আমি দীর্ঘ দিন হলো শিক্ষকতা পেশায় আছি। মনে প্রাণে এই পেশাকে ভালোবাসি এবং এখনও ক্যারিয়ারের ব্যাপারে শিক্ষকতাকেই রেখেছি পছন্দসই পেশা হিসেবে। এবার কথা হলো শিক্ষক ও তার ভূমিকা নিয়ে। বেশ তো আলাপ জমে উঠেছে স্যোসাল মিডিয়ায়। শিক্ষকদের নিয়ে কত রকম কথাই না হচ্ছে। এমনিতেই শিক্ষকদের তুলোধুনো করার সুযোগ পেলে এই সমাজের অধিকাংশ মানুষই ঝাপিয়ে পড়ে। দেখি তো অভিভাবক দিবস বা রেজাল্ট ঘোষণার দিনে কী কী ঘটে। না, মানছি, টাকা দিয়ে পড়াচ্ছেন, কম তো দিচ্ছেন না, রেজাল্টে মার্কস কেন কম আসবে! একেবারে যৌক্তিক কথা। দারভার না নিয়ে পারছি না।
ছেলেমেয়ে প্রেম করে, ফেসবুকে যা-তা করে, বিড়ি-সিগেরেট খায়- এসবের খোঁজখবর কেন শিক্ষকরা রাখেন না? এমন প্রশ্নও অনেকে করে বসেন। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, চাকরি, মিটিং, অফিসিয়াল ট্যুর, বিজনেস প্রোমোশন প্রোগ্রাম- কাজের কি আর অন্ত আছে! তার মধ্যে যদি এত এত টাকা দেয়ার পরও ছেলেমেয়ের আবার খবর রাখতে হয়, তবে টাকাগুলো তো জলে দেয়ার সামিল। শিক্ষকরা কেন এইটুকু করতে পারবেন না? হুম, দায়ভার নিলাম।
এবার বহুল আলোচিত ভিকারুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীর আত্মহত্যার প্রসঙ্গে একটু বলি। হ্যাঁ, স্কুল কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার এড়াতে পারবেন না। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে কিছু ভাবনা তুলে ধরছি।
আমরা প্রায় সকলেই জানি দেশের নামকরা স্কুলগুলোর মধ্যে ভিকারুন্নেসা অন্যতম। এর কড়াকড়ি শাসন এবং পড়ালেখার অত্যাধিক চাপ নিয়ে নেতিবাচক অনেক কথাও শোনা যায়। আবার প্রতিবছর লাখ লাখ শিশুকে নিয়ে ভর্তি কার্যক্রমে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় লাখ লাখ বাবা-মাকে। কারণ একটা তো আছেই। তাই না? হুদাই তো শো-অফ করে এত কিছু করা যায় না। নিশ্চয়ই কোয়ালিটি এখানে একটা ফ্যাক্ট। অস্বীকার করবেন? লাভ নাই করে। তো সেই কোয়ালিটি থেকে বলা যায় অনেক কিছু।
বিভিন্ন পেইজ, ফেসবুক এবং অনলাইন নিউজ থেকে যতটুকু জানা গেছে (সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে) তার প্রেক্ষিতে কিছু জিজ্ঞাসা।
ভিকারুন্নেসা স্কুলের মতো এত প্রতিষ্ঠানে আইন অমান্য করার সাহস খুব কম শিক্ষার্থীরই থাকে। যেখানে ক্লাসেই মোবাইল ফোন নেয়া এলাউ না সেখানে পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়াটা শুধু সাহসেরই নয় বরং দুঃসাহসিকতার পরিচয় বহন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুঃসাহস ভালো না। পরীক্ষার সময় পরিদর্শকেরই যেখানে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই সেখানে এটা অবশ্যই অপরাধ। এবার কথা হলো যে এটা করছে, সেটা কি তার দ্বারা আইন লঙ্ঘন করা প্রথম ঘটনা? আমার তা মনে হয় না।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্ট কিছু বিচার ব্যবস্থা রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার অধিকার শিক্ষকের নেই। তবু যদি শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত বা মানসিক শাস্তি দিয়ে ফেলেন, প্রতিষ্ঠান প্রথমে তাকে মৌখিক, পরে শোকোজ এবং শেষে অব্যহতি দেয়। মানে প্রাথমিকভাবে শুধরে নেয়ার সুযোগ তাকে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা আরো কয়েকধাপে। আইন ভঙ্গের মাত্রার উপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা একাধিকবার ক্ষমা পেয়ে থাকে (যা আসলে তাদের নৈতিকতা তৈরির জন্য নেতিবাচক), তারপর প্রথমে মৌখিক, পরে অভিভাবককে অবগত, পরে সাময়িক বরখাস্ত এবং শেষে টিসি দিয়ে থাকে। তাহলে ভিকারুন্নেসার মতো প্রতিষ্ঠান প্রথমবারেই টিসি দিয়ে দিচ্ছিল- এমনটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।
জানি অনেকে চটে যাবেন আমার উপর। আমি আত্মহত্যাকারীকে দোষী বানাতে চাচ্ছি। আসলে মোটেই তা নয়। অনেকদিন ধরে শিক্ষকতায় আছি। শিক্ষার্থীদের ভালোবাসি। তাদের সঙ্গে যতটা সম্ভব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে পড়াতে চেষ্টা করি। কিছু হলেই তাদের উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিতে পারি না। আমি কেবল ফ্যাক্টগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। একটু ভাববেন। আরো অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু সেগুলো এতই জটিলতা সৃষ্টি করবে যে আমাকে ভুল বোঝার সম্ভবনা আরো বেড়ে যাবে।
দায়ভার এড়াচ্ছি না। স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইলে এভাবে অপমান না করলেও পারত। শিক্ষক তো, একটু সদয়ী হতেই হয়। কিন্তু তাই বলে অন্যায়ের শাস্তি দেয়ার প্রতিবাদস্বরূপ অাত্মহত্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আর সবচে বড় কথা। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষগুলোর ভেতর অনেকগুলো ফ্যাক্ট কাজ করে নির্দিষ্ট একটি ঘটনা আত্মহত্যা সম্পন্ন করতে সহায়তা করলেও এর পেছনে বিশাল প্রেক্ষাপট থেকে যায়। চাইলে নেটে খুঁজে এ ব্যাপারে জানতে পারবেন। তাই কেবল শিক্ষকরা খারাপ বলে বলে, শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষকশ্রেণিকে ছোট করবেন না। শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেকটা সময় জুড়েই শিক্ষকদের সান্নিধ্যে থাকে। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সুন্দর থাকা প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




