
১.
- এই তোমার পছন্দের পোকা কি?
বহ্নি হতাশ চোখে রণোর দিকে তাকালো। এতো ঝামেলা করে বাবা মায়ের চোখ এড়িয়ে রণোর সাথে দেখা করতে এলো। লেকের পাশে বসে পড়ন্ত বিকেলের অদ্ভুত মায়াবী আলোয় কেউ বুঝি তার প্রেমিকাকে এইসব বলে।
- আমার কোন পছন্দের পোকা নেই!!
- আমার মনে হয় তোমার মাকড়শা পছন্দ করা উচিত।
- কেন? তোমার বুঝি মাকড়শা খুব পছন্দ?
- হুউউ...পছন্দ মানে!!! আমি নিজেইতো একটা মাকড়শা।
- তাতো হবেই...আটটা হাত পা দিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরেছো!!!
- আমি মোটেও তোমাকে আঁকড়ে ধরিনি বহ্নি। আর কোন দিন তোমায় ধরেও রাখবো না...আমিতো শুধু জাল বুনে যাবো...তোমার চারপাশে ভালোবাসার জাল...দেখি ধরা পড়ো কিনা!!
রণো হাসছে; লেকের জলের আয়নায় ধাক্কা লেগে অস্তরাগের আলো ওর চোখে মুখে। ছেলেটা যখন হাসে ওর চোখ হাসে; বামপাশের একটা উঁচু দাঁত পাতলা ঠোঁটেটাকে কি সুন্দর করে যে বাঁকিয়ে দেয়! বহ্নি নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলো মানুষটা আরেকটু কম সুন্দর হলে কি হতো?
ওর একটু মন খারাপ লাগছে। আজ বহ্নি কালো শাড়ী পরেছে; রনোর ফেভারিট কালার ব্ল্যাক। শাড়ীটার আঁচলে বেগুনী আর গোলাপী ফুলের ছাপ; ওর ঠোঁটে ম্যাচিং বেগুনী লিপস্টিক। একবার কথায় কথায় রনো বলেছিলো যে ওকে বেগুনী ঠোঁটে মানাবে। গত কয়েকদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষে গুলশানের মার্কেট থেকে বেগুনী লিপস্টিক কিনেছে। এমন সাজগোজ করে বাসা থেকে বেরুতে মাকে অনেকগুলো মিথ্যা বলতে হয়েছে। অথচ রনোতো মনে হয় খেয়ালই করেনি।
রণোর সাথে ওর সম্পর্কের বয়স প্রায় দু’বছর হতে চললো; কিন্তু আজও ছেলেটা একবারো বলেনি ভালোবাসি। দেখা হলেই সব ইয়ার্কি কথাবার্তা!!! মাঝে মাঝে বহ্নির খুব রাগ লাগে; কিন্তু ভালোবাসার কথার জন্য অপেক্ষা করতে যে খুব ভালোও লাগে। দেখা হলেই বুক ধুকপুক ধুকপুক; যদি আজ সে ওই তীব্র সুন্দর শব্দগুলো বলে!! রণো কি ইচ্ছে করেই এমনটা করে? ও কি জানে যে অপেক্ষা ভালোবাসাকে আরো গাঢ় করে?
রণো বকবক করে চলেছে “আমি হচ্ছি তোমার পোষা মাকড়শা...তুমি কি জানো আমার অনেক গুণ? মাকড়শার জাল দিয়ে একদিন ধ্বংসাত্মক মিসাইল আটকে দেয়া যাবে; চারজন মানুষের যতোটুকু ডিএনএ তা একটা মাকড়শার ডিমে থাকে। আর Black Widow নামের নারী মাকড়শা পুরুষের সাথে মিলনের পরপরই তাকে মেরে ফেলতে চায়। ঐ পুরুষকে তারা মনে করে genetic anomaly!! আজব না?”
