somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?

১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক মেরুকরণ ঘটে গেছে ব্যাপকভাবে। মোটাদাগে দুটো পক্ষ তৈরি হয়েছে। একপক্ষে রয়েছে ধার্মিক মুসলমান, ধর্মকর্ম যেমনই হোক, যারা এখন নিজেদের আইডেন্টিটি শো করার জন্য প্রস্তুত থাকে। অপরপক্ষে আছে প্রগতিশীল, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার, যদিও অভিযোগ আছে এরা সিলেক্টিভ বিষয়ে প্রতিক্রিয়াশীল।

যখনি কোন ঘটনা ঘটে, বড় কোন উৎসব আসে, সেটা নববর্ষ হোক বা ঈদ বা অন্য কোন ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসব, তখনই এই দুটি শিবিরে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। যারা পক্ষে তারা যেন উৎসব পালনকে যুদ্ধ পর্যায়ে নিয়ে যায়! বিপরীতে, যারা বিরুদ্ধে তারাও রিএক্ট করা শুরু করে।
.
বছর দশেক আগেও ঠিক এমন অবস্থা ছিল না। একটা অন্তর্বর্তী অবস্থা ছিল, একটা গ্রে এরিয়া ছিল, যেখানে দাঁড়িয়ে বলা যেত, না ভাই তোমরা দুই পক্ষই চরম উগ্রতার পরিচয় দিচ্ছো। এর বাইরেও কিছু আছে। তোমরা দুই পক্ষই সব সময় ঠিক না। কিছু ঠিক কিছু ভুল।
.
যেকোন সংকটে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থেকে দুই পক্ষের লড়াই শুরু হয়। কখনো একদল ক্রিয়াশীল অপরদল প্রতিক্রিয়াশীল।
.
স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রগতিশীলদের পক্ষে ছিল গণমাধ্যম। তারা সংখ্যায় কম হলেও গণমাধ্যমের কারণে খুব সহজে সব ধরনের মানুষের কাছে তাদের ধ্যান ধারনা পৌঁছাতে পারতো। পত্রিকা, টিভি, নাটক, চলচ্চিত্র, বই সবধরনের মাধ্যমে তারা এগিয়ে। এইখানে পিছিয়ে ছিল অপরপক্ষের ধার্মিক প্রতিক্রিয়াশীলরা। কিন্তু তাদের পক্ষে গনমাধ্যম ছিল না বললেই চলে। তাদের কথাও গণমাধ্যমে পৌঁছাতো না।
.
গত কয়েক বছরে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন চলে এসেছে। আগে তরুণপ্রজন্ম পেয়েছে, এখন যুবক বুড়ো সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। স্মার্টফোনের কল্যাণে সহসা সোশাল মিডিয়া জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। প্রগতিশীল দাবিদাররা একসময় হাসাহাসি করতো, ধার্মিক হুজুররা নাকি ব্লগ দিয়ে ইনটারনেট চালায়। সেই ব্লগ দিয়ে ইনটারনেট চালানো মাদ্রাসায় পড়া হুজুর থেকে আমজনতা সবাই সোশাল মিডিয়া চালানো শিখে গেল। এবং তার পরেই দৃশ্যপট গেল পালটে। যে মানুষগুলোর ভাষা, আশা আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস গণমাধ্যমে তাচ্ছিল্যের সাথে পরিহার করতো, সামাজিক মাধ্যম হয়ে গেল সেই গণমাধ্যমের বিকল্প গণমাধ্যম। মানুষ টিভি দেখা কমিয়ে দিয়েছে, পত্রিকা পড়ে না বললেই চলে। গ্রামের বৃদ্ধ চাচা থেকে শুরু করে শহরের সেই গ্যাং চালানো তরুণটিও ফেসবুক ইউটিউবে সময় কাটানো শুরু করলো। সিটিজেনরা হয়ে গেল নেটিজেন, একচুয়াল লাইফের সাথে চলে এল ভার্চুয়াল লাইফ।
.
প্রচলিত গণমাধ্যমও পিছিয়ে থাকলো না। সব টিভি চ্যানেল, রেডিও, পত্রিকা অনলাইন ভার্সনে চলে আসলো। টিভি নাটক আসতে লাগলো ইউটিউবের ভিউয়ে, তৈরি হতে থাকলো ওটিটি প্লাটফর্মের কন্টেন্ট।
.
