দক্ষিণের শহর আর গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে আসছিলো। খবরটা শুনে মে মাসের প্রথম থেকেই গ্রামের লোক আরো উত্তরে শালবনের দিকে সরে যেতে লাগলো। অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে কুচবিহার আর পশ্চিম দিনাজপুরে চলে গেলো।
সীমান্ত বেশি দূরে নয়। অনেকে ওপারে গিয়েও নিয়মিত যাওয়া আসা করছিলো। জুনের মাঝামাঝি যখন সবাই নদীর ওপারের ছোট্ট শহরটাকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখলো, তখন যারা যাবার তারা একেবারেই চলে গেলো। থেকে গেলো জামাত, মুসলিম লীগের কিছু দালাল আর কয়েকজন বুড়ো। গির্জার ঘন্টা টানতো বুড়ো ডেসমন্ড ডি রোজারিও। সে ছিলো থেকে যাওয়া বুড়োদের একজন।
এতোদিন ফাদার মার্টিন ছিলেন গির্জায়। যশোরে পাঞ্জাবীরা মিশনারিদের মেরেছে এই খবর শুনে তিনিও কিছুদিন আগে শহরে চলে গেছেন। বুড়ো ডেসমন্ডকে ডেকে বলেছিলেন, উহারা মিশনারিদিগকেও হত্যা করিতেছে। আমি শহরে যাইতেছি। তুমি বিপদ দেখিলে ইন্ডিয়া চলিয়া যাইও। ইন্ডিয়ার মানুষ আমাদের অসহায় মানুষদিগকে আশ্রয় দিয়াছে। ঈশ্বর উহাদের মঙ্গল করিবেন। এই বলে ফাদার বুকে ক্রস এঁকেছিলেন।
বুড়ো ডেসমন্ড মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে কাটতে জবাব দিয়েছিলো মুই আর কুণ্ঠে যাবেক ফাদার।
অনেক ভেবেছিলো ডেসমন্ড বুড়ো। আসলে সে যাবেইবা কোথায়! তার স্বজাতি সাঁওতালরা যখন সেখানে খুশি অনায়াসে চলে যেতে পারে। ওদের রক্তের সকল অণুতে মহুয়ার মতো মিশে আছে যাযাবরের নেশা। কিন্তু ডেসমন্ডের সেই নেশা কেটে গেছে বহু বছর আগে। নিজেকে এখন মনে হয় ঝুরি নামানো বুড়ো বটগাছের মতো, সারা গ্রামে যার শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামে যখন এই গির্জা প্রতিষ্ঠিত হলো, ডেসমন্ড তখন বারো বছরের বালক। পাদ্রী ছিলেন ফাদার নিকোলাস। তিনিই ডেসমন্ডকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন–প্রভুর স্থান ছাড়িয়া কোথাও যাইও না। প্রভু তোমাকে রক্ষা করিবেন।
সেই থেকে ডেসমন্ড এই গির্জায় পড়ে আছে। গির্জার পাশে সবুজ ঘাসের আঙিনা। দেয়ালের ওপাশে সারি সারি কবর। সবুজ আঙিনা আর কবরের মাঝে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের গায়ে লাগানো ছোট্ট দু’টো ঘর। ছাদটা লাল টালির। দেয়ালগুলো সাদা চুনকাম করা। এই ঘর দুটো ডেসমন্ডের। সারাদিন সে এখানেই থাকে, আর গির্জার ঘন্টা বাজায়। ওর মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র কাজের দায়িত্ব প্রভু ওকেই দিয়েছেন।
আগে ডেসমন্ড সকালে গির্জার বাগানে কাজ করতো। গির্জার ভেতরের ঝাড়ামোছাগুলো শেষ করে রাখতো। বিকেলে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতো। প্রভু ছোটদের ভালোবাসতেন। বহুদিন বাইবেল থেকে ফাদাররা পড়ে শুনিয়েছেন, যীশু কহিলেন, শিশুদিগকে আমার নিকট আসিতে দাও। বারণ করিও না। কারণ স্বর্গরাজ্য এইমত লোকদেরই।”
প্রায় জনশূন্য গ্রামগুলোতে মানুষের সাড়াশব্দ একেবারেই নেই। দু’একজন বুড়ো, যারা এখনো গ্রামে আছে, তারা ছোটদের মতো সারা গ্রাম মাতিয়ে রাখতে পারে না। বুড়ো ডেসমন্ডের বুকে শুধু যন্ত্রণার ঢেউ উত্তাল হয়। নিবির দাদু, হরিপদের খুড়ো যখন এসে শহরে শত্রু সৈন্যদের অত্যাচারের কথা বলে, ডেসমন্ড তখন বুকে জমে থাকা কান্না থামিয়ে রাখতে পারে না।
সারাটা জুলাই মাস বুড়ো ডেসমন্ড একা একা কাটালো। বাগানের কাজে আগের মতো উৎসাহ পেতো না। তবু সকালটা গির্জার কাজে ব্যস্ত থাকতো। বিকেলগুলো ওর কাছে ভয়াবহ মনে হতো। গ্রামের সেই উচ্ছল ঝর্ণার মতো ছেলেমেয়েগুলো কোন শয়তানের যাদুবলে কোথায় কীভাবে যে হারিয়ে গেলো–ডেসমন্ড যতো ভাবে ততো তার বুকে দুঃখের পাহাড় জমে। গির্জার প্রাঙ্গণে কতগুলো শিরিষ গাছ ছিলো। অন্য সময়ে গাছগুলোতে রঙবেরঙের পাখির মেলা বসতো। এখন পাখিরা আর শিরিষের ডালে গান গেয়ে ছুটোছুটি করে না। আঙিনার সবুজ ঘাসের কার্পেটে প্রজাপতিরা নানা রঙের নকশা আঁকে না। শিরিষের পাতা গলিয়ে বিকেলের মরা রোদ গির্জার গায়ে জড়িয়ে থাকে। বিশাল এক শূন্যতা সারা গ্রাম জুড়ে হা হা করে কাঁদতে থাকে। বাতাসকে মনে হয় কোনো ডাইনীর অভিশাপের নিঃশ্বাস। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বুড়ো ডেসমন্ড শুধু ছটফট করে। ভাবে ঈশ্বর কেন ওকে এই নরকে ঠেলে দিলেন!
