somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হারেমখানার রহস্য

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী জীন অগাস্ট, জন ফ্রেডরিক লুইস, জীন লিওন জেরোমি, এন্থন ইগনাজ মেলিং এরকম অসংখ্য চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্র কর্মে হারেমখানা নিয়ে অনেক চিত্র পাওয়া যায়। ইউরোপীয় চিত্রশিল্পীদের এই সব চিত্রকর্ম নিয়েও যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। অনেকে বলেন এখানে নাকি হারেমখানার নারীদের অশ্লীল চিত্রকেই বেশি উপস্থাপন করা হযেছে। এটা একদম ফেলে দেয়ার মত নয়। এসব চিত্র কর্মে সত্যিকার অর্থেই একগাধা নগ্ন নারীর ছবি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু এসব নগ্ন ছবির মধ্যেও ফুটে ওঠে অনেক বিষয়। এই ছবিগুলোও আমাদের ধরিয়ে দেয় ঐ সময়কার নানান ইতিহাস। বিশেষ করে নারী সমাজের সামাজিক অবস্থান।
হারেমখানা নিয়ে রহস্যের যেনো শেষ নেই। অবশ্য শেষ হওয়ারও কথা নয়। কারণ সম্রাটদের আবাসস্থলের এই জায়গাটি ইতিহাসের অনেক বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে। যার সাথে রয়েছে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবিও। অনেকে মনে করেন ইসলাম আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই বোধ হয় হারেম প্রথার প্রচলন শুরু হয়। আসলে বিষয়টা সেরকম ছিলো না। হারেম প্রথার প্রচলন প্রথম শুরু হয় ইরাক, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, প্রাচীন গ্রীস এবং পারস্যের উঁচু শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে। তবে এটা সত্য যে আব্বাসীয় খেলাফতের সময় এই হারেম প্রথা জিনিসটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। আব্বাসীয় খেলাফতের পর থেকে উসমানীয় খেলাফতের সুর্দীঘ সময় পর্যন্ত এই হারেম প্রথাটি প্রত্যেক রাজ প্রাসাদেই দেখা গিয়েছিল। সেখানে অবশ্য হারেম খানাকে হারেমখানা না বলে “সেরাগ্লিয়ো” বলে সম্বোধন করা হতো। সেরাগ্লিয়োর সাথে ভারতবর্ষের সম্রাটদের হারেমখানার হুবুহু মিল পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের মতোই সেখানকার হারেমখানায় সম্রাটের পত্নী, উপপত্নী, মা, বোন, দাদী ও পাশাপাশি অসংখ্য যৌনদাসীর বসবাস ছিলো। এই যৌন দাসীর সংখ্যা অবশ্য একেক রাজার সময় একেক রকম ছিলো। যেমন সম্রাট আকবরের সময় ছিলো পাঁচ হাজারেরও বেশি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ছিলো দুই হাজারেরও বেশি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কী হতো এই হারেম খানায়? কেমন ছিলো ভেতরকার পরিবেশ? হারেমখানায় কী হতো সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজন নেই। হারেমখানার প্রকৃতি দেখলেই তা সহজেই আঁচ করা যায। হারেমখানায় একজন সম্রাটের পত্নী, মা, দাদী এরকম পারিবারিক মহিলার বাইরে প্রচুর পরিমাণে সেবা দাসীর বসবাস ছিলো। এই দাসীদের দিয়ে মিটতো রাজার মনের বিলাসিতা। কখনো গান শোনার ইচ্ছে করলে রাজা গান শুনতেন। কখনো তাদের নাচ দেখতেন। যৌন উদ্দীপনা জাগলে তাদের সাথে যৌন মিলনেও রাজা লিপ্ত হতেন। এখানে ঐ দাসীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে কোনো বিষয় ছিলো না। এসব দাসীদের নাচ গান শেখানোর ব্যবস্থাও সম্রাট নিজে করে দিতেন। এক কথায় খেলার পুতুলের মতো ছিলো হারেম খানায় বন্দী হাজার হাজার মহিলার জীবন। হারেমখানা থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে তাদের ছিলো কঠোর নিষেধাজ্ঞা। অবশ্য বিভিন্ন সময় এবং সম্রাট ভেদে এ নিষেধাজ্ঞায় বিভিন্ন পরিবর্তন ছিলো। যেমন ইলতুৎমিশের কণ্যা রাজিয়া সুলতানা হারেম থেকে শুধু বেরই হন নি। রাজ্য পর্যন্ত চালিয়েছিলেন। এরকম সম্রাট ভেদে এ নিষেধাঞ্জায় কোমলতা কিংবা কঠোর মনোভাব দেখা দিয়েছিল। তবে বেশির ভাগ সময়ই হারেমের মহিলাদের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি জায়গার মতই হারেমের মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়েছিল। তাদের রাজনৈতিক অধিকার তো দূরের কথা, ব্যক্তি স্বাধীনতাটি পর্যন্ত ছিলো না।


