somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান: নারীদের সব থেকে অবহেলিত একটি জায়গা

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(পাকিস্তানের সাহসী কমরেড কুলসুমের লেখাটা আজ অনুবাদ করলাম। সবাইকে পড়ার অনুরোধ রইলো। পাকিস্তানের মত জায়গায় বসে এরকম লেখা একজন কমরেডের পক্ষেই সম্ভব)....


একটা সত্য ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা এটি। আমি আমার গবেষণার কাজে কিছু ঔষধি উদ্ভিদ সংগ্রহের জন্য তখন বেলুচিস্তানের পশনিতে অবস্থান করছিলাম। পশনি শহর থেকে একটু দূরে গোরানি এলাকা থেকেই ডাটা সংগ্রহের জন্য নির্বাচন করেছিলাম। এলাকাটিতে মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। আমি সেখানে পৌঁছেই আমার উদ্ভিদ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এমন সময় হঠাৎ করে পাঁচটি অল্প বয়স্ক মেয়ের দিকে আমার চোখ গেল। তারা সবাই এখানে কাঠ কাটতে এসেছিল। এই কাঠ দিয়েই তাদের বাড়ির রান্নাবান্নার কাজ সম্পন্ন হয়। আমি তাদের মুখের সরল হাসির দিকে তাকাচ্ছিলাম আর তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউড়ে উঠছিলাম।
আমি তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। তাদের নির্মল হাসি আমাকে সেদিন অভিভূত করেছিল। আমি দেখলাম, আমাকে দেখে তারা সবাই খুব লজ্জা পাচ্ছিলো। কেউ ভাল মতন কথা বলতে চাচ্ছিলো না। এমন সময় তাদের মধ্যে একজন আমার দিকে এগিয়ে এল। বললো, “আমার নাম বানুক।” বানুকের সাথে আর যারা ছিল সবাই-ই তার আপন বোন। এদের মধ্যে বানুক সবার থেকে বয়সে ছোট।
আমি বুঝতে পারছিলাম বানুক আমাকে অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি খুব দ্রুত তার সাথে বন্ধুর মতো মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। বানুক বললো যে সে স্থানীয় একটা স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা শেষ করেছে। ঐ স্কুলে কেবল পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্তই পড়াশুনা হত। সেখানে তাদের মিডল স্কুলে একটা বিল্ডিং থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে বানুক তার পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে নি। বানুক বললো, “ঐ স্কুল থেকে আমিই প্রথম পঞ্চম শ্রেণী পাশ করতে পেরেছিলাম। আমার বড় বোনদের কেউই স্কুলে যেতে পারে নি। তারা ইংরেজিতে ওয়ান, টু গণনাটিও শিখতে পারে নি। তবে তারা ভালো উর্দু বলতে পারে।”
তবে তাদের যে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না বিষয়টা সেরকম ছিল না। তারা চেয়েছিল, কিন্তু কোন সুযোগ পায় নি।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এভাবেই একেকটি মেয়ের জীবনের অধ্যায় শেষ হয়ে যাচ্ছে! অথচ আজকের এই আধুনিক সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কত তোড়জোড়! আমাদের পাকিস্তানেও কি কম এরকম নারী অধিকার কর্মী রয়েছেন? কিন্তু কোথায় তারা? তাদের বেশির ভাগই নিরাপদ স্থানে অবস্থান করেন। বেলুচিস্তানের এই গোরানি এলাকায় তাদের আসার যেন কোনো দরকার পড়ে না। এটাই তাদের কার্যকলাপ। যে সকল নারীরা আজকের সমাজে খানিক ক্ষমতা পেয়েছেন, খানিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছেন তাদের নিঃসন্দেহে এই গোরানি এলাকার মত এলাকা গুলোতে এসেই কথা বলা উচিত। কারণ সেখানে অসংখ্য বানুক তাদের আসার অপেক্ষায় রয়েছে। অপেক্ষায় রয়েছে এজন্য যে শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করে তারা দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখবে। বানুকদের এই অবস্থার পেছনে মূলত অনেকগুলো বিষয় দায়ী। পাকিস্তানের আর্থ সামাজিক অবস্থার পাশাপাশি তাদের বেলুচ ( বেলুচিস্তানের অধিবাসী) পরিচয় এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী। এ বিষয়টিতে যাওয়ার আগে অন্য একটা বিষয় নিয়ে একটু আলোকপাত করে নিই।
পাকিস্তান মগজে মগজে একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। বিশ্ব অনেক দূর এগুলেও পাকিস্তানে হাড়ে হাড়ে পিতৃতান্ত্রিকতাকে মানা হয়। পাকিস্তান এখনো এই গোঁড়া বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি। এই গোঁড়া বিশ্বাসের কারণে নির্মমভাবে ধ্বংস হচ্ছে পুরো পাকিস্তানের নারী সমাজের ভবিষ্যত। সামাজিকভাবে এখানে এমন একটা বিশ্রী পরিবেশের সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে যে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া আর কোন শিক্ষা গ্রহণ করলে সমাজ সেটাকে অপরাধের চোখে দেখে।
পুরো পাকিস্তানের থেকে আমাদের বেলুচিস্তানের অবস্থা আরো খারাপ। এখানে উল্লেখ্য পাকিস্তানের মোট আয়তনের ৪৪% জুড়েই রয়েছে বেলুচিস্তান। বেলুচিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি প্রদেশ। কিন্তু এই বেলুচিস্তানই আবার পাকিস্থানের প্রদেশগুলোর মধ্যে সব থেকে দরিদ্র। বেলুচরা সব থেকে বেশি বৈষম্যের স্বীকার হয় পাকিস্তানী সরকার দ্বারা। স্বাস্থ্য বলি, শিক্ষা বলি আর আয় বলি প্রত্যেক ক্যাটাগরিতেই বেলুচিস্তানের অবস্থান একেবারে তলানিতে। এই বৈষম্যে বেলুচ নারীদের দুঃখ গাঁথার নেপথ্যের অন্যতম প্রধান একটি কারণ।
২০১৮ সালের জাতিসংঘের উন্নয়ন রিপোর্ট অনুসারে পাকিস্তানের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। বিশেষ করে বেলুচিস্তানে। ১৫৮ টা দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ১৫০ তম। এই র্যাং কিং হয়েছিল ইন্টেগ্রেশন রেভিনিউ, শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে। এই রিপোর্টে বেলুচিস্তানের জেলাওয়ারী অবস্থাও তুলে ধরা হয়। যেখানে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে বেলুচ নারীদের দুঃখগাঁথা। এরকম অসংখ্য রিপোর্ট আসে রিপোর্ট যায়। কিন্তু বেলুচিস্তান তথা পাকিস্তানকে এই অন্ধকার থেকে উদ্ধার করবে কে? এই অমীমাংসিত প্রশ্নটি আজো আমাদের নারী সমাজের মুক্তির প্রশ্নে এক বিশাল বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মূল: কুলসুম পীরজান বেলুচ
অনুবাদ: সৌরভ দাস
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:০১
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×