজনে মিলে সবাই আড্ডা দিচ্ছি , হাসছি।যে অংশ নিচ্ছে না সেও পাশে আছে সাথে আছে এই ব্যাপারটাও ব্যস্ত সময়ে অনেক । এখন গেমসের ডাক পেয়ে সেই শান্ত ভাব নষ্ট হয়ে গেল। আমি খেলায় বরাবরই বাজে। জিততে হবে, সবার বড় আমি - কিছু না পেলে কেমন দেখাবে, খুব চৌকস হতে হবে -এমন ভাবনাগুলো খেলা শুরুর আগেই পেয়ে বসলো। ব্যাপারটা খারাপ। প্রতিযোগিতা জিনিসটা দরকারী হলেও মানুষের সহজ আনন্দ বড্ড নষ্ট করে দেয়। অথচ প্রতিযোগিতা আমাদের করতে হয় , আর করলে জেতার চাপ চলেই আসে , তা যত ছোট প্রতিযোগিতা হোক না কেন। বারো বছরের উপরের মেয়েগ্রুপের মার্বেল চামুচ রেস। ক্যামেরাম্যান একটা আছে , সবার ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। একবার গাছের তলায় এসেছিল ,হাঁকিয়ে দিয়েছি। এখানে হাত বাঁধা ও মুখে চামুচ , চামুচের উপরে মার্বেল। অতএব এই কিম্ভূত অবস্থায় বাধা দেবার সুযোগ কম। সে চমৎকারভাবে সে সুযোগের সদ্বব্যবহার করলো। হুম , এভাবে সব সুযোগ যারা কাজে লাগায় তেমন কামেল মানুষদেরই জীবনে উন্নতি হয়!


যদিও বলেছিলাম আমি খেলায় মোটেই ভালো না, তবু কেমনে কেমনে একটা পুরস্কার পেয়ে গেলাম ।অতএব বোঝাই যাচ্ছে অন্যরা কেমন বিশ্বমানের খেলোয়াড়!তবু মনে হলো , এসব আয়োজন না থাকলে দিনটা সবাই বেশ উপভোগ করতে পারতাম । এই হারা জেতার ব্যাপারটা পিকনিকে না থাকলেই ভালো।শুধুই ফান করার জন্য আয়োজন তবু হেরে গেলে আমার নিশ্চয়ই মন খারাপ হতো, অল্প সময়ের জন্য হলেও , অল্প একটুখানি! এখন যারা জিতেনি তাদের মতো।এমন চিন্তা কেন আসছে, আচ্ছা আমি কি এসকেপিস্ট?
এরপর বারোর নিচে বয়সের জন্য চকলেট রেস। অনেক গুলো চকলেট বেঁধে দেয়া রশির আগায় । পিচ্চিদের হাত বাঁধা হয়নি।বাঁশি ফুঁ দেয়া হলো । ওদের একটা মেয়ে তালগাছের মতো বেমানান লম্বা। সবচেয়ে ক্ষুদে জন কোন মতে হাঁটতে পারে। দড়িটা পর্যন্ত পৌঁছায় না , তবু বেচারা প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলো, কিছুতেও পারে না, মুখ দিয়ে তো নাই , হাত দিয়েও না।
এমনিতেও যে রেসটা মনে হচ্ছিল খুব সোজা , কত কাছে কত নিচে এতগুলো চকলেট, বাতাসের তালে নাচছে, রোদ লেগে ঝিলমিল করছে সেগুলোর মোড়ক।সেটা দেখলাম আদৌ সোজা না।লম্বা মেয়েটাও ফেল মেরে গেল।পৃথিবীর সব কিছু মনে হয় রকমই।খেলার মাঠে ছয় , চার না মারতে পারলে দুয়ো দেই , মনে করি এর আর এমন কি?আমাকে ধরিয়ে দিলে আমিও পারবো , আসলে তা নয়। জীবনে সুযোগ পাওয়া সোজা , কাজে লাগানো কঠিন , কতটা কঠিন ঠিক ঐ পরিস্থিতিতে না থাকলে আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না।
বড়দের ফুটবলে কিক হচ্ছে, নতুন পরিচিতদের সাথে কথাবার্তা বলতে লাগলাম আমরা। পাশের বসা টিঙটিঙে মেয়েটার নাম প্রমা। আমার চেয়ে বছর পাঁচ ছয় ছোট হবে, দেখায় আরও কম।এ লেভেল দিচ্ছে একটা নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম থেকে। কথায় পোশাকে চালচলনে প্রকট আকারে 'আমি ইংলিশ স্কুলের , তাই ইংলিশ হবার চেষ্টা করছি '- ভাবটা প্রবল। কথা বলতে অরুচি হয়। তারপরে কিন্তু অবাক লাগলো , ব্যস্ত শডিউলে পড়া, বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুতির পড়াশোনা এসব সেরে মেয়েটা যখন বন্ধ পায় বাড়িতে বসে বসে কি করবো ভেবে অটিস্টিক শিশুদের জন্য সেচ্ছ্বাশ্রম দেয়। এক মুহুর্তে ওর প্রতি মনোভাব বদলে গেল। পরীক্ষার পরে আমিও তো কত অবসর পেয়েছি , সেসময়টার এমন উপযুক্ত ব্যবহার কখনো করি নি।শুধু তখন কেন, কখনোই কি আমি নিজের জীবন , নিজের ক্যারিয়ার , নিজের পরিজন এর বাইরে ভেবেছি করেছি? না। প্রমা গল্প করলো ওর অভিজ্ঞতার, পিলো পাসিং গেমস ওর খুব প্রিয়। অটিস্টিক স্কুলেও এটা হয়। সে কোলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে ওর হাতসহ ধরে পিলো পাস করতো, যেহেতু ওরা একা একা পারে না। প্রমা মেয়েটা আমাকে আরো অবাক করলো , যখন ক্থায় নব্বই শতাংশ ইংরেজী মেশানো সে প্রতিটি শব্দ বিশুদ্ধ উচ্চারণ করে রবীন্দ্রসংগীত গাইলো। বিস্ময় বিস্ময়! জীবনে কারোর সম্পর্কে শেষ কথা বলে কিছু নেই। চট করে কাউকে ভালো মন্দ গুণী নির্গুণ বলে ফেলা উচিত না।আমি বড় , প্রমা ছোট । কিন্তু ওর প্রতি স্নেহ নয়, শ্রদ্ধা হলো আমার।


