ঈমান হল বিশ্বাস, কথা ও কাজের সমন্বয়৷ তাই মুমিন হতে হলে অন্তরে বিশ্বাস বা স্বীকৃতি থাকতে হবে যে আল্লাহ ছাড়া ইবাদত পাওয়ার যোগ্য কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল৷ সেই সাথে মুখে এই ঘোষণা বা সাক্ষ্য দিতে হবে৷ এরপর এই সাক্ষ্য অনুযায়ী আমল করতে হবেঃ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে হবে এবং ইবাদতে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না৷ সুতরাং এই তিনটি বিষয় মিলেই ঈমান:
১) অন্তরের স্বীকৃতি৷
২) মৌখিক ঘোষণা৷
৩) আমল৷
মানুষের মুখে প্রচলিত ভাষায় ঈমানকে বিশ্বাস হিসেবে অনুবাদ করা হয়৷ এজন্য অনেকের ধারণা এই যে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করাই ঈমান৷ কেউ মনে করেন যে আল্লাহকে এক বলে জানাই ঈমান৷ কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান আরও ব্যাপক, শুধু বিশ্বাস বা জ্ঞানকে ঈমান বলা যায় না৷ শুধু আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকারকারী আস্তিককে মুমিন বলা যাবে না৷ তেমনি কেবল ইসলাম ধর্মের সত্যতা কিংবা কুরআন বা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর সত্যতা জানাই ঈমান নয়৷ বরং ঈমান এর চেয়েও বেশি কিছু৷ ব্যক্তি যখন এই বিশ্বাস বা জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়ে দুটি সাক্ষ্য দেয় এবং আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে আর তদানুযায়ী আমল করে, তখনই সে মুমিন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে৷ যদি শুধু বিশ্বাস ও জ্ঞানই ঈমান হত, তবে স্বয়ং ইবলীসও মুমিন হয়ে যেত! বিতাড়িত ইবলীস ভাল করেই জানে যে আল্লাহ তাআলাই একমাত্র প্রকৃত মাবুদ, সে ভাল করেই জানে যে মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল৷ তা সত্ত্বেও সে তার দম্ভ ও অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে স্থায়ীভাবে বিতাড়িত হয়েছে৷
আবার অনেকের ধারণা এই যে শুধু মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ - এই ঘোষণা দেয়াই ঈমান৷ এ ধারণাও সঠিক নয়, কেননা মুনাফিকরাও এই ঘোষণা দিত৷ শুধু তাই নয়, তারা মুসলিমদের সাথে সালাতও আদায় করত, কিন্তু তাদের অন্তরে তারা লালন করত কুফরী ও ইসলামের প্রতি শত্রুতা৷ আল-কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই মুনাফিকদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে মুসলিমদেরকে সতর্ক করেছেন এবং জানিয়েছেন যে এরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে৷ তাই শুধু মৌখিক ঘোষণা কাউকে ঈমানদার করে না৷
ঈমান হল অন্তরের স্বীকৃতি, মৌখিক ঘোষণা এবং আমলের সমষ্টি৷ এজন্য আল কুরআনে সাফল্য ও জান্নাত লাভের শর্ত হিসেবে বারবার ঈমানের সাথে আমলে সালিহকে জুড়ে দেয়া হয়েছে৷ কেউ যদি মোটেই কোন আমল না করে, দ্বীন পালন না করে, তবে তার অন্তরের বিশ্বাস কিংবা মৌখিক ঘোষণা তার কাজে আসবে না৷
আমল যে ঈমানের অংশ, তার প্রমাণ এই যে কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন আমলকে ঈমান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ »
ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে, এর মাঝে সর্বোত্তম হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা, আর এর মাঝে সর্বনিম্ন হল পথ থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরানো, আর লজ্জা ঈমানের একটি শাখা৷১
এই হাদীসে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর ঘোষণাকে ঈমান বলা হয়েছে৷ তেমনি পথ থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরানো - যা একটি বাহ্যিক আমল, তাকেও ঈমানের অংশ বলা হয়েছে৷ আবার লজ্জা - যা অন্তরের একটি আমল, তাকেও ঈমান বলা হয়েছে৷
