রিলিফ ওয়ার্ক
আবুল মনসুর
বন্যা ।
সারা দেশ ভাসিয়া গিয়াছে। গ্রামকে গ্রাম ধুধু করিতেছে। বিস্তীর্ণ জলরাশির কোথাও কোথাও ঘরের চাল ও বাশের ঝাড়ের ডগা জাগাইয়া লোকালয়ের অস্তিত্ব ঘোষণা করিতেছে।
এই বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে মৃত্তিকার গৌরব ঘোষণা করিতেছে শুধু কোম্পানীর উচু রেল-সড়কে। এই রেল-সড়কই হইয়াছে বন্যা-বিতাড়িত পল্লীবাসীর একমাত্র আশ্রয়স্থল। যাহারা রেল-সড়কের মাটিতে জায়গা পায় নাই, তাহারা কলা গাছের ভেলা তৈরি করিয়া সপরিবারে সেই ভেলায় ভাসিতেছে। দুপাশের দু-দশখানা গ্রামের সমস্ত লোক আসিয়া এই সড়কের উপর আশ্রয় লইয়াছে। রেল সড়কে তিল ধারণের স্থান নাই। মানুষ, পশু, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া গা ঘেষাঘেষি করিয়া সড়কের উপর ভিড় করিয়া নৈসর্গিক বিপদের সাম্য-সাধনা-ক্ষমতা ঘোষণা করিতেছে।
যাহারা বলিয়াছিলেন, উচুরেল লাইন প্রতিঠাই দেশে অকল্যাণের কারণ, তারা আজ নিজেদের নির্বুদ্ধিতা বুঝিতে পারিয়া দাতে আঙ্গুল কাটিতেছেন। বন্যা ত এদেশে হবেই। তার উপর যদি উচু রেল-সড়কটাও না থাকে, তবে পোড়া দেশের লোক দাড়াইবে কোথায়?
বন্যা পীড়িত দেশবাসীর দুঃখে দেশহিতৈষী পরহিত-ব্ৰতী নেতৃবৃন্দের হৃদয় হুঙ্কার ছাড়িয়া কাদিয়া উঠিয়াছে। কর্মীগণের চোখের দু’পাতা আর কিছুতেই একত্র হইতে চাহিতেছে না। সংবাদপত্র-সম্পাদকের কলমের ডগা ফাটিয়া রক্ত বাহির হইতেছে।
দিকে-দিকে রিলিফ কমিটি স্থাপিত হইতেছে। রিলিফ কমিটির রশিদ বই ছাপিতে গিয়া কম্পোজিটগণের ঘুম নষ্ট কাজে, আর প্রতিবেশীর ঘুম নষ্ট প্রেসের আওয়াজে। রিলিফ কমিটির কর্মিগণ গলায় হারমনিয়াম ঝুলাইয়া দলে দলে মর্মান্তিক গান গাহিয়া চাঁদা তুলিতেছে। সে গানের মর্মান্তিকতায় গৃহলক্ষ্মীরা দোতলার বারান্দা হইতে হাতের বালা খুলিয়া কর্মীদের প্রসারিত ঝোলায় ছুঁড়িয়া মারিতেছেন। কর্মীরা দাত্রীদের জয়ধ্বনি করিতেছে।
হামিদ চিরকালটা কেবল সংবাদপত্রে বন্যা দুর্ভিক্ষের বিবরণ পাঠ করিয়া কাটাইয়াছে। স্বচক্ষে সে কোনও দিন তাহা দেখে নাই। এবার স্বচক্ষে এই নৈসর্গিক বিপদের চেহারা দেখিয়া, আর খানিকটা বা কর্মীদের গানের মর্মান্তিকতায় আকৃষ্ট হইয়া হৃদয় তাহার একবারে গলিয়া গেল।
সেদিন সে অফিসে বেতন পাইয়াছিল। পকেটে একমাসের বেতন লইয়া গৃহে ফিরিতেছিল। মন তার কিছুতেই মানিল না। চাঁদা আদায়কারীদের দলপতির হাতে সে তিনখানা দশটাকার নোট গুজিয়া দিল। দলপতি বিস্থিত হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া নাম জিজ্ঞাসা করিলেন। সে নাম বলিল। তিনি ধন্যবাদের জয়ধ্বনি করিবার ইশারা করিলেন। হামিদের নাম সম্বলিত জয়ধ্বনি তিনবার উচ্চারিত হইল। হামিদ নিজের নাম শুনিয়া লজ্জায় দ্রুতগতিতে বাসায় চলিয়া আসিল; পশ্চাতে নিজের নামে বিপুল জয়ধ্বনি হামিদের কানে বড়ই খারাপ লাগিতে লাগিল ।
পরদিন সকাল না হইতেই বাড়ির বাহিরে মোটরের আওয়াজ শুনিয়া হামিদ বাহিরে আসিল। দেখিল স্থানীয় কংগ্রেস কমিটির সভাপতি, বারের শ্রেষ্ঠ উকিল। হামিদ বসিবার তরে ভাঙা চেয়ার টানাটানি আরম্ভ করিল। নেতাজি বাধা দিয়া বলিলেন : “ভদ্রতার কোনো প্রয়োজন নাই। দুস্থ উৎপীড়িত মেহামানদের পক্ষ হইতে আপনি রিলিফ কমিটির ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। এত বড় একটা অন্তঃকরণ লইয়া আপনি আর লুকাইয়া থাকিতে পরিবেন না। আপনি রিলিফ কমিটির একজন সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন। কমিটির মিটিং এ আপনি উপস্থিত থাকিলে আমরা গৌরব বোধ করিব।”