অর্থ্যাৎ বাঙালির প্রতিদিনের অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো সোশাল মিডিয়া। এইখানে এসে প্রগতিশীল দাবিদার পক্ষটি যেন মারা খেয়ে গেল। যেহেতু তারা সংখ্যায় ধার্মিক দাবিদারদের কম, যদিও জ্ঞানে-গুণে, শিল্পে সাহিত্যে তারাই এগিয়ে। কিন্তু জাস্ট জনসমর্থন যে একটা বিরাট বয়ান, লাইক কমেন্ট শেয়ার যে বড় ধরনের অস্ত্র, সেখানে এসে তারা যেন সংকুচিত হয়ে গেল। এখন তাদের বয়ান টিভিতে, পত্রিকায় থাকলেও মানুষ তো আর ঐভাবে টিভি দেখে না, পত্রিকা পড়ে না! মোটামুটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যাকে বলে, সেটিই যেন হতে লাগলো তাদের সাথে। তাদের বয়ান যে সাধারণ মানুষদের সাথে মিলে না, এইটা স্পষ্ট হওয়া শুরু করলো।
.
ধার্মিক দাবিদারদের দলটি সোশাল মিডিয়াকেই মুখপাত্র বানিয়ে ফেললো। হুহু করে তাদের ফ্যান ফলোয়ার বাড়তে লাগলো। যে বিষয়টি তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে তা উপেক্ষিত, সেসব বিষয় সোশাল মিডিয়াতে শেয়ার হতে থাকলো। অচিরেই সোশাল মিডিয়া হয়ে গেল সাধারণ আমপাব্লিকের জন্য গণমাধ্যম।
.
মজার বিষয় হল, মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কিছু ব্যক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ করে যারা প্রগতিশীল দাবিদার তাদের পক্ষের তথ্যই প্রচার যেন তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু সোশাল মিডিয়াকে তো নিয়ন্ত্রিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নেটিজেনরা কী চায়, কী ভাবে সেই এলগরিদমের উপর। ঠিক এই জায়গাটিতে এসে প্রগতিশীল দাবিদাররা ধরা খেয়ে গেল।
.
সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে ধার্মিক দাবিদার মধ্যেও ইতিহাস ঐতিহ্য , সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্যের চর্চা হতে লাগলো। শুধু ফেসবুককে কেন্দ্র করেই মাত্র কয়েক বছরে শ খানেক লেখকের সৃষ্টি হয়েছে। এদের কেউ কেউ এতোটাই জনপ্রিয় যে প্রগতিশীল পাড়ায় নাক সিটকালেও একটা দুটা বই কিনেছে।
.
এই বাইপোলার ভার্চুয়াল জগতে, কেউ যখন কিচ্ছুটি শেয়ার করে তা যেকোন একপক্ষ লুফে নেয়। অপরপক্ষ বিষোদগার শুরু করে। এইখানে আরিফ আর হোসাইনের জোক্স আর পাবলিক খায় না। হয় আরিফ আজাদ না হয় আসিফ মহিউদ্দিন। হয় পিনাকি ভট্টাচার্য না হয় নিঝুম মজুমদার। যেকোন একপক্ষে আপনার আইডেন্টিটি আপনাকে শো করতে হবে। ভুলক্রমে অথবা লজিক্যালি একপক্ষের কেউ অন্যপক্ষের সাথে মিলে যায় এমন কথা বললে, তাকে নিজেদের পক্ষ থেকে খারেজি ঘোষনা করা হয়, ফেসবুকীয় ব্লাসফেমি আইনে তাকে একঘরে করে দেয়া।
.
এমন অবস্থায় সত্য, সুন্দর, শান্তির চর্চা হয় না। এটা এমন কলিকাল যা, সময়কে পিছিয়ে দেয়, সবকিছু চলে উলটো। ধর্ম-চর্চা এখানে aura-বিহীন, নূর-বিহীন, হেদায়েতের নূরের ছটা এখানে নিষ্প্রভ, ধর্মের ধ্বজাধারীরা যেন গোয়ার, বিশ্বাসের মতো সৌন্দর্য, যুক্তির আদলে কদাকার। কোমলতা বিবর্জিত ধার্মিকদের দেখে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস, ধর্মকর্মের প্রতি আস্থা যেন ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে।
.
অন্যদিকে প্রগতিশীলদের মধ্যে ঢুকে গেছে কট্টর ধার্মিকতা। যুক্তি, বিজ্ঞান ওদের কাছে ধর্ম। দার্শনিক আর বিজ্ঞানীরা ওদের নবী, বিজ্ঞানের বানী ওদের কাছে ঐশী বাণী। ঐ বাণীর বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না, বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। কেউ ওদের কোন নবীর উপর ঈমান হারা হলে তাকে ধার্মিকদের মতো কাফির ফতোয়া দেয়া হয়, ঐ নব্য-ধর্মীয় মতাদর্শ থেকে খারিজ করে দেয়া হয়।
.
আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?
আমরা কি এমন বাংলাদেশ চাই?

