গল্প: মেমোরী ইরেইজ।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আমি আজ কাউকে চিনব না। সবাই আমাকে চিনবে। এটা ভাবতেই এক বিস্ময়কর অনুভূতি আমার মস্তিককে শীতল করে দিচ্ছে। আবার নতুন করে চিনতে হবে পৃথিবী নামক গ্রহের অদ্ভুত জীব সত্তাকে। যারা বদলায় দিনের সূর্যের মতো, রাতের চাঁদের মতো। প্রহরে-প্রহরে। জ্যোৎস্নায় আর অমাবস্যায়। যারা হিংস্র পশুর মতো লোলুপ থাবা বাঁড়ায় তার-ই পরিচিত কোন নিরীহ জীবের ওপর। যা হোক, ক’টা দিন নিশ্চিতে থাকা যাবে। উৎকণ্ঠা, ভয়, দ্বিধা, উদ্বেগ, পাপাচার, পরহিংসা আমাকে গ্রাস করবে না।
একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার। আমার কিন্তু এই শহরের সব পথ, উঁচু-নিচু ইমারত, অফিস পাড়া, ব্যস্ত জীবন, লঞ্চ-বাস, তোমার-আমার ঠিকানা সব পরিচিত। কেননা এগুলো জড়। জীবন নেই। অনুভূতি শূন্য। স্বার্থে টান লাগলে সাপের মত বিষ ছুঁড়ে মারে না। আমি শুধু জীবদের, মনে করতে পারছি না!!
বাসার ঠিকানাটা মনে করে পৌঁছে, দরজায় লাগানো কলিং বেলটায় চাপ দিলাম। ওপাশ থেকে মাঝ বয়সী একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। তার চেহারা আর পোশাক দেখে বুঝতে কষ্ট হলো না, সে এই বাসায় কাজ করে। মানে ভদ্র সমাজে যাদের বলা হয়, কাজের মেয়ে। আমি ড্রয়িং রুম দিয়ে সোজা হেঁটে আমার ঘরে গিয়ে বসলাম। একটু পরে, একজন পঞ্চাশের কাছাকাছি মহিলা এসে বলে উঠলো, “কি ব্যাপার, দু’দিন ধরে কোন খবর নেই? মোবাইল টাও বন্ধ করে রেখেছো?”
চোখ দু’টো বড় বড় করে, একটু বিশ্রাম নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগল,
“অফিসে ফোন দিয়ে জানলাম, সেখানেও নাকি দু’দিন ধরে যাও না। নিজেও ফোন করে বলতে পারতে।”
আমি অবাক হয়ে, চুপচাপ সোফার চেয়ারে গা এলিয়ে, শুনে যাচ্ছিলাম। উনার কথাবর্তা শুনে এটা স্পষ্ট, উনি আমার মা। আমি অসহায় মতো তাকিয়ে থাকলাম। কথা শুনছি, এমন একটা ভাব প্রকাশ করতে চেষ্টা করছিলাম। আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। যা হোক, উনি আরো কিছু উপদেশ আর হতাশা মূলক বাক্য দিয়ে খচমচ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমি আমার ঘরটাই নতুন করে দেখতে লাগলাম। যেন অনেকদিন পর শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে আগমন। না, এতো চিন্তা করার দরকার নেই। দু’দিন ধরে গোসল করা হয়নি। এক বিছানায় শুয়ে শুয়ে গায়ে ঘামের বিশ্রী গন্ধ লেগে আছে। আমি বাথরুমের শাওয়ারে নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ গোসল করলাম। যেন বহু বছরের জমে থাকা স্মৃতির ময়লা ধুয়ে যাচ্ছে।
আমি পরিপাটি হয়ে অফিসের দিকে এগোতে লাগলাম। আমার ডেসকে গিয়ে কিছুক্ষণ বসার পর, একজন আটাশ বছরের স্মার্ট, সুদর্শন যুবক এসে একটা নীল ফাইলের দিকে মুচকি করে হেসে জিজ্ঞেস করছে, “কি ব্যাপার এখনো সিঙ্গাপুরের প্রজেক্ট তৈরি হয়নি? আজ কিন্তু প্রেজেনটেইশন। মনে আছে?”
