নীরবের গায়ে একটা বেশ পুরানো লাল শার্ট। এই শার্ট টা ওর বেশ প্রিয়।লাল রঙয়ের মধ্যে কালো সুতার ডাবল বর্ডার দেয়া। পুরানো হলেও বিশেষ কোন দিনে ও এই শার্ট টা পরে। গত ছ্য় মাস ওর উপর দিয়ে ভালো চাপ গেছে। ক্যানাডার ভিসা পাওয়া তো এতো সহজ না। প্রায় সময় দৌড়ের উপর ছিলো।আজ এক সপ্তাহ হলো ওর ভিসা হয়েছে । আর এক সপ্তাহ পর ওর ফ্লাইট।
এ সময় টা বন্ধুদের নিয়ে বেশ আড্ডা দিয়ে আর মজা করে কাটাচ্ছে। আজ হচ্ছে পরিচিত যত মেয়ে বান্ধবী আছে তাদের সাথে বসুন্ধরা সিটি তে দেখা করার শিডিউল।তার মানে সবাইকে খাওয়াতে হবে।
সকাল ১০টা সময় সবাই বসুন্ধরা সিটির ৭ তলায় থাকবে বলে ঠিক হলো। নীরব সেই লাল শার্ট আর একটা জিন্স পরে হাজির হলো প্রিফিয়া কে নিয়ে
এখন সকাল ৯.৩০ বাজে...
প্রিফিয়া ওদের বান্ধবী দের একজন। বাসা শনির আখড়া। ইডেন কলেজে ইকোনমিক্স এ পড়ছে। নীরব থাকে মধ্য বাড্ডায়। নিরব ৬ নাম্বার বাস এ করে লিংক রোড থেকে সোজা ফার্মগেট ৩ নাম্বার ওভার ব্রীজের নিচে নামল। আগেই প্রিফিয়ার সাথে নীরবের কথা হয়েছিলো যে, প্রিফিয়ার জন্য এই ওভার ব্রীজের নিচে অপেক্ষা করবে। নীরব বাস থেকে নামা মাত্রই ঝির ঝির বৃষ্টি শুরু হলো। বেশ খানিকটা সময় প্রিফিয়ার জন্য অপেক্ষা করার পর একটা শনির আখড়ার একটা বাস এসে থামল।আর নীরবের অপেক্ষার অবসান ঘটল।সোনালী ড্রেস পরা প্রিফিয়া নামল। দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো স্বর্গের অপ্সরী।
-এই নীরব
-নীরবের ঘোর কাটলো
-আরে তোর আসতে কোনো সমস্যা হয়নিতো?
-আরে না !
এতক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে নীরবের শার্ট আধো ভিজে গেছে আর প্রিফিয়া কে দেখে এখন হ্রদয়ে শ্রাবন ধারা শুরু হয়ে গেছে। নীরব বলল.............
-চল হাটি
-রিকশা নিবি না?
-এখান থেকে রিকশা যায় না
-কেনো?
-নিয়ম নেই, ওভার ব্রীজ দিয়ে ওপারে যেতে হবে
-ভিজে যাবো তো
-কেনো ভিজতে তোর ভালো লাগে না
-হ্যাঁ লাগে, কিন্তু নতুন জামা
-আরে বাদ দে, আজ আমার জন্য না হয় একটু ভিজ
-আমি কি তোর প্রেমিকা নাকি?
-একদিনের জন্য হলে সমস্যা কি!
-ক্যানাডার ভিসা পেয়ে কি হলো তোর? পুরা রোম্যান্টিক হয়ে গেলি
-ও কিছু না...মজা করছিলাম... চল হাটি..
ওরা দু জন হাঁটা শুরু করলো। প্রিফিয়া একটা সিগারেট ধরাই। সমস্যা নেই তো। আরে না । বৃষ্টি দেখলেই নীরবের সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।সিগারেট ধরিয়ে মনে মনে বলতে লাগল, প্রিফিয়া আজ একদিনের জন্য আমার প্রেমিকা হবে। আর তো প্রেম করতে পারব না। বিদেশ গেলে আর প্রেম করা হবে না। আসলে একবারে বিয়ে করতে হবে।
কিন্তু পরে কি যেনো চিন্তা করে আর বলা হয়ে উঠল না। সিগারেটের টান টান দিতে সোনালী আভায় জড়ানো পাশের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এই বাদলা দিনে ওর কদম ফুলের কথা মনে পড়ল। প্রিফিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে, যেনো নতুন জামায় কাদা না লাগে। এই সুযোগে নীরব বেশ নীরবেই পাশা পাশি হেঁটে চললো।
পান্থপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিশাল এক অট্টালিকা। এর নাম বসুন্ধরা সিটি। যেখানে নানান জাতের নানান মানুষ নানা কারনে ভীড় জমায়। প্রিফিয়া আর নীরব লিফট দিয়ে ৭ তলায় উঠল।
ওদের পাশে দাঁড়িয়ে জান্নাত, মিথি আর রত্না। অনেকদিন পর আবার সবাই স্কুল এর সেই দিন গুলির মত একসাথে। ভাবতেই অবাক লাগে, কিভাবে যেন দিনগুলি কেটে গেলো। রামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়। বেশ নামকরা মফস্বলের এক স্কুল।
যাই হোক বাস্তবে ফিরে এলো নীরব। সবাই একটা খাওয়ার দোকানে বেশ খানিক্ষন আড্ডা,খাওয়া-দাওয়া আর স্মৃতি রোমন্থন করে কাটালো। তারপর খাওয়া শেষে ওরা শপিং সেন্টার টা চক্কর দিবে বলে ঠিক করল। দেশি দশ তখন নতুন খুলেছে।সবাই মিলে ঢুকল। এখনও প্রিফিয়া আর নীরব পাশাপাশি হাঁটছে। নীরবের চুলগুলো ভিজে আছে,আর শার্ট টা ও ভিজে আছে খানিকটা, দুই হাতা কনুই পর্যন্ত উঠানো, নির্ঘুম গভীর দু চোখ, সিগারেটে পোড়া দু ঠোঁট, আর পাশে সোনালী সজ্জায় স্বর্গীয় অপ্সরী। এরই মাঝে ক্লিক ক্লিক, কে যেনো ছবি তুলল ,ওদের দুজনের। নীরব খুজে বের করার চেষ্টা করেও পেলো না। না, তাকে গালিগালাজ করার জন্য নয়,ছবিটা কালেকশন এ রাখার জন্য। ঘুরাঘুরি শেষে, সবাই নীরব কে ভালো থাকিস ফেসবুকে কথা হবে, এই বলে বিদায় দিলো হাসি মুখে। প্রীফিয়া রয়ে গেলো। একসাথে বাস স্টপেজ এ যাবে বলে। নীরব বলল,বাসায় যাবি না অন্য কোথাও?
-না,খিলগাঁও...
-কেনো?
-এক বান্ধবীর কাছ থেকে একটা নোট আনতে হবে !
-আমি গেলে সমস্যা আছে......।
-আরে না
-তুই গেলে আরো ভালো হয়
-তাহলে চল
ওরা একসাথে বাসে উঠলো। যেতে যেতে অনেক কথা হলো। ট্র্যাফিক জ্যাম টা ও তখন আশীর্বাদ মনে হলো। বিদেশ যাওয়ার আগে এই শহর আর এই দেশটার প্রতি কেমন যেন মায়া অনুভব করল নীরব। বেশ কোলাহলময় আর প্রানময় এক শহর ।এত সমস্যার মধ্যেও মানুষ গুলো একটু সুখের জন্য কি কষ্ট টাই না করছে। এবার প্রিফিয়ার প্রশ্নে নীরবের দেশ নিয়ে ভাবনার ঘোর কাটল। ও শুরু করল........
-পড়াশোনা শেষ করে কি ঐ দেশেই সেটেল হবি?
-না, দেশে ফিরে আসব
-সবাই এমন ই বলে
-কিন্তু আর ফিরে আসে না
-নীরব শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবালের কথা টেনে আনে-
-সবাই কি আর জাফর ইকবাল, ওরকম হাতেগোনা দু একজন
-তোর কি প্ল্যান? পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবি না বিয়ের পিড়িতে বসবি?
