
তোমরা এসেছিলে মাথার উপর বোমা পড়ার ভয়ার্ত গল্প নিয়ে। যে বোমা তোমাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে, লোকালয় ধ্বংস করেছে। আমরা কান বন্ধ করে উদাসীন হয়ে বসে ছিলাম। তোমরা এসেছিলে ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে। হিন্দ রাজাবের দিকে তাক করা ৩৩৫ টি গুলির কথা নিয়ে। নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের উপর চালানো স্নাইপারের গল্প নিয়ে। আমরা চোখ বন্ধ করে ছিলাম।
তোমরা এসেছিলে শুকনো হাড়ে পরিণত হওয়া শিশুদের সাথে নিয়ে। যাদের চোখে মৃত্যুভয়। তারা মৃত্যুর এত কাছে যে কান্না করার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। আমাদের ভুতুড়ে মানবতা তখন সামান্যই জেগে উঠেছিল।
তোমরা যখন অনাহারে ছিলে, আমরা তখন কী করলাম? আমরা ফেসবুকে সময় কাটালাম, পিটিশনে সই করলাম, আর এতেই বিরাট কাজ হয়েছে বলে ভান করলাম। তোমাদের গণহত্যা আমরা থামাতে পারিনি শুধু ক্ষমতার অভাবে নয়, সাহসের অভাবেও। বোমা পড়ার বহু আগে আমরা তোমাদের বিফল করেছি। তোমাদের চোখের সামনে আকাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগেই। তোমাদের অশ্রু থেকে কত সহজে যে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায়, সারা বিশ্ব সেটা দেখিয়ে দেওয়ার আগেই, তোমাদের রক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যে বয়সে তোমাদের জীবন বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, সে বয়সে তোমাদের ছোট্ট শরীর, তোমাদের স্মৃতি, ইতিহাসের দুর্বিষহ আঘাত ও শ্মশানের শূন্যতা বয়ে নিয়ে চলেছে।
আমাদের সব প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়েছে। স্যাটেলাইট, রকেট বা নেটওয়ার্ক থাকলেও কীভাবে শিশুহত্যা বন্ধ করা যায় ও পৃথিবীতে শান্তি আনা যায়, তা আমরা শিখতে পারিনি। আমরা এমন ফোন বানাতে শিখেছি যা মানুষের মুখ চিনতে পারে, কিন্তু ভিন্ন রঙের ভাই-বোনদের আমরা চিনতে শিখিনি। আমরা হৃদস্পন্দন মাপতে পারি, তিনমাত্রার সেলফি বানাতে পারি, কিন্তু মানব জীবনের অসীম মূল্য অনুধাবন করতে পারি না।
শীত নেমে আসায় তোমাদের কষ্টে যুক্ত হয়েছে ঠান্ডা, জলাবদ্ধতা আর অসুস্থতা। বৃষ্টি তোমাদের তাঁবুগুলোকে জলাভূমিতে পরিণত করেছে। ভেজা মেঝেতে কাঁপতে কাঁপতে তোমরা রাত কাটাচ্ছো। স্যাঁতসেঁতে ধোঁয়াটে বাতাসে কাশি দিচ্ছো। গরম কম্বল নেই, শুকনো জায়গা নেই, একে অপরকে আঁকড়ে ধরে তোমরা বাঁচার চেষ্টা করছো। আমাদের কাছে যখন শীত মানে বিশ্রাম, তোমাদের কাছে শীত মানে বড় বিপদ আর বড় অপমান। পানিতে ডুবে থাকা তাঁবুতে, গায়ে ছেঁড়া কম্বল জড়িয়ে শুধু একটা রুটি আর সামান্য উষ্ণতার আশায় তোমরা জেগে আছ।
ইতিহাস থেকে আমরা যদি শিখতে পারতাম! রুয়ান্ডা থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতাম, যেখানে শিশুদের গণহত্যা বিশ্বের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল, তবে জানতাম, চুপ থাকা মানেই গণহত্যাকারীদের সহযোগিতা করা। জানতাম, শিশুদের আর্তচিৎকার এমন সতর্কবার্তা, যা উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। আর এখন অকার্যকর এক যুদ্ধবিরতি গাজার গণহত্যাকে আমাদের চোখের আড়ালে ঠেলে দিয়েছে।
তোমরা দেখেছো, তোমাদের বন্ধুদের হাত-পা উড়ে গেছে। শুনেছো এক শিশুর ফিসফিস, "আমি সমুদ্র দেখতে চাই"। পরদিন সকালে সে আর হাঁটতে পারেনি। তুমি নূরকে চিনতে, যে তার ছোট বোনকে নিরাপদে নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, কখনোই আর জেগে ওঠেনি। কোন মানুষেরই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে মারা যাওয়ার কথা নয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের আগে কারও মৃত্যুবরণ করা উচিত নয়। কারও জীবন ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।
সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্র "আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন" এই মুখস্থ বুলি আওড়ানো ছাড়া আর কোন কাজ করেনি। কেউই ইসরায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করেনি। কাপুরুষেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে দাঁড়িয়েছিল। যে কোনো মূল্যে তারা তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চায়, সেই মূল্য যদি হয় তোমাদের জীবন দিয়েও, তবুও।
প্রতিটি ভাঙা জানালা, হারানো অভিভাবক, শীতে কাঁপতে থাকা ক্ষুধার্ত রাত - এসবই তোমাদের থেকে অনেক দূরে থেকে নেওয়া কতগুলো কাপুরুষের সিদ্ধান্তের ফল। এমন সব কাপুরুষ তোমাদের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারা কখনও তোমাদের চোখে দেখেনি, তোমাদের হাত ছু্ঁয়ে দেখেনি। তারা তোমাদের হত্যাকে ন্যায্যতা দিয়েছে, তোমাদের বসতভিটা জবরদখল করাকে নিরাপত্তা বলেছে, তোমাদের দুর্ভিক্ষকে উপহাস করেছে। তোমাদের রক্ত যেন তাদের সুবিধার খতিয়ানে কতগুলো কালির দাগ মাত্র।
তবু তোমদের কেউ কেউ বেঁচে আছো। ধ্বংসস্তূপে খেলেছো। অল্প খাবার ভাগ করে নিয়েছো। তোমরা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছো মর্যাদা কেড়ে নেওয়া যায় না। যারা মানবতা বিসর্জন দিতে অস্বীকার করে, তারাই মর্যাদা বাঁচিয়ে রাখে। নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে এটি এক অবিচল শিখা।
জানিনা বলে অজুহাত দেবার সময় আগেই শেষ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাসে ঘোলাটে আয়নায় মুখ দেখার মতো করে বিশ্ব তোমাদের দেখে। স্পষ্ট করে দেখার সাহস নেই, কারণ সেটা দায়িত্ব দাবি করে। নিরপেক্ষতা যে দুর্বলের বিরুদ্ধে শক্তিশালীদের পক্ষ নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়, এ ভানও আর চলবে না। অবিরাম ধ্বংসযজ্ঞ মেনে নিয়ে ন্যায়ের দাবি করা হাস্যকর। হলোকাস্ট থেকে শুরু করে উপেক্ষিত গণহত্যাগুলো বারবার দেখিয়েছে, শিশুহত্যা দেখে, তাদের কষ্ট দেখে, নীরব থাকার অর্থ তাদের কাজে সহযোগিতা করা।
এই গণহত্যা তোমরা শুরু করোনি, আর এই গণহত্যা থামানোর ক্ষমতাও তোমাদের নেই। তোমাদের বেঁচে থাকাটাই যখন অসুবিধা হিসেবে দেখা হয়, তখন ভেবে দেখ কি নিষ্ঠুর পৃথিবীতে তোমরা এসেছ? পৃথিবীর এই দুরবস্থার কথা আমরা যে জানতাম না, সেটা সত্যি নয়। সত্যটা হলো, আমরা জানতাম, কিন্তু আমরা কিছুই করিনি।
গণহত্যাকারীদের কাজের নিন্দার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পাওয়ার ছিল তোমাদের। খবরের কাগজের শিরোনামে, তোমাদের নামগুলোকে শুধু সংখ্যা হিসেবে প্রকাশের চেয়েও বেশি কিছু। সরা বিশ্বের নির্লিপ্ত উদাসীনতার ভেতরে এমন নৃশংসভাবে মরার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পাওয়ার কথা ছিল তোমাদের। একটি সরল ও আনন্দময় শৈশব পাওয়ার কথা ছিল।
আমরা এই চুপ করে থাকা প্রত্যাখ্যান করি। মিথ্যা কথার বয়ান প্রত্যাখ্যান করি। কণ্ঠ জোড়ালো করি। গণহত্যা থেকে যারা মুনাফা করে তাদের বয়কট করি। আমাদের সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বাধ্য করি। আমরা বাধ্য না করলে এগুলো বদলাবে না।
(লেখাটি জুলিয়ান আসাঞ্জের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট "দ্যা ট্রাস্ট ফল" থেকে নেওয়া। অনুবাদ করতে এআই এর সাহায্য নিয়েছি। মূল লেখাটির লেখক "কিম স্ট্যাটন"।)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