ভদ্রলোক একদমে এতগুলি কথা বলিয়া হামিদের হাত ধরিয়া একটা বিরাট রকমের ঝাঁকি দিয়া মোটরে উঠিয়া পড়িলেন। মোটরে বসিয়া আবার দুই হাত তুলিয়া হামিদকে নমস্কার করিলেন। মোটর ভোঁ করিয়া চলিয়া গেল। হামিদ স্তম্ভিতের মতো দাঁড়াইয়া রহিল।
বিকালে অফিসে বসিয়া হামিদ রিলিফ কমিটির সভার নিমন্ত্রণ পাইল । জনসেবা মহৎ কার্যে সে জীবনে কোনো দিন যায় নাই। দেশ ও জনসেবকদিগকে চিরকাল দূর হইতে সে সারা অন্তঃকরণ দিয়া ভক্তি করিয়া আসিয়াছে। আজ জীবনে প্রথম নিজেকে জন-সেবকদের পবিত্র দলের একজন হইতে দেখিয়া সে একেবারে ম্রিয়মাণ হইয়া গেল।
বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত লোক এড়াইয়া অতি সাবধানে-সন্তপণে একরকম গা ঢাকা দিয়া হামিদ সভায় গেল। জিলার খ্যাতনামা নেতৃবৃন্দ ও দেশ-কর্মীগণের মধ্যে পড়িয়া সে লজ্জায় এতটুকু হইয়া গেল। সভায় যাহাদিগকে সে উপস্থিত দেখিল, প্রত্যহ ইহাদের নাম পাঠ করিয়া শ্রদ্ধায় কতবার ইহাদের উদ্দেশ্যে মাথা নেয়াইয়াছে। ইহাদের সঙ্গে এক সভায় বসিয়া দেশ সেবার আলোচনায় যোগদান করিবে হামিদ নিজেকে সে কিছুতেই অতখানি বড় করিয়া ভাবিতে পারিল না।
হামিদকে সভাগৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়াই সভাপতি মহাশয় নানা-প্রকার অতিশয়োক্তি সহকারে সমবেত নেতৃবৃন্দের কাছে হামিদের পরিচয় দিলেন। হামিদ মাথা নিচু করিয়া বসিয়া রহিল।
সভায় অনেক আলোচনা হইল। বাক-বিতণ্ডা হইল। মর্মস্পশী ভাষায় বন্যাপীড়িতদের দুরবস্থা বর্ণিত হইল। সে সব বক্তৃতায় ক্ষণে-ক্ষণে হামিদের রোমাঞ্চ হইল। কিন্তু সে স্তম্ভিত হইয়া বসিয়াই আলোচনায় যোগদানের সাহস তাহার হইল না। সৰকথা সে শুনিলও না, বুঝিলও না।
সভা-শেষে সকলে তাহাকে কংগ্রাচুলেট করিতে লাগিলেন। অতিকষ্টে সে কংগ্রাচুলেশনের কারণ জানিল যে কয়েকটি কেন্দ্রের পরিদর্শনের ভার তাহার উপর দেওয়া হইয়াছে।
আর্তমানবতার সেবা-কার্যের জন্য ছুটি চাওয়া মাত্র অফিসের বড়-কর্তা হামিদের ছুটি মনজুর করিলেন। জীবনে এই প্রথম আর্তমানবতার সেবাকার্যের জন্য পল্লী অঞ্চলের বন্যাপীড়িত ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত দেশবাসীর মধ্যে হামিদ ঝাঁপাইয়া পড়িল । আর্ত জন-সেবায় অনভ্যস্ত সে। প্রথম কয়েকদিন সেবাকার্যের পদ্ধতির সঙ্গে সে নিজেকে কিছুতেই মানাইয়া চলিতে পারিল না। সেবাকার্যকে সে যতটা কষ্টকর, সুতরাং স্বগীয় মনে করিত, ততটা কোথায়ও দেখিল না বলিয়া প্রথম প্রথম তাহার মনটা একটুখানি কেমন-কেমন করিতে লাগিল। মোটরলঞ্চে করিয়া চলে ভাসমান ভেলায় বাস-করা অভুক্ত কঙ্কালসার কৃষকগণকে দু-চার সের চাউল দিয়া আসিয়া রাত্রিবেলা তাম্বুর মধ্যে রাশি রাশি কম্বল-বিছানা খাটিয়ার উপর শয়ন করিয়া অঘোরে নিদ্রা যাইতে অথবা চা-সিগারেটসহ রাত্রি জাগিয়া তাস পিটিতে হামিদের প্রথম-প্রথম ভাল লাগিল না। কিন্তু সহকর্মীদের যুক্তিবলে কতকটা এবং নিজের অভিজ্ঞতায়ও কতকটা কয়েকদিনেই হামিদ বুঝিয়া উঠিল যে, সেবাকার্যের মতো অমন কঠোর কর্তব্য সাধন করিতে গেলে কর্মীদের দেহ জুৎসহ টেকসই রাখিবার জন্য ওসবের দরকার আছে। সে নিজে মানাইয়া লইবার চেষ্টা করিতে লাগিল; পারিলও কতকটা । সে দেখিল রিলিফ ফান্ডের টাকায় চৌদ্ধআনা কর্মীদের ভরণ-পোষণে ব্যয় হইতেছে। বাকী দুই আনায় মাত্র সেবাকার্য চলিতেছে। তবু সেবা-কার্যে আনাড়ি সে ইহার প্রতিবাদে সাহসী হইল না। কারণ হয়ত বা এমন না হইলে সেবাকাৰ্যই চলে না।
আগামী পর্বে সমাপ্য ........