প্রিয় মেঘ,
জানো,আজ অনেক বছর পর খুব রান্না বান্না করলাম।ছোট বোন বর নিয়ে বেড়াতে এসেছিল,গা ভর্তি নানান রঙের গহনা।দেখে মনে হচ্ছিল মেয়ের চাইতে গহনার ওজন অনেক বেশী।মেয়েরা বড় হতে হতে অনেক পাকনা হয় ,আর বিয়ে হলেতো কথাই নেই ;আদিখ্যেতার চূড়ান্ত।তবে আমার হাতেই বাড়তে থাকা খালাতো বোনের এই আধিখ্যেতা কিন্তু অনেক ভালো লাগছিল।না চাইতেও চোখ চলে যাচ্চিল নতুন যুগলের দিকে-আহা,আমার অদ্রিও বুঝি বিয়ে হয়ে গেলে স্বামীর সঙ্গে এমন ঢং করবে।দেখেই মনটা কেমন খুশীতে ভরে উঠছিল।আমি জামাইয়ের প্লেটে যাই দেই সে না না করে ,আর আমার বোন চোখ রাঙ্গিয়ে তাকে মুখে তুলে খাওয়ায়।আমি দেখেও না দেখার ভান করে মোবাইলে চোখ রাখি-ইশ,স্যারযে কেন এখনো আসছে না।জানতো ,কিছু ভালো মন্দ রান্না করলেই স্যারকে খেতে বলি।একা মানুষ,কাজের মেয়ের হাতে কি ছাই পাস যে খায়।দেখেই মায়া লাগে।তাই আজই বললাম রাতে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় খেয়ে যেতে।স্যার বললেন-সেন জোসেফে তিনি আজকের প্রধান অতিথি।অনুষ্ঠান শেষ করেই চলে আসবেন।সেই থেকে অপেক্ষা করছি,রাত হয়ে গেলে এ পথে আর সিটিং সার্ভিস চালু থাকে না।
টোনা টোনি খাওয়া শেষ করেই চলে গেল,নব দম্পতির খুব তাড়া ।আমি তাদের বাঁধা দিলাম না,কিছুক্ষনের মধ্যেই স্যার ঘরে ঢুকলেন।এক হাতে অদ্রির জন্য অনেক খাবার ,অন্য হাতে চমৎকার সন্মানী।বোঝাই যাচ্ছে বেশ বড় সড় প্রোগ্রাম সেড়েই এসেছেন,আমি হাতের খাবারগুলো দ্রুত সড়িয়ে রাখার চেষ্টা করলাম।কিন্তু অদ্রি ঠিকি ফক্স নিয়ে বসলো।এর আগেও স্যার ফক্স এসেছেন,সে রাতেও অদ্রি কিছুই খায়নি।এই চকলেট পুনর্বার আনতে স্যারকে আমি বহুবার বারন করেছি,কিন্তু তিনি আগের মতোই –ওহ সরি ,আর হবে না বললেন।আমি আইস্ক্রীমের বক্স উঠিয়ে রাখতে রাখতে দেখলাম ভেতরে ম্যাঙ্গো ফ্লেভার।গত এক বছরে স্যার বুঝতেই পারেননি আমার প্রিয় ফ্লেভার –ভ্যানিলা।কি আর করা,লোকটা এত কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন ফ্রীজেই থাক।খাবার শেষ হলে তাকেই দেব।এতো ভুলো মনা মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ কেমন করে নেন আমি বুঝি না,আরো অবাক লাগে কখোন জানো ? তিনি যখন গুনে গুনে বলে দিতে পারেন গত এক বছরে আমার সাথে তার কতো বার কোথায় কতো মিনিট দেখা হয়েছে।একদম ভুল হয় না সে সব ক্ষেত্রে ,কিন্তু আমি কি পছন্দ করি তা তিনি ঠিক করে বলতে পারেন না।আমি খুব আশ্বর্য হয়ে খাবার দিলাম টেবিলে।স্যার তখন ফুল ভলিউমে রাতের খবর দেখছেন,সেই একি খবর ।খুনীদের মধ্যে কাকে কাকে ধরা হয়েছে ,এই সব আর কি –যে খবরে জাতির কোন কিছুই আসে যায় না।আমি প্রশ্ন করলাম –রান্না কেমন হয়েছে?তিনি টিভির দিকেই তাকিয়ে উত্তর করলেন-খুব ভালো ,খুব ভালো।আমি অদ্রিকে খাওয়ানোর ব্যর্থ কৌশল করতে লাগলাম,মেয়ে মুখ থেকে চকলেটই ফেললো না।
রাত সাড়ে দশটা,আমি খুব তাড়া দিতে লাগলাম-স্যার এগারোটার পর মিরপুর রোডে আপনি আর ইতিহাস পাবেন না।এখন না বের হলে আটকে যাবেন।বলাই বাহুল্য,স্যারের হাতে রিমোট।তিনি ফুল ভলিউমে খবরের এন্ডিং দেখছেন,এই মুহূর্তে সেন জোসেফ স্কুলের খবর প্রচারিত হলো।আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম এবং বললাম-স্যার,এই জগত আপনার ভীষন প্রিয়।এই যে ছাত্র ছাত্রী এতো সন্মান।তাই না?