-না, চাকরি করব, বিসিএস ট্রাই করব
-সবাই এমনি বলে, কিন্তু পরিবার আর সমাজের চাপে বিয়ে করে সংসার করতে হয়
-আরে না, আমি দেশ আর দেশের মানুষের জন্য কিছু করব...।
কথায় কথায় বাস খিলগাঁও রেল গেটে চলে এলো, এখান থেকে রিক্সায় করে যেতে হবে, প্রিফিয়ার বান্ধবীর বাসায়। ওরা একটা রিকশা নিলো। এই প্রথম রিক্সায় কোনো মেয়ের সাথে উঠল নীরব। বেশ জুবথুবু হয়ে বসল। বেশ চুপচাপ ই ছিলো নীরব রিক্সায়। রাস্তা ভাঙ্গা চুরা থাকায় বার বার ঝাক্কি খাচ্ছিলো আর তাতেই নীরবের কাঁধের সাথে প্রিফিয়ার কাঁধ ধাক্কা খাচ্ছিলো।
বেশ লাগছিলো নীরবের আর কিছুটা লজ্জা ও পাচ্ছিলো। অবশেষে প্রিফিয়ার বান্ধবীর বাসায় পৌছালো । বান্ধবীকে না পেয়ে ফিরে আসল। এরপর কি করা যায় চিন্তা করল ওরা দুজন।
দুপুর হয়ে এসেছে। প্রিফিয়া চল ,
-বেইলি রোডের দিকে যাই
-কেনো শাড়ি কিনে দিবি
-আরে না , লাঞ্চ করাব
-আচ্ছা চল
আবার রিক্সায় উঠল ওরা।এবার সূর্যের সোনালী আভা টা ওর সোনালী ড্রেসের উপর পড়ে চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে যেন মরুর দেশের রানী।বেশ লাগছিলো। বেইলি রোড কাছেই ছিলো। ২০ মিনিট পরেই চলে এলো। নীরব জিজ্ঞাসা করল......।
-কি খাবি?
-আমার খুব পিজ্জা খেতে ইচ্ছে করছে
-আচ্ছা চল
-আমি খাওয়াবো
-ওকে
ওরা দুজন মিলে পিজ্জার দোকানে ঢূকে একটা বারবিকিউ চিকেন পিজার অর্ডার দিলো। দুজন গিয়ে বসল এক কর্নারে । প্রিফিয়া ব্যাগ থেকে কি জেনো একটা বের করল। এই নে লাইটার। বেশ সুন্দর একটা লাইটার গিফট করল।
-সিগারেয় ধরানোর জন্য
-হ্যাঁ
-আমি ভাবলাম আবার বলবি, সিগারেট ধরানোর জন্য না, ক্যান্ডেল জ্বালানোর জন্য
-আরে না,তোকে সিগারেট ধরাতে দেখতে আমার ভালো লাগে
-তাই নাকি, তোকে বউ বানাতে পারলে ভালো হতো
-কেনো
-সিগারেট টানতে না করতি না
এর মধ্যে অর্ডার চলে আস্লো।আরও বেশ খানিক্ষন কথা হলো। নীরব ওর চোখের দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে ছিলো একদৃষ্টিতে। ও বললো, এই কি দেখছিস?কিছু না, তারপর ও বিলটা দিতে ঊঠল, নীরব না করে ও পারলো না।
এখন যাবার পালা।এই অনেক দেরী হয়ে গেলো।বাসায় যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমি নামিয়ে দিয়ে আসি। আরে না। গোধূলি বেলা আর ওর সোনালী ড্রেসের সোনালী আভাটা যখন ওর গালে ছড়াচ্ছিলো, নীরবের ইচ্ছে করছিলো হাতটা ধরে ওর মায়াময় চোখের দিকে তাকিয়ে বলে.........।
না আর বলতে পারলো না।
-তোকে বাস স্টপেজ পর্যন্ত নামিয়ে দেই-
-ওকে, দোস্ত ভালো থাকিস, ফেসবুকে যোগাযোগ রাখিস
-তুইও
নীরব ওর লাইটার টা দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। এখনও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কি অদ্ভুত মিল আজ দিনের শুরুতেও বৃষ্টি ছিলো আর এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। আর লাল শার্ট টা আবার ভিজে যাচ্ছে, না নীরবের কান্নায় না,
না পাওয়ার বেদনায় না, অদ্ভুত স্বপ্নময় এক ভালো লাগার প্রহর এর নীরব
সমাপ্তিতে।তবুও নীরবের নীরবতা ভাঙ্গাতে পারল না কেউ।
একটু পর ,দূ জন ই চুপ হয়ে গেলো। কোনো এক বিষন্নতা যেনো ওদেরকে বোবা করে দিলো। শনির আখড়ার বাস টা এসে মালিবাগ মোড়ে থামল। প্রিফিয়া উঠে পড়ল। নীরব তাকিয়ে রইল একরাশ নীরবতা নিয়েই।
সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে দেখলো বাস ছেড়ে দিয়েছে আর প্রিফিয়া জানালা দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে।আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো সেই হাত.... আর নীরবের হাতে আঙুলে তখন আরেকটি সিগারেট এর জন্ম।
আজকের সূর্যটার মত নীরবের জীবনে সোনালী আভার মেয়েটাও ডুব দিলো। পার্থক্য এটাই কাল সকালে আবার সূর্য ঊঠবে কিন্ত নীরব জানে না তার জীবনের সোনালী রংটা আর কোনদিন ফিরবে কি না.....................
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৬