আমি যেহেতু দু’দিন ধরে অফিসে আসিনি তাই ফাইলটি এখানেই পড়ে ছিল। উনার আচরণ দেখে বুঝতে চেষ্টা করলাম, উনি সম্ভবত আমার চেয়ারটা দখল করার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় আছে। কারণ আমি কাজটি শেষ করতে না পারায় উনি খুব খুশি হয়েছেন এবং চোখে-মুখে এক ধরনের দাম্ভিক ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পিয়ন এসে বলে গেল, অফিসের বস আমাকে দেখা করতে বলেছেন। আমি আমার অশুভ ফলাফলের জন্য প্রস্তুত ছিলাম।
যথারীতি চাকরীটা গেল। আর আমার জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হলো সেই সুদর্শন যুবককে। চাকরীটা চলে যাওয়ায় কষ্ট হবার কথা কিন্তু আমার তেমন কষ্ট লাগছিল না। যেহেতু আমি কাউকে চিনতে পাচ্ছি না, তাই কোন মানুষের প্রতি আমার দায়িত্ব-কর্তব্য বা দূর্বলতা বোধ বা বেঁচে থাকার জন্য শুধু চাকরীটা মুখ্য মনে হচ্ছে না। পরে কিছু একটা করা যাবে। জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার স্রোতের তাগিদে আমাকে আবার কাজ করতে হবে। আবার ফিরে যেতে হবে পৃথিবীর মানুষের ক্রোধানলে। যেখানে আবার আমি হয়ে উঠবো পাকা অভিনয় শিল্পী।
অফিস থেকে বের হয়ে, সোজা পার্কে গিয়ে বসলাম। কয়েকটা ছেলে মাঠের অভাবে পার্কেই ক্রিকেট খেলছে। অনেক লোকজন আসছে, যাচ্ছে। জুটিরা বেঞ্চে বসে প্রেম করছে। মনে পড়ে যায় –
বেঞ্চিগুলোর কাঠ, রোদে পুড়ে জলে ভিজে
সমকাল এসে বসেছে সেখানে আহত প্রেমিক সেজে।
পাড়ার ছোট্ট পার্ক, ঘাস নেই আছে ধুলো
ঘাসের অভাব পরোয়া করে না সবুজ বাচ্চাগুলো।
লোহার গেটের পাশে উনুন ধরায় কারা
রেলিং ঘেসেই সংসার করে ক’জন বাস্তুহারা।
আর মনে করতে পারছি না। তাইতো পার্কে মধ্যে যারা জীবন-যাপন করে, তাদের চেয়ে আমি তো অনেক ভাল ছিলাম। হয়ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, মাথার উপর ছাদ, ফ্যান, টিভি, মাস শেষে অনেক টাকা, সংসার সব ছিল। কিন্তু এই রঙ্গমঞ্চে আমরা জীবন ধারনের জন্য সবাই অভিনয় করে যাচ্ছি। আমরা কি আমাদের সব কথা বলতে পেরেছি? সব সঠিক কাজ করতে পেরেছি? সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পেরেছি? অসততাকে দূরে ঠেলতে পেরেছি? আমরা কি নিজের সাথে প্রতারণা করছি না?
আমি কি আমার বাবা-মাকে সব খুশি দিতে পেরেছি? তাঁরাও কি আমাকে সব দিতে পেরেছে? কর্মক্ষেত্রে কি সবসময় সঠিক কাজটি সম্পন্ন করেছি? না। অনেক কিছুই করতে পারিনি, করা হয়নি। কাউকে কথা দিয়েছিলাম, কেউ কথা দিয়েছিল! রাখতে পারিনি, রাখে নি! চলে এসেছি। চলে গেছে। হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে গেছে। সব হারিয়ে যাবে। দূর-বহুদূরে। আমি হয়তো কাউকে চেয়েছিলাম। পাইনি। তবুও আমাকে বাঁচতে হবে। অভিনয় করতে হবে। হাসতে হবে। সুখী-সুখী ভাব প্রকাশ করতে হবে। বংশবৃদ্ধি করতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে। আরো অনেক; অনেক কিছু। অবশ্য আমি যদি - মরে না যাই!!
এইসব কিছুকে ভুলে থাকার জন্য আমি, দু’দিন আগে; আমার মেমোরী ইরেইজ করেছি। ওরা বলেছে, তিন মাস আমি পুরানো কাউকে মনে করতে পারব না। তাই এ ক’টা দিন আমি আবার নতুন করে ওদের চিনে নিচ্ছি। বুঝতে চেষ্টা করছি। কিন্তু তিন মাস পর, তাদের স্মৃতির পেরেক আমার মেমোরীকে আঘাত করবে। মনে পড়ে যাবে সব। শুরু হবে আবার বেঁচে থাকার জন্য অপরূপ অভিনয়।
১৯টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন
=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=
০১।
=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।
পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।
জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সমস্যা মিয়ার সমস্যা
সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।
তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন