গভীর রাত। বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দের আওয়াজ। জানালা দিয়ে উকি দিতেই দেখি গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়ে রাস্তা পড়ে আছে একটা কুকুর। বাসার দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি গলিতে। আহত কুকুরটি বাসায় এনে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পরের দিন পশুহাসপাতালে নিয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন সেবা যত্ন করার পর কুকুরটিকে সুস্থ করে তুলি। এখন এক চোখে সমস্যা ও একটি পা খুড়িয়ে হাটলেও সে বেঁচে আছে। আর তাকে বাঁচাতে পাড়াটাই আমার কাছে স্বার্থকতা।
এমনই বলছিলেন, কুকুর বিড়ালের 'রবিন হুড' আফজাল খান। তরুণ এই টিভি অভিনেতার ঘরে আশ্রয় পেয়েছে দুর্ঘটনায় আহত ও রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা ৪২ টির বেশি কুকুর-বিড়াল। যার খাবার-চিকিৎসা সব বহন করেন তিনি। রাস্তার কুকুর বিড়ালের প্রতি তার আছে অগাত ভালোবাসা। তাই তো নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন বছরের পর বছর।
ছোটবেলা থেকে তাঁর শখ ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে নিজের অজান্তেই এই অবলা প্রাণীগুলোর বন্ধুতে পরিণত করেছেন এই তরুণ। 'রবিন হুড দ্যা এনিমেলস রেসকিউয়ার' নামে একটা ফোসবুক পেজ আছে তার। যেখানে তার কাজের সকল কিছু আপডেট দেন।
রাজধানীর খিলগাঁ তিলপাপাড়ায় বসবাস আফজালের। পিতা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ছোট বেলা থেকে অভিনয় ও পশুপাখির প্রতি দুর্বলতা ছিল তার। তাইতো বাড়িতে বানর, বিড়ালসহ হরেক রকম প্রাণী পুশতেন। তবে পরিবারের সদস্যরা তার এসব কাজকে ভালো চোখে দেখতেন না। তবে পড়াশোনায় মেধাবী হবার কারণে আফজাল খানের সব আবদার রাখতেন পরিবারের সদস্যরা। বেশ কিছুদিন বাড়িতে পোষাপ্রাণীদের নিয়ে থাকলেও ২০১০ সালে আফজাল বাড়িতে শুরু করেন রাস্তায় আহত পশু পাখিদের দেখভাল। গাড়িতে আহত অথবা মানুষের দ্বারা নির্যাতিত কুকুর বিড়াল তিনি নিজেই উদ্ধার করে বাড়ি আনেন। সেগুলোকে চিকিৎসা, সেবা-যত্ন করে লালন পালন করে নিজের ঘরেই রাখেন তিনি।
আফজাল জানান, অনেক আগে থেকে কুকুর-বিড়াল পোষার শখ ছিল। কিন্তু কখনও ভাবিনি সেগুলোকে বাড়িতে এতো বড় পরিসরে লালন-পালন করতে পারব। ২০১৫ সালে আমি আহত প্রাণীদের কিভাবে ট্রিটমেন্ট (চিকিৎসা) করতে হয় সেটার মোটামুটি ধারণা পাই। এরপর থেকে পুরো দমে কাজ শুরু করা।
তিনি জানান, বর্তমানে তার বাড়িতে বিভিন্ন ভাবে আহত হওয়া ৯টি কুকুর ও ৩৩টি বিড়াল আছে। যেগুলো তার ঘরেই থাকে। এই সব কটি প্রাণী কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন জায়গা থেকে এদের উদ্ধার করা হয়েছে।
আফজালের বোন তাইয়েবা নাসরীন রাকা। তিনিও ভাইয়ের মতো বাড়ির কুকুর-বিড়ালগুলোকে আপন করে নিয়েছেন। আফজালে অবর্তমানে সেই কুকুর বিড়াল গুলোকে খাবার খাওয়ানো, ঔষধ খাওয়ানোসহ বিভিন্ন দেখভালের কাজ করেন। ঢাকাটাইমস কে তিনি জানান, ভাই আফজালের কাছ থেকেই মূলত আহত কুকুর-বিড়ালদের নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত হয়েছেন।
তিনি জানান, অনেক সময় কুকুর-বিড়ালের ওপর নির্যাতনকারীদের সঙ্গে মারপিটেও জড়ান তার ভাই। এমনকি চলার পথে কুকুর-বিড়ালদের আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলে সেগুলোকে হাসপাতালে নিয়ে যান আফজাল। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে গেলে আশ্রয় দেন নিজের ঘরেই বলছিলেন আফজালের বোন।
আফজালের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, ৫তলা বাড়ির দুটো রুম ও বারান্দায় কুকুর বিড়ালের বসবাস। রুমে ঢুকতেই দেখা গেল কয়েকটি বিড়াল এসি রুমে আফজালে বেডে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। কিছু বিড়াল ঘরের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে খেলায় মগ্ন। ঘরের বিছানা, আলমারির ছাদ সব বিড়াল কুকুরের দখলে। এমনকি খাটের নিচেও বাদ নেই। এর মধ্যে কিছু কুকুর-বিড়াল প্যারালাইসড, কিছু মেরুদন্ড ভাঙ্গা, কিছুর চোখে সমস্যা। এর মধ্যে একটি বিড়াল সাত তলা থেকে পরে মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। তাই বিড়ালটিকে আফজাল নিজে ধরে বাথরুম করান।
আফজাল বলেন, এই কুকুর বিড়ালের জন্য প্রতিমাসে ৪মণ মুরগির মাংশ, ১০০ পিছ ডিম, ৬০কেজি চাল, ৫০ লিটার দুধসহ হরেক রকম ঔষধ ও ইনজেকশন লাগে। সকালে ডিম ও বিকালে দুধ দেওয়া হয় বেশির ভাগ দিন। আর দুপুরবেলা ও রাতে ভাতের সাথে মুরগির মাংশ দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার খাওয়ানো হয়। আর এসব কাজ সারেন তার ছোট বোন রাকা বলছিলেন আফজাল।
রাস্তার প্রাণীদের সুরক্ষায় আফজাল তার পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জন সচেতনা টিম গঠন করবেন। যারা রাস্তার কুকুর-বিড়াল কারও শত্রু নই মানুষকে বোঝাবেন। এছাড়া রাজধানীর হোটেলগুলোতে প্রতিদিন যে খাবার ফেলে দেওয়া হয় সেগুলো নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিতে হবে। তার দলের সদস্যরা সে খাবার সংগ্রহ করে রাস্তার কুকুর, বিড়াল, কাকসহ বিভিন্ন পশু পাখিতে খেতে দিবে নির্দিষ্ট স্থানে। তাহলে তারা ক্ষিপ্ত হবে না। কারণ এরা ক্ষিপ্ত হয় খাবারের অভাবে।
এতো কুকুর বিড়াল পালন করতে অনেক টাকার প্রয়োজন সংগ্রহ করেন কিভাবে এমন প্রশ্নে আফজাল বলেন, টিভিতে অভিনয়ের সব টাকা তাদের পিছনে খরচ করি। তবে এখন খরচ আরো বেড়েছে। মানুষের সাহায্য ছাড়া এখন কোন ভাবে সম্ভব হচ্ছে না পশুগুলো পালন করার। কারণ সরকারি পশু হাসপাতালগুলোতে গরু, ছাগল বা অন্য প্রানীর চিকিৎসা বা ঔষধ পাওয়া যায় কিন্তু কুকুর বিড়ালের কোন ঔষধ পাওয়া যায় না। ফলে বাহির থেকে ঔষধ কিনতে গেলে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। "তবে এতো কিছুর পরও আমি থামব না। প্রয়োজনে এই কুকুর বিড়ালের জন্য আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রক্ত বিক্রি করে হলেও লালন পালন করব।"
তথ্যসূত্র:
১)বাংলাদেশের প্রাণীদের রবিনহুড
২)বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়ালের নিরাপদ নিবাস চান 'রবিনহুড'
৩)কুকুর-বিড়ালের প্রতি আফজালের অকৃত্রিম ভালোবাসা
৪)কুকুর-বিড়ালের রবিন হুড
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:০০