somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা জানে—সংবাদমাধ্যম পুড়লে শুধু কাগজ পুড়ে না, ইতিহাস সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বাংলাদেশে এই লজ্জাজনক নজির একবার নয়, বারবার ঘটেছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিল তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক–এর কার্যালয়। ব্রাশফায়ারে শহীদ হন একজন নিরীহ ক্যান্টিনকর্মীর ভাতিজা। আগুনের মধ্য দিয়ে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন সাংবাদিকরা—কিন্তু পরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে প্রাণ দিতে হয় সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। এর চারদিন পর, ৩১ মার্চ, আগুন দেওয়া হয় দৈনিক সংবাদ অফিসে। ঘুমন্ত সাংবাদিক শহীদ সাবের দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

৫৪ বছর পর, সেই ইতিহাসের ভয়াবহ পুনরাবৃত্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশে।

আগুন দেওয়া হলো—রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে রইল
১৮ ডিসেম্বর রাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি সংবাদপত্র— প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার—এর কার্যালয়ে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। তখনও ভবনের ভেতরে কাজ করছিলেন বহু সাংবাদিক ও কর্মী। বিশেষ করে ডেইলি স্টার ভবনের আগুন ছিল ভয়াবহ। প্রাণ বাঁচাতে কর্মীরা ছাদে আশ্রয় নেন। ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা লিখেছিলেন— “আমরা মরে যাচ্ছি।”

রাষ্ট্র যদি সেদিন আরও কিছুক্ষণ দেরি করত, তবে ১৯৭১ সালের ইত্তেফাক–সংবাদের ইতিহাস হয়তো আরও নিষ্ঠুরভাবে ফিরে আসত।

ঘোষণা দিয়ে হামলা, ভিডিওসহ অপরাধ—তবু প্রশ্নহীন রাষ্ট্র
এই হামলা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েই প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ডাক দেওয়া হয়েছিল। হামলাকারীদের ভিডিও, ছবি, লাইভ ফুটেজ ছড়িয়ে আছে হাজারো মোবাইলে। কেউ কেউ আবার নিজেদের ‘কীর্তি’ গর্বের সঙ্গে প্রচারও করেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ৩১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, ১৭ জন আটক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—
হামলাকারীরা ধরা পড়ছে, অথচ উসকানিদাতারা কেন অধরাই থেকে যাচ্ছে?

আগাম সতর্কতা ছিল—কিন্তু প্রস্তুতি ছিল না
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে টার্গেট করে দীর্ঘদিন ধরেই হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও এই দুটি পত্রিকা আগে আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাহলে শাহবাগে লোক জড়ো হওয়ার মুহূর্তেই রাষ্ট্র বুঝল না কী আসছে?

কারওয়ান বাজার—রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র। সেখানে পৌঁছাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কত সময় লাগে? তবু তারা হাজির হলো ঘটনার পরে, বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো এসে বলল— “কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।”
কিন্তু ততক্ষণে আগুন জ্বলেছে, প্রাণ বিপন্ন হয়েছে।

নূরুল কবীরকে নাজেহাল: নতুন বাংলাদেশের নতুন লজ্জা
একই রাতে নূরুল কবীর, ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ–এর সম্পাদক, নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে ডেইলি স্টারে যান পরিস্থিতি দেখতে। সেখানে তাকে ঘিরে ধরে মব, করা হয় অপমান।

বিগত সরকারের আমলেও যাকে টকশোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তার গায়ে হাত তোলার সাহস তখন কেউ পায়নি। অথচ একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটল।

বিবৃতি আছে, বিচার নেই
ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ফোনে সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলে সমবেদনা জানান, নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। প্রেস সচিব শফিকুল আলম দুঃখ প্রকাশ করেন— “সাহায্য করতে পারিনি।”

কিন্তু কোথাও নেই একটি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি—
অপরাধীদের বিচার হবে।

সান্ত্বনা দেওয়া সরকারের কাজ নয়। সরকারের কাজ ব্যবস্থা নেওয়া। রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হলো—এই ব্যাখ্যা তাকে দিতেই হবে।

দুটি প্রশ্ন, যাদের উত্তর সবাই জানে
প্রথমত, যে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার আওয়ামী লীগ আমলে ‘জাতির শত্রু’ তকমা পেয়েছিল, শেখ হাসিনার পতনের পরও সেখানে আগুন কীভাবে সম্ভব হলো?

দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক ইউনূসের মতো একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে, যাঁর সঙ্গে এই পত্রিকা দুটির সুসম্পর্ক সর্বজনবিদিত—সেই সময়েই কেন এই হামলা?

উত্তর অজানা নয়। বরং এই হামলার ঔদ্ধত্য প্রমাণ করে—কিছু শক্তি রাষ্ট্রের চেয়েও নিজেকে শক্তিশালী মনে করছে।

উপসংহার: আগুনে পুড়ে না প্রশ্ন
সংবাদমাধ্যম সব সময়ই ক্ষমতার প্রতিপক্ষ। সে বন্ধুর অপরাধও প্রকাশ করে। তাই এক সরকারের আমলে সে শত্রু হয়, অন্য সরকারের আমলেও আক্রান্ত হয়।

কিন্তু ইতিহাস বলে—
আগুন দিয়ে সংবাদমাধ্যম থামানো যায় না।
আগুন শুধু প্রশ্নকে আরও ধারালো করে।

আজ যদি রাষ্ট্র এই আগুনের বিচার না করে, তবে কাল আগুন রাষ্ট্রের দরজায়ও কড়া নাড়বে।

এটা কোনো অনুমান নয়—
এটা ইতিহাসের নিয়ম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৫
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অল্প পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসার সন্ধান, যে কেউ চাইলে শুরু করতে পারে

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৫



কেউ একজন জানতে চেয়েছেন ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কিভাবে মাসে ১/২ লাখ টাকা ইনকাম করা যায়? বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে দেখলাম বাংলাদেশে ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পন্ডিত, ব্লগার তানভীর জুমারের পোষ্টটি পড়েন, জল্লাদ আসিফ মাহমুদ কি কি জানে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



সামুর রাজনীতির ডোডো পন্ডিত, ব্লগার তানভীর ১ খানা পোষ্ট প্রসব করেছেন; পোষ্টে বলছেন, ইউনুস ও পাকিসতানীদের জল্লাদ আসিফ মাহমুদ ধরণা করছে, "সেনাবাহিনী ও ব্যুরোক্রেটরা বিএনপি'কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নীল নকশার অন্ধকার রাত

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৬


কায়রোর রাস্তায় তখন শীতের হিম হাওয়া বইছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুইটা বড় সংবাদপত্র অফিস: আল-আহরাম এবং আল-মাসরি আল-ইয়াউম—হঠাৎ করেই আগুনে জ্বলে উঠলো। কিন্তু এই আগুন কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×