লাঞ্চ শেষ।বাইরের শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আমি এর আগে কখনো সামনাসামনি ম্যাজিক দেখিনি। এবার দেখলাম।বেশীরভাগ টিভিতে খুব কমন সোজা আইটেম। ছোটবেলায় বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে দেখতাম। এখন বড় হয়েছি। সোজায় মুগ্ধ হবার ক্ষমতা গেছে নষ্ট হয়ে। আমি, আনিকা , অনিন্দিতা, প্রমা, আরেক নতুন মেয়ে রিহানা সবাই মিলে গুজগুজ করে ম্যাজিকের কৌশল ধরার চেষ্টা করতে লাগলাম।' কবুতর বের হয়েছে। ' ' নিচে লুকানো ছিল।' 'দড়ি জোড়া লেগেছে।' 'ভালো দড়িটা কব্জির কাছে শার্টের তলায় গোটানো ছিল।' ম্যাজিকের আনন্দের লক্ষ্যের চেয়ে এখন আমাদের কাছে ধান্দার ফন্দিরহস্য বড় উপলক্ষ্য আনন্দ খুঁজে নেবার।বেচারা যত চেষ্টা করলো মন ভোলাবার আমরা ততই সজাগ, কিছুতেই ভুলবো না।বেচারাকে তাই বারবার বলতে হলো তালি বাজাতে। হায়! সেই সরল ছোটবেলাই তো ভালো ছিল! -এমন আফসোসও লাগে কেন? ম্যাজিকের একটা আইটেম ছিলো খুব শিক্ষণীয়। জাদুকর তিনটা তিন মাপের দড়ি নিয়ে দেখালো, রাতে তার দেখা স্বপ্নকে ম্যাজিকের সংকেতে- 'এই দড়ি তিনটা- সমাজের তিন বিত্তের মানুষের প্রতীক।' স্বপ্নে সে দেখেছে উচ্চবিত্তরা বিত্তহীন মানুষে প্রতীক সবচেয়ে ছোট দড়িকে নিজেদের সম্পদ সুষমে ভাগ করে দিচ্ছে , তাই সব দড়ি মাপে এক হয়ে গেল জাদুতে- সবাই এখন সমান। তারপরে তার ঘুম ভেঙে গেল - আগে যে তিন দড়ির যে তিনরকম আকার ছিল তাই আছে। 'স্বপ্ন তো স্বপ্নই। বাস্তবে কি আর হয়? 'জাদু সাধারণ হলেও ভাবনাটা অসাধারণ।
অনুষ্ঠানের শেষে এসে একটা আড়াই বছরের বাচ্চা এসে দাঁড়ালো। নিজে থেকেই। অবাক! ও রাইম আবৃত্তি করবে! ভালো করে দাঁড়াতেই তো পারে না। 'হাম্পটি ডাম্পটি স্যাট অন এ ওয়াল' বার কয়েক তোঁতলাতে তোঁতলাতে একই লাইন বললো, হাসতে হাসতে আমরা শেষ। বেসুরো গানে এক নাড়োবান্দা আন্টি সেইরকম বিরক্তি উৎপাদন করলো, আরেক আঙ্কেলের প্রেমের কবিতা, যাতে কোথায় প্রেম আছে স্বল্প জ্ঞানে বুঝতে পারলাম না- সেইরকম বিনোদন জোগালো।সব মিলে ভালোমন্দ যাই হোক অপেশাদার অপারদর্শী মানুষগুলোর পারফর্মেন্স বেশী মন কাড়লো পেশাদারদের চেয়ে । হয়তো প্রথমোক্তদেরটা সত্যি মন থেকে উৎসারিত বলে। হয়ত তারা আপন বলে। পেশাদারেরা দিনশেষেই দূরের মানুষ , পর।
কিছু বিরক্তিকর বক্তব্যের পরে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। এক প্রেগন্যেন্ট আন্টি প্রথম পুরস্কার পেয়ে গেলেন এক গেমে। অথচ তার শরীর খারাপ বলে আসতেই চান নি। এখনও শুনছিলাম, লম্বা সময় সবার সাথে বসে আছেন , কষ্ট হচ্ছে।তারপরেও তিনি একটা কিছু জিতলেন- ব্যর্থতার অজুহাত বলে আমরা বেশিরভাগ আসলে খোঁড়া যুক্তি ব্যবহার করি।জেতার জন্য জেতার ইচ্ছাই সবচেয়ে বড় কথা।