যখন সময়গুলো একেবারেই অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন ডেসমন্ড জানালার তাকের ওপর থেকে, ফাদার গাঙ্গুলীর দেয়া মথি লিখিত সুসমাচার’খানা নামিয়ে আনে। ভালো মতো পড়তে পারে না ডেসমন্ড। চোখে ঝাঁপসা দেখে। তবু কোনো রকমে বানান করে জোরে জোরে পড়ে–ইতিমধ্যে পিতর বাহিরের প্রাঙ্গণে বসিয়াছিলেন। আর একজন দাসী তাঁহার নিকটে আসিয়া কহিল, তুমিও সেই গালীলীয় যীশুর সঙ্গে ছিলে । কিন্তু তিনি সকলের সাক্ষাতে অস্বীকার করিয়া কহিলেন, তুমি কি বলিতেছ আমি বুঝিতে পারিলাম না। তিনি ফটকের নিকট গেলে আরেক দাসী তাঁহাকে দেখিয়া সেস্থানের লোকদিগকে কহিল, এ ব্যক্তি সেই নাযারথীয় যীশুর সঙ্গে ছিল। তিনি আবার অস্বীকার করিলেন, দিব্য করিয়া কহিলেন, আমি সে ব্যক্তিকে চিনিনা। অল্পক্ষণ পরে যাহারা নিকট দাঁড়াইয়াছিল তাহারা আসিয়া পিতরকে কহিল, সত্যই তুমি তাহাদের একজন। কেননা তোমার ভাষা তোমার পরিচয় দিতেছে। তখন তিনি অভিশাপপূর্বক শপথ করিয়া বলিতে লাগিলেন আমি সে ব্যক্তিকে চিনিনা। তখনই কুকুড়া ডাকিয়া উঠিল। তাহাতে যীশু এই যে কথা বলিয়াছিলেন, কুকুড়া ডাকিবার পূর্বে তুমি তিনবার আমাকে অস্বীকার করিবে, তাহা পিতরের মনে পড়িল। এবং তিনি বাহিরে গিয়া অত্যন্ত রোদন করিলেন।”
ডেসমন্ড যতোবার বাইবেল পড়ে যীশুখৃস্টের ক্রসবিদ্ধ হবার ঘটনার কথা ভাবে, ততোবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। তবু সে জোরে জোরে বাইবেল পড়ে। ওর মনে হতো বাইবেলের পবিত্র শব্দগুলো, শয়তানের মতো ভয়ঙ্কর নিরবতাকে তাড়া করে ফিরছে। গির্জার প্রাঙ্গণে অন্ধকার নামা পর্যন্ত ডেসমন্ড বাইবেল পড়ে। নিরবতাকে ও ভয় করে, একই সঙ্গে ঘৃণাও করে।
আগস্টের শেষে এক বৃষ্টিভেজা রাতে ওরা কয়েকজন এলো বুড়ো ডেসমন্ডের ঘরে। হারিকেনের ম্লান আলোয় ডেসমন্ড তখন গির্জার আইকন পরিষ্কার করছিলো। দরজায় হালকা পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো। দেখলো তিনটি ছেলে, বৃষ্টিতে ভেজা সারা শরীর, চুলের ডগা বেয়ে মুক্তোর দানার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। ওদের উজ্জ্বল চোখগুলো হারিকেনের ম্লান আলোতেও চকচক করছিলো। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ডেসমন্ডের মনে হলো, ওরা যেন তিনজন দেবদূত, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। তারপর সে এতো বেশি অভিভূত হয়ে গেলো যে, আর কোনও কথাই বলতে পারলো না।
ওরা তিনজন একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। একজন একটু হেসে বললো, আমরা আজ রাতে তোমার এখানে থাকবো ডেসমন্ড দাদু।
আরেকজন বললো, তোমাদের গায়ের দাশু খুড়ো বলেছে, তুমি খুব ভালো লোক।
স্বর্গের দেবদূত ওর কাছে এসেছে, ওর ঘরে থাকতে চাইছে ডেসমন্ড কী বলবে সহসা কিছুই ভেবে পেলো না। তারপর এলোমেলো ভাবে বললো, হায় হায়, থাকতি কেনে দিবেক নেই। তোমাদের কষ্ট হতিছে বাছা। আগুনের ধারে বস। সব ভিজ্যে গেছে।
হাতের ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রেখে ওরা ছোট্ট উনুনটির পাশে গিয়ে বসলো। বললো, দাশু খুড়ো তোমার কথা অনেক বলেছে ডেসমন্ড দাদু। বলেছে, তুমিই আমাদের সাহায্য করতে পারো। তোমার মতো ভালো লোক এ গায়ে আর নেই।
বিরাশী বছরের বুড়ো ডেসমন্ড লজ্জায় লাল হলো। স্বর্গের দেবদূত ওকে একি কথা শোনাচ্ছে! মাথা নেড়ে বললো, না না, সেটি ঠিক বুলে নাই। সাহাইয্য লিচ্চয়ই করিব। ঈশ্বর তুমাদের মঙ্গল করিবেন।
অনেক রাত অবধি বুড়ো ডেসমন্ডের সঙ্গে ওদের কথা হলো। ডেসমন্ডের মনে হলো, দেবদূতরা ওর জন্যে স্বর্গের বাণী বয়ে এনেছে। ওরা জানে, শিরিষ গাছে পাখিরা কেন গান গায় না, ঘাসফুলের প্রজাপতিরা কেন আর আসে না, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দের শব্দ আর রঙ কোথায় হারিয়ে গেছে। ওরা আনন্দের হারিয়ে যাওয়া শব্দকে ফিরিয়ে আনবে। শয়তানের বিষাক্ত যন্ত্রণার ছায়া পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দেবে। শিরিষের ডালে আবার পাখিরা গান গাইবে। মুগ্ধ হয়ে ডেসমন্ড ওদের কথা শোনে। ওর ঘোলাটে চোখে আনন্দ নেচে বেড়ায়। বার বার বলে, ঈশ্বর তুমাদের মঙ্গল করিবেন।
স্বর্গের দেবদূত হাসতে হাসতে ওকে বলে, তোমাকে আমরা শিখিয়ে দেবো কি করে গ্রেনেড মারতে হয়, আর রাইফেল চালাতে হয়।
আনন্দে উত্তেজনায় ডেসমন্ড শুধু বলে, লিচ্চয়ই, লিচ্চয়ই।
এরপর দিনগুলো যে কীভাবে কাটলো ডেসমন্ড বুড়ো আর হিসেব রাখতে পারলো না। স্বচ্ছ সরোবরে হাঁসের মতো তরতর করে সময় বয়ে যেতে লাগলো। সকালে লাঠিতে ভর দিয়ে ও নদীর তীর অবধি চলে যায়। কোনোদিন আবার একেবারে শহরে ঘুরে ঘুরে সব দেখে আসে। পাহারারত পাঞ্জাবী সৈন্যরা কেউ ওকে উপেক্ষা করে, কেউ রসিকতা করে। রাতে দেবদূতের দল আসে ওর কাছে। সারা ঘর আলো হয়ে যায়। ওর কানে গির্জার প্রার্থনা সঙ্গীত বাজতে থাকে। ওদের সঙ্গে ওর কথা হয়। তারপর গভীর রাতে ওরা চলে যায়। দূরে শহরে বিস্ফোরণের শব্দ হয়। মেশিনগান গর্জন করে, আবার কোথাও গ্রেনেড ফাটে। গভীর আনন্দ আর উত্তেজনায় ডেসমন্ড ডুবে যায়। একটা গ্রেনেডের শব্দ একশটা হয়ে ওর কানে গির্জার ঘন্টার মতো বাজতে থাকে। ডেসমন্ডের চোখে আর ঘুম নামে না। শেষ রাতে ওরা এসে বলে, আমরা যাচ্ছি। ভালো থেকো ডেসমন্ড দাদু। আবার দেখা হবে।
ওরা চলে যাবার পর আবার শয়তানের মতো কদাকার সেই নিরবতা ডেসমন্ডকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়। লাঠিতে ভর দিয়ে ও গ্রামের ভেতরে যায়। হরিপদর খুড়ো অনেক দিন ধরে বাতের ব্যথায় কষ্ট পাছে। কটা আকন্দ পাতা তুলে নিয়ে হরিপদর তালা বন্ধ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকে, হরিপদর খুড়ো ঘরে আছো? ও হরিপদর খুড়ো? কেউ কোনো সাড়া দেয় না।
আরেকটা শেকল তোলা দরজার সামনে গিয়ে ডেসমন্ড ডাকে, নিবির দাদু? ও নিবির দাদু?
