১.
গতরাতে কাজের বুয়া এসে জিজ্ঞেস করে, পুরাতন অকেজো কোন চটি স্যান্ডেল আছে কিনা।
জিগাই, কেন, পুরাতন চটি দিয়ে কি করবেন?
- আমার নাতির স্যান্ডেল নাই। পুরাতন এক জোড়া কোথাও পাইলে নিয়া ওরে দিতাম।
জিজ্ঞেস করি, আপনার নাতি করে কি?
- রিশকা চালাইতো। আইজ দু'দিন ঘরে বসা। কাজ কাম নাই। লকডাউনে কামে যাইবো ক্যামনে?
- লকডাউনে রিকশা চালানো কোন সমস্যা নাই।
- হ্যায় তো ব্যাটারির রিশকা চালায়। ব্যাটারির রিশকা চালানো তো নিষেদ। তাছাড়া রিশকা নিলে প্রত্যাক দিন চাইর'শ ট্যাহা মালিক'রে ভাড়া দেওন লাগে। এহন তো দিন চাইর'শ ট্যাহা কামাই অইবো না। এই জন্য যাই নাই। ঘরে শুইয়া থাহে।
বুয়া খালার কপালে চিন্তার ভাজ। কয়েকটি ব্যাচেলর বাসায় রান্না করে। লকডাউনে সেইসব বাসার লোকেরা বাড়ি চলে গিয়েছে। ঈদের আগে হয়তো ফিরবে না। সব মিলিয়ে প্রায় এক মাস এক রকম কর্মহীন থাকতে হবে। ঝিয়ের ঘরের এক নাতী ছেলেকে নিয়ে বুয়া খালার সংসার। সেও ঘরে বন্দি। কাজে যেতে পারছে না। ঘরে অল্পকিছু চাল ছাড়া আর কিছু নাই। কি করবে? কি খাবে? কেমন চলবে? আর কবেই শেষ হবে এই লকডাউন? এই চিন্তায় মন মরা।
২.
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের তথ্যমতে, ঢাকায় অতিদরিদ্র বেড়েছে ৪ গুণ। চলতি বছরের শুরুর দিকে সানেম এ তথ্য প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে ঢাকার পরেই সিলেট, এরপরে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। এ দুই বিভাগেই গেল ২ বছরে দরিদ্র মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। তবে সিলেটের চেয়ে চট্টগ্রামে অতিদারিদ্র্য বেড়েছে বেশি দ্রুত হারে। বন্দরনগরে অতিদরিদ্র মানুষ ৩ গুণের বেশি বেড়ে এখন প্রতি ১০০ জনে ১৯ জন, আর সিলেটে প্রায় ৩ গুণ বেড়ে ১০০ জনে ২৭ জন। অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকায় সবচেয়ে দ্রুত হারে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মোট ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৪ ওয়ার্ডেই দরিদ্র মানুষ বসবাস করেন। এসব ওয়ার্ডে মোট দরিদ্র এলাকা রয়েছে ৭৮৬টি। যেখানে মোট ৭১ হাজার ৩৪৬টি পরিবারের তিন লাখ ৪২ হাজার ৪০৯ দরিদ্র মানুষ বসবাস করেন। জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে করা এক গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
৩
করোনা ভাইরাস ইস্যুতে দেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। সার্বিক দিক বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য কোন পেশার মানুষ খুব একটা ভালো নাই। দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বিমুখ হয়ে পড়েছে। আসক্ত হয়ে পড়ছে অনলাইন ভিত্তিক নানা ভিডিও গেমে। নন-এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তা। ভালো নেই বেসরকারি ছোটপদে চাকুরি করা ব্যক্তিগণ। সব মিলিয়ে চরম ক্রাতিকালের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের দিন।
করোনা ভাইরাস জাতীয় সমস্যা নয়। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। করোনা ইস্যুতে উন্নত অনেক দেশেই লকডাউন চলেছে বা চলছে। অনেক দেশ নাগরিকদের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। অনেক দেশই স্বাভাবিক জনজীবনে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের দেশে সর্বসাধারণদের ভ্যাকসিন প্রয়োগে খুব একটা আন্তরিক দেখা যাচ্ছে না। এদেশে অনেক ভ্যাকসিন ও টিকা এখনও সর্বসাধারণের জন্য ফ্রীতে গ্রহণের সুযোগ আছে। সেখানে করোনার এতো মহামারি একটা ভাইরাসের টিকা সর্বসাধারণের জন্য ফ্রী করলে সরকারের লাভের চেয়ে ক্ষতি কি বেশি হবে? সরকার তো অনেক ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভর্তুকি দিলে ক্ষতি কি?
৪.
চলমান লকডাউনে জনসাধারণ যেন ঘরে থাকে একারণে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় মানুষ ঘরে বন্দি। তারপরও যাদের উপায় নাই। তারা বের হচ্ছে। অনেক ক্ষুদ্র দোকানী আড়ালে আবডালে পণ্য বেচা কেনা করছে। অটোচালক লুকিয়ে দু'টাকা ইনকাম করার চেষ্টা করছে। কখনও কখনও ধরা পড়ছে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। মামলা পড়তে হচ্ছে কিংবা ভেঙ্গে ফেলছে আয় রোজগারের একটা মাত্র সম্বল অটোরিকশা।
কথায় আছে, পেটে খেলে পিঠে সয়। আগে ঘরে ঘরে খাদ্য নিশ্চিত করলে তবেই লকডাউন সার্থক হবে।
-সোহাগ তানভীর
কথাসাহিত্যিক
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২১ সকাল ১১:৩৭