সময় শেষ হয়ে আসছে; সূর্য ডুবুডুবু; আকাশটার সাথে সাথে লেকের জলও কমলা লাল। নাহ্...রণো আজ আসলেই ওকে একটুও খেয়াল করেনি! সবুজ পাতায় ফিকে রোদের মতো এক টুকরো বিষাদ লেপ্টে থাকে সারাটা বিকেল। অথচ এই বিকেলটা হতে পারতো অন্যরকম; আকাশ দোলের আবীর মেখেছিল। মন খারাপ করে বহ্নি রিকশায় উঠে বসতেই রণো বললো “বাসায় পৌঁছে জানিও। আর শোনো আমার জারুল ঠোঁটের মেয়ে...তুমি কি জানো যে তুমি আমার রানী মাকড়শা, Black Widow? মরে যাবো জেনেও বার বার তোমার কাছেই যেতে ইচ্ছা করে!!!”
বহ্নির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো; বুকের মধ্যে হঠাত ধাক্কা লাগলো। ভাগ্যিস সন্ধ্যা নামছে; রণো দেখতে পায়নি যে ওর চোখে জল চলে এসেছে। মানুষটা এমন করে বলে যে বুকের মাঝে একই সময়ে কষ্ট আর সুখেরা ঘাই মারে!! এটাই কি ভালোবাসা?
২.
- প্রত্যেকদিন ঝুল ঝাড়ো...মাকড়শাটা মেরে ফেললেইতো হয়!!
- না না...থাক না! ঝুল ঝাড়তে কি আর এমন কষ্ট?
- ভয় পাও নাকি? ভয় লাগলে আমি মেরে দিতে পারি!!
- না না আবীর...প্লিজ!! কি দরকার? ও তো কাউকে কামড়াচ্ছে না...থাক না!!
কোমরে আঁচল পেঁচানো আর লম্বা ঝুলঝাড়ন হাতে বহ্নি; কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। লালচে মুখের কাজে ব্যস্ত বহ্নিকে আবীর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
- ইশশ রে আমার বউটা না একটু বেশীই ভালো...একটা মাকড়শার জন্যেও এতো মায়া?
- যাওতো...অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে...আর আল্লাদী করতে হবে না।
বাইরের দরজা বন্ধ করে বহ্নি শোবার ঘরের বিছানায় এসে বসলো। ও ঠোঁট চেপে কান্নার দমক সামলাচ্ছে; আবীর জানে না কিন্তু ও আসলেই একটা বিষাক্ত মাকড়শা, Black Widow। একবছর আগে ঠিক আজকের দিনটাতে রণো ঠিক ওর ঠোঁটের মতো বেগুনী হয়ে গিয়েছিলো। এতো অভিমানী হয় মানুষ? বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে বহ্নির মানুষটা চুপচাপ ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরে যাবে? একবারো বললো না যে “বিয়ে করো না”; শুধু কষ্টে বেগুনী হতে হতে চিরকুট লিখে গেলো “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ না শুধু একটা রানী মাকড়শা দায়ী।“
বহ্নি দেয়াল বেয়ে ওঠা মাকড়শাটার দিকে তাকিয়ে বললো “রণো...মিছেমিছি তুমি জাল বুনে যাচ্ছ। রানী মাকড়শাটা সেই কবেই তোমার ভালোবাসার জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে। আমার বোকা মাকড়শা...ভালোবাসার জাল বুঝি কেউ ছাড়াতে পারে? কিন্তু আমার জাল তুমি কাটলে কেন বলতো? খুব অভিমানী ছিলে যে...বেশী বেশী ভালোবাসা পেতেই বুঝি ভালোবাসার জাল ছিড়েছো? তুমি ফেরারী আর আর আমি? সেই কবে থেকে বাঁধা পড়ে আছি.....আর কতোদিন তোমাকে একা একা ভালোবাসবো বলতো? আমি যে এখনো অপেক্ষা করে আছি...এখোনো...”
(১১/৩০/২০১৫) (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