উঠোনের কোণ থেকে হাড় বের করা একটা লোমঝরা কুকুর শুধু একবার মাথা তুলে ওকে দেখে। গ্রামের সবাই চলে গেছে। ভীষণ ভয় পায় ডেসমন্ড। লাঠিতে ভর দিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে আবার গির্জায় ফিরে আসে। অসময়ে গির্জার ঘন্টা বাজায়। ডেসমন্ডের মনে হয়, শব্দের অভাবে ও বুঝি পাগল হয়ে যাবে।
কখনো নদী পেরিয়ে ওপারের গ্রামে চলে যায় ডেসমন্ড। সেই গ্রামের অনেকে ওকে চেনে। এখনো সবাই গ্রাম ছেড়ে যায়নি। ভেবেছিলো পাঞ্জাবীরা বুঝি এতো ভেতরে আসবে না। ওরা ডেসমন্ডকে বলেছিলো একা গির্জায় পড়ে না থেকে ওদের গ্রামে এসে থাকতে। ম্লান হেসে ডেসমন্ড মাথা নেড়েছে। ও জানে শেকড় উপড়ে ফেললে গাছ বাঁচে না।
এক রাতে ডেসমন্ড দেখলো নদীর ওপারের ছোট্ট গ্রামটাও দাউ দাউ করে জ্বলছে। অসহায় মানুষের কান্না আর আর্তনাদের আবছা শব্দ ভেসে আসছে বাতাসে। ডেসমন্ড কি করবে কিছুই ভেবে পেলো না। গির্জার ভেতর ছুটোছুটি করলো ফাঁদে আটকা পড়া ভয় পাওয়া ইঁদুরের মতো। কখনো যীশু খৃস্টের মূর্তির সামনে নতজানু হয়ে হাত জোড় করে বিড় বিড় করে কি যেন বললো। কখনো আবছা আর্তনাদের শব্দে ও ছিটকে বেরিয়ে এলো। ওর চোখের সামনে ঘর বাড়ি জ্বলছে, গাছ পালা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, মানুষ মরছে। ওর বুকের ওপর হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন পেরেক ঠুকছে, হাতে পায়ে পেরেক ঠুকে ওকে ঝুলিয়ে দিচ্ছে ক্রুসকাঠে।
সারা রাত ডেসমন্ড কাঁদলো। ওর কান্নায় রাতের অন্ধকার গলে গেলো। গ্রামের আগুন নিভে গেলো। সূর্য ওঠার আগে ডেসমন্ড লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেলো সেই গ্রামে।
ও জানতো গ্রামের একজন মানুষও বেঁচে নেই। শয়তানরা এভাবেই গরিব দুঃখী মানুষদের মেরে ফেলে। চারপাশে ও তাকিয়ে দেখলো শুধু লাশ আর লাশ। তখনো কোথাও কয়লার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে। বাতাসে লাশের পোড়া গন্ধ। বুড়ো করমআলীর ছোট নাতনিকে একটা কাপড়ের পুতুল কিনে দিয়েছিলো ডেসমন্ড। তাকিয়ে দেখলো পোড়া ঘরের নিচে চাপা পড়েছে ওরা সবাই। কেউ বেঁচে নেই। করমালীর নাতনির হাতে ধরা পুতুলটাও পুড়ে গেছে।
ওরা এভাবে পড়ে থাকলে ওদের শেয়াল, কুকুর আর শকুন টেনে ছিঁড়ে খুবলে খাবে। ডেসমন্ড ঠিক করলো সবাইকে কবর দেবে ও। সবার জন্য প্রার্থনা করবে ঈশ্বরের কাছে। ঈশ্বরের কাছে সব মানুষই সমান।
কোদাল আনার জন্য গির্জায় যাচ্ছিলো ডেসমন্ড । হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। কৃষ্ণচুড়া গাছের আড়ালে বসে আছে ছোট্ট একটা মেয়ে। ডেসমন্ডের মনে হলো বুঝি ও চোখে ভুল দেখছে। চোখ কচলে আবার দেখলো। মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে বসেছিলো নদীর দিকে মুখ করে। যেন কেউ আসবে ওকে নিতে।
পায়ে পায়ে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলো ডেসমন্ড। ওর পায়ের শব্দ শুনে চমকে তাকালো মেয়েটা। নরম গলায় ডেসমন্ড জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে?
মেয়েটা কোনো কথা বললো না। ওর দু’চোখে পৃথিবীর সব ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। ডেসমন্ড আরো নরম গলায় বললো, তুমার নাম কী?
মেয়েটা কথা বলতে চাইলো, পারলো না। ডেসমন্ডের ভীষণ কষ্ট হলো। মেয়েটার পাশে বসে ওকে কাছে টেনে আদর করে আবার বললো, তুমার নাম কী গো মা?
মেয়েটা কথা বলতে চাইলো। আঁ-আঁ শব্দ হলো। মাথা নাড়লো সে।
ডেসমন্ডের বুকটা কেঁপে উঠলো–তুমি কথা বুইলতে পারো না? বলে মেয়েটাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলো। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলো। ডেসমন্ডের সঙ্গে বোবা মেয়েটাও কাঁদলো।
মেয়েটাকে ওর ঘরে রেখে সারা দিন ধরে ডেসমন্ড পাশের পোড়া গ্রামে কবর খুড়লো। এক এক করে সবাইকে কবর দিলো। গির্জায় অনেক মোমবাতি ছিলো। রাতে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে কবরগুলোতে মোমবাতি জ্বেলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো। ডেসমন্ড জানে শয়তানের হাতে যারা মারা যায় স্বর্গ তাদেরই জন্য।
কয়েকদিন পর আবার ছেলেরা এলো। ডেসমন্ড ওদের বললো বোবা মেয়েটাকে ও কীভাবে কুড়িয়ে পেয়েছে। ছেলেদের নরম চেহারা কঠিন হয়ে গেলো। বললো, আমরা জানি পাকিস্তানী সৈন্যদের কারা গ্রামের পথ চিনিয়ে দিয়েছে। ওদের কাউকে আমরা ক্ষমা করবো না।
যাবার আগে ওরা সবাই মেয়েটাকে আদর করলো। ডেসমন্ডকে বললো, যেদিন আমাদের দেশ স্বাধীন হবে সেদিন ও কথা বলবে।
ডেসমন্ড হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো। বললো, তুমরা কুন চিন্তা কইরো না। উরে আমি কথা শিখামু।
শেষ রাতে ডেসমন্ড দূরের শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনলো। ওর বুকের ভেতরটা হালকা মনে হলো। মেয়েটাকে সকালে বললো, মা, আর কুন ডর নাই।
ডেসমন্ড ভেবেছিলো শয়তানের দল বুঝি শহর ছেড়ে চলে গেছে। রাতে আকাশ হঠাৎ করে লাল হয় না। গুলির শব্দও শোনা যায় না। শেষ রাতে ওদের বিস্ফোরণের শব্দে বুকটা ভরে যায়। বোবা মেয়েটাকে এক সকালে বললো, আস, আমরা বাগানের আগাছা তুলি। আবার ফুলের গাছ লাগাই।
ওরা দুজনে মিলে গির্জার বাগানে মাটি কোপালো। গাঁদা, কসমস আর সূর্যমুখীর বীজ ছিটালো। রোজ ভোরবেলা বোবা মেয়েটাকে নিয়ে বাগানে বসে থাকে ডেসমন্ড। একটা চারা গজালে দু’জন আনন্দে মেতে ওঠে। এ যেন এক নতুন খেলা।
অবশেষে একদিন সেই ভয়ঙ্কর সময়ের মুখোমুখি হলো ডেসমন্ড বুড়ো। শেষ রাতে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ওরা গভীর আনন্দে ঘুমিয়েছিলো। তখন আকাশের অন্ধকার সবেমাত্র ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে–গির্জার বড় ফটকের বাইরে শব্দ শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। কিছু উত্তেজিত আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর–কথা বোঝা যাচ্ছে না।
মেয়েটাকে ঘরে লুকিয়ে রেখে লাঠি হাতে বেরিয়ে এলো ডেমন্ড। ততোক্ষণে ফটকে করাঘাত পড়েছে। ভারি ফটকটা ধীরে ধীরে খুলে বাইরে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে ওর সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেলো। কয়েকজন হিংস্র মানুষ ওদের ঘিরে পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ওরা তিনজন, স্বর্গের সেই দেবদূত হাতগুলো বাধা, সারা শরীরে ধুলো আর রক্তের দাগ নিয়ে একদল ভয়াল নেকড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলো।
একজন নেকড়ে ধারালো গলায় বললো, এই বুড়ো, এগুলোকে চিনিস? তোদের গির্জার পাশে ঘুরছিলো।
ডেসমন্ড আবার দেখলো ওর প্রিয় দেবদূতদের, যারা ওর জন্যে স্বর্গের বাণী বয়ে আনতো। ডেসমন্ড অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো, ওদের চোখে এখনো স্বর্গের আলো খেলা করছে। বিড় বিড় করে বললো, ওরা স্বর্গের দেবদূত।
নেকড়েরা আবার গর্জন করে উঠলো, কিরে কথা বলছিস না কেন? আগে কখনো দেখিসনি এগুলোকে?
ডেসমন্ডের গলাটা কেঁপে গেলো। বললো, না। তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হেঁটে ওর ঘরে চলে গেলো। পবিত্র বাইবেলে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে বার বার বললো, না, প্রভু না–।
বোবা মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে বসে থাকলো ঘরের কোণে।
বাইবেলের ভেতর থেকে ক্রুসবিদ্ধ যীশুর অন্তিম বাণী শুনতে পেলো ডেসমন্ড। প্রভু ক্রুসের উপর থেকে বলছেন, ঈশ্বর, আমার ঈশ্বর! তুমি কি আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছ? এতটুকু শব্দ না করে ডেসমন্ড অঝোরে কাঁদতে লাগলো ।
বেশিক্ষণ ঘরে থাকতে পারলো না ডেসমন্ড বুড়ো। বাইরের কোলাহল আরো কাছে মনে হলো। তাকিয়ে দেখলো নেকড়ের দল পাঁচিলের ধারে পড়ে থাকা কবরের কাঠগুলো নিয়ে ছুটোছুটি করে কি যেন বানাচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ডেসমন্ড। সহসা ওর বুকের ভেতরটা কে যেন অদৃশ্য মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিলো। একি করছে ওরা? ডেসমন্ড দেখলো অল্প সময়ের মধ্যে শয়তানের দল তিনটি ক্রুস বানিয়ে উঁচু ঢিবিটার ওপর পুঁতে দিয়েছে। আর তিনজন দেবদূত–হায় ঈশ্বর–ছুটে যেতে গিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ডেসমন্ড।
তিনজন দেবদূত এতটুকু শব্দ করেনি। ওদের মুখে শুধু যন্ত্রণার নীল ছায়া গাঢ় হলো। ডেসমন্ড মাটি থেকে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশের ঘন কালো মেঘের গায়ে তিনটি বিশাল ক্রুস। গির্জার প্রাঙ্গণে যীশুখৃস্টের ক্রুসবিদ্ধ মূর্তি দেখেই শয়তানের দল এই নির্মম মৃত্যুর কথা ভেবেছিলো।
তিনজন মুক্তিযোদ্ধা, যারা গতরাতেও শত্রুর শিবিরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, সকালে তারা তিনজন যীশুখৃস্ট হয়ে গেছে।
ডেসমন্ড মেঘের গায়ে কুসবিদ্ধ যীশুকে দেখতে পেলো। ঠিক এই রকম ক্রুসের উপর থেকেই তিনি বলেছিলেন, এলী এলী লামা শবানী। ঈশ্বর আমার ঈশ্বর …”।
নেকড়ের দল হল্লা করে বেরিয়ে গেলো। ডেসমন্ড দেখলো কি যেন বিড় বিড় করে বলছে ওরা। হাত থেকে রক্ত ঝরছে। সারা শরীর বেয়ে রক্তের ধারা নেমে এসেছে। সবুজ ঘাসের আঙিনায় লাল রক্ত জমছে। ওদের মাথা একপাশে কাত হয়ে ঝুলে পড়েছে। ডেসমন্ড ছুটে গেলে ক্রুসের নিচে। আবার মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। তবু সে শুনতে পেলো। একবার, দুবার তিনবার। পরপর তিনবার শুনলো সেই কথা। ডেসমন্ডের বুকের ভেতর গেঁথে গেলো–স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা। আর ঠিক সেই সময় আকাশ আর মাটি কাঁপিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো।
তিনদিন পর বুড়ো ডেসমন্ড ঘরে বসে গুণ গুণ করে বাইবেল থেকে যীশুর পুনরুত্থানের অধ্যায় পড়ছিলো। দরজায় পায়ের শব্দ শুনে চমকে তাকালো। দেখলো তিনজন দেবদূত। হাসি মুখ, উজ্জ্বল চোখ, মুক্তোর মত ঘাম। আগের মতো তিনজন মুক্তিযোদ্ধা।
বোবা মেয়েটার মুখে হাসি ফুটলো।
ডেসমন্ডের চোখের সামনে তখন মথি লিখিত সুসমাচারের শেষ কথাটা নেচে বেড়াতে লাগলো–আর দেখ, আমিই যুগান্ত পর্যন্ত প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে আছি।” শব্দগুলো ধীরে ধীরে লক্ষ লক্ষ সবিদ্ধ যীশুখৃস্ট হয়ে গেলো।
ওদের একজন একটু হেসে বললো, আমরা এসেছি। বুড়ো ডেসমন্ড কয়েক লক্ষ যীশুখৃস্ট দেখতে দেখতে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।
একাত্তরের যীশু নামের গল্পটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭৩ সালে দৈনিক বাংল পত্রিকায়। তারপর বাংলা একাডেমীর একটা সংকলনে সবশেষে বইয়ে ছাপা হয়েছে ১৯৮৫ সালে।দক্ষিণের শহর আর গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগিয়ে আসছিলো। খবরটা শুনে মে মাসের প্রথম থেকেই গ্রামের লোক আরো উত্তরে শালবনের দিকে সরে যেতে লাগলো। অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে কুচবিহার আর পশ্চিম দিনাজপুরে চলে গেলো।
সীমান্ত বেশি দূরে নয়। অনেকে ওপারে গিয়েও নিয়মিত যাওয়া আসা করছিলো। জুনের মাঝামাঝি যখন সবাই নদীর ওপারের ছোট্ট শহরটাকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখলো, তখন যারা যাবার তারা একেবারেই চলে গেলো। থেকে গেলো জামাত, মুসলিম লীগের কিছু দালাল আর কয়েকজন বুড়ো। গির্জার ঘন্টা টানতো বুড়ো ডেসমন্ড ডি রোজারিও। সে ছিলো থেকে যাওয়া বুড়োদের একজন।
এতোদিন ফাদার মার্টিন ছিলেন গির্জায়। যশোরে পাঞ্জাবীরা মিশনারিদের মেরেছে এই খবর শুনে তিনিও কিছুদিন আগে শহরে চলে গেছেন। বুড়ো ডেসমন্ডকে ডেকে বলেছিলেন, উহারা মিশনারিদিগকেও হত্যা করিতেছে। আমি শহরে যাইতেছি। তুমি বিপদ দেখিলে ইন্ডিয়া চলিয়া যাইও। ইন্ডিয়ার মানুষ আমাদের অসহায় মানুষদিগকে আশ্রয় দিয়াছে। ঈশ্বর উহাদের মঙ্গল করিবেন। এই বলে ফাদার বুকে ক্রস এঁকেছিলেন।
বুড়ো ডেসমন্ড মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে কাটতে জবাব দিয়েছিলো মুই আর কুণ্ঠে যাবেক ফাদার।
অনেক ভেবেছিলো ডেসমন্ড বুড়ো। আসলে সে যাবেইবা কোথায়! তার স্বজাতি সাঁওতালরা যখন সেখানে খুশি অনায়াসে চলে যেতে পারে। ওদের রক্তের সকল অণুতে মহুয়ার মতো মিশে আছে যাযাবরের নেশা। কিন্তু ডেসমন্ডের সেই নেশা কেটে গেছে বহু বছর আগে। নিজেকে এখন মনে হয় ঝুরি নামানো বুড়ো বটগাছের মতো, সারা গ্রামে যার শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামে যখন এই গির্জা প্রতিষ্ঠিত হলো, ডেসমন্ড তখন বারো বছরের বালক। পাদ্রী ছিলেন ফাদার নিকোলাস। তিনিই ডেসমন্ডকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন–প্রভুর স্থান ছাড়িয়া কোথাও যাইও না। প্রভু তোমাকে রক্ষা করিবেন।
সেই থেকে ডেসমন্ড এই গির্জায় পড়ে আছে। গির্জার পাশে সবুজ ঘাসের আঙিনা। দেয়ালের ওপাশে সারি সারি কবর। সবুজ আঙিনা আর কবরের মাঝে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের গায়ে লাগানো ছোট্ট দু’টো ঘর। ছাদটা লাল টালির। দেয়ালগুলো সাদা চুনকাম করা। এই ঘর দুটো ডেসমন্ডের। সারাদিন সে এখানেই থাকে, আর গির্জার ঘন্টা বাজায়। ওর মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র কাজের দায়িত্ব প্রভু ওকেই দিয়েছেন।
আগে ডেসমন্ড সকালে গির্জার বাগানে কাজ করতো। গির্জার ভেতরের ঝাড়ামোছাগুলো শেষ করে রাখতো। বিকেলে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতো। প্রভু ছোটদের ভালোবাসতেন। বহুদিন বাইবেল থেকে ফাদাররা পড়ে শুনিয়েছেন, যীশু কহিলেন, শিশুদিগকে আমার নিকট আসিতে দাও। বারণ করিও না। কারণ স্বর্গরাজ্য এইমত লোকদেরই।”
প্রায় জনশূন্য গ্রামগুলোতে মানুষের সাড়াশব্দ একেবারেই নেই। দু’একজন বুড়ো, যারা এখনো গ্রামে আছে, তারা ছোটদের মতো সারা গ্রাম মাতিয়ে রাখতে পারে না। বুড়ো ডেসমন্ডের বুকে শুধু যন্ত্রণার ঢেউ উত্তাল হয়। নিবির দাদু, হরিপদের খুড়ো যখন এসে শহরে শত্রু সৈন্যদের অত্যাচারের কথা বলে, ডেসমন্ড তখন বুকে জমে থাকা কান্না থামিয়ে রাখতে পারে না।
সারাটা জুলাই মাস বুড়ো ডেসমন্ড একা একা কাটালো। বাগানের কাজে আগের মতো উৎসাহ পেতো না। তবু সকালটা গির্জার কাজে ব্যস্ত থাকতো। বিকেলগুলো ওর কাছে ভয়াবহ মনে হতো। গ্রামের সেই উচ্ছল ঝর্ণার মতো ছেলেমেয়েগুলো কোন শয়তানের যাদুবলে কোথায় কীভাবে যে হারিয়ে গেলো–ডেসমন্ড যতো ভাবে ততো তার বুকে দুঃখের পাহাড় জমে। গির্জার প্রাঙ্গণে কতগুলো শিরিষ গাছ ছিলো। অন্য সময়ে গাছগুলোতে রঙবেরঙের পাখির মেলা বসতো। এখন পাখিরা আর শিরিষের ডালে গান গেয়ে ছুটোছুটি করে না। আঙিনার সবুজ ঘাসের কার্পেটে প্রজাপতিরা নানা রঙের নকশা আঁকে না। শিরিষের পাতা গলিয়ে বিকেলের মরা রোদ গির্জার গায়ে জড়িয়ে থাকে। বিশাল এক শূন্যতা সারা গ্রাম জুড়ে হা হা করে কাঁদতে থাকে। বাতাসকে মনে হয় কোনো ডাইনীর অভিশাপের নিঃশ্বাস। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বুড়ো ডেসমন্ড শুধু ছটফট করে। ভাবে ঈশ্বর কেন ওকে এই নরকে ঠেলে দিলেন!
যখন সময়গুলো একেবারেই অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন ডেসমন্ড জানালার তাকের ওপর থেকে, ফাদার গাঙ্গুলীর দেয়া মথি লিখিত সুসমাচার’খানা নামিয়ে আনে। ভালো মতো পড়তে পারে না ডেসমন্ড। চোখে ঝাঁপসা দেখে। তবু কোনো রকমে বানান করে জোরে জোরে পড়ে–ইতিমধ্যে পিতর বাহিরের প্রাঙ্গণে বসিয়াছিলেন। আর একজন দাসী তাঁহার নিকটে আসিয়া কহিল, তুমিও সেই গালীলীয় যীশুর সঙ্গে ছিলে । কিন্তু তিনি সকলের সাক্ষাতে অস্বীকার করিয়া কহিলেন, তুমি কি বলিতেছ আমি বুঝিতে পারিলাম না। তিনি ফটকের নিকট গেলে আরেক দাসী তাঁহাকে দেখিয়া সেস্থানের লোকদিগকে কহিল, এ ব্যক্তি সেই নাযারথীয় যীশুর সঙ্গে ছিল। তিনি আবার অস্বীকার করিলেন, দিব্য করিয়া কহিলেন, আমি সে ব্যক্তিকে চিনিনা। অল্পক্ষণ পরে যাহারা নিকট দাঁড়াইয়াছিল তাহারা আসিয়া পিতরকে কহিল, সত্যই তুমি তাহাদের একজন। কেননা তোমার ভাষা তোমার পরিচয় দিতেছে। তখন তিনি অভিশাপপূর্বক শপথ করিয়া বলিতে লাগিলেন আমি সে ব্যক্তিকে চিনিনা। তখনই কুকুড়া ডাকিয়া উঠিল। তাহাতে যীশু এই যে কথা বলিয়াছিলেন, কুকুড়া ডাকিবার পূর্বে তুমি তিনবার আমাকে অস্বীকার করিবে, তাহা পিতরের মনে পড়িল। এবং তিনি বাহিরে গিয়া অত্যন্ত রোদন করিলেন।”
ডেসমন্ড যতোবার বাইবেল পড়ে যীশুখৃস্টের ক্রসবিদ্ধ হবার ঘটনার কথা ভাবে, ততোবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। তবু সে জোরে জোরে বাইবেল পড়ে। ওর মনে হতো বাইবেলের পবিত্র শব্দগুলো, শয়তানের মতো ভয়ঙ্কর নিরবতাকে তাড়া করে ফিরছে। গির্জার প্রাঙ্গণে অন্ধকার নামা পর্যন্ত ডেসমন্ড বাইবেল পড়ে। নিরবতাকে ও ভয় করে, একই সঙ্গে ঘৃণাও করে।
আগস্টের শেষে এক বৃষ্টিভেজা রাতে ওরা কয়েকজন এলো বুড়ো ডেসমন্ডের ঘরে। হারিকেনের ম্লান আলোয় ডেসমন্ড তখন গির্জার আইকন পরিষ্কার করছিলো। দরজায় হালকা পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো। দেখলো তিনটি ছেলে, বৃষ্টিতে ভেজা সারা শরীর, চুলের ডগা বেয়ে মুক্তোর দানার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। ওদের উজ্জ্বল চোখগুলো হারিকেনের ম্লান আলোতেও চকচক করছিলো। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ডেসমন্ডের মনে হলো, ওরা যেন তিনজন দেবদূত, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। তারপর সে এতো বেশি অভিভূত হয়ে গেলো যে, আর কোনও কথাই বলতে পারলো না।
ওরা তিনজন একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। একজন একটু হেসে বললো, আমরা আজ রাতে তোমার এখানে থাকবো ডেসমন্ড দাদু।
আরেকজন বললো, তোমাদের গায়ের দাশু খুড়ো বলেছে, তুমি খুব ভালো লোক।
স্বর্গের দেবদূত ওর কাছে এসেছে, ওর ঘরে থাকতে চাইছে ডেসমন্ড কী বলবে সহসা কিছুই ভেবে পেলো না। তারপর এলোমেলো ভাবে বললো, হায় হায়, থাকতি কেনে দিবেক নেই। তোমাদের কষ্ট হতিছে বাছা। আগুনের ধারে বস। সব ভিজ্যে গেছে।
হাতের ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রেখে ওরা ছোট্ট উনুনটির পাশে গিয়ে বসলো। বললো, দাশু খুড়ো তোমার কথা অনেক বলেছে ডেসমন্ড দাদু। বলেছে, তুমিই আমাদের সাহায্য করতে পারো। তোমার মতো ভালো লোক এ গায়ে আর নেই।
বিরাশী বছরের বুড়ো ডেসমন্ড লজ্জায় লাল হলো। স্বর্গের দেবদূত ওকে একি কথা শোনাচ্ছে! মাথা নেড়ে বললো, না না, সেটি ঠিক বুলে নাই। সাহাইয্য লিচ্চয়ই করিব। ঈশ্বর তুমাদের মঙ্গল করিবেন।
অনেক রাত অবধি বুড়ো ডেসমন্ডের সঙ্গে ওদের কথা হলো। ডেসমন্ডের মনে হলো, দেবদূতরা ওর জন্যে স্বর্গের বাণী বয়ে এনেছে। ওরা জানে, শিরিষ গাছে পাখিরা কেন গান গায় না, ঘাসফুলের প্রজাপতিরা কেন আর আসে না, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দের শব্দ আর রঙ কোথায় হারিয়ে গেছে। ওরা আনন্দের হারিয়ে যাওয়া শব্দকে ফিরিয়ে আনবে। শয়তানের বিষাক্ত যন্ত্রণার ছায়া পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দেবে। শিরিষের ডালে আবার পাখিরা গান গাইবে। মুগ্ধ হয়ে ডেসমন্ড ওদের কথা শোনে। ওর ঘোলাটে চোখে আনন্দ নেচে বেড়ায়। বার বার বলে, ঈশ্বর তুমাদের মঙ্গল করিবেন।
স্বর্গের দেবদূত হাসতে হাসতে ওকে বলে, তোমাকে আমরা শিখিয়ে দেবো কি করে গ্রেনেড মারতে হয়, আর রাইফেল চালাতে হয়।
আনন্দে উত্তেজনায় ডেসমন্ড শুধু বলে, লিচ্চয়ই, লিচ্চয়ই।
এরপর দিনগুলো যে কীভাবে কাটলো ডেসমন্ড বুড়ো আর হিসেব রাখতে পারলো না। স্বচ্ছ সরোবরে হাঁসের মতো তরতর করে সময় বয়ে যেতে লাগলো। সকালে লাঠিতে ভর দিয়ে ও নদীর তীর অবধি চলে যায়। কোনোদিন আবার একেবারে শহরে ঘুরে ঘুরে সব দেখে আসে। পাহারারত পাঞ্জাবী সৈন্যরা কেউ ওকে উপেক্ষা করে, কেউ রসিকতা করে। রাতে দেবদূতের দল আসে ওর কাছে। সারা ঘর আলো হয়ে যায়। ওর কানে গির্জার প্রার্থনা সঙ্গীত বাজতে থাকে। ওদের সঙ্গে ওর কথা হয়। তারপর গভীর রাতে ওরা চলে যায়। দূরে শহরে বিস্ফোরণের শব্দ হয়। মেশিনগান গর্জন করে, আবার কোথাও গ্রেনেড ফাটে। গভীর আনন্দ আর উত্তেজনায় ডেসমন্ড ডুবে যায়। একটা গ্রেনেডের শব্দ একশটা হয়ে ওর কানে গির্জার ঘন্টার মতো বাজতে থাকে। ডেসমন্ডের চোখে আর ঘুম নামে না। শেষ রাতে ওরা এসে বলে, আমরা যাচ্ছি। ভালো থেকো ডেসমন্ড দাদু। আবার দেখা হবে।
ওরা চলে যাবার পর আবার শয়তানের মতো কদাকার সেই নিরবতা ডেসমন্ডকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়। লাঠিতে ভর দিয়ে ও গ্রামের ভেতরে যায়। হরিপদর খুড়ো অনেক দিন ধরে বাতের ব্যথায় কষ্ট পাছে। কটা আকন্দ পাতা তুলে নিয়ে হরিপদর তালা বন্ধ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকে, হরিপদর খুড়ো ঘরে আছো? ও হরিপদর খুড়ো? কেউ কোনো সাড়া দেয় না।
আরেকটা শেকল তোলা দরজার সামনে গিয়ে ডেসমন্ড ডাকে, নিবির দাদু? ও নিবির দাদু?
উঠোনের কোণ থেকে হাড় বের করা একটা লোমঝরা কুকুর শুধু একবার মাথা তুলে ওকে দেখে। গ্রামের সবাই চলে গেছে। ভীষণ ভয় পায় ডেসমন্ড। লাঠিতে ভর দিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে আবার গির্জায় ফিরে আসে। অসময়ে গির্জার ঘন্টা বাজায়। ডেসমন্ডের মনে হয়, শব্দের অভাবে ও বুঝি পাগল হয়ে যাবে।
কখনো নদী পেরিয়ে ওপারের গ্রামে চলে যায় ডেসমন্ড। সেই গ্রামের অনেকে ওকে চেনে। এখনো সবাই গ্রাম ছেড়ে যায়নি। ভেবেছিলো পাঞ্জাবীরা বুঝি এতো ভেতরে আসবে না। ওরা ডেসমন্ডকে বলেছিলো একা গির্জায় পড়ে না থেকে ওদের গ্রামে এসে থাকতে। ম্লান হেসে ডেসমন্ড মাথা নেড়েছে। ও জানে শেকড় উপড়ে ফেললে গাছ বাঁচে না।
এক রাতে ডেসমন্ড দেখলো নদীর ওপারের ছোট্ট গ্রামটাও দাউ দাউ করে জ্বলছে। অসহায় মানুষের কান্না আর আর্তনাদের আবছা শব্দ ভেসে আসছে বাতাসে। ডেসমন্ড কি করবে কিছুই ভেবে পেলো না। গির্জার ভেতর ছুটোছুটি করলো ফাঁদে আটকা পড়া ভয় পাওয়া ইঁদুরের মতো। কখনো যীশু খৃস্টের মূর্তির সামনে নতজানু হয়ে হাত জোড় করে বিড় বিড় করে কি যেন বললো। কখনো আবছা আর্তনাদের শব্দে ও ছিটকে বেরিয়ে এলো। ওর চোখের সামনে ঘর বাড়ি জ্বলছে, গাছ পালা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, মানুষ মরছে। ওর বুকের ওপর হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন পেরেক ঠুকছে, হাতে পায়ে পেরেক ঠুকে ওকে ঝুলিয়ে দিচ্ছে ক্রুসকাঠে।
সারা রাত ডেসমন্ড কাঁদলো। ওর কান্নায় রাতের অন্ধকার গলে গেলো। গ্রামের আগুন নিভে গেলো। সূর্য ওঠার আগে ডেসমন্ড লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেলো সেই গ্রামে।
ও জানতো গ্রামের একজন মানুষও বেঁচে নেই। শয়তানরা এভাবেই গরিব দুঃখী মানুষদের মেরে ফেলে। চারপাশে ও তাকিয়ে দেখলো শুধু লাশ আর লাশ। তখনো কোথাও কয়লার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে। বাতাসে লাশের পোড়া গন্ধ। বুড়ো করমআলীর ছোট নাতনিকে একটা কাপড়ের পুতুল কিনে দিয়েছিলো ডেসমন্ড। তাকিয়ে দেখলো পোড়া ঘরের নিচে চাপা পড়েছে ওরা সবাই। কেউ বেঁচে নেই। করমালীর নাতনির হাতে ধরা পুতুলটাও পুড়ে গেছে।
ওরা এভাবে পড়ে থাকলে ওদের শেয়াল, কুকুর আর শকুন টেনে ছিঁড়ে খুবলে খাবে। ডেসমন্ড ঠিক করলো সবাইকে কবর দেবে ও। সবার জন্য প্রার্থনা করবে ঈশ্বরের কাছে। ঈশ্বরের কাছে সব মানুষই সমান।
কোদাল আনার জন্য গির্জায় যাচ্ছিলো ডেসমন্ড । হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। কৃষ্ণচুড়া গাছের আড়ালে বসে আছে ছোট্ট একটা মেয়ে। ডেসমন্ডের মনে হলো বুঝি ও চোখে ভুল দেখছে। চোখ কচলে আবার দেখলো। মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে বসেছিলো নদীর দিকে মুখ করে। যেন কেউ আসবে ওকে নিতে।
পায়ে পায়ে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলো ডেসমন্ড। ওর পায়ের শব্দ শুনে চমকে তাকালো মেয়েটা। নরম গলায় ডেসমন্ড জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে?
মেয়েটা কোনো কথা বললো না। ওর দু’চোখে পৃথিবীর সব ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। ডেসমন্ড আরো নরম গলায় বললো, তুমার নাম কী?
মেয়েটা কথা বলতে চাইলো, পারলো না। ডেসমন্ডের ভীষণ কষ্ট হলো। মেয়েটার পাশে বসে ওকে কাছে টেনে আদর করে আবার বললো, তুমার নাম কী গো মা?