স্যার হেসে উত্তর দিলেন-না ,তেমন কিছু না।অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করে ।আমিতো সব প্রোগ্রামে যাই না।
মানুষের মনের মাঝখানে অসাধারনত্ব খুঁজতে গিয়ে আমি অমূলক কিছু খুঁজে পাই যা সম্পূর্ন অপ্রাসঙ্গিক।পুরো ক্যাম্পাস চোষে এমন ফেমাস টিচার দ্বিতীয়টি নেই।জানো,আমি বার বার তার মধ্যে ডুব দিয়ে ঘুরে আস্তে চেয়েছি।কিন্তু ওখানে আত্ব-মর্যাদার বিষবাষ্প ছাড়া তেমন কিছু আমাকে কেন স্পর্শ করে না-তা সত্যি বিস্বয় কর।
রাস্তার নেমে দেখলাম-শীত চলে এসেছে।আমার পাতলা ফিন ফিনে কাপড়ের ভাঁজ গলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের বাতাস এসে ঢুকে পড়ছে।ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হলো,তোমার বাহু জড়িয়ে ধরে হাঁটতে পারতাম।কিন্তু কি আশ্চর্য আমার পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে এমন মানুষ যার হাত পরম নিশ্চিন্তে আমাকে নিরাপত্তার ছায়া দেবে।হুড খোলা রিক্সার হৈমন্তী রাতে নির্ভরতার আকাংখা কেন যে তোমার বাহুতে সমর্পিত হতে চায় এ এক অদ্ভূত ব্যাপার।যদিও আমি জানি তোমার ও হাত এখানে থাকবার নয়।রাত বাড়ছে ,আর বেশি দূর যাওয়া আমার জন্য ঠিক না জেনেও এক রিক্সায় যাচ্ছি।ফিরতে হবে একা,আমি প্রশ্ন করলাম-স্যার ,আমি যে আপনার সাথে যাচ্ছি,আপনার কেমন লাগেছে।তিনি সেই বিখ্যাত হাসি দিয়ে বললেন-খুব ভালো।কিন্তু তুমি যাচ্ছো কেন?তোমার কি ওদিকে কোন কাজ আছে?আমি না সূচক মাথা নড়লাম।
আচ্ছা ,এই বেলা হলে তুমি কি করতে?আমাকে তোমার সাথে নিতে ?তারপর গাড়িতে উঠে আমাকে টা টা দিতে ।আমি অন্ধকার রাস্তায় একা একা বাড়ি ফিরতাম?নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে বাড়ির গেইট থেকেই বিদায় দিতে ,আমি কান্না কাটি করলেই সাথে নিতে না।কিন্তু স্যার আমাকে সাথে নিয়েই যাচ্ছেন,তার অর্থ এই না যে তিনি আমাকে কেয়ার করেন না।করেন,কিন্তু আমার সংগ তার ভালো লাগছে।অনিরাপদ শহরের চিন্তাটা মাথায় এলেও ,আমরা আমূলে নিচ্ছি না।আমি আবার বললাম-অদ্রি যখন কথা বলছিল আপনি তখন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জবার দেন নি কেন?এই ধরনের প্রশ্নে মানুষটা সত্যি হক চকিয়ে গেল,একটু ভেবে উত্তর করলেন-দিয়েছিতো,আমার সাথে ওর কতো খাতির।আমি ঠান্ডা গলায় বললাম-না ,ওর মুখের দিকে না ,আপনি খবর দেখতে দেখতে উত্তর দিয়েছেন।অদ্রির দিকে খেয়াল না করলে আমার খুব রাগ হয়।