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৫
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৪–৫ আগস্ট : রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোশ খুলে দেওয়া রাত ও দিন

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০১

৪–৫ আগস্ট : রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোশ খুলে দেওয়া রাত ও দিন

৪ আগস্ট রাত — আশ্বাসের আড়ালে ছদ্ম-অভ্যুত্থানের নীরব নকশা
৪ আগস্ট সন্ধ্যায় কোটা-আন্দোলনের বিশৃঙ্খলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যখন রাষ্ট্রজুড়ে উত্তেজনা,... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে এমপি হওয়ার মতো ১ জন মানুষও নেই

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪



দলগুলোতে মানুষই নেই, আছে হনুমান।

আমেরিকায় যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় না'আসতো, বাংলাদেশে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে ইউনুসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, দেশ চালাতো প্রাক্তন মিলিটারী অফিসারেরা ও বর্তমান জামাতী অফিসারা মিলে। দুতাবাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

=চলো দেখি সূর্য উদয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫০


শীত কুয়াশা ফুটো করে,
সূর্য যখন উঠে নীলে
দেয় ছড়িয়ে সোনা আলো,
দেখলে মনে শান্তি মিলে।

একটি সকাল ফের পেয়ে যাই
নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচি সুখে,
পাই প্রেরণা সূর্যের কাছে
আলোর শক্তি তুলি বুকে।

দেখবে নাকি আমার সাথে
রোজ বিহানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মজনু নামাজ পড়ার পর মোনাজাত ধরল তো ধরলই, আর ছাড়তে চাইল না | পাক আর্মির বর্বরতা!!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭



১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মি পুরো বাঙালী জাতির উপর যে নৃশংস হত্যাংজ্ঞ, বর্বরতা চালিয়েছে যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। সত্যি বলতে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির উপর পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক... ...বাকিটুকু পড়ুন

সব দোষ শেখ হাসিনার !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৬


অনেকদিন পর zahid takes এর ডা. জাহেদুর রহমানের এনালাইসিস ভিডিও দেখলাম। জুলাই আন্দোলনের পূর্বে বিশেষত যখন র‍্যাব স্যাংশন খায় তখন থেকেই উনার ভিডিও দেখা আরম্ভ করি। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×