মেয়েটা কথা বলতে চাইলো। আঁ-আঁ শব্দ হলো। মাথা নাড়লো সে।
ডেসমন্ডের বুকটা কেঁপে উঠলো–তুমি কথা বুইলতে পারো না? বলে মেয়েটাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলো। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলো। ডেসমন্ডের সঙ্গে বোবা মেয়েটাও কাঁদলো।
মেয়েটাকে ওর ঘরে রেখে সারা দিন ধরে ডেসমন্ড পাশের পোড়া গ্রামে কবর খুড়লো। এক এক করে সবাইকে কবর দিলো। গির্জায় অনেক মোমবাতি ছিলো। রাতে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে কবরগুলোতে মোমবাতি জ্বেলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো। ডেসমন্ড জানে শয়তানের হাতে যারা মারা যায় স্বর্গ তাদেরই জন্য।
কয়েকদিন পর আবার ছেলেরা এলো। ডেসমন্ড ওদের বললো বোবা মেয়েটাকে ও কীভাবে কুড়িয়ে পেয়েছে। ছেলেদের নরম চেহারা কঠিন হয়ে গেলো। বললো, আমরা জানি পাকিস্তানী সৈন্যদের কারা গ্রামের পথ চিনিয়ে দিয়েছে। ওদের কাউকে আমরা ক্ষমা করবো না।
যাবার আগে ওরা সবাই মেয়েটাকে আদর করলো। ডেসমন্ডকে বললো, যেদিন আমাদের দেশ স্বাধীন হবে সেদিন ও কথা বলবে।
ডেসমন্ড হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো। বললো, তুমরা কুন চিন্তা কইরো না। উরে আমি কথা শিখামু।
শেষ রাতে ডেসমন্ড দূরের শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনলো। ওর বুকের ভেতরটা হালকা মনে হলো। মেয়েটাকে সকালে বললো, মা, আর কুন ডর নাই।
ডেসমন্ড ভেবেছিলো শয়তানের দল বুঝি শহর ছেড়ে চলে গেছে। রাতে আকাশ হঠাৎ করে লাল হয় না। গুলির শব্দও শোনা যায় না। শেষ রাতে ওদের বিস্ফোরণের শব্দে বুকটা ভরে যায়। বোবা মেয়েটাকে এক সকালে বললো, আস, আমরা বাগানের আগাছা তুলি। আবার ফুলের গাছ লাগাই।
ওরা দুজনে মিলে গির্জার বাগানে মাটি কোপালো। গাঁদা, কসমস আর সূর্যমুখীর বীজ ছিটালো। রোজ ভোরবেলা বোবা মেয়েটাকে নিয়ে বাগানে বসে থাকে ডেসমন্ড। একটা চারা গজালে দু’জন আনন্দে মেতে ওঠে। এ যেন এক নতুন খেলা।
অবশেষে একদিন সেই ভয়ঙ্কর সময়ের মুখোমুখি হলো ডেসমন্ড বুড়ো। শেষ রাতে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ওরা গভীর আনন্দে ঘুমিয়েছিলো। তখন আকাশের অন্ধকার সবেমাত্র ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে–গির্জার বড় ফটকের বাইরে শব্দ শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। কিছু উত্তেজিত আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর–কথা বোঝা যাচ্ছে না।
মেয়েটাকে ঘরে লুকিয়ে রেখে লাঠি হাতে বেরিয়ে এলো ডেমন্ড। ততোক্ষণে ফটকে করাঘাত পড়েছে। ভারি ফটকটা ধীরে ধীরে খুলে বাইরে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে ওর সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেলো। কয়েকজন হিংস্র মানুষ ওদের ঘিরে পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ওরা তিনজন, স্বর্গের সেই দেবদূত হাতগুলো বাধা, সারা শরীরে ধুলো আর রক্তের দাগ নিয়ে একদল ভয়াল নেকড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলো।
একজন নেকড়ে ধারালো গলায় বললো, এই বুড়ো, এগুলোকে চিনিস? তোদের গির্জার পাশে ঘুরছিলো।
ডেসমন্ড আবার দেখলো ওর প্রিয় দেবদূতদের, যারা ওর জন্যে স্বর্গের বাণী বয়ে আনতো। ডেসমন্ড অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো, ওদের চোখে এখনো স্বর্গের আলো খেলা করছে। বিড় বিড় করে বললো, ওরা স্বর্গের দেবদূত।
নেকড়েরা আবার গর্জন করে উঠলো, কিরে কথা বলছিস না কেন? আগে কখনো দেখিসনি এগুলোকে?
ডেসমন্ডের গলাটা কেঁপে গেলো। বললো, না। তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হেঁটে ওর ঘরে চলে গেলো। পবিত্র বাইবেলে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে বার বার বললো, না, প্রভু না–।
বোবা মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে বসে থাকলো ঘরের কোণে।
বাইবেলের ভেতর থেকে ক্রুসবিদ্ধ যীশুর অন্তিম বাণী শুনতে পেলো ডেসমন্ড। প্রভু ক্রুসের উপর থেকে বলছেন, ঈশ্বর, আমার ঈশ্বর! তুমি কি আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছ? এতটুকু শব্দ না করে ডেসমন্ড অঝোরে কাঁদতে লাগলো ।
বেশিক্ষণ ঘরে থাকতে পারলো না ডেসমন্ড বুড়ো। বাইরের কোলাহল আরো কাছে মনে হলো। তাকিয়ে দেখলো নেকড়ের দল পাঁচিলের ধারে পড়ে থাকা কবরের কাঠগুলো নিয়ে ছুটোছুটি করে কি যেন বানাচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ডেসমন্ড। সহসা ওর বুকের ভেতরটা কে যেন অদৃশ্য মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিলো। একি করছে ওরা? ডেসমন্ড দেখলো অল্প সময়ের মধ্যে শয়তানের দল তিনটি ক্রুস বানিয়ে উঁচু ঢিবিটার ওপর পুঁতে দিয়েছে। আর তিনজন দেবদূত–হায় ঈশ্বর–ছুটে যেতে গিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ডেসমন্ড।
তিনজন দেবদূত এতটুকু শব্দ করেনি। ওদের মুখে শুধু যন্ত্রণার নীল ছায়া গাঢ় হলো। ডেসমন্ড মাটি থেকে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশের ঘন কালো মেঘের গায়ে তিনটি বিশাল ক্রুস। গির্জার প্রাঙ্গণে যীশুখৃস্টের ক্রুসবিদ্ধ মূর্তি দেখেই শয়তানের দল এই নির্মম মৃত্যুর কথা ভেবেছিলো।
তিনজন মুক্তিযোদ্ধা, যারা গতরাতেও শত্রুর শিবিরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, সকালে তারা তিনজন যীশুখৃস্ট হয়ে গেছে।
ডেসমন্ড মেঘের গায়ে কুসবিদ্ধ যীশুকে দেখতে পেলো। ঠিক এই রকম ক্রুসের উপর থেকেই তিনি বলেছিলেন, এলী এলী লামা শবানী। ঈশ্বর আমার ঈশ্বর …”।
নেকড়ের দল হল্লা করে বেরিয়ে গেলো। ডেসমন্ড দেখলো কি যেন বিড় বিড় করে বলছে ওরা। হাত থেকে রক্ত ঝরছে। সারা শরীর বেয়ে রক্তের ধারা নেমে এসেছে। সবুজ ঘাসের আঙিনায় লাল রক্ত জমছে। ওদের মাথা একপাশে কাত হয়ে ঝুলে পড়েছে। ডেসমন্ড ছুটে গেলে ক্রুসের নিচে। আবার মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। তবু সে শুনতে পেলো। একবার, দুবার তিনবার। পরপর তিনবার শুনলো সেই কথা। ডেসমন্ডের বুকের ভেতর গেঁথে গেলো–স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা। আর ঠিক সেই সময় আকাশ আর মাটি কাঁপিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো।
তিনদিন পর বুড়ো ডেসমন্ড ঘরে বসে গুণ গুণ করে বাইবেল থেকে যীশুর পুনরুত্থানের অধ্যায় পড়ছিলো। দরজায় পায়ের শব্দ শুনে চমকে তাকালো। দেখলো তিনজন দেবদূত। হাসি মুখ, উজ্জ্বল চোখ, মুক্তোর মত ঘাম। আগের মতো তিনজন মুক্তিযোদ্ধা।
বোবা মেয়েটার মুখে হাসি ফুটলো।
ডেসমন্ডের চোখের সামনে তখন মথি লিখিত সুসমাচারের শেষ কথাটা নেচে বেড়াতে লাগলো–আর দেখ, আমিই যুগান্ত পর্যন্ত প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে আছি।” শব্দগুলো ধীরে ধীরে লক্ষ লক্ষ সবিদ্ধ যীশুখৃস্ট হয়ে গেলো।
ওদের একজন একটু হেসে বললো, আমরা এসেছি। বুড়ো ডেসমন্ড কয়েক লক্ষ যীশুখৃস্ট দেখতে দেখতে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।
একাত্তরের যীশু নামের গল্পটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭৩ সালে দৈনিক বাংল পত্রিকায়। তারপর বাংলা একাডেমীর একটা সংকলনে সবশেষে বইয়ে ছাপা হয়েছে ১৯৮৫ সালে।