প্রশ্ন জাগতেই পারে, হারেমখানার এই মহিলারা আসতো কোত্থেকে? হারেমখানার এই মহিলাদের আসার পেছনেও রয়েছে এক নির্মম ইতিহাস। তৎকালীন সম্রাটরা নতুন একটি রাজ্য জয় করেই বসে থাকতেন না। রাজ্য জয়ের পর তাদের চোখ পড়তো সে রাজ্যের নারীদের উপর। ফলে একটি রাজ্য নতুন রাজার হাতে যাওয়ার পরে সে রাজ্যের নারীরা অপেক্ষা করতেন এক মহা বিভীষিকার জন্য। রাজ্যের নারীদের পছন্দ মতো রাজা হারেমখানায় থাকতে বাধ্য করতেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময় সুলতান কিংবা মোগলরা উপঢৌকন হিসেবেও সুন্দরী নারীদের পেয়ে থাকতেন। ফলে হারেমখানা তৎকালীন ভারতবর্ষের নারী সমাজের জন্য এক আতঙ্কের নাম ছিলো। যদিও মোগল-সুলতান আমল পর্যন্ত বহাল তবিয়তে এই আতঙ্কজনক হারেমখানার বিষয়টি ছিলো। তখন সমাজ এতটাই সম্রাট এবং রাজাদের কুক্ষীগত ছিলো যে, এ্ই বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো শক্তিশালী কোনো মানুষই দাঁড়াতে পারে নি। মোগল সুলতানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিদ্রোহের খবর পেলেও হারেমখানার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহের কথা শোনা যায় না। রাজতন্ত্রের করাল গ্রাস তখন হারেমখানাগুলোকে এতটাই চেপে ধরেছিল যে এর বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত বলার সাহস পেত না। ফলে হারেমখানায় এই অসহায় নারীদের কাটতো ভয়াবহ সময়।
এখন প্রশ্ন হলো হারেম প্রথা কি ইসলাম সম্মত ছিলো? এ প্রশ্নটি নিয়ে যথেষ্ট মত বিরোধ রয়েছে। কট্টোরপন্থীরার এখানে হারেমখানার পক্ষে যুক্তি করেন। তারা বলতে চান এটি ইসলাম সম্মত। তৎকালীন উলেমাদের বক্তব্যও একই ছিলো। তারা এরকম বক্তব্যের মাধ্যমে একটু আড়াল করে রাখতে চাইতেন এর পেছনের উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতাকে। রাজ প্রাসাদের নারীরা রাজ প্রাসাদে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে শৃঙ্খলিত জীবন যাপন করতেন- এটাই তাদের বক্তব্য। তাদের এ বক্তব্য অস্বীকার করতে চায় নারীর প্রতি রাজার অবাধ যৌন আচরণকে। নারীর স্বাধীনতা হরণের বিষয়টিও তারা এড়িয়ে যেতেন। এটা যে স্রেফ রাজাদের বর্বর যৌন আচরণ আর ফ্যান্টাসির একটি জায়গা ছিলো তা তারা অস্বীকার করে যান। সর্বোপরি হারেমপ্রথাটিকে বিভিন্ন সম্রাট বিভিন্ন ভাবে ইসলাম সম্মত বলে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হারেম প্রথার সাথে ইসলামের দূরত্ব ব্যাপক। ইসলাম আসার আগে ভারতবর্ষেও এক ধরনের হারেমপ্রথা প্রচলিত ছিলো। তৎকালীন হিন্দু রাজারাও বহু বিবাহ প্রথা অনুযায়ী অনেক নারীকে বিয়ে করতেন। সেই সকল বিবাহিত নারীদের জীবনযাপনের সাথে মোগল- সুলতান রাজাদের হারেমখানায় বন্দী নারীদের জীবনযাপনের অনেক মিল পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলাম আগমনের মধ্য দিয়ে সুলতান মোগলদের হাত ধরে হারেম প্রথা নামে সরাসরি নারীর উপর শোষণমূলক এ ব্যবস্থা এই উপমহাদেশে আবির্ভূত হয়। পরে বিভিন্ন মুসলমান সম্রাট এটিকে ধর্মের সাথে মিশিয়ে দেন।

লেখক
সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী
বাকৃবি, ময়মনসিংহ।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ২:১৮
১১টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×