হাদীসে আরও বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لَا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ
ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না৷২
অর্থাৎ যখন সে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন সে পরিপূর্ণ ঈমানদার থাকে না। তার এই পাপ অনুপাতে তার ঈমান মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়৷সালাত প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
الْعَهْدُ الَّذِي بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ الصَّلَاةُ فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ
আমাদের ও তাদের [অর্থাৎ মুনাফিকদের] মধ্যে চুক্তি [অর্থাৎ এমন বিষয় যার কারণে তাদেরকে মুসলিম গণ্য করা হচ্ছে ও জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে] হল সালাত, যে তা পরিত্যাগ করবে, সে কুফরীতে লিপ্ত হবে৷৩
অপর হাদীসে এসেছে:
إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلاَةِ
নিশ্চয়ই ব্যক্তি এবং শিরক ও কুফরের মাঝে রয়েছে সালাত ছেড়ে দেয়া৷৪
এমনিভাবে আরও বহু আমলের সাথে সরাসরি ঈমানের থাকা বা না থাকাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে - যা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আমল ঈমানেরই একাংশ৷
ঈমানের বাস্তবতার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক আরও একটি বিষয় হচ্ছে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি৷ যেমনিভাবে ঈমান অন্তরের স্বীকৃতি, কথা ও কাজের সমষ্টি, তেমনি এই স্বীকৃতি বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা, ঘোষণার সত্যতা ও আমলের পরিমাণ কিংবা মানের হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সাথে ঈমানেরও তারতম্য ঘটে৷ সুতরাং সকলের ঈমান সমপর্যায়ের নয়৷ আবু বকর, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা প্রমুখের ঈমান আর একজন সাধারণ মুসলিমের
ঈমানে মধ্যে আছে বিরাট ফারাক৷ তেমনি একই ব্যক্তির ঈমান ভাল কাজের দ্বারা বৃদ্ধি পায়, মন্দ কাজের দ্বারা হ্রাস পায়৷ এছাড়া আল্লাহ তাআলার যিকর, তাঁর প্রতি ভালবাসা, ভয়, আশা, ভরসা ও ভক্তির তারতম্যের কারণে ঈমানের তারতম্য হয়৷ নিয়তের তারতম্যের কারণেও ঈমানের তারতম্য হয়৷ এই বাস্তবতাকে বোঝানোর জন্যই আলেমগণ বলেন:
الإيمان قول وعمل يزيد وينقص
ঈমান হল কথা ও কাজ, তা বাড়ে ও কমে৷
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি আল-কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত৷ আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ ءَايَتُهُۥ زَادَتْهُمْ إِيمَنًۭا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
প্রকৃত মুমিন তো তারাই, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের অন্তর কেঁপে উঠে, আর তাদের কাছে তাঁর আয়াতগুলো পাঠ করা হলে তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা একমাত্র তাদের রবের উপরই তাওয়াক্কুল করে৷৫
এই আয়াতে স্পষ্টত বলা হয়েছে যে কুরআনের আয়াত মুমিনদের ঈমানকে বাড়িয়ে দেয়৷ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إن الإيمان ليخلق في جوف أحدكم كما يخلق الثوب فاسألوا الله أن يجدد الإيمان في قلوبكم
নিশ্চয়ই তোমাদের কারও অন্তরে ঈমান পোশাক মলিন হয়ে যাওয়ার মত করে পুরোনো হয়ে যায়, সুতরাং আল্লাহর কাছে তোমরা চাও - যেন তিনি তোমাদের ঈমানকে আবার নতুন করে দেন৷৬
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ
যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকবে, সে ঈমানের মিষ্টি স্বাদ আস্বাদন করবে: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয় হবে, এবং সে কোন ব্যক্তিকে ভালবাসলে শুধু আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে আর সে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে অপছন্দ করবে যেমনিভাবে সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে৷৭
« مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ »
যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্যই দেয় আবার আল্লাহর জন্যই দেয়া থেকে বিরত থাকে, সে তার ঈমানকে পূর্ণ করেছে৷৮
এ হাদীসগুলো থেকেও আমরা ঈমানের তারতম্যের বিষয়টির ইঙ্গিত পাই৷
সারকথা হল ঈমানের অর্থ অনেক ব্যাপক৷ অন্তরে বিশ্বাস আছে, কিংবা শাহাদাত পাঠ করে আমরা মুসলিম হয়েছি - এ কথা মনে করে নিশ্চিন্তে বসে থাকার কোন সুযোগ নেই৷ আল্লাহ তাআলার কাছে মুমিন হিসেবে গণ্য হতে হলে আমাদেরকে জেনে-বুঝে ঈমানের ঘোষণা দিতে হবে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করতে হবে: সালাত আদায় করতে হবে, সাওম পালন করতে হবে, যাকাত দিতে হবে, হাজ্জ করতে হবে৷ তেমনি হত্যা, ব্যভিচার, সুদ, চুরি, মদ্যপান সহ অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজ ছেড়ে দিতে হবে৷ পর্দা করতে হবে, লজ্জাস্থান, দৃষ্টি, জিহবা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাযত করতে হবে৷ তেমনি আল্লাহকে ভালবাসা, ভয় করা, তাঁর সওয়াবের আশা রাখা, তাঁর ওপর ভরসা করা সহ অন্তরের অন্যান্য আমলগুলো করতে হবে৷ এই সবকিছু মিলেই ঈমান৷
আর এগুলোর তারতম্যের কারণে ঈমানের তারতম্য হয়৷ এজন্য আল্লাহর রাসূলের যুগে একদল বেদুইন সদ্য ইসলামে প্রবেশ করেই যখন পরিপূর্ণ ঈমানের দাবী করতে লাগল, তখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন:
قَالَتِ ٱلْأَعْرَابُ ءَامَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا۟ وَلَكِن قُولُوٓا۟ أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ ٱلْإِيمَنُ فِى قُلُوبِكُمْ ۖ وَإِن تُطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَا يَلِتْكُم مِّنْ أَعْمَلِكُمْ شَيْـًٔا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌ
বেদুঈনরা বলল, ‘আমরা ঈমান আনলাম৷’ বল, ‘তোমরা ঈমান আননি৷’ বরং তোমরা বল, ‘আমরা আত্মসমর্পণ করলাম৷’ আর এখন পর্যন্ত তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি৷ আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তাহলে তিনি তোমাদের আমলসমূহের কোন কিছুই হ্রাস করবেন না৷ নিশ্চয় আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু৷৯
অর্থাৎ তোমাদের ঈমান এখনও পূর্ণতায় পৌঁছেনি, সুতরাং এখনই তোমরা এর দাবী করো না৷ বরং তোমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য করতে থাক, তবে তোমাদের ঈমান পূর্ণতায় পৌঁছাবে বলে আশা করা যায়, আর তোমরা যে আমলই কর না কেন - তার পূর্ণ প্রতিদান তোমরা আল্লাহর কাছে পাবে৷
নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে, ঈমানের ব্যাপারে নিশ্চিত না থেকে আমাদের কর্তব্য ঈমানকে শেখার, বৃদ্ধি করার ও দৃঢ় করার অবিরাম চেষ্টা করে যাওয়া৷ নিজেকে পরিপূর্ণ মুমিন দাবী না করে আমাদের উচিৎ ঈমানের দাবী অনুযায়ী সাধ্যমত নেক-আমল করার প্রচেষ্টা চালানো৷
১বুখারী, মুসলিম৷
২বুখারী, মুসলিম৷
৩আহমদ, তিরমিযী ও অন্যান্য৷
৪মুসলিম৷
৫সূরা আল আনফাল, ৮ : ২৷
৬আল-হাকিম৷
৭বুখারী, মুসলিম৷
৮আবু দাউদ ও অন্যান্য৷
৯সূরা আল হুজুরাত, ৪৯ : ১৪৷