আলো ঢলে এসেছে। মাগরিবের আজান শুরু হলো। শহরতলীর আকাশ অদ্ভূত রাঙা। বিদায় নেবার সময় হয়েছে। আজকে আসা ঠিক হলো না আগে বার বার বলার পরেও এখন মনে হলো এসে ভালোই হয়েছে। না হলে কি এমন সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেতাম? সমাজের ভ্রুকুটি থাকলেও পৃথিবী তেমনই প্রশস্ত। পাশে মনের মানুষ না থাকলেও পৃথিবী তেমনই মোহনীয়।শুধু আমাদের দেখার দোষে সেগুলো মাঝে মাঝে বর্ণহীন দেখায়। মন ভরিয়ে তোলা স্ম্বৃতির সাথে আরো লাভ- ব্যাডমিন্টনের একজন পার্টনার পেয়েছি -প্রমারা নাকি আমাদেরই পাশের বিল্ডিং-এ থাকে - কি আজব ! আগে জানতাম না।অথচ আরো আগে দেখা হলে আমার আগের সঙ্গীদের চলে যাবার দুঃখ কত আগেই লাঘব হতো! কত কাছে থেকেও সে কত দূরের মানুষ ছিলো।
আমাদের ফিরতি যাত্রা শুরু হলো। রাত হয়ে এসেছে। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় দোকান। উজ্জ্বল সাদা আলো জ্বলছে।আগের গ্রাম ভাবটা নেই হয়ে গেছে। ঠিক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রাস্তার পাশের একটা লোক খুব কুৎসিত একটা ভঙ্গি করলো। কেন? একটা গাড়িতে বসা অচেনা ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে এমন বিকৃত প্রদর্শনী দেখাবার মানে কি? অনেকখানি আনন্দের মনে একরাশ কালি পড়লো । ও লোকের আচরণের মানে যাই থাক,আমি এটাও ঠিক করলাম আমাদের বাৎসারিক এই আয়োজনে আগামী বছর আমি আবারও নিশ্চয়ই আসবো। এবারের মত দ্বিধা নিয়ে না। কারণ আমাদের বেশীর ভাগ সুখ যখন আমরা নিজেই নিশ্চিত করতে পারি জীবনের বিভিন্ন ধাপে সমাজের ঠিক করে দেয়া টার্গেট, বা খোদ সমাজটাকেও আমরা আমাদের সুখ নিয়ন্ত্রণ করতে দিতে পারি না।

'At first society was created for sake of mankind , now mankind lives for sake of society'

টিম টিম করে দূরে দূরে আলো জ্বলছে।হলুদ বাল্ব নাকি? লাগছে যেন আগেকার কুপি বাতি বা প্রদীপ। দূরে থেকে থেকে বইপ্রিয় মনে মাটির অন্ধকারে দেখতে পাই পোস্ট মাস্টারের রতন, পথের পাঁচালির দূর্গা, শ্রীকান্তের গঙ্গামাটির রাজলক্ষীও ঐখানে থাকা বিচিত্র না। মন টানে। কাচ বন্ধ এসি চলছে তাই তবু গ্রাম্য লাকড়ি পোড়ানোর মত মৃদু মিষ্টি জ্বালা গন্ধটা পাওয়া যায়। এবং হালকা বাতাস বইছে তার শব্দ পাচ্ছি , সেই সোঁদা মাটি নিকিয়ে মুছে ঠান্ডা স্পর্শও পাই। পাই, না ভেবে নেই? তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝিমুনী ভাব আসে। হঠাৎ চোখ মেলে দেখি কতটা সময় পার হয়েছে-হাজার হাজার আলো জ্বলছে। আহ! শহরে ফিরে এসেছি।মনজুড়ে স্বস্তি! শরীরজুড়ে ক্লান্তি দূর! নাহ, আমি বড়জোর গৃহদাহর অচলা হতে পারি। শহরে মানুষ। গ্রামের কাব্য আমার মোহ। মোহের আয়ু নাগরিক সত্যিকার ভালোবাসার চেয়ে ক্ষণস্থায়ী হবে এতো জানা কথা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:১৪
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×