তাকে এই ধরণের কথা বলার আসলে কোন কারন নেই।আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম-তুমি অদ্রির সাথে এই মুহূর্তে থাকলে কি করতে।অবশ্যই মা মা করে আদর করতে এবং ওর সাথে সব কিছুতেই হৈই হুল্লোর করতে।সব মানুষ বাচ্চাদের সাথে মেতে উঠতে পারে না,স্যার অদ্রিকে খুব ভালোবাসে কিন্তু যে টুকুন সময় থাকে তাকে কেবল চকলেট দিয়েই তার মন জয় করতে হয়।তুমি কি বুঝতে পারছো –আমি কি বলতে চাইছি।অদ্রিয়ানা তোমার কাছে যে নির্ভরতা পায় তা অন্য কারো কাছে পায় না। মানুষ ভুল করে ঠেকে শিখে।কিন্তু আমি ভুল পথে হাঁটছি,কেন জানো ?আমি বুঝতে চাইছি তোমার বিকল্প এই পৃথিবীতে কোন ভাবে গড়ে তোলা যায় কিনা।যে তুমি কো্টি কোটি মাইলে দূরে বসে এক অদৃশ্য সূতো দিয়ে এই আমাকে বেঁধে রাখো তা ছিন্ন করে আমি বের হবার পথ খুঁজছি যাতে তুমিও বেঁচে যাও,আমিও বেঁচে যাই।কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তুমি আমার পথ আগলে দাঁড়াচ্ছ।না,আমি কারো সাথে কারো তুলনা করতে চাইছি না,নিজেকেই পরীক্ষা করছি-কি আমি চাই।
রাত সাড়ে এগাড়োটা,রাস্তা এখন অনেকাংশেই নীরব।দশ নম্বর গোল চক্করে রিক্সার আওয়াজ কমছে,আমি দাঁড়িয়ে আছি।কেউ রূপনগর আসতে চাইছে না।আমার যে ভয় করছে না তা না ।ভয় করছে,কিন্তু নিজেকে আমি জয় করতে পারছি।অনেক বলে কয়ে একটা রিক্সায় হুড তুলে বোসলাম,আমি কোন টাকা নিয়ে বের হইনি ।স্যারের কাছে ভাড়া চেয়ে নিয়েছি,এই মানুষটাকে যদি আমি বলতাম-আমার খুব বিপদ ,এক্ষনি লাখ খানেক টাকা লাগবে।তিনি আমাকে কার্ড ঘষে হলেও নিজের একাউন্টের সব টাকা উজার করে দিতেন,স্যার এমনি।কিন্তু,তিনি যাবার সময় একবারো বলেন নি-তুমি রিক্সা নাও,আমি পরে বাসে উঠবো।কি অদ্ভূত তাই না?সব মানুষ এক হয় না-এটাই সত্য।।আমরা ঠিক যাকে যে ভাবে চাই সে সেই ভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয় না।আর যে কিনা অবহেলার তীব্র আলোক বর্ষ দূরত্বে রেখে ঘুরে বেড়ায় তার জন্যেই মন কেমন করে।
ঠিক তাই মেঘ।আমার মন কেমন করছে তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা আমি দিতে পারবো না।কেবলি মনে হচ্ছে-আর একটি পৌষ আমাকে একা কাটাতে হবে।জোর করে মিলে থাকার চেষ্টা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে।তুমি আমাকে ঠেলে ঠুলে আর ও পথে তাড়িত করো না।এইতো ভালো আছি,তোমার ভাবনা আর স্মৃতির অবিনশ্বর মেল বন্ধনে।অপেক্ষা করছি কোন এক ম্যাজিকের জন্য।হয়তো তুমি একদিন ফিরবে সত্যিকার ভালোবাসার কাছে পরাধীন হয়ে।একবার হলেও আমার হাত ধরে বলবে-তোমার হাত এতো ঠান্ডা কেন?আমি কেবল ওই টুকুর জন্যই অপেক্ষায় থাকবো ...
তোমার নীলা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:২৮